#কাননবালা!
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ৩৭
মাইক্রো চলছে ঢাকা টু খুলনার উদ্দেশ্যে।রাতের নিস্তব্ধতায় কালো গাড়িটা শাঁ শাঁ করে ছুটে চলছে। চারপাশের শত কোলাহল ছাপিয়ে একটা মেয়ের নিদারুণ কান্নায় সবার হৃদয়ে হাহাকার তুলছে যেন!
সেতু কাঁদছে।ব্যকুল হয়ে কাঁদছে। কখনো উচ্চস্বরে, কখনো গুনগুন করে। ফর্সা মুখশ্রী অত্যাধিক কান্নার ফলে লাল হয়ে ফুলে আছে।নীতুর বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদছে মেয়েটা।এ কান্না একজন পিতা হারানো কন্যার কান্না! কেঁপে কেঁপে উঠছে সেতু কান্নার দমকে।নীতু শক্ত হাতে জরিয়ে ধরে ছোট বোনকে।সেতু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে ওঠে, “আপি, আমাদের বাবা মরে গেছে…. তুমি কাঁদছো না কেন?তুমি এতটা শক্ত কিভাবে থাকছো?আপি বাবা আর নেই…..আমাদের বাবা আর নেই!”
নীতু ফোঁস করে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে, তবুও কাঁদে না।সেতুর মাথা কোলের উপর রেখে বলে,”এত কাঁদিস না, তোর শরীর ভালো না।অসুস্থ হয়ে পড়বি।”
নীতুর কথায় সেতুসহ গাড়িতে থাকা প্রতিটা সদস্যের চোখে দেখা দেয় অবাক বিস্ময়। সেতু কাঁদতে কাঁদতে রাগী স্বরে বলে,”তুমি আমাকে ছুঁবে না আপি…..একদম ছুঁবে না!তুমি নিষ্ঠুর হয়ে গেছো!”
নীতু তবুও কিছু বলে না।মুখের অভিপ্রায় প্রবল কঠিন।চোখ মুখ অত্যাধিক স্বাভাবিক! সেতু একসময় কাঁদতে কাঁদতে নীতুর কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে।রাত তখন তিনটে।নীতুর কেমন চোখ জ্বলে ওঠে! কান্না আসে না।শুধু বুকের উপর পাহাড় সমান চাপ অনুভব হয়!বিষাক্ত বিস্বাদে ছেঁয়ে যায় শরীর! নীতু চোখ ঘুরিয়ে সবার দিকে তাকায়। রুশিয়া আন্টি,রাবেয়া বেগম, তাজের বাবা,তাজ, অভীক সবাই চুপচাপ মৌনতা বজায় রেখে বসে আছে। নীতু ক্লান্ত কন্ঠে বলে,”আর কতক্ষণ অভীক?”
“আরো ঘন্টা দুয়েক।”
নীতু চোখ বন্ধ করে জানালায় মাথা রাখলো।অভীক সেদিকে করুণ দৃষ্টিতে একপলক তাকিয়ে রইলো!
অভীক ড্রাইভ করছিল।গাড়িটা বড় স্যারের।সন্ধ্যার পরে যখন মৃত্যু সংবাদ জানায় জায়েদ,তখন অভীক এক মুহুর্তের জন্য বাকহারা হয়ে পড়েছিল।নীতুকে কি বলবে?কি করে সামলাবে ভেবে পাচ্ছিলো না।অভীক এতদিনে জেনে গিয়েছিল নীতু তার বাবাকে প্রচন্ড ভালোবাসে! সেই মেয়েটার কাছে কি করে বলবে?তোমার বাবা আর পৃথিবীতে নেই!
অভীক যখন দিশেহারা তখন তাজ কল করলো।তারাও বেরোচ্ছে খুলনার উদ্দেশ্যে।তাই স্যারের গাড়ি নিয়ে যখন সবাই নীতুদের বাসায় উপস্থিত হলো।তখন নীতু কেবল অফিস থেকে ফিরে ফ্রী হয়েছে।সবাইকে একসঙ্গে দেখে নীতু চমকালো।সেতুও অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল।অভীকও অসহায় চোখে তাকিয়ে ছিলো নীতুর দিকে।কি মায়াবী শান্ত মুখ!এই মুখটায় এখন বর্ষার ঢল নামবে!কি করে সইবে অভীক? নীতু হতভম্ব স্বরে অভীককে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে? ”
অভীক কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে ওঠে, “আমাদের এখুনি খুলনা যেতে হবে নীতু।”
নীতু চোখ বন্ধ করে দরজার পাল্লা খাঁমচে ধরলো।জানতে চাইলো না কেন?যেন উত্তরটা তার জানা!
