কাননবালা পর্বঃ২৬

0
803

#কাননবালা!
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ২৬

নীতু আয়নার সামনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে।অফিসের জন্য তৈরি হচ্ছে! আয়নায় দেখতে পেলো সাথি ক্লান্ত ভঙ্গিতে খাটে আধশোয়া হয়ে বসে আছে।নীতু দীর্ঘ শ্বাস ফেললো।একটা মাস চলে গেলো চোখের পলকে।আটমাস চলছে সাথির।প্রেগ্ন্যান্সির ছাপ পড়েছে। হাত পা কেমন ফুলতে শুরু করেছে।রিপনের বারণে চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে সাথি। নীতু চুলে খোঁপা করে ঘাড়ের নিচে এলিয়ে রাখলো।কপালের দুপাশ থেকে কিছুটা চুল হাত দিয়ে ছড়িয়ে দিলো গালের দু’পাশে । হাতে লোশন মাখতে মাখতে এসে বসলো সাথির পাশে।তারপর বললো,”ঠিক করেছি একটা কাজের লোক রাখবো। সারাদিন তুই বাসায় থাকিস।কখন কি হয়?আমার খুব চিন্তা হয়।বাসায় কেউ একজন থাকলে আমি নিশ্চিন্তে অফিস করতে পারবো!”

সাথি হাসলো।নীতুর মনে হলেও এতেও মেয়েটার কষ্ট হচ্ছে।সাথির ফোলা হাত পায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো মায়া চোখে।সাথি বললো,’আপু আমার পাশে এসে বসতো।দূরে বসেছো কেন?কাছে আসো।”

নীতু সাথির গা ঘেঁষে বসলো।সাথি নীতুর হাত ধরে বললো,”আপু শাড়িতে তোমাকে যে কি ভালো লাগে!মনে হয় দেখতেই থাকি।”

“হয়েছে ফুলাতে হবে না,কি বলবি বল?”

সাথি হুট করে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো,নীতু হতভম্ব! কাঁদতে কাঁদতে সাথি বললো,”আপু আমার সন্তান প্রথম তুমি কোলে নিবে!কথা দাও।তাকে তোমার মত হতে হবে।একমদ তোমার মত!মা বাবা তো মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে,আমি যদি মরে যাই আমার বাচ্চাটা তুমি দেখে রেখো আপু।আমাকে ছুঁয়ে বলো,তুমি আমার কথা রাখবে।”

নীতু আৎকে উঠে সাথিকে বুকের মধ্যে জরিয়ে ধরলো।সাথি কাঁদতেই রইলো।নীতুর হুট করে মনে পরে গেলো,যে দিন তুতুন হলো নীতু তখন ইতুর পাশে। ইতুকে ওটিতে নেয়া হলো। মা আর ইতুর শাশুড়ী নামাজ পরছিল।নার্স এসে বাচ্চাটা নীতুর কোলে দিল।কি আদুরে মুখ!নীতু বুকের সাথে জরিয়ে ধরেছিল।তখনই ইতুর মামী শাশুড়ী নীতুর থেকে তুতুনকে একপ্রকার ছিনিয়ে নিয়ে বলেছিল,”তুমি বাচ্চা কোলে নিলা কে?কি সর্বনাশ করেছো!নিষ্পাপ শিশু দুনিয়াতে এসেই তোমার মত অভাগীর কোলে প্রথম উঠলো!তোমার এমনিতেই অপয়া ভাগ্য! বিয়ে হয় নাই,ঘর সংসার তোমাকে টানে না।তোমার মত মেয়ের প্রথমেই বাচ্চা কোলে নেয়া ঠিক হয়নি।”
নীতু সেদিন কিছুই বলতে পারেনি।কেবল আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছিল মহিলার মুখের দিকে। কি ভয়ানক কথা মহিলা অবলীলায় বলে গেলেন!
আজ সাথির কথা শুনে পুরানো স্মৃতি মনে পরে গেলো। পৃথিবী যেমন সৃষ্টি হয়েছে বাহারি রঙে তেমন পৃথিবীর মানুষগুলোর স্বভাবও ভিন্ন ভিন্ন রঙের! নীতুর বুক চিড়ে নিঃশব্দ হাহাকার নির্গত হয়।তখনও সাথি কেঁদে চলছে নীতুর বুকে মাথা রেখে……….

