#কাননবালা!
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ৩৪
প্রকৃতিতে শীতের আগমনী গান।হিম বাতাসে মুড়িয়ে রেখেছে জনপদ! তুরাগ নদীর পাড়ের শীতের পড়ন্ত বিকেলটা ঝাপসা কুয়াশায় মাখোমাখো!
সোনালী পাড়ের টুকটুকে লাল শাড়ি পড়ে নীতু দাঁড়িয়ে আছে নদীর পাড়ে! হিম শীতল বাতাস নীতুকে ক্ষণে ক্ষণে ছুঁয়ে দিচ্ছে!সেই হিম ছোঁয়ায় নীতুও কেঁপে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে! তবুও নীতুর ভালো লাগছে।পদ্মদিঘির মত চোখ দুটোতে এক অন্যরকম ভালো লাগা ছুঁয়ে যাচ্ছে! ঠোঁটের কোণে ঈষৎ হাসি!কপাল ঘেঁষে কানের পাশে অবহেলায় ছড়িয়ে পরা চুলগুলো ঈষৎ বাতাসে উড়ছে!
কৃষ্ণবতীর এই মোহনীয় রুপ পাশে দাঁড়ানো শুভ্র রঙের ছেলেটির বুকে মুগ্ধতার ঝড় তুলেছে! নীতু আলগোছে অভীকের দিকে তাকায়।অভীক তাকিয়ে আছে তার দিকে!চাহনিতে প্রখর মাদক মেশানো অনুনয়…..!
হিম বাতায়ন যতটা নীতুকে ছুঁতে পেরেছে তার থেকেও বেশি ছুঁয়ে দিল ওই প্রখর চাহনি! নীতুর মনে প্রশ্ন জাগে, এই লম্বা সুদর্শন পুরুষটা কেন তার মত এক কৃষ্ণঙ্গীকে এতটা ভালোবাসে? হুট করেই নীতুর অবচেতন মন বলে ওঠে, ভালোবাসায় শুধু ভালোবাসা থাকতে হয়,কোন কারণ নয়!
নীতু দু’পা এগিয়ে অভীকের খুব কাছে এসে দাঁড়ায়। মুখোমুখি দৃষ্টি দুজনের।অভীকের বুকের ভিতর ধ্বক করে ওঠে! এতটা কাছে কেন এসেছে মেয়েটা? মেরে ফেলতে চায়? মরে তো সে কবেই গেছে…..এতটা কাছে এসে কি এবার সমাধি রচিত করবে নাকি?
অভীকের এমন উদ্ভট চিন্তার মাঝে নীতু সঙ্কোচহীন কন্ঠে বলে বসে,”দাদা ভাই চায় এবার আমি থিতু হই।আর সেই মানুষটা যেন আপনি হন…..!”
অভীক প্রতিত্তোরে বলে ওঠে, “আপনি কি চান মিস নীতু? কে কি চাইলো তা মূখ্য নয় আমার কাছে, যতটা আপনি। ”
অভীকের কন্ঠে আত্মবিশ্বাস।নীতু ঝরঝরে স্বরে বলে,” আপনি দাদাভাইর মাধ্যমে প্রপোজাল পাঠিয়েছেন….! কেন? কেন আমাকেই আপনার এতটা চাই?”
অভীক নীতুর করা প্রশ্নে উদ্ভ্রান্ত হয় না।একটু করে আলতো হাসে।কপালে ছড়িয়ে পড়া চুলগুলো আলতো করে পিছনে ঠেলে।চোখের দৃষ্টি দিগ্বিদিক ঘুরিয়ে নীতুর দৃষ্টিতে দৃষ্টি তাক করে বলে,”মিস নীতু,আপনাকে আমি ঠিক ততটাই চাই যতটা চাওয়ার পরে এই জনমে আর কাউকে চাওয়া যায় না!শুধু এই জনমেই নয়,পরজনম বলে যদি কিছু থাকে….তবে সেখানেও অভীকের জন্ম হবে শুধুমাত্র নীতুর জন্য! আর কারো জন্য নয়!”