সেতু অসহিষ্ণু স্বরে বললো,”হুট করে কেন খুলনা যাবো ভাইয়া?কার কি হয়েছে? তাজ আপনি অন্তত খুলে বলুন।”
তাজের মুখ থেকে শোনার পর সেতু উচ্চস্বরে কেঁদে উঠেছে।আহাজারি করেছে।রুশিয়া বেগমের বুকে আঁচড়ে পড়ে কেঁদেছে অথচ নীতু ছিল নির্বিকার! অভীক নিজেও থমকে গিয়েছিল নীতুর আচরণে। তাজ বুঝতে পারলো না কাকে কি বলবে?পাগলের মত কাঁদছে সেই সেতুকে কি বলে স্বান্তনা দিবে আর যে কঠিন পাথরের মত দাঁড়িয়ে আছে তাকেই বা কি বলবে?
নীতু চুপচাপ শান্ত পায়ে গাড়িতে উঠে পড়েছিল।সেই থেকে এখনো শান্ত।কোন কান্না বা কষ্টের চিহ্ন মুখে ফুটে উঠেনি অথচ অভীক জানে মেয়েটা মনে মনে গুমড়ে মরছে।লুকিং গ্লাসে আলতো করে চাইতেই দেখলো নীতু জানালা গলে উদাসীন চোখে বাহিরে তাকিয়ে আছে! অভীকের ইচ্ছে করে নীতুকে বুকের ভিতর জরিয়ে ধরে বলতে,”এত ভেঙে পরো না ।তুমি দূর্বল হলে আমিও যে দূর্বল হয়ে পরবো কাননবউ!তোমার নিরাবতা আমাকে পোড়াচ্ছে! একটু আধটু কাঁদলে কোন ক্ষতি নেই তো কাননবউ!তোমার চোখের জলে আমার বুকটা ভাসিয়ে দাও তো!তবুও এভাবে নিরব থেকো না!” মনের কথা মনেই চেপে রইলো। নীতুকে আর বলা হয় না।
তাজ বসেছিল ড্রাইভিং সিটের পাশে।যে মানুষটা মারা গেছে সে তার শশুড়।কিন্তু তাকে কেবল একবারই দেখেছে সে।তার মৃত্যুতে মানবিক দিয়ে খারাপ লাগলেও সেতু আর নীতুর জন্য বেশি কষ্ট হচ্ছে! নীতুর থম মারা মুখের দিকে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে চাইলো তাজ।তাজ অবাক না হয়ে পারলো না।এতটা শক্ত কবে হয়েছে মেয়েটা? চোখ ঘুরিয়ে নীতুর কোলের দিকে চাইতেই তাজের এবার মনখারাপ হয়ে গেলো।সেতু ঘুমের ঘোরেও ফোঁপাচ্ছে।কেমন কেঁপে কেঁপে উঠছে মেয়েটা!
************
সুমধুর ধ্বনিতে ফজরের আজান দিলো মুয়াজ্জিন। কুয়াশা ভেদ করে সূর্যের আলো পৃথিবী রাঙাতে যেন ব্যর্থ! ঠিক সে সময় এসে গাড়িটা থামলো নীতুদের বাসার সামনে। দুয়েকটা কাক উচ্চস্বরে ডেকে উঠলো!
সবাই একে একে নামলেও নীতু বসেছিল ঠায়।সেতু কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির দিকে ছুটে গেলো। অভীক গাড়ির দরজা খুলে নীতুকে নামতে ইশারা করলো।নীতু অসহায় চোখে অভীকের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।অভীকের বুক পুড়লো যেন ঐ অসহায় জড়সড় হয়ে বসে থাকা মেয়েটিকে দেখে!কেমন উদ্ভ্রান্ত চাহনি! অভীক কিছুটা ঝুকে নীতুর হাত ধরলো।নামতে সাহায্য করলো।নীতু অভীকের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বললো,” বাবা কি আমার উপর অভিমান করে চলে গেছে অভীক? বলুন না? বাবা কেন চলে গেলো অভীক?”