************

জ্যামের কারণে নীতুর অফিসে পৌঁছাতে লেট হলো।ঢাকার শহরের জ্যামে নীতু অতিষ্ট!অভীকের ঝাঁঝালো কথা শুনার অপেক্ষায় তটস্থ হয়ে রইলো নীতু!কতক্ষণ পরই অভীক নীতুকে ডেকে পাঠালো।নীতু ধীর গতিতে অভীকের কেবিনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করলো।এই অভীককে নীতু বুঝতে পারে না।মানুষটা একেক সময় একেকরকম!কাজের ক্ষেত্রে যেমন কঠোর তেমন নরম অফিসের বাহিরে!কখনো খুব সুন্দর করে কথা বলবে কখনো বা তিক্ত কথার ঝালে পুড়িয়ে ফেলবে।অভীকের কেবিনে ঢুকতেই বড় স্যারকে দেখে নীতু আরো সাবধানী হলো। অভীক এক আকাশ গাম্ভীর্য নিয়ে নীতুকে পর্যবেক্ষণ করলো।ভয়ে সিটিয়ে আসা আমচুরের মত নীতুর মুখটাকে দেখে অভীকের প্রচন্ড হাসি পেলো।কিন্তু বাহ্যিক গাম্ভীর্য দিয়ে অভীক হাসি গিলে ফেললো মুহুর্তেই! নীতুকে বসতে বলতেই নীতু বসে পরলো।এসির ভিতরেও কুলকুল করে ঘামছে নীতু!কোন ভুল হলো কি না?এই প্রশ্নে কপালে ভাঁজ পরলো।বড় স্যারকে দেখে সংশয় বেরে গেলো।মোটা গোঁফের নিচে অবস্থিত পুরুষ্ট ঠোঁট নাড়িয়ে বড় স্যার বলে উঠলে,”নীতু আমি সত্যিই তোমার ব্যপারে কনফিউজড ছিলাম।কিন্তু তোমার ওয়ার্কিং পারফরম্যান্স আমাকে মুগ্ধ করেছে।তার উপরে অভীক কারো উপরে সহজে সন্তুষ্ট হয় না!মাঝে মাঝে তো আমারো মনে হয়, অভীক বড় স্যার হিসেবে আমার প্রতিও সন্তুষ্ট না। কিন্তু আজ যখন অভীক তোমার কাজের প্রশংসা করলো।সত্যিই আমার ভালো লেগেছে!এভাবেই স্পৃহা রেখো তাহলে উপরে ওঠার সিঁড়ি খুবই সহজ হবে!”

নীতু আড়ষ্টভাবে অভীকের দিকে আঁড়চোখে চাইলো।অভীকের ঠোঁটে তখন ঈষৎ হাসি!কঠিন ইস্পাতের মত মুখটায় ওই ঈষৎ মৃদু হাসি যেন আরো বাড়তি সৌন্দর্য যোগ করেছে।নীতু চোখ ফিরিয়ে নিল!বড় স্যার আরো কতক্ষণ কথা বলে চলে গেলেন।সে চলে যেতেই অভীক বলে উঠলো,”মিস নীতু আপনিও ভয় পেতে জানেন?”

নীতু কপাল কুঁচকে তাকালো! অভীক বললো,”প্রশংসায় গা ভাসিয়ে ফেলা বাঙালির স্বভাব!আর আমাদের বড় স্যার আমুদে মানুষ। উনি একটু সবসময় বাড়িয়েই বলেন।বয়স হয়েছে তো।বুঝেছেন?”
নীতু চোখা চোখে তাকিয়ে বললো,”স্যার কিন্তু বলেছে আপনিও আমার পারফরম্যান্সে সন্তুষ্ট! ”

অভীক আফসোসের সুরে বললো,”এটুকু তো বলতেই হয়,শত হলেও আপনি আমার প্রতিবেশী! ”

নীতু হতাশ হলো।অভীকের কাছ থেকে সরাসরি কোন উত্তর পাওয়া খুবই কঠিন। “আমার মনে পরে না স্যার আপনি অফিসিয়ালি কোন ফেবার করেছেন প্রতিবেশী হিসেবে!”….নীতু বললো সরাসরি অভীকের চোখের দিকে তাকিয়ে।

অভীক প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে ফেললো মুহুর্তেই।একটা ফাইল সামনে টেনে চোখ মুখ কঠিন করে বললো,”আজও কিন্তু আপনি লেট করেছেন মিস নীতু!আশা করি এসব ব্যাপরে আরো যত্নশীল হবেন!এখন আসুন আপনি।”

নীতু গোমড়ামুখে বেরিয়ে আসলো। নীতু চলে যেতেই অভীক বড়সড় দম ফেললো! মেয়েটা চোখের সামনে এলেই নিজের কঠোর ব্যক্তিত্ব কেমন হাওয়াই মিঠাইয়ের মত গলে যায়!নিজেকে আস্ত কাঙাল মনে হয়!গাম্ভীর্যের দেয়াল খসে পড়তে চায়! অভীকের ভয় হয় কখন যেন নীতু ধরে ফেলে তার দূর্বলতা!মেয়েটা কি তখন উপহাস করবে?মনে মনে হাসবে তাকে নিয়ে!অভীকের প্রায়ই মনে হয়, পদ্মদিঘির ন্যায় গভীর চোখ দুটো দিয়ে অন্তর্ভেদী চাহনিতে মুহুর্তেই পড়ে ফেলবে অভীকের ভিতরটা!যেখানটা কপট আস্তরে আচ্ছাদিত এই মেয়েটির জন্য এক টুকরো উদ্যান!কাননবালা ছাড়া সেই উদ্যানটুকু যে ধু ধু মরুভূমি! তা কি কখনো বুঝতে পারবে মেয়েটা? বড় বিপন্ন বোধ করে অভীক!এই অন্তর্জ্বালার শেষ কোথায় নিজেই বুঝতে পারে না!

