কাননবালা পর্বঃ৩৬

0
808

#কাননবালা!
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ৩৬

দিনটা শুক্রবার। রৌদ্রস্নাত প্রকৃতি! ঝিকমিক রোদ ছুঁয়ে দিচ্ছে সারা রুম! তাজ চোখ বুজে শুয়ে আছে। চোখে ঘুম নেই,তবুও কেমন আলস্য!
পিটপিট করে তাকায় তাজ।চারপাশে এত আলো! তার জীবনটা এমন অন্ধকার কেন?বুকটা খাঁ খাঁক করতে থাকে গ্রীষ্মের উত্তপ্ত দুপুরের মত!

রাবেয়া বেগম দরজা ঠেলে রুমে প্রবেশ করে।মাকে দেখেও তাজ নড়ে না।চোখের দৃষ্টি নির্লিপ্ত!
রাবেয়া বেগম ছেলের শিয়রে বসেন।তাজের এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে দেন পরম আদরে! তাজ চোখ বন্ধ করে ফেলে।বুক চিড়ে অজান্তেই বের হয় তপ্ত নিঃশ্বাস! রাবেয়া বেগমের চোখে পানি চলে আসে।তার এত সুন্দর ছেলেটা দিনদিন কেমন হয়ে যাচ্ছে? সারা মুখে ছন্নছাড়া দাঁড়ি।তবুও কি মায়া! তাজ মৃদুস্বরে বলে,”কিছু বলবে মা?”

“বৌমা আসবে না? আর কত?ফিরিয়ে নিয়ে আয় বাবা।”

তাজ হালকা হাসে।বড়ই শ্লেষাত্মক হাসি! তারপর বলে,”সেতু ফিরতে চায় না মা।ওর তো কোন দোষ নেই মা।কেনই ফিরবে?ভালো থাকতে তো সবাই চায়! ”

রাবেয়া বেগম অসন্তোষ কন্ঠে বলেন,”নাকি তুই চাস না ও ফিরুক? আমাদের প্রথম নাতি হবে….অথচ।চোখের দেখাও দেখতে পাচ্ছি না।ভুল আমি করেছি, তোরা আমাকে শাস্তি দে তবুও সব কিছু ভালো হোক।”

তাজ চোখ মেলে মায়ের মুখের দিকে তাকায়। কিচ্ছু বলে না।ছেলেকে নিরব দেখে রাবেয়া বেগম মিনমিনে স্বরে বলেন,”তোর বাবা সেদিন সেতুকে একটা ছেলের বাইকের পিছনে দেখলো। তোর বাবা তোদের দুজনের উপরই রেগে আছে।”

তাজ এবার উঠে বসে।বালিশের পাশে রাখা শার্টটা গায়ে জড়িয়ে বোতাম লাগাতে লাগাতে বলে, “মা ছেলেটার নাম মেহেদি। পুরান ঢাকায় বাপের ভালোই ব্যবসা আছে। আর ছেলেটা ভালো এবং সেতুর খুবই ভালো বন্ধু। তাই বাবাকে অহেতুক চিন্তা করতে নিষেধ করো।”

রাবেয়া বেগম কপাল কুঁচকে বলেন,”কেমন স্বামী তুই?জেনে শুনে বউকে ছেলে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে ফিরতে দিচ্ছিস।”

তাজ মাথা দুলিয়ে হাসে।এরপর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,”পঁচা স্বামী আমি!খুবই পঁচা।

রাবেয়া বেগম ব্যথিত চোখে তাকিয়ে রইলো। তাজ উঠে মায়ের পাশে দাঁড়ায়। মায়ের চুলে হাত বুলিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বলে,”আমার মা তুমি।তোমার অন্যায় আমার নামে দলিল হোক, তবুও আমার জান্নাত নিষ্কলুষ থাকুক! তোমার নামে এভাবেই বারবার আমার জীবন উৎসর্গ হোক!”……..বলে দ্রুত পায়ে তাজ উঠে চলে যায়।
রাবেয়া বেগম ছেলের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হু হু করে কেঁদে উঠেন।তার ছেলের হাসিমুখ তো কবেই উৎসর্গ দিয়েছে!পরে আছে শুধু শরীরটা!

