কান্নাভেজা রাত পর্ব ১০

0
364

#কান্নাভেজা_রাত
#১০ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক



পরদিন সকাল সকাল আমার ঘুম ভেঙে গেল।ঘুম ভাঙার পর দেখি জানলার কাছে দাঁড়িয়ে আছে রাতুল ।কার সঙ্গে যেন কথা বলছে ফোনে। তার মুখ হাসিহাসি। প্রথমে কথাগুলো বুঝতে না পারলেও খানিক পরেই বুঝতে পারলাম।ওপাশ থেকে কে কি বলেছে কে জানে। রাতুল জবাব দিলো হেসে হেসে।বললো,’ নেক্সট ফ্রাইডেতে ওকে নিয়ে যাবো আপনার বাসায়।গ্যারেন্টি!’
তারপর থামলো।থেমে কান পেতে ওপাশের কথাগুলো শুনলো মনোযোগ দিয়ে।শোনার পর বললো,’ হ্যা হ্যা, আপনার মতো করেই হবে। কোন সমস্যা নাই।ওর সম্মতি অসম্মতি আপনার খোঁজার কি প্রয়োজন? এটা আমার উপর ছেড়ে দিন। ‘
তারপর আবার কান পেতে কিছু কথা শুনলো। তারপর হাসলো। হেসে বললো,’ আপনি খুশি হলেই আমি স্বার্থক স্যার। তাহলে রাখি স্যার। আসসালামুয়ালাইকুম।’
ফোন রেখে দিলো রাতুল। সঙ্গে সঙ্গে আমি চোখ গুলো বন্ধ করে ফেললাম।কাঁথাটা বুকের উপর থেকে টেনে পুরোটা মাথা ঢেকে দিলাম।
আমি জানি এতোক্ষণ কাকে নিয়ে কথা বলেছে রাতুল। আমায় নিয়ে।আজ বুধবার। মাঝখানে শুধু একটিই দিন আছে। বৃহস্পতিবার ‌। এরপর শুক্রবার এলেই সে আমায় বলবে, চলো এক জায়গায় যাই!
আমি জিজ্ঞেস করবো, কোথায় যাবে?
সে হয়তো আদুরে গলায় বলবে, আত্মীয়ের বাড়িতে। বেড়াতে যাবো।অথবা বলবে কোন এক রেস্টুরেন্টে। খেতে যাবে। ঘুরতে যাবে। কিন্তু আমি জানি এসবের কোথাও সে যাবে না। সে আমায় নিয়ে যাবে এমন একজনের বাসায় যে অনেক বেশি ক্ষমতাধর। এই ক্ষমতাধর ব্যাক্তির কাছ থেকে বিশেষ কিছু সুবিধা নেয়ার বিনিময়ে আমায় ওর কাছে সমর্পণ করবে।ব*লির পাঁঠা বানাবে আমায়।
চোখ দুটো হঠাৎ করেই জলে ভিজে উঠলো। বুকের ভেতর যে হৃৎপিণ্ডুর, ওখানে হাতুড়ি পেটা হচ্ছে যেন। আর আসন্ন বিপদের ভয়ে কাঁপতে লাগলো সারা শরীর!