অভীক কি বলে স্বান্তনা দিবে ভেবে পেলো না।কেবল শক্ত করে হাতটা ধরে রইলো।
হুট করে নিখিল এসে বোনকে জরিয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলো।একসময় ইতু, মিতু, সেতু এসেও নীতুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।হাউমাউ করে কাঁদছে সবাই।কি বিভৎস করুণ দৃশ্য! পাঁচ ভাইবোন জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। কিন্তু নীতু যেন ঠিক কাঁদছে না।শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তাকে ঘিরে চার ভাইবোনের কান্নার রোল।তবুও কেমন ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।অভীকের চোখেও পানি এসে গেলো।মনে পড়ে গেলো তার বাবার মৃত্যুর দিনটি।ঠিক সেইসময় একটা কাক পুনরায় চিৎকার করে কা কা করে ডাকতে লাগলো মাথার উপরের ওই কুয়াশা মিশ্রিত আকাশে।নীতু উদাস চোখে কাকটির দিকে তাকিয়ে রইলো। ক্রমশই নীতুর চোখ ভিজে উঠতে শুরু করলো!দম আটকে আসলো।নীতু হা করে নিঃশ্বাস নিতে লাগলো!ঠিক কৃষ্ণ পক্ষীটির মত!
বসার রুমের ঠান্ডা মেঝেতে শুয়ে আছে নীতুর বাবা। মাথার কাছে আগরবাতি জ্বলছে। কয়েকজন ছেলে কোরআন শরীফ পড়ছে দুলে দুলে।নীতু জড়ানো পায়ে এসে বাবার মাথার কাছে বসলো।ছোট্ট শিশুর মত বাবার কপালে চুমু খেলো।মুখে হাত বুলিয়ে দিলো বারংবার! মায়ের দিকে তাকিয়ে নীতু অশ্রুসিক্ত চোখে প্রশ্ন করলো,”মা বাবার তো ঠান্ডা লেগে যাবে,এমন ঠান্ডা মেঝেতে কেন রেখেছো?বুকে কফ জমে গেলে সারারাত তো আর ঘুমাতে পারবেনা, তখন?”
মহিমা বেগম হু হু করে কেঁদে উঠলো মুখে আঁচল চেপে। নীতু ফের বাবার দিকে চাইলো।তার বাবা আজ মৃত ভাবতেই কলিজাটা পুড়ে উঠলো যেন! নীতু একটু ঝুঁকে বাবার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলতে শুরু করলো, “বাবা,ও বাবা… ঘুমিয়ে গেলে তো চিরতরে? এতই তাড়া ছিলো তোমার। আমি কিন্তু আমার কথা রেখেছি বাবা।তোমাকে কন্যা দায়গ্রস্থ হয়ে মরতে হয়নি।সবসময় না আফসোস করতে….আজ দেখো কেমন চলে গেলে।বাবা, একটু পড়ে গেলে কি খুব ক্ষতি হতো বাবা?কালো মেয়েটার বিয়ে না দিয়ে মরতে চাইছিলে না কিন্তু কালো মেয়েটার সংসার দেখতে একটুও ইচ্ছে হলো না?এতই তাড়া তোমার বাবা? বাবা….. ও বাবা,খুব কষ্ট হয়েছিল কি তোমার?এমন মুখটা নীল হয়ে আছে কেন? কেন কথা বলছো না বাবা? কথা না বলো তাকাও আমার দিকে…..তোমার কালো মেয়ের সুখ না দেখে কেন চলে গেলে বাবা?আমি এখন কাকে বাবা ডাকবো বলো তো??মুক্তি দিয়ে গেলে তো? ভালো! খুব ভালো!….. ”
নীতুকে টেনে সেখান থেকে সরিয়ে দিলো জায়েদ। নীতু কোন উচ্চ বাচ্চ্য করলো না।গোসল করে পরিষ্কার জামা পড়ে বাবার মাথার কাছে বসে গুনগুন করে কোরআন শরীফ পড়তে লাগলো।শান্ত শিষ্ট নরম মেয়েটার এমন শক্তরুপ যেন সবাইকে বিস্মিত করলো!