নীতু থমকায়!কিছুটা লজ্জা এসে ভির করে নাকে ডগায়! এতটা কাঁটা কাঁটা কথা কিভাবে বলে মানুষটা? সেই আলতারঙা লজ্জা দেখে অভীক হেসে ফেলে।
কিছুটা ক্ষণ কেঁটে যায়… চুপচাপ! ঠিক শান্ত নদীর মত। একসময় নিরবতা ভেঙে নীতু অভিমানী কন্ঠে বলে,”একজনের কাছ থেকে আঘাত পাওয়ার পরে ভেবেছিলাম এই জীবনে আর কাউকে আঘাত দিবার সুযোগ দিবো না।কিন্তু আপনি আমার সিদ্ধান্ত বদলে দিলেন….হুট করেই মনে হলো, কার জন্য স্যাক্রিফাইস করবো?যে আমার ভাগ্যে নেই তার জন্য? কখনো নয়।আমার জীবনটা কেবল আমার।এখানে হস্তক্ষেপের সুযোগ কারো নেই। এখন সে ভালো নেই বলে যে আমি ভালো থাকতে পারবো না।তা তো নয়? সবাইকেই তার প্রাপ্যটুকু পেতে হবে। হয় আজ নয় তো কাল!”
অভীক ফের মুগ্ধ হয়।নীতুর পড়ে গিয়ে উঠে দাঁড়ানোর মানসিকতা অভীকের খুব পছন্দ। চলার পথে সবাইকে একবার বাঁধার মুখে পড়তে হয়,যে উঠে দাঁড়াতে পারে সেই তো বিজয়ী!
হুট করেই নীতুর চোখ ছলছল করে ওঠে। কন্ঠরোধ হয়ে আসে খুব পরিচিত কষ্টে!হালকা রঙের ছোঁয়ায় রাঙানো পেলব ঠোঁট দুটোও কেঁপে কেঁপে ওঠে…. অভীকের অস্থির লাগে! নীতুর কষ্ট তার জন্য পাহাড়সম ব্যথার মত। নীতু আদ্র ভেজা কন্ঠে বলে ওঠে, ” ভালোবাসেন আমায়?”
“খুউউউব…..!”….. নিঃশ্বাস আটকে উত্তর দেয় অভীক।
” কালো আমি,একসময় আরো মুটিয়ে যাবো,তারউপরে বয়স বেশি…. বুড়ি হবো তাড়াতাড়ি।মন উঠে যাবে। কোন অষ্টাদশী তো নই আমি!তখন?”
অভীকের বুকের ভিতর যেন বাঁধ ভাঙে!চোখ দুটোতে একরাশ মাদক মিশিয়ে বলে,”ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়েছি মেয়ে,মৃত্যু ছাড়া এই মুগ্ধতা কাঁটানো অসম্ভব !”
নীতু অধৈর্য্য স্বরে,”আমি এখনো অন্য একটা মানুষকে ভালোবাসি।”
“জানি তো।”
“তবুও বিয়ে করতে চান?যদি আপনাকে কখনো ভালোবাসতে না পারি?”
“ইট’স ওকে…আমি এডজাস্ট করে নিবো!”…..মুখ আমচুরের মত করে বলে অভীক।চোখ দুটিতে ঝরে ঝরে পরে বাচ্চাদের মত হাজারো অভিমান!
নীতু হুট করেই ঝরঝর করে হেসে ফেলে অভীকের বলার ভঙ্গিমায়। ছোট্ট একটা বাচ্চার থেকে প্রিয় খেলনাটি কেড়ে নিলে যেমন দেখায় ঠিক তেমন লাগছে অভীককে।
দুটো মানব মানবী নদীর তীর ঘেঁষে দাঁড়ানো মুখোমুখি। শেষ বিকালে সূর্য অস্ত যাচ্ছে নতুন এক ভালোবাসার সাক্ষী নিয়ে।কমলা রঙা অর্ধ অস্তমিত সূর্যের আলো ভাসিয়ে দিচ্ছে দুজনকে!মেয়েটির শাড়ির আঁচল তরতর করে উড়ছে….ছেলেটি মুগ্ধ চোখে দেখছে তার কাননবালাকে! কি অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য! অর্ধ অস্তমিত সূর্যটা নতুন ভোরের প্রার্থনায় ভাসিয়ে দিচ্ছে দুজনকে।
হুট করেই অভীকের বুকের ঠিক বা পাশে নীতু আলতো করে হাত রাখে।
অভীক সেদিকে বিস্ফোরিত নেত্রে তাকায়! হার্টবিটের সর্বোচ্চ গতির উঠানামা হচ্ছে খুবই বিশ্রী ভাবে! মেয়েটা বুঝে যাবে না তো?
