#কাননবালা!
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ১৬
ধূসররঙের কোট মেরুন রঙের ফুল স্লিভ শার্ট আর কালো প্যান্টে সজ্জিত অভীক।শুভ্র মুখশ্রীতে স্ট্রিম করা খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি!ঘন চুলগুলো জেল দিয়ে সেট করা।গভীর চোখ দুটিতে বুদ্ধির ঝিলিক!ঠোঁটের ভাঁজে একরাশ কঠোরতা নিয়ে অভীক লম্বা লম্বা পা ফেলে অফিসে প্রবেশ করে।
নীতুর মনে হলো তার ভ্রম হচ্ছে। চোখের সামনে অভীকের অবয়ব তার উর্বর মস্তিষ্কের সৃষ্টি! ইনি কি সত্যিই অভীক?
নীতু ধপ করে চেয়ারে বসে পরে।পাশে দাঁড়ানো রিপার হাত খপ করে চেপে ধরে।রিপা তখনও অভীককে হা করে গিলছে।বেহুশের মত! নীতু বিরক্ত হয়ে রিপাকে ধাক্কা দেয়।রিপার সম্বিত ফিরিয়ে এনে জিজ্ঞেস করে, “এই মাত্র কে আসলো?”
রিপা সম্মোহনী কন্ঠে বলে,”আমাদের অফিসের একমাত্র রাফ এন্ড টাফ স্যার!তাশরীফ অভীক!”
নীতুর চোখ মুখ কাঁদো কাঁদো হয়ে গেলো।দুদিন আগেও যে মানুষটার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেছে আজ তাকে দেখে নীতুর শরীর মন দুটোই অস্তিত্বে আছন্ন হলো।সেদিন কি ভেবেছিল এই অভীককেই চোখের সামনে দেখতে হবে সারাটাদিন। নীতুর মাথা চক্রাকারে ভনভন করে ঘুরতে লাগলে।নীতু যতোই নিজেকে কঠোর বলে প্রেজেন্ট করুক,আদতে তো সেটা সত্যি না!কঠিন আবরুর আড়ালে নীতু এখনও সেই শান্ত ধীর মেয়েটি! যে পুরুষটা তাকে অযোগ্য বলে রিজেক্ট করেছে তার সামনে কিভাবে সারাক্ষণ স্বাভাবিক থাকবে?ভেবে পায় না নীতু।
এই অভাবের বাজারে নতুন একটা চাকরি পাওয়া যে কতটা কঠিন তা নীতুর থেকে ভালো আর কে জানে?
একরাশ চিন্তায় নীতুর মুখ অন্ধকার হয়ে আসে!
***-***—***
তাজ ব্যস্ত হাতে নিজের আলমিরা ঘাটছে।চোখ মুখ বিরক্তিতে কুঁচকে আছে।অফিস থেকে নিয়ে আসা গুরুত্বপূর্ণ ফাইলটা তাজ প্রথম ড্রয়ারে রেখেছিল তার স্পষ্ট মনে আছে।অথচ এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাজ গুছানো প্রকৃতির মানুষ। সবকিছুই তার গুছানো থাকে।অথচ আজ তার ব্যবহৃত এক একটা জিনিস এক একেক জায়গায়।
সেতু বারান্দায় বসে হাত পায়ের নখ কাঁটছে।তাজের এই খোঁজাখুঁজি পর্ব দেখেও সেতু নড়লো না। সেতু চায় এই ছুতোয় অন্তত তাজ তার সাথে কথা বলুক।একটু কথা বলায় তো আর দোষ নেই!
তাজ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে। অফিসের লেইট হয়ে যাচ্ছে! বারান্দার কাছে এসে কপালে বিরক্তির ভাঁজ ফেলে বলে,”সেতু ফাইলটা কোথায়?”
সেতু একবার ঘাড় উঁচু করে তাকিয়ে আবার নখ কাটতে মনোযোগ দেয়।ওই উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ মুখটির দিকে সেতু বেশিক্ষণ তাকাতে পারেনা। তাহলেই ভীষণ প্রেম পায় তার!নিজের এই দূর্বিষহ অবস্থায় সেতু নিজেই বিরক্ত।
“আপনার ফাইল কোথায় তা আমি জানবো কি করে?”
