#কালো_হরিণ_চোখ (শেষ পর্ব-১)
নুসরাত জাহান লিজা
প্রিয়ম একমাস থাকল বাইরে বাইরে। বেশি করে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। রাতে নয়টার পরে বাসায় ফিরে এসে রুবিনার সাথে কিছুক্ষণ গল্প করে এরপর ছবি, ভিডিও এডিট করতে বসে। এরপর যখন শোয়, ঘুম আসে না। চোখের কোল জুড়ে সেই হরিণ চোখ দুটোও আর আসে না। একটা মুখ ভাসে, শান্ত সৌম্য, মায়াময় একটা স্নিগ্ধ মুখ। সেই শান্ত মুখ কখনো কখনো ভীষণ ক্ষ্যাপাটে হিসেবে আবির্ভূত হয় প্রিয়মের মানসপটে।
চেনা মুখের রকম বদলে গেছে এখন। ওর মানসপটে ধরা দিচ্ছে অন্য রূপে। ভীষণ জ্বালাচ্ছে প্রকৃতি। মধুর যন্ত্রণায়। জ্বলতে ভালো লাগছে। এই একমাসে প্রকৃতির সামনে একবারও সে যায়নি। ওকে দেখেওনি। ইনফ্যাচুয়েশন নয়, এটা সে বুঝতে পেরেছে আরও আগে। তবে এবার সে কোনো ভুল করতে চায় না। নিজেকে প্রকাশ করতে চায় পরিপূর্ণ রূপে। তার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছে সে।
কিন্তু সমস্যা হলো, মেয়েটা ওকে ভুল বুঝেছে। আবার আরেকটা দ্বিধা আছে, ওর মনে যা আছে, প্রকৃতি ওকে সেভাবে গ্রহণ করতে প্রস্তুত তো! যেভাবে ঝগড়া করে, তাতে মনে হয় প্রিয়মকে সে অপছন্দই করে।
ছেলের মতিগতি বোঝা দায়, তাই একদিন রুবিনা রাতে খাবার পরে ওর ঘরে এলেন।
“ব্যস্ত?”
“মা, ব্যস্ত হলেই কী? তোমার জন্য আমার অনেক সময় আছে।”
রুবিনা ছেলের বিছানার কাছে এসে বসলেন।
প্রিয়মের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “তুই ইদানিং অন্যমনস্ক থাকিস। আগে তো এমন ছিলি না। কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করছিস?”
“মা, কেউ যদি ভুল করে, সেটা শুধরানোর জন্য কী করা উচিত?”
“ভুলটা কী সেটা না জানলে কীভাবে বলব?”
“ধরো কারোর সাথে একটা ভুল এপ্রোচ করে ফেললে?”
“সেই কারোর টা কি কোনো মেয়ে?”
প্রিয়ম থমকে গিয়ে মায়ের দিকে তাকাল। উত্তর দিতে গিয়ে ভীষণ লজ্জা পেল। গাল লাল হয়ে উঠল। কিন্তু কথা ফুটল না।
“আমার ধারণা ঠিক তাহলে। বলেই যখন ফেলেছিস, এবার ঝেড়ে কাশ তো দেখি! এভাবে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই।”
প্রিয়ম ভীষণ ভদ্র ছেলে হিসেবে বড় হয়েছে। তাই নিজেকে সহজে মেলে ধরতে পারে না। কিন্তু মা ওর সবচাইতে কাছের বন্ধু। কোনো সমস্যায় পড়লে সে সবসময় মা’র সাথে শেয়ার করে এসেছে। মা’য়ের কাছে মনে হয় একটা ম্যাজিক বক্স থাকে। যার ছোঁয়ায় সন্তানের মন এক তুড়িতে ভালো করে দিতে পারেন। তাই প্রিয়ম মনস্থির করল, এই সমস্যার কথাও সে মা’কে বলবে। অন্তত নিজেকে হালকা লাগবে।
“মা, তুমি লাভ এ্যাট ফার্স্ট সাইটে বিশ্বাস করো?”