রাতুল তখনও জানলার কাছেই।কাঠের চেয়ার নিয়েছে ওখানে টেনে। বসে সিগারেট ধরিয়েছে।আমি একবার কাঁথা সরিয়ে এক পলক দেখে নিলাম।
তার ফোন বেজে উঠেছে হঠাৎ।দু বার রিংটোন বাজলো।রাতুলের হাতেই আছে ফোন। কিন্তু সে রিসিভ করলো না। তৃতীয়বারের সময় রিসিভ করে একটা ধমক দিলো।বললো,’ বার বার কল দিচ্ছিস কেন? বিরক্ত করতে ভালো লাগে? ‘
ওপাশ থেকে কিছু একটা বললে সে উত্তর করলো ভীষণ ক্ষীপ্র হয়ে।বললো,’ জয়ের হাতে কখনোই মেহেরুনকে তুলে দিবো না। মেহেরুনের মতো সুন্দরী মেয়েদের প্রতি বড়দের অনেক চাহিদা থাকে।আমি ওকে আরো ইউজ করবো‌। ও যখন ইউজলেস হয়ে যাবে তখন অব্যবহৃত প্যাকেটের মতো ছুড়ে ফেলে দিবো জয়ের মতো ডাস্টবিনদের কারোর কাছে।’
ওপাশ থেকে তখন হয়তো জয় সম্পর্কে কিছু বলেছে লোকটি।জয় এটা মানবে না। বাড়াবাড়ি করবে। ভেজাল লাগাবে। এরকম কিছু হয়তো!
রাতুল তখন গাল ব*কলো। বকে বললো,’ তুই কার বা* ছিঁ*ড়বি তাহলে? তোরে পালতেছি কেন দুধ কলা দিয়ে? জয় গলা উঁচু করতে চাইলে এটা কে*টে সমান করে দিবি।’
শব্দ করে হাসলো রাতুল।
ভয়ে আমার ভেতরটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে এখান থেকে এক্ষুনি নাই হয়ে যাই। মিলিয়ে যাই কোথাও!যেন রাতুল আমায় আর দেখতে না পায়। কিন্তু আমি তো রক্তে মাংসে গড়া মানুষ। ইচ্ছে করলেই আর কারোর চোখ ফাঁকি দিয়ে মিলিয়ে যেতে পারবো না!
কিন্তু একটা সিদ্ধান্ত তখনই নিয়ে নিলাম। শুক্রবার আমি আসতে দিবো না রাতুলের জীবনে।এর আগেই আমি মেহেরুনের সঙ্গে কথা বলবো। ওকে বলবো, মেহেরুন, আমি তোমার সঙ্গে আছি। তোমার কি সাহায্য লাগবে বলো আমায়। তবুও এই কা*লপ্রিটকে ধ্বং*স করো তুমি!
রাতুলের অধ্যায় শেষ হবার পর মেহেরুন নিজ থেকে পুলিশের কাছে ধরা দিক অথবা নিজে এই অন্ধকার সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী বনে যাক।এসব এখন আর ভাববার সময় নাই। আমার সিদ্ধান্ত যা নেয়ার তা নিয়ে নিয়েছি ‌। এখান থেকে আর কোনো ভাবেই পিছপা হবো না!হওয়া যাবে না।