তাজ কোমড়ে দু’হাত রেখে বলে,”প্রশ্নের বিপরীতে প্রশ্ন করবে না সেতু।এ ঘরে তুমি ছাড়া আর কে থাকে?আমার জিনিস তুমি ছাড়া কে ধরেছে?তাড়াতাড়ি বলো। ”
সেতু কন্ঠে একরাশ উদাসীনতা নিয়ে বলে,”একঘরে থাকলেই বুঝি সব ছোঁয়া যায়?সব জানা যায়?”
সেতু পরক্ষণেই মনে মনে বলে,”কই আপনাকে তো আমি ছুঁয়ে দিতে পারলাম না?আর আপনার মন? সে তো সেতুর নাগালের বাইরে! ”
“একদম হেয়ালি করবে না সেতু।আমার গুরুত্বপূর্ণ একটা ফাইল।অফিসে যেতে পারবো না ফাইলটা না পেলে।সকাল থেকেই দেখছি আমার ব্রাশ বাথরুমের বদলে ড্রেসিং টেবিলে,আয়রন করা শার্ট এলোমেলো,তোয়ালেটা ভেজা,আলমিরার সবকিছু একেকটা একেক জায়গায়। এসবের কারণ কি?”
সেতু কিচ্ছু বললো না।পায়ের নখ যত্ন সহকারে কাটতে শুরু করলো।তাজ কতক্ষণ সেতুর দিকে তাকিয়ে থেকে রুমে ফিরে অফিসের জন্য রেডি হতে শুরু করলো। শার্টে বোতাম লাগাতে লাগাতেই তাজ দেখতে পেলো সেতু এলোমেলো পায়ে আলমিরার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।কাপড়ের স্তূপের মধ্যে থেকে সবুজ ফাইলটা বের করে বিছানায় রেখে চুপচাপ রুম ছেড়ে বেড়িয়ে গেলো সেতু। তাজ গোপনে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো।দিনকে দিন সেতু অধৈর্য হয়ে পড়ছে আর তাজ বিরক্ত! এভাবে একটা সম্পর্ক কি বয়ে নেয়া যায়?
**************
অভীক নীতুকে অফিসে দেখে কেন জানি অবাক হলো না।ঠোঁটের কোণে ঈষৎ হাসির রেখা দেখা দিল কেবল।হসপিটালে নীতুকে দেখে যেমন দমবন্ধকর অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল এখন সেরকম লাগলো না বরং কোথাও যেন একটা স্বস্তির আমেজ দেখা গেলো।
নীতুকে অভীক ডেকে পাঠিয়েছে তার কেবিনে।শুনেই নীতুর হাত পা ঠান্ডা হতে শুরু করেছে।নীতুর কিছুতেই অভীকের মুখোমুখি হতে মনে চাইছে না। পলাশ এসে তাগাদা দিয়ে বললো,”নীতু তুমি এখনও দাঁড়িয়ে আছো কেন?নতুন সব এমপ্লয়িয়ের সাথে অভীক স্যারের দেখা হয়েছে কেবল তুমি বাকি।যাও তাড়াতাড়ি যাও।অভীক স্যার মোটেও গাফলতি পছন্দ করেন না।”
নীতু বারকয়েক দম ফেলে নিজেকে আস্বস্ত করলো।এত ভয় পাওয়ার কি আছে?বলে নিজেকে শাসালো।মাথা সোজা করে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনার বৃথা চেষ্টা করলো। এরপরই অভীকের কেবিনে নক করে বললো,” মে আই কাম ইন স্যার?”
