#কান্নাভেজা_রাত
#৫ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক
‘
‘
‘
আমি ঘরে আসার পর পরই আমার শাশুড়ি বাজার করে নিয়ে এলেন। আমি তখনও কিচেনে যাইনি। ঘরের জানলার কাছে দাঁড়িয়ে আছি। ততোক্ষণে সন্ধ্যা হয়েছে।ঘরে এসে কয়েক টুকরো অন্ধকার ঢুকেছে।
শাশুড়ি কিচেনে বাজারের ব্যাগ নামিয়ে রেখে আমার ঘরে এলেন। এসে আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন,’ সন্ধ্যা হয়ছে ঘর এভাবে অন্ধকার করে রাখছো কেন? লাইট জ্বালাও নাই কেন? নাকি এই ঘররে নিজের ঘর মনে করো না?’
আমি কিছু বললাম না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম।
শাশুড়ি নিজেই সুইচ টিপে বাতি জ্বালিয়ে নিলেন। তারপর বললেন,’ কিচেনে যাও।মাছ কাটো গিয়ে।আমি নামাজ পড়তে গেলাম।’
আমি বললাম,’ আচ্ছা।’
তিনি আবার বললেন,’ তাড়াতাড়ি যাও।নরম হয়ে যাবে।’
আমি তখনও কথা বললাম না।
আমি তার কথার সঙ্গে সঙ্গে কিচেনেও গেলাম না। গেলাম আরো পরে।আমি গিয়ে ব্যাগ থেকে মাছ বের করে কাটতে বসেছি মাত্র। এরিমধ্যে আমার শাশুড়ি এলো। এসে মোড়ার উপর বসে বললো,’ এক কাজ করো।হাত ধোও। ধুয়ে আগে চা করো আমার জন্য। তারপর মাছ সবজি নিয়ে বসো।’
আমি কিছুই বললাম না।মনে মনে রাগে জ্বলছি। কিন্তু রাগ দেখাচ্ছি না। তার কথা মতোই চা করলাম। কাপ ভর্তি করে তার হাতে চা দিয়ে আবার মাছ নিয়ে বসলাম।
আমার শাশুড়ি এবার বললেন,’ পিল টিল খাও না তো আবার তুমি?’
আমি চমকে তাকালাম তার দিকে। বললাম,’ কিসের পিল?’
শাশুড়ি বললেন,’ বাচ্চা কাচ্চা না হইবার পিল।’
আমি বললাম,’ জ্বি না।’
তিনি চায়ে চুমুক দিয়ে আমায় ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলেন। তারপর বললেন,’ মিথ্যা বলতেছো না তো আবার?’
আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম,’ মিথ্যে বলবো কেন? আপনার ছেলে আমায় পিল এনে দিবে? আপনি এনে দিবেন? আপনারা যদি এনে না দেন তবে আমি এটা পাবো কোথায়? নাকি নিজে নিজেই তৈরি করে ফেলবো?’
রাতুলের মা মুখ কালো করে খানিক সময় বসে রইলেন। তারপর গলায় তেজ নিয়ে বললেন,’ আমি কি তোমার অমঙ্গল চাই বলো? আমার প্রতি রাগ দেখাও কেন? তোমার মা নাই।আমারে কি তোমার মা ভাবতে পারো না তুমি!’
আমি তার দিকে না তাকিয়েই বললাম,’ কোথায় রাগ দেখালাম? ‘
তিনি এবার বললেন,’ তোমার কৌতুহল মেহেরুনরে নিয়ে।মেহেরুনের একটা ঝামেলা আছে।আমি সময় হলে বলবো সব। এখন এইসব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করো না’
আমি বললাম,’ কোথায় ঘাঁটাঘাঁটি করলাম? আপনি তো আমাকে তালাবদ্ধ করেই রাখেন। বেরুতে পর্যন্ত দেন না । এরচেয়ে এক কাজ করেন। একটা শেকল এনে হাতে পায়ে পরিয়ে দেন। একেবারে বন্দী হয়ে যাই।’
রাগ এবং দুঃখ নিয়েই কথাগুলো বললাম।
রাতুলের মা বললেন,’ মা, রাগ কইরো না। সময় হলে সব জানবা তুমি। এখন শুধু এইটুকু জেনে রাখো, মেহেরুনরে তুমি যেরকম ঠান্ডা রকমের মানুষ দেখতেছো সে আসলে এই রকম কেউ না। তার বিরাট ইতিহাস আছে। সে একটা বি*ষধর সাপের চেয়েও ভ*য়ংকর।সময় হলে আমিই সব বলবো। অপেক্ষা করো কয়দিন। তোমার ভালোর জন্যই আমি সব গোপন রাখতেছি।’
আমি বললাম,’ আপনি সেদিন কি বলেছিলেন? মনে আছে আপনার?’