ঠিক দুপুরের সময় খবর এলো ভিতর রুমে লাশ দাফনের সময় এসেছে। কারো কোন ইচ্ছে থাকলে বলতে পারেন। সাথে মাটি নিয়ে এসেছে নীতুর মামাতো ভাই।ছুঁয়ে দিতে হবে।সেই মাটি কবরে দিবে। ইতু সেতু সেই কথা শুনে ফের কেঁদে উঠলো কিন্তু শব্দ হলো না।আজ যেন কান্নারাও ক্লান্ত। নীতুর সামনে মাটির বাটি ধরতেই নীতু মাটিতে হাত বুলালো,বিড়বিড় করে বলে উঠলো…,”ও মাটি আমার বাবাকে ব্যথা দিস না।তোর প্রতি আমার অনুরোধ!বড্ড নরম শরীর আমার বাবার।ইহকালে মৃত্যু যন্ত্রণা সয়েছে যে মানুষটা তাকে আর কষ্ট দিস না।”….বলে মাটিতে চুমু দিলো নীতু। সবার চোখে পানি এসে গেলো।
খাটিয়া কাঁধে তুলেছে জায়েদ, নিখিল, মিলন আর অভীক। তাজ ধরেছে তাদের সাথে। খাটিয়া নেওয়ার সময় সবাই থেমে যেতে বাধ্য হলো।নীতু পাগলের মত এসে সামনে দাঁড়িয়েছে। চোখের কোলে নিরব অশ্রু! নীতু দিগ্বিদিক ভুলে বলতে লাগলো,”দাদাভাই কেন মেয়ে হলাম বলতো?বাবাকে কাঁধে নিতে পারছি না।অথচ কন্যা দায়গ্রস্ত হয়ে বাবার কাঁধে ঠিকই তো এতদিন সওয়ার ছিলাম।দাদাভাই কন্যাদায় গ্রস্থ হয় কেন পুত্রদায় গ্রস্থ পিতা হয় না বলো তো?”
নীতুর এমন পাগলামো প্রশ্নে জায়েদ বোকার মত তাকিয়ে রইলো। নিখিল কাঁদো স্বরে বলে ওঠে, “বোন নিজেকে সামলা।সরে যা।আমাদের যেতে দে।”
নীতু ভাইয়ের পায়ের কাছে বসে পড়লো।অনুরোধের স্বরে বলে উঠলো, “ভাইয়ারে বাবাকে নিয়ে যাস না।আমাকে কে মা ডাকবে বলতো? ভাইয়া ও ভাইয়া, বাবাকে আমার আস্তে রাখিস মাটিতে।ব্যথা যেন পায় না। মাটি দিয়ে পাড়াস না যেন।সইতে পারবো না আমি। বাবাকে রেখে চলে আসবি না কথা দে,বসে থাকিস কিছুক্ষণ। তুই না ছেলে,বাবার ভরসা।বাবার হয়ে দোয়া পড়িস।আমার বাবা যেন শাস্তি পায় না।”
নীতুর উদ্ভ্রান্ত কথায় বাধ্য হয়ে অভীক এসে শক্ত করে ধরে নীতুকে সরালো। সবাই খাটিয়া নিয়ে চলে যেতে নিলেই নীতু চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। অভীক শক্ত করে ধরে রাখতে চাইলো পারলো না।নীতু মাটিতে গড়াগড়ি করে কাঁদছে, ব্যকুল হয়ে কাঁদছে।আকাশ বাতাসও যেন কেঁপে উঠলো সেই কান্নায়। অভীক টেনে হিঁচড়ে বুকের মাঝে ধরে রাখলো নীতুকে।নীতু বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদছে আর বলছে, “আল্লাহ, আমার আল্লাহ তুমি বাবাকে আর কোন কষ্ট দিও না।জান্নাতের খুশবু আমার বাবার জন্য বরাদ্দ রেখো। অভীক আপনি জানেন? আমার বাবা আজ মুক্তি পেয়েছে।কতটা দিন ওই শক্ত বিছানায় আমার বাবা শুয়ে ছিলো বন্দী পাখির মত।কথা বলতে পারে নি,বসতে পারে নি,হাঁটতে পারেনি,নিজ হাতে খেতে পারে নি।আমার বাবার পিঠে ঘাঁ হয়েছে,চোখ থেকে অশ্রু ঝরেছে।এত কষ্ট আল্লাহ আমার বাবাকে দিয়েছে।আজ সেই কষ্ট থেকে মুক্তি পেলো বাবা! অভীক আপনি আল্লাহকে বলুন,আর কোন কষ্ট যেন আমার বাবাকে না দেয়! আমার বাবা সইতে পারবে না।আমার ভালো বাবা সইতে পারবে না!”