অভীক নতুনদের গ্রুমিং ফাইল দেখছিলো। দরজার দিকে একপলক তাকিয়ে কাম ইন বলে আবার ফাইলে মনোযোগ দিলো। সেই একপলকেই অভীকের নীতুকে পর্যবেক্ষণ করা হয়ে গেলো।বড় নেকের ব্লাউজ, বাঙ্গি রঙের শাড়ি। ঘাড়ে এলানো হাত খোঁপা।হাতে চিকন বেল্টের ঘড়ি আর কাকচক্ষু জলের গভীর চোখ দুটিতে কাজল দিয়ে সজ্জিত নীতু।
পারমিশন নিয়ে নীতু চেয়ারে বসে পড়লো।
অভীক সরাসরি নীতুর দিকে তাকিয়ে বললো,”কি নাম আপনার?”
নীতু অবাক চোখে তাকালো অভীকের প্রশ্নে।নাম জানা স্বত্বেও কেন জিজ্ঞেস করলো নীতু বুঝতে পারলো না।
“আফসানা নীতু।”
অভীক টেবিলের উপরে রাখা ফাইলের ভিতর থেকে একটা ফাইল বের করলো।নীতু বুঝতে পারলো ফাইলটা তারই।এসি রুমের মধ্যে বসেও নীতু নার্ভাসনেসের কারণে ঘামতে শুরু করলো।নাকের ডগায় মুক্তোর মত বিন্দু বিন্দু ঘাম চকচক করছে। অভীক ভ্রু কুঁচকে একবার নীতুর দিকে তাকিয়ে আবার নিজের কাজে মনোনিবেশ করলো। রুম জুড়ে পিনপন নিরবতা। পুরোটাসময় নীতু অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে বসে রইলো। একটাসময়ে অভীকের ফাইল দেখা শেষ হলো।চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়ে নীতুর দিকে সরাসরি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,”মিস নীতু আপনি দেখছি রিকোয়েস্ট ক্যান্ডিডেট।আমার জানা মতে সুপারিশ তার জন্যই করা হয় যে নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসে ভুগে।আমি কি ঠিক বলছি মিস নীতু?”
অভীকের কথায় নীতু একপলক তাকিয়ে দৃষ্টি নত করে ফেললো। নীতুর চোখ স্পষ্ট দেখেছে অভীকের ঠোঁটের কোণে ঈষৎ হাসি।মি.অভীক কি নীতুকে বিদ্রুপ বা কটাক্ষ করে হাসলো?নীতু তা বুঝতে পারলো না।কেবল মনের মধ্যে খুঁত খুঁত করতে লাগলো। নীতুর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসলো।
অভীক ফের বললো,”মিস নীতু আপনি দৃষ্টি নত করে কেন রেখছেন?কারো সম্মুখে চোখের দৃষ্টি তারাই নত করে যারা কোন অন্যায় করে থাকে বা কোন বিষয়ে লজ্জা পেলে।আপনি কি সেরকম কিছু করেছেন?”
নীতু বহুকষ্টে ভার হয়ে আসা কন্ঠে বললো,”না!”
“গুড।এখন থেকে আমার সাথে সরাসরি কথা বলবেন। মনে থাকবে?”
“অবশ্যই স্যার!”
গ্লাসে ঢেকে রাখা পানি অভীক নিঃশব্দে ঠেলে নীতুর দিকে এগিয়ে দেয়। নীতু প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকালে।
অভীক বলে ওঠে, “আপনার দরকার মিস নীতু।”
নীতু গ্লাসে চুমুক দিয়ে নিজের শুকিয়ে আসা গলাটা ভিজিয়ে নেয়।কপালে ছড়িয়ে পরা ক’গাছি অবাধ্য চুল কানের পাশে গুজে নেয়।সবকিছুই অভীক পর্যোবেক্ষণ করে। এরপর টেলিফোন কানে তুলে বলে,”পলাশ আমার কেবিনে আসো।”
কিছুক্ষণ পরই পলাশ অনুমতি নিয়ে কেবিনে প্রবেশ করে।
অভীক পলাশের দিকে তাকিয়ে বলে,”পলাশ আমি জানি তুমি তোমার কাজে খুবই দায়িত্বশীল। কিন্তু মাঝে মাঝে তোমার মধ্যে সফট কর্ণার কাজ করে, কেন?এটা যে কোম্পানির জন্য হুমকি স্বরুপ তা অবশ্যই তুমি জানো?”