***********

নীতু অভীকের বিয়েটা চড়াও ভাবে ঘোষিত না হলেও অঘোষিত ভাবে অনেকে বুঝে গেছে সম্পর্কের গভীরতা! নীতুদের বাসায় আজকাল ঘন ঘন যাতায়াত বেড়ে গেছে অভীকের।নীতুর শত বারণ অভীকের কাছে ডাল ভাত! বড়ই ড্যাম কেয়ার তার চলাফেরা!এই জগতে নীতু ছাড়া যেন তার আর কিছুই নেই।একেই হয়তো বলে দুঃখের শেষে সুখের ঘড়ার মুখ দেখা!
আজ ছুটির দিন বলে নীতুদের বসার রুমে তুমুল আড্ডা চলছে।আড্ডার মধ্যমণি অভীক আর শ্রোতা সাথি,সেতু, নীতু।অভীকের দুষ্টু কথায় হেসে কুটিকুটি হচ্ছে সাথি, সেতু। ঠিক তখনই কলিং বেল বেজে ওঠে। অভীক উঠে দরজা খুলতেই চমকে ওঠে। চমকে ওঠে অপর পাশের মানুষটাও! তাজ কে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে থাকতে দেখে অভীক হেসে করমর্দন করে ভিতরে আসতে বলে। অভীকের উপস্থিতি যেন তাজের কাছে বিষের ন্যায়!

তাজের আগমন যেন হাসিখুশি আড্ডায় এক প্রলেপ অস্বস্তি ঢেলে দিলো।কেউই সহজ হতে পারলো না আর। শানের কান্নার শব্দে সাথি উঠে চলে গেলো রুমে।নীতু কি করবে ভেবে পেলো না। চা করার বাহানায় উঠে চলে গেলো কিচেনে।তাজ অবাক হয়ে দেখলো অভীকও কেমন সঙ্কোচহীন ভাবে নীতুর পিছু পিছু কিচেনে প্রবেশ করলো।তাজ মাথা নত করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।সবকিছু কেমন ধোঁয়াশা মনে হয়!পুনরায় মাথা সোজা করে সেতুর দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলে,”শরীর কেমন সেতু?”

সেতু চোখা চোখে তাকিয়ে ছিল তাজের দিকে। আঁতিপাঁতি করে খুঁজছিল কিছু বিষাক্ত অনুভূতি! তাজের প্রশ্নের উত্তরে বললো,”ভালো আছি।এই সময় হটাৎ কি মনে করে?”‘

“কেন এসে ভুল করেছি নাকি?”……. তাজের ত্যাড়া কথা।

সেতু চোখমুখ শক্ত করে তাকিয়ে থাকে। দাঁতে দাঁত পিষে বলে,”কেন আসেন রোজ রোজ? আমি ফিরবো না।কতবার বলবো?আপনাকে দেখলেই আমার কষ্ট হয়! কেন বুঝেন না আপনি?”

“মুক্তি চাইছো সেতু?”…. কেমন ব্যথিত শোনায় তাজের কন্ঠ ।
সেতু চমকে তাকায়। চোখে মুখে ভর করে শূন্যতা! আসলেই তো কি চায় সে? যে মানুষটা তাকে কোনদিন ভালোবাসবে না তার থেকে কি মুক্তি ভালো নয়?তবে মুক্তি শব্দটা শুনে বুকটা এমন কেঁপে উঠলো কেন? সেতুকে চুপ থাকতে দেখে তাজ হালকা হাসে।
ঠিক তখনই নীতু চায়ের ট্রে সামনে রেখে সেতুকে বলে তাজকে চা দিতে।আর অভীককে সাথে করে সাথির রুমে চলে যায়!তাজ সেদিকে নিষ্পলক চোখে চেয়ে থাকে। সাথির রুমের বারান্দা বসার রুম থেকে সরাসরি দেখা যায়।অভীক আর নীতু বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।নীতুর কোলে সাথির বাচ্চা। সাথি কাঁপড় ভাঁজ করছে খাটে বসে।নীতুর পাশে বড়সড় চায়ের মগ নিয়ে অভীক দাঁড়িয়ে আছে। কি অদ্ভুত অসহ্য দৃশ্য! তাজের মনে হচ্ছে কেউ এক পেয়ালা বিষ ঢেলে দিয়ছে তার কলিজায়!কতটা দিন চলে গেলো তবু নীতুর প্রতি কেন তার অনুভূতি চলে যায় না?কেন সদ্য ঘাঁয়ের মত সদা জ্বলজ্বল করে! কেন বিষের মত ব্যাথা মুছে যায় না?