“না। লাভ এট ফার্স্ট সাইট বলে আসলে কিছু হয় না৷ সেখানে কেবল একটা আকর্ষণ কাজ করে। সেই আকর্ষণ থেকে লোকে পরিচিত হয়, কথা বলে, এরপর জানাশোনা হয়, আন্ডারস্ট্যান্ডিং তৈরি হয়৷ তারপর হয়তো ভালোবাসা আসে। সেটাকেই লোকে লাভ এট ফার্স্ট সাইট বলে বোধহয়।”
প্রিয়মের মন থেকে একটা বিশাল পাথর ভার নেমে গেল, ভীষণ হালকা বোধ করল।
“তুই প্রথম দেখায় কারোর প্রেমে পড়েছিস নাকি?”
“তাই ভেবেছিলাম। বহুদিন তেমন ধারণা নিয়ে ছিলাম। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে, ওটা শুধুই একটা ইনফ্যাচুয়েশন ছিল। কারণ তাকে আড়াল করে দিচ্ছে অন্য কেউ।”
একগাল হাসলেন রুবিনা। এরপর বললেন, “তা মেয়েটি কে? নাম কী?”
ইতস্তত করল প্রিয়ম, আরেকবার রাঙা হলো। এরপর ধীর স্বরে বলল, “ওকে তুমি চেনো মা। তোমার খুব কাছের একজন।”
রুবিনা খানিকক্ষণ ভাবলেন, এরপর বললেন, “প্রকৃতি?”
প্রিয়ম ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিল৷ রুবিনা মনে মনে উচ্ছ্বসিত হলেন৷ মেয়েটাকে তার বড় পছন্দ। মনে মনে প্রিয়মের জন্য ওকে ভেবেছিলেন বটে। কিন্তু ছেলে যদি অন্য কাউকে পছন্দ করে, সেজন্য কখনো মুখে আনেননি। পাছে তাকে আর প্রকৃতিকে অপ্রস্তুত হতে হয়! দুই পরিবারের এত ভালো সম্পর্কে যদি চিড় ধরে! এবার তার সেই চিন্তা দূরীভূত হলো। না, তার ছেলেও তার পছন্দে একাকার হয়েছে। তবে সেই উচ্ছ্বাস এখনই প্রকাশ করলেন না।
“ভুল করেছিস কেন? তুই কী বলেছিস প্রকৃতিকে?”
প্রিয়ম সেদিনের কথার সমস্তটুকুই মাকে খুলে বলল।
রুবিনা বললেন, “এটা খুব স্বাভাবিক বাবা। এই বিষয়ে মেয়েরা সেনসেটিভ হয়। এখন যেহেতু তুই নিজের কাছে পরিষ্কার, তাই তোর ওর কাছেও সেটা প্রকাশ করে ফেল। দেখবি ঠিক হয়ে যাবে।”
“কিন্তু মা, ও যদি আমাকে পছন্দ না করে!”
“তোকে পছন্দ করবে না কেন? তুই অপছন্দ করার মতো ছেলেই নোস। খালি একটু কাঠখোট্টা। আবার লাজুক।”
মায়ের দুষ্টুমিতে হতাশ বোধ করল প্রিয়ম। বলল, “মা, তুমি মজা করছো?”
“আরে গাধা, ও যদি তোকে পছন্দ না-ই করত, তাহলে সরাসরি বলেই দিত সেদিন। তোকে নিজের কাছে আগে ক্লিয়ার হতে বলত না। ও ভীষণ সোজাসাপটা কথা বলে। নিজের অপছন্দও বলত। কিন্তু বলেনি, তুই এভাবে বলায় দুঃখ পেয়েছে। বোঝায় যায় তোর কাছে ওর কিছু এক্সপেকটেশন ছিল। সেটা পূরণ হয়নি বলে মন খারাপ করেছে।”
“তুমি সত্যি বলছো মা?”
“মেয়েরা সব কথা মুখ ফুটে বলে না সবসময়। তাদের কিছু কথার মানে একটু মাথা খাটিয়ে বের করতে হয়। তোর ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখছি। কিচ্ছু হবে না তোকে দিয়ে।”
“মা, এভাবে বলছ কেন? আমি…” থেমে গিয়ে প্রিয়ম আবার বলল, “মা, আমি কি করব এখন?”
“সেটা তো আমি তোকে বলে দেব না। ওটা তোর নিজেকেই বের করতে হবে। ওর অভিমান হয়েছে। অভিমান ভাঙা। আমি এই বিষয়ে প্রকৃতির দলে।”
“এখনই দলাদলি শুরু করেছ?”