নীতু এবার আলতো হাসে।বুকের উপর রাখা নীতুর হাতটির দিকে তাকিয়ে অভীক কৌতুহলী চোখে নীতুর মুখপানে চায়। নীতু মৃদুস্বরে বলে,” আপনার প্রশস্ত বুকের একচ্ছত্র মালকিন হতে চাই!বৈধতার অনুমতি চাই….মি.অভীক!ঠিক ততটা বৈধতা চাই যতটা বৈধ হলে মৃত্যু ছাড়া বিচ্ছেদ হয় না!”
অভীক খুকখুক করে বিষম খায়।কপাল ঘেঁষে ঘামের চিকন ধারা নেমে আসে।তরতর করে লাফিয়ে ওঠে হৃদপিন্ডটা!তার কাননবালা আজ নিজে প্রপোজ করছে…..এত সুখ! এতটা প্রশান্তি কেন চারপাশে?
অভীক বিড়বিড় করে বলে ওঠে, “অনুমতি দিলাম!অনুমতি দিলাম…..কাননবালা!”
নীতু খিলখিল করে হেসে দেয়, অভীকের বেহাল দশা দেখে।বুকের কাছ থেকে হাত সরিয়ে নেয় নীতু।অভীক মনে মনে বলে ওঠে,”বুকের বা পাশে ঠিক যেখানটায় আমার একটুকরো হৃদয়, সেই জমিনটা অলিখিত স্বাক্ষরে আপনার নামে দলিল করে দিলাম…..মিস নীতু!”
নীতু শাড়ির আঁচলটা কাঁধে জরিয়ে নিয়ে বললো,”চলুন মি.অভীক….।”
“কোথায়?”
“যাওয়ার পরেই না হয় জানলেন।”
দুজনেই পাশাপাশি হাঁটছে। শক্ত পোক্ত অভীকের আজ বেহাল দশা।মাথা ভনভন করে ঘুরছে।নীতুর এমন সহজ সারল্য আত্মসমর্পণ হজম করতে পারছে না বেচারা! এতটা পাশে নীতু তবুও বিশ্বাস হচ্ছে না।কেমন সব স্বপ্ন মনে হচ্ছে। অবিশ্বাসের সুরে অভীক বলে ওঠে, “মিস নীতু, আমার হাতটা একটু ধরবেন?”
“না। “….. নীতু চোখ মুখ শক্ত করে জবাব দেয়।
অভীকের মুখ গোমড়া হয়ে আসে। তবে কি সব স্বপ্ন? ঠিক তখনই আলগোছে সেচ্ছায় নীতু অভীকের হাত ধরে খুব আলতো করে।অভীক কেঁপে ওঠে।কি শীতল ঠান্ডা হাত!অভীকের বুকেও যেন শীতলতার আহরণ তুলে!
অভীক বিস্ফোরিত নেত্রে তাকায় নীতুর মুখের দিকে।নীতু সামনে দৃষ্টি রেখে হাঁটছে।কিন্তু অভীক দৃষ্টি ফেরাতে পারছে না!কি ভয়ংকর আত্মবিশ্বাসী মেয়েটির মুখ! পরক্ষণেই আলগোছে ধরা হাতটা অভীক শক্ত করে ধরে।যেন ছেড়ে দিলেই পরে যাবে ঠিক তেমন ভাবে। অভীক বিড়বিড় করে বলে, ” ঠিক এমন করেই পাশে থাকবো আপনার…মিস নীতু! আপনার সকল আক্ষেপ, অপূর্ণ সুখ আমি আমার ভালোবাসা দিয়ে পূর্ণতায় রুপান্তর করবো।তখন আমায় ভালোবাসবেন তো?”
চলবে,
গত পর্বে অনেকেই তেমন রেসপন্স করেন নি।বুঝেছি রাগ করেছেন আমার উপর…..এত রাগ! তবে আমি কিন্তু আপনাদের উপর একটুও রাগ করিনি, হুহ!দেখলেন তো কেমন একটা জোশ পর্ব দিলাম।