রাতুলের মা বললেন,’ কি বলেছিলাম?’
আমি হাসার চেষ্টা করলাম। মৃদু হেসে বললাম,’ আপনি বলেছিলেন মেহেরুন আমার ননদ।মানে ও আপনার মেয়ে।তো নিজের মেয়েকে নিজেই বি*ষধর সাপ বলতেছেন কেন? নিজের মেয়েকে কি কেউ এরকম বলে?’
রাতুলের মা আমতা আমতা করে বললেন,’ এইসব কথা এখন রাখো মা। আল্লাহ আল্লাহ করো কোনমতে যেন বিপদটা কাটে!’
আমি তার দিকে তাকালাম।অবাক হবার চোখে। তারপর বললাম,’ কিসের বিপদ কাটার কথা বলছেন আপনি? ‘
রাতুলের মা চায়ের কাপটা মেঝেতে নামিয়ে রাখলেন। তারপর বললেন,’ এই সা*পটাকে এই বাড়ি থেকে বিদায় করলেই তো সব বিপদ কেটে যাবে।’
আমি বললাম,’ এরকম টেজার দিচ্ছেন কেন একটু একটু করে। বলতে চাইলে সব কিছুই খুলে বলুন। না চাইলে কিছুই বলতে হবে না।’
আমার শাশুড়ি কিছু বললেন না। মুখ ফুলিয়ে বসে রইলেন। হয়তো তিনি আমার কাছ থেকে এরকম কড়া গলার জবাব আশা করেননি। কিন্তু তার এসব কথা শুনে হঠাৎই মনে হলো, এই মহিলা ভ*য়ংকর কেউ না। কিন্তু কিছু কিছু পরিস্থিতি এরকম তৈরি হয় যে, নিজেকে কঠিন দেখাতে হয়। তিনি হয়তো কঠিন হবার সেই অভিনয়টাই করে যাচ্ছেন। কিন্তু মজার বিষয় হলো আস্তে আস্তে তার কাঠিন্যতা গলে যাচ্ছে। তিনি চেতনে অবচেতনে নিজেকে সহজ করে তুলছেন আমার কাছে।
সেদিন আর তার সঙ্গে এই বিষয়ে কোন কথা হলো না। আমারও ইচ্ছে হলো না।তিনিও কেমন চুপ মেরে গেলেন। হয়তো বুঝে ফেলেছেন বেশি কথা বলতে গিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না তিনি।মনের অজান্তেই অনেক কিছু প্রকাশ করে দিচ্ছেন।তাই ভাবলেন হয়তো, কথা না বলাই মঙ্গল জনক।
‘
রাতে রাতুল ফিরলে দেখলাম তার হাতে কালো একটা ব্যাগ।মনে হলো ভারী। সে সেই ব্যাগ খুব সাবধানে রাখলো খাটের নিচে। রাখার সময় কেমন একটা শব্দ হলো। শক্ত কিছু রাখলে যেরকম শব্দ হয় ওরকম। তারপর জামা ছেড়ে বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এলো।ও আসতে আসতে আমি উঁকি দিয়ে ব্যাগটা একবার দেখলাম। ভাবলাম এর চেইন খুলে দেখবো ভেতরে কি ! ততোক্ষণ সময় আর পেলাম না। রাতুল এসে গেছে । এসে সুইচ টিপে লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়েছে।
আমি বললাম,’ কি হলো? খাবে না?’
সে বললো,’ না।’
‘ কেন? খাবে না কেন?’
‘ খেয়ে এসেছি।’
আমি ওর আরো কাছে গেলাম। বললাম,’ কোথায় খেয়ে এসেছো?’
রাতুল রাগ দেখিয়ে বললো,’ এরকম জেরা করছো কেন তুমি? ফাউল!’
আমি চুপ হয়ে গেলাম একেবারে।সরে এলাম ওর থেকে।
খানিক পর সেই কাছে এলো। এসে জাপটে ধরে বললো,’ পরিশ্রম করে এসেছি।খুব ক্লান্ত লাগছে।এর মধ্যে এরকম জেরা করলে রাগ লাগে না বলো?’