“করলাম। মেয়েটা আমার মতো গাছ ভালোবাসে। খুব ভালো মেয়ে।”
“ভালো মেয়ে? আমার সাথে সারাক্ষণ ঝগড়া করে সেটা তোমার চোখে পড়ে না?”
“তা ভালো যদি নাই হয়, ওই ঝগড়াটে মেয়ের প্রেমে পড়লি কেন চিৎপটাং করে?”
“কী জানি? ওটাই হয়তো আমার ভালো লাগে।” অস্ফুটস্বরে অবচেতনে কথাটা বলল প্রিয়ম৷ এরপর আরেকদফা লজ্জা পেল। কী একটা অবস্থা, আজ বোধহয় ওর লজ্জা পাবার দিন।
মা সশব্দে হাসলেন। এরপর বললেন, ‘ঘুমা গাধা পুত্রধন। এরপর সুস্থির হয়ে একটা গেম প্ল্যান সেট করে। প্ল্যান এ, প্ল্যান বি, প্ল্যান সি রেডি কর। একটা ফেইল করলে অন্যটা যাতে কাজে লাগে৷ ঢাল ত”লো”য়ার নিয়ে নামিস মাঠে।”
প্রিয়মও এবার হাসল মায়ের রসিকতায়। অনেকদিন পর সে স্বস্তি পেল। ঘুমটাও চমৎকার হলো।
***
প্রকৃতির পরীক্ষা চলছে। প্রিপারেশন অনুযায়ী ভালোই হচ্ছে বলা যায়৷ আর দুটো পরীক্ষা আছে। পরের পরীক্ষার আগে বেশ বড় গ্যাপ পড়েছে। তাই আজ ছাদে এসেছে। কিন্তু এসে দেখল প্রিয়ম দাঁড়িয়ে আছে৷
ওকে দেখে হাসল, “তোমার এক্সাম কেমন হচ্ছে?”
“আমার এক্সাম খারাপ হয় না। পড়াশোনা করি তো।”
“তোমার সময় হবে এখন? একটু কথা বলতাম।”
“আমার গাছগুলো অনেকগুলো দিন আমাকে দেখেনি। ময়নার মা’কে দেখেছে। তার যত্নের নমুনা আমি জানি।”
“তোমার গাছের অযত্ন হয়নি। দেখতে পারো।”
প্রকৃতি ঘুরে ঘুরে দেখল, এরপর প্রিয়মের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “আপনি আমার গাছের পরিচর্যা করেছেন কেন?”
“তোমার ভালোলাগাগুলো আমারও ভীষণ ভালো লাগছে ইদানিং। তাই। আমরা দু’জনে মিলে পুরো ছাদ আর বাড়ির আশেপাশে ছোটখাটো একটা অরণ্য বানাবো ভাবছি। তাতে অনেক লম্বা সময় প্রয়োজন। আমাকে এর সুযোগ দেবে?”
এমন অদ্ভুত প্রেমের প্রস্তাব প্রকৃতি কোনোদিন পায়ওনি, আশেপাশে দেখেছে বা কারোর কাছে শুনেছে বলেও মনে পড়ে না। তবুও সে গলে গেল না। কাঠিন্য বজায় রেখে বলল,
“আপনার কনফিউশন?”
“নেই। সেখান শুধু তুমি আছো।”
“আমিও যে কেবল কনফিউশান নই, কী করে বুঝব? প্রমাণ চাই আমার।”
“কীভাবে প্রমাণ করতে হবে?”
“সেটা তো আমি বলে দেব না। যদি আপনার এক্টিভিটিজ আমাকে স্যাটিসফাই করে তবেই সুযোগ পাবেন।”
প্রিয়ম জানত এই মেয়ে এত সহজে রাজি হবে না। ওকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাতে চাইছে। তা চাক, রিজেক্ট তো এখনো করেনি। সে অবশ্যই উপায় বের করে ফেলবে। উপায় বের করতে আদাজল খেয়ে লাগবে।
……….