নীতুর শরীরে হালকা মিষ্টি রঙের কুর্তি।চুলে এলো বেণী!চোখ মুখ বড় বড় করে বাচ্চাটার সাথে কথা বলছে।অভীক মুগ্ধ হয়ে দেখছে!বাচ্চাটা হাসছে সাথে হাসছে নীতুর ফোলা ফোলা কৃষ্ণ মুখশ্রী! অভীক চায়ের মগে আলতো ফু দিয়ে ঠোঁট ছোঁয়ায়,এক চুমুক পানের পরে নীতুর ঠোঁটের সামনে ধরে।নীতু জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকায়। অভীক ইশারায় ঠোঁট ছোঁয়াতে বলে।নীতু মৃদু হেসে ঠোঁট ছোঁয়ায় চায়ের কাপে।তারপর আবার লেগে পড়ে শানের সাথে দুষ্টুমিতে।অভীক মিষ্টি হেসে নীতুর ঠোঁটের স্পর্শ যেখানে লেগে আছে সেইখানটাতে ঠোঁট ছোঁয়াতেই তাজ চোখ বন্ধ করে ফেলে।হাতের মুঠো শক্ত হয়ে আসে।চোখ মুখ পাথরের ন্যায় শক্ত করে ফেলে! যখন চোখ মেলে তাকায় সেই চাহনি দেখে সেতু চমকে ওঠে! কি রক্তাভ চাহনি! যেন রক্তক্ষরণ হচ্ছে। সেতুর বুকের ভিতর কান্নার দোলাচল! তাজ বারান্দায় দৃষ্টি রেখেই বলে,” সেতু, ভালোবাসার মত আগ্রাসী অনুভূতি আর দ্বিতীয়টি হয় না!এক অদ্ভুত জ্বালাময়ী অনুভূতি! জ্বলে পুড়ে নিঃশেষ হওয়ার পরও আমরা এই অনুভূতি থেকে মুক্তি চাই না।যেমন তুমি পারছো না।আমার থেকে মুক্তি পেলেই তোমার স্বস্তি অথচ সেই স্বস্তিটুকু পেতেই যত ভয়! ভুল মানুষটিকে ভালোবাসার শাস্তি আজীবন কেউ না কেউ বয়ে বেড়ায়! ”

সেতুর হুট করে মনে হলো মরে যেতে!এই অসহ্য দোলাচল বয়ে বেড়ানোর থেকে মৃত্যুই ভালো মনে হলো!

**********
মেহেদি বসে আছে কেন্টিনে।ছেলেটা ছটফটে স্বভাবের। শ্যামলা গাত্রবর্ণ।মুখশ্রীতে এখনো বাচ্চা বাচ্চা আদুরে ভাব!চুল হালকা লালচে!চোখ মাঝারি আকারের কিন্তু ভীষণ চঞ্চল।
পুরুষ্ট ঠোঁটে পাঁচ নম্বর সিঙ্গারায় কামড় দিতেই সেতু টান মেরে সিঙ্গারাটা নিয়ে যায়।মেহেদি এমন ভাবে তাকায় যেন তার দুটো কিডনির একটা কিডনি এই মাত্র সেতু ছিনিয়ে নিয়েছে!চোখমুখ খিঁচিয়ে বলে ওঠে, “ঠিক এই জন্যই মানুষ বলে, মেয়ে জাত অন্যের সুখ দেখতে পারেনা।তুই তো পেটে বমির মেশিন বসিয়েছিস।কিছু মুখে দিলেই মেশিন স্টার্ট হয়ে যায়। আর এখন আমার খাওয়াও সহ্য করতে পারছিস না স্বার্থপর মহিলা! আমার সিঙ্গারা ফেরত দে….দেখ কেমন মায়া মায়া মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে! একটু মায়া কর সেতুমন্ত্রী। ”

