#কিশোরী_কন্যার_প্রেমে
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_১০
.
সূর্য অস্ত যাচ্ছে। গাছের নিচে বেঞ্চের উপর বসে সেই সৌন্দর্য উপভোগ করছে অর্ঘমা। নীরদ গেছে সামনের স্টল থেকে ফুচকা আনতে। তখন অর্ঘমার কানের পিঠে গোলাপ গুঁজে দেওয়ার পর তারা দু’জন অনেকক্ষণ একে অপরের দিকে তাকিয়ে ছিল। নীরদের ফোনের শব্দে ঘোর কেটেছিল তাদের। দু’জনেই কিছুটা লজ্জা পেয়েছিল। অস্বস্তিতে ভুগছিল। সেই অস্বস্তি কাটানোর জন্যই নীরদ বলেছিল,
-“ছবি তুলতে পছন্দ কর?”
-“হ্যাঁ।”
-“তাহলে তুমি দাঁড়াও, আমি ছবি তুলে দিচ্ছি।”
-“না, না দরকার নেই।”
-“অবশ্যই দরকার আছে। তুমি দাঁড়াও।”
এরপর নীরদ বেশ অনেকগুলো ছবি তুলে দিয়েছে তার। সেগুলো সব নীরদের ফোনেই রয়েছে।
অর্ঘমা আশেপাশে তাকিয়ে দেখছিল। তারা আসার পর তেমন একটা লোকসমাগম ছিল না জায়গাটায়। কিন্তু এখন লোকের অভাব নেই। এখানে বেশিরভাগই প্রেমিক-প্রেমিকা এসেছে। কেউ একে অপরের হাতে হাত রেখে হাঁটতে ব্যস্ত। কেউ আবার লেকের ধারে বসে প্রেমিকের কাঁধে মাথা রেখে গল্প করতে ব্যস্ত। অথবা কেউ কেউ একে অপরকে খাইয়ে দিতে ব্যস্ত। ভালোই লাগল অর্ঘমার। হালকা হেসে সামনে তাকাল। নীরদকে দেখা যাচ্ছে। যে এখন স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে ফুচকা বানানো দেখছে। মাঝে মাঝে তার দিকে তাকিয়ে দেখছে সে ঠিক আছে কিনা।
কিছুক্ষণ বাদেই হাতে দুই প্লেট ফুচকা নিয়ে ফিরে এলো নীরদ। একটা প্লেট অর্ঘমার দিকে এগিয়ে দিয়ে অন্য প্লেট নিয়ে নিজে অর্ঘমার পাশে বসল। প্রতিটা ফুচকা বেশি করে টক দিয়ে ভিজিয়ে চোখ বন্ধ করে মুখে দিচ্ছে অর্ঘমা। মুখে নিয়েই চোখমুখ কুঁচকে ফেলছে। যেন এর থেকে তৃপ্তি আর কিছুতে নেই। অর্ঘমার চেহারার অভিব্যক্তি দেখে হা করে তাকিয়ে রইল নীরদ। অর্ঘমা ফুচকায় বেশি করে ঝাল দিয়ে নিয়ে আসতে বলেছিল। নীরদও তার কথা মতো বেশি ঝাল দিতে বলেছিল ফুচকাওয়ালাকে। ঝালে অর্ঘমার নাক লাল হয়ে গেছে। ভ্রু কুঁচকে নিজের প্লেট থেকে একটা ফুচকা নিয়ে মুখে দিতেই নীরদের মনে হলো তার কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। খুব কষ্টে ফুচকাটা গিলে নিল। বাকি ফুচকাগুলো আর খাওয়ার সাহস হলো না। অথচ এই ফাঁকে অর্ঘমা নিজের পুরো প্লেট সাফ করে ফেলেছে। নীরদের প্লেটে ফুচকা গুলো আগের মতোই আছে দেখে সে বলল,
-“আপনি খাচ্ছেন না কেন?”
-“একটা খেয়েছি। আর খেতে মন চাচ্ছে না।”
-“ফুচকাগুলো তো ভালোই ছিল। তাহলে?”
-“আসলে আমার এসব খাওয়ার অভ্যাস নেই।”
-“ওহ্!”
-“তোমার ঝাল লাগেনি?”
-“ফুচকায় ঝাল না হলে খেয়ে মজা আছে নাকি?”
-“তাহলে এগুলোও তুমি খাও।”
-“আপনি সত্যি আর খাবেন না?”