#কালো_হরিণ_চোখ (শেষ পর্বের শেষ)
নুসরাত জাহান লিজা
প্রকৃতি পরীক্ষা দিতে গেছে আজ। প্রিয়ম ছাদে বসে আছে মেয়েটা কখন ফিরবে সেই তার প্রতীক্ষায়। প্রিয়ম জানে না, পাশার দান ঘুরে গিয়ে প্রকৃতির জায়গায় আজ সে চলে এসেছে। সময়টা পাল্টেছে অবশ্য, সে এসেছে খটখটে দুপুরবেলায়। এই একই জায়গায় বহুদিন ধরে মেয়েটা ওর ফেরার অপেক্ষায় থাকত। প্রিয় ক্ষণে প্রিয় গাছগুলোর সাথে প্রিয় মানুষের ঘরে ফেরার স্বাক্ষী হতো প্রকৃতি।
জানলে হয়তো আজকের ভয়াবহ টেনশন হতো না ওর। আজ প্রিয়মের ভালোবাসা জয়ের পথে এগিয়ে যাবার দিন। তবে এই ভালোবাসার বীজ ওর মধ্যে কবে, কখন বপন করা হয়েছে সে জানে না। হয়তো বহু আগে, সে-ই বুঝতে দেরি করে ফেলেছে। নয়তো অন্য কাউকে পাশে দেখে ভেতরে ভেতরে পুড়ছিল কেন!
এই কয়েকদিনের ওকে না দেখা সময়ের ব্যপ্তি যেন অসীম। এর শেষ নেই, দীর্ঘ একাকিত্ব মনে হচ্ছে প্রিয়মের জন্য। অপেক্ষার সময় এত দীর্ঘ হয় কেন! অথচ একসাথে কাটানো সময়গুলো, ঝগড়া আর খুঁনসুটিতে কবেই চোখের নিমিষে ফুরিয়ে গেছে।
পায়ের শব্দে সে পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখল আনোয়ার সাহেব এসেছেন।
“আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল।”
“ওয়ালাইকুম আসলাম। কেমন আছো? তোমার ফটোগ্রাফি কেমন চলছে ইয়াং ম্যান?”
“ভালো আঙ্কেল।”
আশেপাশে অনেকগুলো নতুন টব দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “প্রকৃতি তো পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত। এসবের সময় পায়নি। এসব…”
“আমি এনেছি আঙ্কেল।” ইতস্তত করে বলল প্রিয়ম।
“বাহ্! তুমি ক্যামেরা প্রীতির পাশাপাশি বৃক্ষপ্রেমী হয়ে গেছ দেখে ভালো লাগল।”
প্রিয়ম অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাসল। মনে মনে বলল, “প্রকৃতি প্রেমীও হয়েছি।”
“এত আয়োজন যে, কোনো বিশেষ ব্যাপার আছে নাকি আজ?”
প্রিয়ম দপ করে নিভে গেল, মেয়েকে পটানোর আগে যদি মেয়ের বাবাকে পটানোর প্রয়োজন হয়, পরিস্থিতিটা কেমন ভয়াবহ হয় তাই হাড়েমজ্জায় টের পাচ্ছে প্রিয়ম।
সে কোনো উত্তর খুঁজে পেল না, কী বলবে। আনোয়ার অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে তাকালেন ওর চোখের দিকে। প্রিয়ম চোখ নামিয়ে নিল। ওর অপ্রস্তুত অবস্থা দেখে কিছু একটা যেন আঁচ করতে পারলেন তিনি।
“তুমি কারো জন্য অপেক্ষা করছ? বিশেষ কেউ যার এই সময় ছাদে আসবার কথা?”
প্রিয়মের ইচ্ছে হলো বলতে, ধরণী দ্বিধা হও। এভাবে ধরা পড়ে যেতে হলো। ওর মুখ কী খোলা বই? তাহলে প্রকৃতি ওকে পড়তে পারছে না কেন!
একটা মাদুর বিছিয়ে রাখা। তার পাশে ব্যানারের মতো একটা জিনিস উনার চোখে পড়ল। তাতে লেখা, “প্রকৃতি কণ্যা, তোমার বৃক্ষছায়াকে গ্রহণ করো। দাবি না মানা পর্যন্ত আমরণ অনশন চলবে এই ছাদে।”
“বেস্ট অফ লাক ইয়াংম্যান। আমার মেয়েটার আসার সময় হলো বলে।”
প্রিয়মের এত বছরের জীবনে এমন অবস্থায় জীবনে কোনোদিন পড়েনি। কী বলতে হবে তাই বুঝতে পারছে না। এই সময় ইনি ছাদে এসে উপস্থিত হবেন, এটা ওর মাথায় ছিল না একেবারে। ওর এই মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে৷ সুপার হিউম্যান হলে ভালো হতো, অদৃশ্য হবার সুপার পাওয়ার থাকা সুপার হিউম্যান। তবে হয়তো এমন লজ্জাস্কর পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ মিলত।
“আমি ঘরে ওর জন্য অপেক্ষা করি। ওকে ছাদে দ্রুত পাঠাব নাকি দেরি করিয়ে দেব?”