নীতুর আহাজারিতে অভীকের বুক ফেঁটে যাচ্ছে যেন। একসময় অভীক অনুভব করলো নীতু নেতিয়ে পড়েছে।জ্ঞান হারিয়েছে মেয়েটা।নীতুকে কোলে করে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে অভীক পা বাড়ালো কবর স্থানের উদ্দেশ্যে।যেখানটায় মানবজীবনের সকল সমাপ্তির শুরু!
রাতটা কাঁটলো সবার উদ্বিগ্নতায়।নীতু জ্বরে অচেতন হয়ে বাবার খাটে শুয়ে আছে।যখনই একটু জ্ঞান ফিরে বাবা বাবা বলে চিৎকার করে ওঠে।সবাই সারারাত নীতুর কাছে বসেছিলো।মহিমা বেগম সারারাত মেয়ের শিয়রে বসে মুখে আঁচল চেপে কেঁদেছে।অভীক রুমের বাইরে ছটফট করে কাটিয়েছে। ভোর হয়েছে মাত্র। মহিমা বেগম নামাজে দাঁড়িয়েছে। নীতুর পাশে ইতু আধশোয়া হয়ে বসেছিলো।কখন যেন চোখটা লেগে এসেছে।অভীক আর থাকতে না পেরে নীতুর কাছে চলে আসলো।মাত্র একটা দিনের ব্যবধানে কেমন হয়ে গেছে মেয়েটা।চোখ মুখ বসে গেছে।অভীকের বুকটা হু হু করে উঠলো! নীতুর পাশে বসে চুলে হাত বুলিয়ে দিলো।কাঁথাটা টেনে দিলো ভালো মত শরীরে।নীতুর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে চুমু দিলো।নীতুর নিস্তেজ শরীর অভীকের বুকে ছুরির আঘাত বসালো যেন!কখন ভালোবেসে ফেললো এতটা মেয়েটাকে? কে জানে?কপালে পড়ে থাকা অবহেলিত চুলগুলো সরিয়ে চুমু দিলো পরম যত্নে।অভীকের চোখে তখন বর্ষার পানি ছলছল করে উঠলো।
“খুব ভালোবাসেন বুঝি আমার বোনকে?”….. হুট করে ইতু প্রশ্ন করলো।
অভীক ইতুর করা প্রশ্নে মৃদু হাসলো।ভেজা কন্ঠে বলে উঠলো, ” উহু, তোমার বোনকে আমি একটুখানি ভালোবাসি।”
“তবে আপনার চোখে জল কেন?”….. ইতু অবাক হয়ে জানতে চাইলো।
“এ চোখের জলটুকু আমার কাননবউয়ের নামে লিপিবদ্ধ! সে যখনই কষ্ট পাবে তখনই আমার চোখ অশ্রুসিক্ত হতে কার্পণ্য করবে না! ইতু তোমার বোনকে আমি একটুখানি ভালোবাসলেও আমার কাননবউকে ভালোবাসি হৃদয়ের সবটুকু দিয়ে!”
এত কষ্টের মাঝেও ইতুর চোখে প্রশান্তি নামলো যেন!
**********
সুরভির মেজাজ সপ্তমে।এত ছোটলোক মানুষও যে পৃথিবীতে আছে তা জানা ছিল না তার। পরক্ষনেই সুরভির মন খারাপ হয়ে যায়।একসময় তো সেও এরকমই ছিল। সুরভি সোনাডাঙার মামিকে আসতে দেখে দ্রুত সরতে নিলেও পারলো না।মামি চেপে ধরলো।ফিসফিসিয়ে বললো,”হ্যারে নীতুকে কাল যে কোলে নিলো সে কে?একে তো বিয়ে হয় না তারউপর পরপুরুষের কোলে উঠেছে, এরপর কে বিয়ে করবে?”