-“সত্যি করে বলি! আসলে আমি এত ঝাল খাই না। তোমার দেখাদেখি আমি আমারটাও ঝাল দিয়ে বানাতে বলেছিলাম। কিন্তু একটা খেয়ে দেখি অনেক ঝাল হয়েছে। আমি আর খেতে পারব না।”
নীরদের অসহায় চেহারা দেখে হেসে ফেলল অর্ঘমা। খালি প্লেট পাশে নামিয়ে রেখে নীরদের ফুচকার প্লেটটা হাতে নিয়ে খেতে লাগল। নীরদ গালে হাত দিয়ে অর্ঘমার ফুচকা খাওয়া দেখতে লাগল।
ফুচকা খাওয়া শেষ করে বিল দিয়ে উঠে গেল তারা। এবার বাসায় ফেরার পালা। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। রিকশায় ওঠার আগে অর্ঘমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে নীরদ কোথায় যেন গেল। ফিরে এলো কিছুক্ষণের মাঝে। অর্ঘমাকে রিকশায় উঠিয়ে এবারও ওড়নাটা ঠিক করে তার কোলের মাঝে দিল। নিজে পাশে উঠে বসে একটা পানির বোতলের মুখ খুলে এগিয়ে দিল। মৃদু হেসে বোতলটা নিয়ে পানি খেয়ে বোতল ফিরিয়ে দিল। সেই বোতল থেকে নীরদ নিজেও পানি খেল। অর্ঘমা শুধু মুগ্ধ হয়ে দেখল। এই ছোট ছোট যত্নগুলো অর্ঘমার মনে প্রতিনিয়ত নতুন করে আরো বেশি ভালো লাগার বীজ জন্ম দিচ্ছে।
___
অভ্র বাসায় এসেছে দু’হাত ভরতি মিষ্টি নিয়ে। তার চেহারায় খুশির ঝলক। অভ্রর মা মিনা বেগম ভীষণ অবাক হলেন ছেলের হাতে এত মিষ্টি দেখে।
-“এত মিষ্টি কিসের?”
-“আমার এত এত পরিশ্রম অবশেষে সফল হয়েছে মা।”
মিনা বেগম ছেলের দিকে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হাসিমুখে বললেন,
-“তোর চাকরি হয়ে গেছে?”
-“হ্যাঁ, মা। আমার চাকরি হয়ে গেছে। মাসে পয়ত্রিশ হাজার টাকা বেতন। কাজ ঠিকঠাক মতো করলে দু’মাস পর বেতন আরও বাড়াবে।”
-“আলহামদুলিল্লাহ্।”
-“অর্ঘ এখনো ফেরেনি?”
-“না। ও তো নীরদের সাথে বের হলো।”
-“আমি জানি নীরদের সাথে বেরিয়েছে। কিন্তু এখনো এলো না কেন?”
-“জানি না তো। তুই ফোন করে দেখ। আমি মিষ্টিগুলো রেখে আসি।”
অভ্র ফোন বের করে নীরদকে কল করতে গেলেই বাসার বেল বেজে উঠল। অভ্র গিয়ে দরজা খুলে দেখল অর্ঘমা এসেছে। মেয়েটার হাসিখুশি চেহারা দেখেই অভ্রর ভালো লাগল। মনটা ভরে উঠল প্রফুল্লতায়। অর্ঘমার হাতে গোলাপ ফুল দেখে দুষ্টু হেসে বলল,
-“কিরে! প্রপোজ টপোজ করল নাকি? রিলেশন হয়ে গেছে?”
-“ধুর! তুমি যে কিসব বলো না!”
-“না মানে, লাল গোলাপ তো কেউ আর এমনি এমনি দেয় না তাই না?”
-“হয়েছে তোমার ফাজলামো! এমনি কিনে দিয়েছে। লাল জামা পরেছিলাম। লাল গোলাপ হাতে ছবি ভালো আসবে ভেবে কিনে দিয়েছিল।”
-“বুঝলাম।”
-“উদ্ধার করে ফেললে বুঝে। আচ্ছা, তুমি ভাই নাকি অন্য কিছু! অনায়াসে কীভাবে বলো এসব?”
-“আমি তোর ভাইও আবার বন্ধুও। বুঝেছিস! এখন যা ফ্রেস হয়ে আয়। তোকে গরম গরম একটা খবর শোনাব।”
-“কী খবর?”
-“আগে ফ্রেস হয়ে আয়, তারপর বলছি।”
ভাইয়ের দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল অর্ঘমা। অভ্র নিজেও দরজা লাগিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল ফ্রেস হতে।
ফ্রেস হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে সোফায় নীরদকে বসে থাকতে দেখে অবাক হলো অর্ঘমা। পাশেই অভ্র বসে আছে। দু’জনে মিলে কিছু একটা নিয়ে কথা বলছে। অর্ঘমা এগিয়ে যেতেই অভ্র তাকে দেখে হেসে পাশে বসতে বলল। ভাইয়ের কথা মতো অর্ঘমা পাশে এসে বসল।
-“তুমি না বলছিলে আমাকে কিসের গরম গরম খবর শোনাবে!”
-“হ্যাঁ।”
-“কী সেই খবর?”
-“তোর অকর্মা ভাইয়ের চাকরি হয়ে গেছে।”
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল অর্ঘমা। পর পরই খুশিতে চেঁচিয়ে উঠল ভাইয়ের গলা ধরে। অভ্রও দু’হাতে আগলে নিল বোনকে।
-“সত্যি!”