সেতু রাগ করতে গিয়েও হেসে ফেললো।মনখোলা হাসি যাকে বলে।সিঙ্গারা টা ফেরত দিতেই লাল টকটকে সসে ডুবিয়ে মুখে দিল মেহেদি।সেতুর শরীর গুলিয়ে উঠলো।

খাওয়া শেষে ব্যাগ থেকে একটা টিফিন বক্স বের করে মেহেদি ঠেলে দেয় সেতুর দিকে।সেতু প্রশ্নচোখে চাইলে খুলে দেখতে বলে।বক্সটা খুলতেই আচারের ঘ্রাণে চারপাশ মোঁ মোঁ করে ওঠে।সেতুর চোখ মুখ চকচক করে ওঠে।মেহেদি প্রসন্ন হেসে বলে,”মা পাঠিয়েছে, পুরান ঢাকার বিখ্যাত আচার! ”

“ধন্যবাদ মেদু।”…… বলে সেতু চটপট খেতে শুরু করে। মেহেদি আহ্লাদী চোখে তাকিয়ে সেতুর খাওয়া দেখে।কোথা থেকে একদলা আফসোস এসে ভির করে বুকের ভিতর!সেতু কি একটু বেশিই সুন্দর নয়?হ্যা! একটু বেশিই!
খাওয়া শেষ হতেই অঘটনটা ঘটলো।ওয়াশরুমে দৌড় দিলো সেতু।গলগল করে বমি করে দিলো।যখন বের হলো তখন সেতু পুরোপুরি ঘামে ভেজা,চোখে জল।যেন বিধ্বস্ত রুপ! মেহেদি শুকনো মুখে পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বললো,” মা হওয়া সত্যিই কষ্টের।এই একটা কারণেই তোরা মেয়ে জাত যতই স্বার্থপর হোস…আমি তোদের অসম্মান করতে পারিনা।”
সেতু শত কষ্টেও হেসে দিলো। আর মেহেদি বিরক্ত চোখে তাকিয়ে রইলো।এত বমির পর একটা মানুষ হাসে কি করে? কপট বিরক্ত কন্ঠে তাই বলে ওঠে, “হাসি বন্ধ কর….. তোর মুখ থেকে বমির গন্ধ আসছে….হাসলে মুখ বুজে হাসবি সেতুমন্ত্রী! ”
সেতু চোখ কটমট করে তাকায়। যেন ভস্মীভূত করে দিতে চায় মেহেদীকে।

***********

সময়টা শেষ বিকেল।ঝাপসা কুয়াশার চাদর পড়া পড়ন্ত বিকেল!দু-একটা পাখি নীড়ে ফেরার গান গাইছে।মৃদু শীতল বাতাস ছুঁয়ে দিচ্ছে প্রকৃতিকে!
নীতু হালকা পাতা রঙের শাড়ি পড়ে বসে আছে লম্বা বেঞ্চিতে।কাঠ রঙের একটা চাদর পেঁচানো শরীরের উপরাংশে।চোখে মোটা কাজলের প্রলেপ, ঠোঁটে বড় অবহেলায় পড়ে আছে লিপস্টিকের শুকনো হালকা ছাপ,এলোনো খোঁপা, কানের দুপাশে এলিয়ে আছে খোঁপা থেকে খসে পড়া ক’গাছি চুল,এন্টিকের বড় বড় ঝুমকো কানে দুলছে মৃদু ভাবে। নীতুর চোখের দৃষ্টি নিবদ্ধ সামনের বিস্তর লেকের স্বচ্ছ জলে।লেকের জলে হালকা কুয়াশার স্তর পড়ে এক অদ্ভুত মোহনীয় রুপ সৃষ্টি করেছে। কি সুন্দর!
অভীক নীতুকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে ফট করে নীতুর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। নীতু চমকে তাকায়। নীতুর চমকানো দৃষ্টি অভীককে আচ্ছন্ন করে! নীতু ভেবে পায় না এই বেসামাল পুরুষ টাকে কি করে সামলাবে? মানুষটা যেন দিন দিন বড়ই অবাধ্য হয়ে যাচ্ছে! তাকে নিয়ে অফিস শেষে দিগ্বিদিক ঘুরবে,কখনো রাতের নিস্তব্ধতায় হাত ধরে রেলিং ঘেসে বসে থাকবে ঘন্টার পর ঘন্টা,একসাথে ভোর দেখবে। কত শত আবদার! যেন নীতুর কাছেই মানুষটার সমাপ্তি!