সুরভি ফোঁস করে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। কাল থেকে আত্মীয় মহলের এমন হাজার খানিক প্রশ্নে সে জর্জড়িত। কেউ বলছে,নীতুর বিয়ে না দিয়ে মরে গেলো বাবা।আহারে!কেউ বলছে, নীতু প্রেম করছে,কোলে উঠেছে হেনতেন!
নীতুর বিয়েটা সবাইকে না বলায় যে যেমন পারছে কথা বলছে।মানুষ বিয়ে বাড়ি আর মরা বাড়ি সুখ বা দুঃখ ভাগ করতে আসে না,আসে কার কেমন অবস্থা সমালোচনা করতে!
সুরভি চোখ মুখ শক্ত করে বললো,”মামি নীতুকে নিয়ে আপনার চিন্তা করতে হবে না।ফুপু বাড়ি থেকে ভাত দিয়েছে আপনাকে খাবার দেই?”
“দেও, আর কি করার। তা বাপু কাল তোমার বাপের বাড়ি থেকে ওসব কি চাউলের ভাত দিয়েছে বলো তো?কেমন ত্যাসা ত্যাসা!ওসব যে আমরা খাই না তা তুমি তাদের বলো নি।”
সুরভির চোখ থেকে আগুন ঝরে পড়লো।কিছু বলতে নিবে তখনই রুশিয়া বেগম এসে টেনে নিয়ে গেলেন। সুরভিকে শান্ত করে বললেন,”ওসবে কান দিও না মা। এসব মানুষ আসেই ঝামেলা পাকাতে!”
সুরভি কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকালো অভীকের মায়ের দিকে।
**************
তাজ ছাদে দাঁড়িয়ে ছিলো।সেখান থেকেই দেখতে পেলো সেতু কথা বলছে মেহেদির সাথে। তাজ চেয়ে রইলো ভাবলেশহীন চোখে।
নীতুদের বাসার সামনে একটা আমগাছ আছে।গাছের তলায় বসার মত একটা ব্যবস্থা করা।সেখানে পাশাপাশি বসে আছে সেতু আর মেহেদি।
কান্নার ফলে সেতুর মুখশ্রী কেমন ফুলে আছে।মেহেদি তাকিয়ে রইলো বন্ধুর দিকে।সেতু নিস্তেজ স্বরে বলে, “ঠিকানা পেলি কই?”
“এ আর এমন কি।তোকে না পেয়ে তোদের বাসায় গেলাম।সাথি আপুর থেকে ঠিকানা নিলাম আর সোজা চলে এলাম।”…… মেহেদির কাঁটা কাঁটা উত্তর।
” এত কষ্ট কেন করলি? ”
সেতুর প্রশ্নে মেজাজ খারাপ হলো মেহেদির।এমন একটা খবর পাওয়ার পর মেহেদি কি করে বসে থাকবে?বারবার মনে হচ্ছিল সেতু কষ্ট পাচ্ছে! সেতুর খবর না পাওয়া পর্যন্ত শান্তি হচ্ছিল না কিছুতেই! তাই তো ছুটে আসলো।আর বোকা মেয়েটা বলছে,কেন কষ্ট করলি?
সেতু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বললো,”বাবাকে ভীষণ মনে পড়ছে মেদু!”
মেহেদি শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তারপর বললো,”কাঁদিস না প্লিজ। জানি কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু যা প্রকৃতির নিয়ম তা কি খন্ডানো যায়? এভাবে কাঁদলে তোর ভিতরে যে বেড়ে উঠছে তারও কষ্ট হবে।তাই নিজেকে সামলা।বাবা মা চিরকাল কারো বেঁচে থাকে না!”