পলাশ কিছুটা দ্বিধা নিয়ে বলে,”কোন ভুল হয়েছে স্যার?”
অভীক নীতুর দিকে একবার তাকিয়ে আবার পলাশের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,”একজন অভিজ্ঞতাহীন এমপ্লয়ির কাজে তুমি কি করে জব পারফরম্যান্স এইটটি পার্সেন্ট রাখো?তোমার কি সত্যিই মনে হয় মিস নীতুর পারফর্ম এতটা ভালো?”
পলাশ আমতা আমতা করে কিছু বলতে নিলে অভীক কথা থামিয়ে দিয়ে বলে,”আমার তো মনে হয় মিস নীতুর ওয়ার্ক পারফরম্যান্স বুঝে তাকে ফিফটিতে ফেলা যায়!”
“মিস নীতু আপনাকে বলছি। কি কারণে পলাশ আপনাকে এতটা ফেবার করলো আমি জানি না।তবে আমি এরপর অবশ্যই দেখবো আপনার কাজ। যদি কোন ভুল পাই তবে আপনার পূর্বে আপনার মেন্টরকে আমার কাছে যথাপোযুক্ত জবাবদিহী করতে হবে।এবার আপনারা দুজনেই আসুন!”
নীতু এলোমেলো পা ফেলে কেবিন থেকে বের হয়। চোখের দৃষ্টি বিধ্বস্ত। মনে হচ্ছে কোন ঝড়ের সামনে থেকে বেঁচে ফিরেছে। পলাশ আস্বস্ত ভঙ্গিতে বলে,”নীতু তুমি কিছু মনে করো না।অভীক স্যার কাজের বেলা খুবই কঠোর হলেও তিনি মানুষটা চমৎকার! ”
নীতু পলাশের কথায় ফ্যাকাশে হাসলো।ধীর পায়ে নিজের ডেস্কে ফিরে গেলো।
নীতু চলে যেতেই অভীক গলা ছেড়ে হো হো করে হেসে দিলো।নীতুর ভেজা বেড়াল মুখটা এত স্নিগ্ধ লাগছিল। অভীকের ইচ্ছে করছিল নীতুর গাল টেনে বলতে,”এই মেয়ে এত ভয় পাচ্ছা কেন?আমি কি বাঘ নাকি ভালুক? আমি তো তাশরীফ অভীক!”
অভীক আবার হেসে উঠলো।পরক্ষণেই হাসি মুছে গিয়ে অভীকের শরীরে জুড়ে আলাদা শিহরণ বয়ে গেলো।চোখের সামনে ভেসে উঠলো, নীতুর নাকের উপর জ্বলজ্বল করতে থাকা মুক্তোর মত ঘামের বিন্দু!কাকচক্ষু জলের পদ্মদিঘির মত অবাক করা ভীষণ সুন্দর দুটি চোখ।
অভীক মুহুর্তেই চোখ বন্ধ করে ফেললো!তার সাথে এসব কি হচ্ছে ভেবে পেল না!
নীতু অভীকের আচরণে এতটুকু বুঝতে পারলো।মি.অভীক পারসোনাল লাইফে আর প্রোফেশনাল লাইফে একই ব্যক্তির আলাদা সত্তা! নীতু কেন যেন অভীকের এই আচরণে মুগ্ধ হলো।অফিসে কাজ করা কঠিন হবে না ভেবে নিশ্চিন্ত হলো।
চলবে,
আম্মু ভীষণ অসুস্থ। ডায়বেটিস, প্রেসার সব আন্ডারকন্ট্রোল।শরীরে গোটা গোটা উঠেছে।তিন ব্যাগ রক্ত দিতে হবে।এতকিছু নিয়ে আমি ভীষণ ব্যস্ত তাই গল্প দিতে দেরি হলে রাগ করবেন না।আমি সময় পেলেই গল্প পোস্ট করবো।