রাতুল সিগারেট শেষ করে আমার পাশে এসে শুয়ে পড়লো। তারপর একটা হাত আমার গায়ের উপর রেখে বললো,’ জেসি, একটু আগে কাঁথা তুলে কি দেখেছিলে?’
ওর কথা শুনে ভ*য়ে আমি জমে গেলাম! কাঁপতে লাগলো শরীর থরথর করে।
রাতুল একটানে আমার উপর থেকে কাঁথাটা টেনে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আমার দু বাহুতে ধরে শক্ত করে ঝাঁকি দিয়ে বললো,’ বলো, কি দেখেছিলে? ‘
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,’ কিছু না।’
রাতুল আমার একটা কান টেনে ধরে বললো,’ তোমার কান দুটো বড় সমস্যা করে।এরা ঘুমে থেকেও অন্যের গোপন কথা শুনতে চায়। এটা তো সমস্যা।বিরাট সমস্যা।এক কাজ করলে কেমন হয় জেসি? ধরো, আমি তোমার কান দুটি কে*টে ফেললাম। তারপর সেই কান দুটো প্যা*কেটে ভরে একটা কাগজে লিখলাম, ‘আপনার একমাত্র আদুরে কন্যা কুমকুম জাহান জেসির কান’ । তারপর এই কানভর্তি প্যাকেট কুরিয়ার করে তোমার বাবা অর্থাৎ আমার শ্বশুরের কাছে উপহার স্বরূপ পাঠালাম। কেমন হবে চমকটা বলো?’
এই কথাগুলো বলে রাতুল হাসলো নাকি সা*পের মতো ফু*সফু*স করে উঠলো আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। কিন্তু এটা ঠিক বুঝতে পারলাম যে সে আমার গলা শক্ত করে চে*পে ধরেছে। আমার মনে হচ্ছে আমি ম*রে যাচ্ছি।চোখ দুটি কেমন নীল নীল অথৈ অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে। হৃৎপিণ্ড কেমন স্তব্ধ হয়ে আসছে। শরীর অ*সাড় হয়ে আসছে।পা দুটো শুধু নড়াবার শক্তি পাচ্ছি।আর কিচ্ছু পারছি না।
রাতুল গলা চে*পে ধরে রেখেই বললো,’ তোমায় মা*রবো না জেসি ! আমি নিজ থেকে এখন পর্যন্ত একটা খু*নও করিনি।আমি খু*ন খারাবিতে নাই।খু*ন খা*রাবি করে সামান্য ক্রি*মিনাল যারা তারা।বড়রা খু*ন করায়।আমি বড়।আমি বাদশাহ। অন্ধকার জগতের একক অধিপতি হবো আর কদিন পর।’
শেষের কথাটা হয়তো চিৎকার করে বললো সে।
আমি শুনতে পেলাম না খুব একটা। ততোক্ষণে শরীর নিস্তেজ হয়ে এসেছে বলেই হয়তো। রাতুল বুঝতে পারলো আর সময় নেই। আরেকটু হলেই প্রাণবায়ু বে*রিয়ে উড়াল দিবে মহা অসীমের দিকে। সে তখন আমায় ছাড়লো। ছেড়ে এক ঝটকায় দূরে সরিয়ে দিয়ে তার কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললো,’ নিজেকে বেশি চালাক ভাবতে যাবি তো কুকুরের মতো ম*রবি।তোরে আগে বলিনি আমি? স্বতর্ক করিনি? এবার শেষ বারের মতো সুযোগ দিলাম।তোর প্রাণ ভি*ক্ষা দিলাম। এরপর কোন ভুল করলে —‘
বাক্যটা অপূর্ণ রেখেই সে উঠে গেল। তারপর শার্ট পরলো আলনা থেকে নামিয়ে। চুল আঁচড়ে নিলো চিরুনি দিয়ে। তারপর দেখলাম খুব দ্রুত সে যে দিকে বিছানায় শুয়ে ঘুমায় সেদিকে, তার শিউরের কাছে বিছানার নিচে হাত দিয়ে কিছু একটা বের করে এনে দ্রুত পেছনে শার্টের নিচে পিঠ বরাবর গুঁজে রাখলো।কাজটা খুব দ্রুত করলেও আমি বুঝতে পারলাম এটা কি! পি*স্তল।কালো রঙের। তাহলে রাতুলও তার নিরাপত্তার জন্য সব সময়ই সঙ্গে করে অ*স্ত্র রাখে।এমনকি ঘুমোতে গেলেও!
ঘর থেকে বেরুবার আগে সে আমার কাছে এলো। তখনও আমি ভ*য় কাটিয়ে উঠতে পারছি না।গলার কাছে খুব জ্বলছে। শক্ত করে ধরেছিল তো।ছিলে গেছে সম্ভবত। তাছাড়া ব্যথাও করছে গলার রগ গুলোতে। প্রচন্ড!
চোখ থেকে অনর্গল জল গলছে।ভিজে চুপসে গেছে গাল। ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাঁদতে। কিন্তু ওর সামনে কাঁদাও যাবে না । কাঁদলে হয়তো জী*বনের জন্য একেবারে কান্নাকাটি বন্ধ করে দিবে! ওর মনে মায়া দয়া জিনিসটা হয়তো নাই। অথবা থাকলেও এটাকে এখন আর ব্যবহার করে না!
রাতুল কাছে এসে আমার দু’ গাল মুছে দিলো। তারপর গলায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,’ সরি জেসি! ‘
আমি কিছু বললাম না। শুধু চোখ থেকে আরো কয়েক ফোটা জল নামলো গালে।
সে তখন আমায় জড়িয়ে ধরে চু*মু খেয়ে আমার গালে আঙুল টেনে দিয়ে উঠে যেতে যেতে বললো,’ আর এরকম করবো না। কখনোই করবো না জেসি। যদি তুমি আমার সব কথা শুনো। স্বামীর সব কথা শুনতে হয়। না শুনলে পাপ হয় যে তা তো জানো জেসি!মহা পাপ হয়। এই পাপের শা*স্তি নাকি মৃত্যুর পর সৃষ্টিকর্তা দেয়। কিন্তু আমি এর আগেই দিয়ে দিবো।’

এই কষ্টের ভেতরেও ওর এই কথাটা শুনে আমার হাসি পেলো। কিন্তু হাসতেও পরলাম না আমি। কিন্তু মনে মনে আমি বললাম, আমি ম*রবো, অথবা তুই। ভেতরের ভয়কে আমি জয় করে তুলবো।আমি কিছুতেই নিজেকে অন্যের উপভোগের বস্তু বানাতে দিবো না।আমি মেহেরুনকে সাহায্য করবো । মেহেরুন যদি ব্যর্থ হয় তবে হয়তো আমার মৃত্যু হবে। মেহেরুন নিজেও হয়তো ম*রবে । এরকম য*ন্ত্রণাময় জীবনের চেয়ে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে ম*রে যাওয়া সুন্দর।সম্মানের।আমি মেহেরুনকে অবশ্যই সাহায্য করবো।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here