“তুই খুব ভালো রে মেদু।”
“উহু আমি খুব পঁচা!”…… মেহেদির উদাসিন উত্তর।
তাজ ছাদ থেকে নেমে এসে সেতুর কাছে আসলো।মেহেদি তাজকে দেখে দাঁড়িয়ে সালাম দিলো। সেতু তখনও বসে আছে। তাজ জিজ্ঞেস করলো,” কেমন আছো মেহেদি? তোমাকে তুমি করেই বললাম।আমার থেকে অনেক ছোট তুমি।”
মেহেদি কিছুটা অবাক হলো।আজকেই তাজের সাথে প্রথম দেখা অথচ কেমন পরিচিতর মত কথা বলছে।
“ইটস ওকে ভাইয়া।”
তাজ সেতুকে বললো,”কাল থেকে তো কিছুই খাওনি। চলো খাবে।আর তোমার বন্ধুও কতদূর থেকে এসেছে তাকেও কিছু খেতে দিতে হবে তো নাকি? উঠো?”
সেতু অলস পায়ে উঠে দাঁড়ালো।একবার তাজের দিকে একবার মেহেদির দিকে চাইলো।তারপর হাঁটতে শুরু করতেই হোঁচট খেয়ে পড়তে নিলো। মেহেদি খপ করে সেতুর হাত ধরে ধমকিয়ে বলে ওঠে, “একটু দেখে হাঁটবি তো নাকি?শরীর দূর্বল তার উপর কানার মত হাঁটিস। যদি কিছু হয়ে যেতো? দেখে পা ফেল।”
সেতু মেহেদির ধমকে কেঁপে উঠে আঁড়চোখে তাজের দিকে চাইলো।তাজ তাকিয়ে আছে সেতুর হাতের দিকে। যে হাতটা মেহেদি ধরে আছে।মেহেদি সেতুর দৃষ্টি লক্ষ্য করে হাত ছেড়ে দিলো। সৌজন্য হাসি দিয়ে নিজের ব্যাগটা কাঁধে আরো একটু উঠিয়ে বড় বড় পা ফেলে বাড়ির ভিতর হাঁটতে শুরু করলো। তাজ ফোঁস করে দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো,”তোমার বন্ধু দেখি তোমার ভালোই কেয়ার করে!”
“সবাই তো আর কেয়ারলেস হয় না।”…… সেতু কপাল কুঁচকে ভাবলেশহীন কন্ঠে বলে উঠলো। তাজ চোখা চোখে তাকালো।সেতু সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে চলে গেলো। তাজ দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো তার আসলে ঠিক কি করণীয় আছে?
***-****–*
তিনদিনের মিলাদ সম্পন্ন হলো বাদ আছর।নীতুর বাবার মৃত্যুতে শোকপালনের থেকে নীতুকে নিয়েই যেন সবার আফসোস বেশি।আহারে!মেয়েটার কোন গতি হলো না!
এসব কানাঘুঁষায় যেমন অভীক বিরক্ত তেমন নীতুর ফ্যামিলি।জায়েদ ঠিক করলো মিলাদ শেষে সবাইকে নীতুর বিয়ের কথা জানাবে। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে বলা হলো না। ঠিক তখনই কেউ একজন বলে উঠলো,” নীতু তো ঢাকা গিয়ে ভালোই করেছে।এতদিন যা করতে পারে নি তাই করেছে।তবুও ভালো, একজন তো জুটাতে পেরেছে কপালে।কালি হয়ে ভালোই ধলা প্রেমিক ঠিক করেছে।”
এমন কথা শুনে তাজের কপালের শিরা ফুলে উঠলো। রুশিয়া বেগম ভয় ভয় চোখে ছেলের দিকে তাকালেন। অভীক তখন নীতুর পাশে দাঁড়িয়ে ইতুর সাথে কথা বলছিলো ভালো ডক্টরের ব্যপারে। নিখিল শুনে ফুঁসে উঠে বললো,”মুখ সামলে কথা বলুন চাচি।আপনারা কি মানুষ? আমার বাবা মারা গেলো দুদিন হয়নি অথচ তারই সন্তানদের আপনারা এমন কথা বলছেন?”