আমি কিছুই বললাম না।
সে বললো,’ তুমি এরকম কেন? মানুষ তো তাদের বরের কাছে কতো কিছু আবদার করে। তুমি তো কোন আবদার করো না আমার কাছে!’
আমি চাপা কন্ঠে বললাম,’ আবদার করলে তুমি আবদার পূরণ করবে?’
রাতুল আমাকে আরো শক্ত করে ধরে বললো,’ অবশ্যই করবো।করবো না কেন?’
আমি বললাম,’ আমি বাড়িতে যাবো। বাবার কাছে যাবো। কদিন থাকবো গিয়ে। তুমি গিয়ে দিয়ে আসবে আমায়?’
রাতুল বললো,’ অবশ্যই যাবে। কিন্তু কদিন পর। এখন আমি একটু ঝামেলায় আছি। অফিসে অনেক কাজ।এসব সমাধান হলেই পরে যাবো তোমায় নিয়ে।’
আমি আর কথা বললাম না। চুপচাপ ঘুমাতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুতেই চোখে ঘুম আসে না। আমার কেন জানি কিরকম একটা সন্দেহ হচ্ছে।ও অফিস টফিস করে বলে আমার মনে হয় না।ওর ভাব সাব অফিসিয়ালদের মতো না মোটেও। তাছাড়া আজ রাতুল যখন ব্যাগটা খাটের নিচে রাখলো তখন মেঝেতে কেমন একটা শব্দ হলো।ভারী কিছুর। তখনই কেমন একটা খটকা লাগলো মনে। আচ্ছা ব্যাগে করে ও ভারি কি আনবে এমন?
আমি ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম না এই বিষয়ে কিছুই। জিজ্ঞেস করলে যদি ব্যাগটা সরিয়ে ফেলে এখান থেকে। তাছাড়া ও আমার কৌতুহলপূর্ণ আচরণ পছন্দ করে না।
রাতুল সম্ভবত পরিশ্রান্ত।মিনিট পনেরো পরেই দেখা গেল মৃদু নাক ডাকছে। ঘুমিয়ে পড়েছে ও।এই কদিন ওর সঙ্গে থেকে ওকে আমি খুব ভালো করেই আয়ত্ত করে ফেলেছি।অন্য কিছু না বুঝলেও ওর ঘুম।ও কখন সত্যি সত্যি ঘুমায় তা আমি বুঝি। রাতুল ঘুমাবার আরো ঘন্টাখানেক পর চুপিচুপি আমি বিছানা থেকে নামলাম। তারপর ব্যাগটা টেনে খাটের নিচ থেকে সামান্য বের করে আনলাম। হাতে মোবাইল ফোন ছিল।এর ফ্ল্যাশটা আঙুল দিয়ে বন্ধ করে মৃদু যে আলো হলো সেই আলোটা সামনে নিয়ে ব্যাগের চেইনটা খুলতে চাইতেই খাটে মড়মড় একটা শব্দ হলো। ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে গেল। তাড়াহুড়ো করে ব্যাগটা ভেতরে রেখে বিছানার দিকে তাকালাম। না রাতুল ঘুম থেকে উঠেনি। ঘুমে থেকেই নড়েছে। এবার আর সাহস হচ্ছে না ব্যাগটাতে হাত দেবার। কিন্তু মনও মানছে না। আমার আগে থেকেই এই বিষয়টা নিয়ে সন্দেহ ছিল। ওর আচার -আচরণ দেখেই মনে হয়েছিল, ও স্বাভাবিক কোন কাজের সঙ্গে জড়িত নয়।
কাঁপা কাঁপা বুক নিয়ে আবার ব্যাগটার কাছে গেলাম।টেনে আনলাম এর সামান্য। তারপর থরথর করে কাঁপতে থাকা হাতে ব্যাগের চেইন ধরে টান দিয়ে সামান্য খুলতেই ফ্ল্যাশের আলোতে দেখা গেল জিনিস গুলো। দেখে আমার মাথা প্রচন্ড রকম ঘুরতে শুরু করলো। সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেলো আমার।আগের চেয়ে বেশি কাঁপছে এখন হাত, বুক।সবটা শরীর। এই ঘরে এখন থাকতেই তো আমার ভয় করবে।সব সময় একটা আ*তঙ্কের মধ্যে থাকতে হবে আমার। জীবন মরণের মাঝখানে অবস্থান করতে হবে আমায়। আমার খুব ভয় করছে। এখন যে ওর পাশে গিয়ে শুয়ে ঘুমাবো এই সাহসটুকুও পাচ্ছি না পর্যন্ত!
‘
#চলবে