“আঙ্কেল, আসলে, মানে আমি… আমার… ওই যে.. আসলে…”
“আমাকে এত ভয় পাবার কারণ নেই ইয়াং ম্যান। তবে ওকে ভয় পাবার যথেষ্ট কারণ আছে। আমিও পাই মাঝেমধ্যে। লেগে থাকো৷ আসি।”
প্রিয়মের মাথায় হাত দিলেন পরম স্নেহে। এরপর উদ্ভাসিত হেসে তিনি নেমে গেলেন। এই ছেলেটাকে তার ভীষণ পছন্দ। ভদ্র, সৌম্য একটা ছেলে। অন্যকে যথাযথ সম্মান দিতে জানে। এর সাথে তার মেয়ে ভালো থাকবে।
মেয়েকে তিনি খুব ভালো বুঝতে পারেন। মেয়েরও যে অমত নেই, তা তিনি জানেন। তারুণ্যের মধ্যে এমন একটু আধটু পাগলামি থাকা বোধহয় মন্দ নয়। এতে কোনো ভণিতা যে নেই সেটা বোঝার মতো যথেষ্ট প্রাজ্ঞ তিনি।
স্ত্রীর সাথে কথা বলে এরপর চার হাত এক করে দেবার ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রকৃতির বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতায় মনটা ভরে উঠল প্রিয়মের।
এরমধ্যেই দেখল বহু প্রতীক্ষিত ক্ষণ উপস্থিত। ওই তো ফিরছে সে। হেলেদুলে গেটের ভেতরে ঢুকল প্রকৃতি। দুরুদুরু কেঁপে উঠল প্রিয়মের ভেতরটা।
***
ছাদের মেঝেতে একটা মাদুর বিছিয়ে রেখেছিল প্রিয়ম। সেখানে বসল সে হাত পা ছড়িয়ে।
প্রকৃতি ছাদে এসে হতভম্ব হয়ে গেল।
“এসব কী পাগলামি?”
“ভালোবাসায় এটুকু পাগলামি হয়ই। আমার এখন কিন্তু কোনো কনফিউশন নেই।”
দেখল একদিকে কতগুলো গোলাপের চারা, সবগুলোতে আধফোঁটা গোলাপ। আরও কয়েক ধরনের গাছপালা।
“গাছের চারা দিয়ে প্রপোজ করছেন?”
“ওগুলো ভালোবেসে এনেছি।”
“এই অনশনের পাগলামি কতদিন চলবে?”
“যতদিন আমাকে একা থেকে দোকা না হব।” প্রকৃতির কঠিন চোখে তাকিয়ে হেসে নির্ভয়ে বলল প্রিয়ম।
“যা খুশি করুন।” বলেই নেমে গেল প্রকৃতি।
প্রিয়ম করুণ চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইল। এখন থেকে পিছিয়ে আসার উপায় নেই। সে অনশন কর্মসূচিতে ঠিকঠাক মতো বসল।
সময় গড়াতে থাকল। কঠিন হৃদয় গলল না। তৃষ্ণা পাচ্ছে, কিন্তু সে পণ করেছে পানিও খাবে না। এরমধ্যে এই বাড়ির সবাই এসে ওকে দেখে গেছে, ভাড়াটিয়ারাও। এমন অভিনব ঘটনা ঘটতে কেউই দেখেনি। শুধু যার আসার সেই আসছে না।
গুণে গুণে তিন ঘণ্টা বত্রিশ মিনিট পরে সে আরেকবার এলো। প্রিয়মের চোখ স্থির হয়ে গেল। শাড়ি পরেছে মেয়েটি। টিয়া রঙের শাড়িটায় ঠিক প্রকৃতি কন্যা বলে ভ্রম হলো। গোধূলির লালচে সূর্যের আভা পুরোটাই যেন মেয়েটার গালে আদুরে পরশ বুলিয়ে গেল। কপালে কালো একটা টিপ, খোলা চুলগুলো মৃদুমন্দ বাতাসে উড়ছে। হাতে একটা ট্রে।