সেই মহিলাও ফুঁসে উঠে বললো,”ঠিকই তো কইছি।ভুল কিছু তো বলি নাই।বাপে মরছে তবু তোমার বইনের রঙ্গ তো কমে নাই।”
নীতুর শরীর দূর্বল।জ্বরে জ্বরে ক্লান্ত। এমন অশ্রাব্য কথায় নীতুর মাথা ঘুরে উঠলো।পড়ে যেতে নিলেই ইতু ধরে ফেললো।সেদিকে তাকিয়ে অভীকের মাথায় রক্ত চড়ে উঠলো যেন।নীতু ফিসফিস করে বললো,”আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলুন অভীক।আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে।”
এ কথা শুনে ইতুর কাছ থেকে নীতুকে এক প্রকার ছিনিয়ে এনে বুকের বা পাশে শক্ত করে জরিয়ে ধরে অভীক বললো,”আমি গত দুদিন ধরেই আপনাদের এমন মন্তব্য শুনছি।কিছু বলি নাই কেননা তখন সময় টা ঠিক ছিল না।কিন্তু আজ সকলে কান খুলে শুনে রাখুন নীতু আমার বিবাহিত স্ত্রী। ধর্ম মতে বিয়ে হয়েছে আমাদের এবং বিয়েটা নীতুর পরিবারের সম্মতিতে হয়েছে।সবথেকে বড় কথা নীতুর বাবা চেয়েছেন বলে আমি নীতুকে পেয়েছি।শুনতে পেয়েছেন আপনারা? আমি নীতুকে পেয়েছি। নীতুর আমাকে ফাঁসাতে হয় নি বরং মেয়েটিকে একপ্রকার বাবার কাঁধ থেকে কন্যাদায় গ্রস্থতা নামাতে আমাকে বিয়ে করতে হয়েছে।আর সেকারণেই আমি এমন ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন,সুন্দর মনের পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর নারীটিকে আমার বউ রুপে পেয়েছি। আকদ করে রেখেছি খুব শীঘ্রই অনুষ্ঠানের দাওয়াতও পাবেন আপনারা তখন এসে আবার সমালোচনা করে যাবেন। এখন যারা এইমাত্র নীতুকে নিয়ে কুমন্তব্য করেছেন তারা বেড়িয়ে যাবেন।দাদাভাই,ভাইয়া তারা চলে না গেলে আমি নীতুকে নিয়ে চলে যেতে বাধ্য হবো।”
অভীকের এমন কঠিন কথায় কয়েক জন আত্মীয় চলে গেলো। জায়েদের খুশিতে চোখে জল এসে গেলো।তাড়াহুড়ো করে সেদিন নীতুর বিয়েটা দিয়ে যে মন্দ করে নি।তা আজ আবারো প্রমাণ হয়ে গেলো। নিখিল খুশিতে মাকে জরিয়ে ধরলো।মহিমা বেগমের চোখেও পানি। তাজ করুণ দৃষ্টিতে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো।রাবেয়া বেগম ছেলের চাহনিতে নিজের দৃষ্টি মেলাতে পারলেন না। তাজ যেন আজ আবারো নিজের ভুল বুঝতে পারলো,”শুধু ভালোবাসলেই হয় না।প্রিয় মানুষটাকে ধরে রাখার ক্ষমতাও রাখতে হয়!ভালোবাসার মানুষটির সম্মানের জন্য লড়তে জানতে হয়।ভালোবাসা যে যুদ্ধসম!তাই তো যুদ্ধ আর ভালোবাসায় সকল কৌশল অবলম্বন করা শ্রেয়!”
মেহেদি সেতুর কানে ফিসফিস করে বলে ওঠে, “বাপরে কি নিখুঁত কথামালা!তোর আপার ভাগ্য সত্যিই ভালো!”
সেতু ভেজা চোখে তাজের দিকে তাকিয়ে বললো,”ঠিক বলেছিস মেদু,সবাই এমন নিখুঁত মানুষ পায় না।”
মেহেদি সেতুর কথায় চেয়ে রইলো সেতুর মুখপানে রিক্ত চোখে!যেখানে হাজার শূন্যতা!
চলবে,
এতটা অসুস্থ যে কি বলবো?নিজের উপর নিজেও বিরক্ত আমি।জ্বর, শরীরের জয়েন্টে জয়েন্টে ব্যথা।শ্বাস নিতেও সমস্যা হচ্ছে। ভেবেছিলাম গল্প দিতে পারবো না।কিন্তু এন্টিবায়োটিক ঘুম কেড়ে নিয়েছে।তাই নির্ঘুম চোখে পর্ব লিখে ফেললাম। ধন্যবাদ এন্টিবায়োটিক কে দিয়েন। লেখায় ভুল থাকতে পারে…অসুস্থতা নিয়ে লিখছি তো।দোয়া করবেন।