নীতু কাজল চোখে তাকায়। অভীকের শুভ্র মুখটিতে অজস্র মায়া ঝড়ে ঝড়ে পড়ে। অভীক ঝরঝরে স্বরে বলে,” একটু পতিসেবা করতো। চুলে একটু হাত বুলিয়ে দাও।”

নীতু ঘন চুলে কাঁপা কাঁপা হাতে হাত বুলাতে শুরু করে।চোখের দৃষ্টি এলোমেলো।বুকের ভিতর নতুন এক অনুভূতির প্রগাঢ়তা টের পায় নীতু খুব করে! নীতু ফের তাকায় অভীকের মুখ পানে।অভীকও তাকিয়ে আছে তৃষ্ণার্তের মত।নীতুকে তাকাতে দেখেই অভীক একহাতে নীতুর গাল স্পর্শ করে মাদক স্বরে বলে,”ওমন করে কি দেখো কাননবউ? ”

নীতু কেঁপে ওঠে! মানুষটা ইদানীং ক্ষণে অক্ষণে কাননবউ বলে ডাকে।নীতু নিতে পারে না।এমন প্রগাঢ় অনুভূতি নীতুকে ক্ষণে ক্ষণে অনুতপ্ত করে! মানুষটার হুটহাট ছুঁয়ে দেয়া, খুব কাছে এসে বসা নীতুকে বসন্তের বিবাগী কোকিলের মত ছন্নছাড়া করে তুলে! নীতুর তখন হাঁসফাঁস লাগে!
নীতুকে একমনে তাকিয়ে থাকতে দেখে অভীক ফের ভারীস্বরে বলে,” কাননবউ?…”

“হুম…।”…. নীতু অস্ফুটে বলে।

” তোমাকে পেয়েও কেন মনে হচ্ছে আমার অপূর্ণ থেকে গেছে কিছু!বুকের ভিতর এ কেমন তৃষ্ণা? কত কাছে তুমি তবুও এ কেমন দূরত্ব আমাকে পোড়াচ্ছে কাননবউ?”

নীতু পারে না নিজেকে আঁচলে ঢেকে ফেলে।মানুষটার এমন অদ্ভুত প্রশ্নের কি উত্তর দিবে? নীতু বিড়বিড় করে বলে, “আপনি পাগল!আস্ত, মস্ত পাগল!”

“” তুমি করেছো।”…..অভীকের দ্বিধাহীন উত্তর।

নীতুর ইচ্ছে করে পালিয়ে যেতে।এমন দুর্ভেদ্য চাহনি নীতুর জন্য অসহনীয়!
একটুপরই অভীক রাগি স্বরে বলে,”এই বিঁটলামো তোমার দাদাভাই ইচ্ছে করে করেছে।শোধ নিচ্ছে আমার উপর।একসময় তার বোনকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম বলে আজ নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাচ্ছে।ইচ্ছে তো করছে…. ”

নীতু অভীককে কথা শেষ করতে দেয় না।শক্ত করে চুল খামচে ধরে। অভীক উহ্ করে শব্দ করে ওঠে।নীতু চোখ রাঙিয়ে বলে,”আমার দাদাভাইকে নিয়ে কোন ফালতু কথা বলবেন না। তাহলে ভালো হবে না বলছি।”

অভীক মুখ গোমড়া করে বলে,”আর কি ভালো হতে বলছো কাননবউ?ম্যারিড পারসন হয়ে ব্যাচেলরের মত দিন কাটাচ্ছি….এ যে কি যন্ত্রণার তুমি কি বুঝবে? এরকম একটা নাদুসনুদুস বউ থাকতে রোজ কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে হচ্ছে…. কি লজ্জা জনক ব্যাপার স্যাপার! তুমি বুঝতে পারছো?”