মেয়েটা ভীষণ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে, প্রিয়ম তাকিয়ে আছে তার প্রতিটা পদক্ষেপে। স্বপ্নের মতো সুন্দর একটা ক্ষণ। এমন ক্ষণ পেতে সে বহুযুগ অনশন করতে রাজি৷ মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে আছে মোহাচ্ছন্ন প্রিয়ম।
নিজের হাতে চিমটি কেটে দেখল, ঘটনা সত্যি কি-না। চিমটিটা কিঞ্চিৎ জোরেই হয়েছে। ব্যথায় বুঝল, এই ক্ষণ স্বপ্ন নয়। বরং স্বপ্নময় বাস্তবতা।
প্রকৃতি রাগী গলায় বলল, “এই যে ফটোগ্রাফার সাহেব, সারাদিন ধরে অনেক রঙঢঙ সহ্য করেছি। এখন উঠে আসুন তো। পুরো বাড়িসুদ্ধ সব্বাইকে এই পাগলামির জানান দিয়ে আমাকে অস্বস্তিতে ফেলার খুব দরকার ছিল?”
“আমি একজনকে ভালোবেসে ফেলেছি, যে পৃথিবীর স্নিগ্ধ সুন্দরতম প্রকৃতির মতোই সুন্দর। আমার সাধ্য থাকলে শুধু এই বাড়ি কেন পুরো পৃথিবীকে জানিয়ে দিতাম৷”
“মেলোড্রামা।”
“হলে হোক। প্রেমে মেলোড্রামা থাকা স্বাভাবিক এবং মার্জনীয়।”
প্রকৃতি পাশে ট্রে রেখে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “উঠে এসো মিস্টার ফটোগ্রাফার। অনশন ভাঙার সময় হয়েছে।”
প্রিয়মের এখনো বিশ্বাস করতে বেগ পেতে হচ্ছে যে এমন মিষ্টি আদুরে ক্ষণ ওর জীবনে এসেছে। তাই টপ করে হাত ধরতে পারল না।
“দাবী আদায় হয়েছে কিনা বুঝব কী করে?”
“এরপরও বোঝোনি? হাতটা ধরো, প্রিয়ম।”
এমন প্রেমময় আহ্বান এড়ানোর মতো শক্তি কোনো প্রেমিকের থাকে না। প্রিয়মেরও নেই৷
মোহাচ্ছন্ন প্রিয়ম প্রকৃতির হাত ধরতে অপার্থিব প্রশান্তিতে ভেতরটা আচ্ছন্ন হয়ে উঠল। হাত ধরে উঠে এগুতে গিয়ে একটা অঘটন ঘটল। প্রকৃতির প্রিয় দোলনচাঁপা গাছের একটা টব ভেঙে পড়ল প্রিয়মের গায়ের ধাক্কা লেগে।
প্রকৃতি আগুন চোখে তাকাল৷ তবে তার উত্তাপ আজ ভালোবাসায় ঢেকে গেছে। প্রকৃতির চোখে কাজল নেই৷ তবুও ভীষণ গভীর। চোখ কালো হরিণ না হোক, প্রকৃতির চোখে ডুবে যাওয়া যায় অনায়াসে।
ভালোবাসার একটা সমুদ্র ধারণ করতে পারে ভালোবাসাময় একজোড়া চোখ, চোখের গঠন যেমনই হোক। সেই সমুদ্র গভীর চোখের অথৈ জলে প্রিয়ম ডুবে গেল অকুণ্ঠ ভালোবাসায়।
…………
(সমাপ্ত)
এই গল্পের প্লটের শুরুর অংশের পুরোটা আমার ছোট বোন রওনক জাহান প্রীতির দেয়া। গহীনের সুর’এর পরে আরেকটা প্লট ও আমাকে দিয়েছে। যদিও ওর মনের মতো হয়নি আমি জানি। ও আমার লেখা পড়ে না বলেই নিশ্চিন্ত খানিকটা। আপনাদের কেমন লাগল কৃপণতা না করে জানাবেন কিন্তু। নতুন বছরের উপহার ছিল গল্পটা, আপনাদের জন্য।