************
লাঞ্চ আওয়ারের পর নীতুর ফোনে আননোন নম্বর থেকে একটা কল আসে।কলটা রিসিভ করতেই নারী কন্ঠের কান্নায় নীতু চমকে ওঠে! অপর পাশের মানুষটা কয়েকমিনিট কিছুই বলতে পারে না কান্নার দমকে!একসময় শান্ত হয়ে পরিচয় দিতেই নীতু আরো বিস্মিত হয়।তাজের মা কেন তাকে কল দিয়ে কান্নাকাটি করছে? প্রশ্নটি আর করা হলো না তার আগেই ওপাশ থেকে রাবেয়া বেগম বলে ওঠেন কাঁদো কন্ঠে,”নীতু আমারে তুমি মাফ করে দিও। আমি ছেলের সুখের আশায় সুন্দর মেয়ে বউ করে আনছি।কিন্তু সুখ আমার কপালে নেই।ছেলেটা দিন দিন শুষ্ক কাঠে পরিণত হয়েছে।সেতুও ভালো নেই।এত কষ্ট আমি নিতে পারছি না।তুমি আমাকে ক্ষমা কইরো। তোমার বদদোয়া লাগছে….নাহলে এমন হইবো কেন?”

নীতু শান্ত কন্ঠে বলে,”আমার আপনার সাথে কথা বলার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে নেই।আপনাদের মত কিছু মানুষের জন্য আমাদের মত সন্তানদের সাফার করতে হয়।দিনশেষে নিজেকে মানিয়ে চলতে আত্মসুখের বলিদান দিয়ে! সবকিছু শেষ হওয়ার পর কান্না করা,মাফ চাওয়া অনার্থক!রাখছি।”

রাবেয়া বেগম দ্রুত কন্ঠে বলে,”রাইখো না মা।আমার কথা শেষ হয় নাই।সেতুকে খুঁজে পাচ্ছি না।সেতু কিছু না বলে বাসা থেকে চলে গেছে।তাজকে ফোনে পাচ্ছি না।আমি কি করবো? আমার মরণ হয় না কেন?”

“কি বলছেন আপনি?আমার বোন কোথায় গেছে?”…… নীতু চিৎকার করে বলে। ভয় আর উত্তেজনা মিশিয়ে নীতুর হাত পা কাঁপছে!

” আমি কিচ্ছু জানি না…..”…..বলে রাবেয়া বেগম ফের কাঁদতে শুরু করেন।
নীতু মাথায় হাত দিয়ে কেঁদে ফেলে।সেতু কোথায় গেলো?অফিসের ব্যস্ততার কারণে সেতুর সাথে এ কয়েকদিন বেশি কথা হয় নি।কল দিলেও হা হু ছাড়া বেশি কিছু বলতো না।বড় ভুল হয়ে গেছে! নীতু উদ্ভ্রান্তের মত ছুঁটতে শুরু করলো।এতবড় শহরে কোথায় খুঁজবে সেতুকে? পলাশ নীতুকে দৌড়াতে দেখে বলে,”কোথায় যাচ্ছো নীতু এমন করে।”

“আমাকে এখনই যেতে হবে পলাশ ভাই। আপনি স্যারকে দয়া জানিয়ে দিয়েন। “…… বলে নীতু বোতাম চেপে লিফ্টে উঠে পরে। পলাশ আহাম্মাকের মত চেয়ে থাকে নীতুর চলে যাওয়ার দিকে!
নীতু অনবরত কল দিয়ে যাচ্ছে সেতুর নম্বরে। পরক্ষণেই আবার কল দিচ্ছে তাজের নম্বরে।কেউ ফোন তুলছেনা।নীতু অজানা অাশংকায় কেঁদে ফেলে।সেতুর বয়সটা হলো আবেগের বয়স।কোন ভুল করেনি তো মেয়েটা? নীতুর চোখ মুখ গাঢ় অন্ধকারে গ্রাস হয়ে আসে! সেতুর কিছু হলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে তো?আর মা বাবা তো মরেই যাবে!নীতু দ্রুত কল দেয় জায়েদের নম্বরে…….সেতু কোথায় বোন আমার? বলে নীতু ফের কেঁদে ফেলে!

চলবে,
ইনশাআল্লাহ পর্ব ছোট দিবো কিন্তু রোজ দিবার চেষ্টা করবো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here