নীতু অভীকের বলার ভঙ্গিমায় খিলখিল করে হেসে দিলো। হাসতে হাসতে চোখে জল এসে গেলো। তবুও হাসি দমাতে পারলো না।ডাগর ডাগর চোখে অশ্রুসজল হাসি।বড়ই অতুলনীয়! অভীক এই হৃদয় কাঁপানো ঝর্ণার মত কলকল হাসির বাণে নিজেকে আরো একবার কৃষ্ণগাঙ্গে ভাসিয়ে দিলো। নীতুর কোলে মাথা রেখে চেয়ে রইলো অবিন্যস্ত চোখে! কি যেন হলো অভীকের?হুট করে নীতুর ঘাড়ের উপরে চুলের ভিতর হাত রেখে হ্যাচকা টান মারলো। নীতুর মাথা নত হয়ে অভীকের মুখের খুব কাছে চলে আসলো। নীতু আকস্মিক হামলায় হতবুদ্ধি হয়ে পড়লো।চোখের মণি কেঁপে উঠলো। অভীকের নিলজ্জ দৃষ্টি ঘুরে ফিরে পর্যবেক্ষণ করলো নীতুর মুখশ্রী। সূঁচালো ভ্রু, কাকচক্ষু জলের চাহনি,এই শীতেও নাকের ডগার বিন্দু বিন্দু ঘাম, রুক্ষ ঠোঁট! সব কিছু!সব কিছু পর্যবেক্ষণ করলো অসভ্য দৃষ্টি মেলে! চোখের চাহনি আটকে রইলো নীতুর রুক্ষ ঠোঁট জোড়ায়! চোখে মুখে দুষ্টুমি ফুটে উঠলো অভীকের।আঁড়চোখে নীতুর চোখে একবার চেয়ে ঠোঁটের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বললো,” এভাবে হাসতে হয় না মেয়ে।হুটহাট ওষ্ঠদ্বয়ে চুম্বন বর্ষিত হলে বান্দা কিন্তু দায়ী থাকবে না!”

নীতু চোখ বড় বড় করে আৎকে উঠে মাথা সরিয়ে ফেললো।মুহুর্তেই এক ঠোঁট দিয়ে অন্য ঠোঁট চেপে ধরলো।ফাঁকা ঢোক গিললো কয়েকবার। অভীক ফিঁচলে হেসে ফেললো। চোখে মুখে হাজারো দুষ্টামি!ছোট্ট বেঞ্চিতে সোজা থেকে পাশ ফিরে নীতুর কোমড় জড়িয়ে ধরে অভীক বলতে লাগলো,”বাপ ভাইকে বলো তাড়াতাড়ি আমার বউ আমার কাছে সোপর্দ করতে।এরপর যদি অনশন লাগে তখন কিন্তু আমার কোন দোষ থাকবে না মিসেস তাশরীফ অভীক! ”

নীতু নিজেকে এক ঘোর থেকে সামলিয়ে পরক্ষণে অন্য ঘোরে নিজেকে আবিষ্কার করে! কি অদ্ভুত এক মানুষ।নীতুর শরীর জুড়ে বরফ ঠান্ডা স্রোত তরতর করে বয়ে যায়।এমন করে কেউ পেঁচিয়ে ধরে?মানুষটার উত্তপ্ত নিঃশ্বাস কেমন ছুঁয়ে দিচ্ছে! নীতু টের পায় অভীক ফিসফিস করে বলছে,” ভালোবাসি নীতু! ভীষণ….!”

নীতু চোখ বন্ধ করে ফেলে।এ অসহ্য অনুভূতি নীতুকে বর্ষার ভরা পুকুরে তলিয়ে ফেলছে যেন!শত চেষ্টায়ও কোন ঠাঁই নেই!ঠিক সেই মুহুর্তে নীতু অনুভব করে, অভীকের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস পাতলা শাড়ির আস্তর ভেদ করে পেটের কাছের অংশটা খুব আলগোছে ছুঁয়ে দিচ্ছে! ঠিক হেমন্তের হিম হিম বাতাসের মত!কি উত্তপ্ত! কি নিদারুণ নিষ্ঠুর অনুভুতি!

চলবে,
সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা। সবার মন্তব্য জানতে চাই…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here