-“হ্যাঁ, সত্যি। আগামীকাল থেকেই জয়েন করব।”
অর্ঘমা অভ্রর চুল টেনে বলল,
-“মোটেও আমার ভাই অকর্মা নয়। তুমি একদম আমার ভাইকে অকর্মা বলবে না। আমার ভাই বেস্ট। বেস্টের উপরে যদি কিছু থাকে তাহলে সেটা আমার ভাই।”
অভ্র কিছু বলল না। শুধু হেসে অর্ঘমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। নীরদ বসে বসে দুই ভাই-বোনের এই মধুর খুনসুটি দেখছিল। কি সুন্দর, কি মিষ্টি তাদের সম্পর্ক।
___
সকাল থেকে নীরদদের বাসায় হুলস্থূল কাণ্ড চলছে। আজ নুসরাতকে দেখতে আসবে। কম তো বয়স হলো না মেয়েটার। অবশ্য নুসরাতকে আরও অনেক আগে থেকে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছিল। কিন্তু নুসরাত রাজি হচ্ছিল না কোনোভাবেই। অবশেষে এতদিন পর এসে মেয়েটা রাজি হয়েছে।
কলেজে থাকাকালীন এক ছেলের সাথে নুসরাতের সম্পর্ক হয়েছিল। সেই সম্পর্কের মেয়াদ ছিল দীর্ঘ ছয় বছর। ছেলের পরিবার আর নুসরাতের পরিবার থেকে সব জেনেশুনে তাদের বিয়েও ঠিক করা হয়। কিন্তু বিয়ের সপ্তাহখানেক আগে বেঁকে বসে নুসরাতের বয়ফ্রেন্ড। নুসরাত তার বয়ফ্রেন্ডের কাছে জবাবদিহি চাওয়ার পর জানতে পারে ছেলেটা তাকে কখনো ভালোই বাসেনি। সম্পূর্ণটা একটা অভিনয় ছিল শুধুমাত্র সম্পত্তির জন্য। নুসরাত বাড়িওয়ালার মেয়ে হওয়ায় আর তাদের আর্থিক অবস্থা অনেক বেশি স্বচ্ছল হওয়ায় তার বয়ফ্রেন্ড রাজি হয়েছিল বিয়েতে। কারণ অর্ধেক সম্পত্তি তো নুসরাতের নামেই করে দিবে নুসরাতের বাবা। অর্থাৎ সম্পত্তি নুসরাতের হওয়া মানেই তার হওয়া। কিন্তু বিয়ের সপ্তাহখানেক আগে যখন নুসরাতের বাবা সম্পত্তি মেয়ের নামে দিতে চান তখন নুসরাত এই সম্পত্তি নিতে চায় না। মূলত এর জন্যই বিয়েতে অমত করে বসে নুসরাতের বয়ফ্রেন্ড। এরপর থেকেই নুসরাতের বিয়ের শখ মিটে গেছে। তবে বিয়ে ভাঙায় একটা উপকার হয়েছে। একজন ভুল মানুষকে নিজের জীবনের সাথে জড়াতে গিয়ে বেঁচে গেছে। আর নিজের পড়াশোনা শেষ করে একজন সফল ডাক্তার হতে পেরেছে।
প্রাক্তন প্রেমিকের থেকে এত বড় ধোঁকা পাওয়ার পর নুসরাতের মনে হয়েছিল সে আর কাউকে বিশ্বাস করে নিজের জীবনের সাথে জড়াতে পারবে না। তাই তো বয়স ত্রিশ পার হওয়ার পথে প্রায় তবুও তার মধ্যে বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু তার ইচ্ছেকে বদলাতে সক্ষম হয়েছে এক চমৎকার ব্যক্তিত্বের অধিকারী পুরুষ। যদিও বেচারাকে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি নুসরাতকে রাজি করানোর জন্য।
ছেলেটার নাম তমাল। সে নিজেও পেশায় একজন ডাক্তার। সেমিনারে কয়েকবার দেখা হয়েছিল নুসরাতের সাথে। ব্যস! তখন থেকেই নুসরাতকে তার মনে ধরেছে। এরপর থেকেই আঠার মতো পেছনে লেগে ছিল নুসরাতকে রাজি করাতে। অবশেষে সে সফল হয়েছে।
নুসরাতকে সাজানোর দায়িত্ব পরল অর্ঘমার উপর। কারণ অর্ঘমা খুব ভালো মেকআপ করতে জানে। নুসরাত নিজে গিয়ে নিয়ে এসেছে অর্ঘমাকে। তাদের দু’জনের মাঝে সম্পর্কটা বেশ ভালো। যদিও হাতেগোনা কয়েকবার দেখা হয়েছে। এতেই তাদের মাঝে বেশ ভালো খাতির হয়ে গেছে।
অর্ঘমা ফ্ল্যাটে ঢুকার সময় নীরদের সাথে তার চোখাচোখি হলো। ট্রাউজার আর টি-শার্ট পরা নীরদকে এই প্রথম এভাবে দেখল সে। চুলগুলো কিছুটা অগোছালো। তবুও কেন যেন ভীষণ চোখে ধরছে ছেলেটাকে। অর্ঘমা বিরবির করে নিজে নিজেই বলল,
-“ছেলেদের এত সুন্দর হওয়া একদমই উচিত নয়। এটা ঘোরতর অপরাধ। এই অপরাধের শাস্তি হিসেবে আপনি কী নিবেন নীরদ ভাই?”
চলবে…