“কাঠগোলাপের সুবাস”
০১।।
বউ-এর সাজে রুমে বসে আছে হুমায়রা। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরছে। চোখের কাজল লেপ্টে গেছে একদম। পাশ থেকে একজন মুরব্বি টিপ্পনী কেটে বললো,
— “মুখ ওমন কাইল্লা বানাইয়া রাখলে সোয়্যামির সোহাগ জীবনেও পাইবা না। তোমরে রাইক্ষা আরেক বেডির কাছে যাইবো।”
মুরব্বি ব্যক্তি আর কেউ নয় তার মাইমা। অর্থাৎ ভাবির মা। হুমায়রা এক নজর তাকালো রহিমা বানুর দিকে। আবার চোখ নামিয়ে নিলো। আসরের আযান কানে আসতেই একটু নড়েচড়ে খাট থেকে নামতে গিয়ে ব্যাথা অনুভব করলো পায়ের গোড়ালিতে। কোনোরকমে উঠে দাঁড়িয়ে আস্তেধীরে হেটে যায় বাথরুমে। ওজুর পানিতে ধুয়ে ফেলে সমস্ত কৃত্রিম প্রসাধনীর ঝকঝকে বাহার।
নামাজে দাঁড়িয়ে গেলো হুমায়রা। রুকুতে যেতেই চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে আসে। এতোটা যন্ত্রণা হচ্ছে পুরো শরীরে, দাঁড়িয়ে থাকাই একটা যুদ্ধ মনে হচ্ছে। খুব কষ্টে নামাজ আদায় করে নিলো। জায়নামাজ ভাজ করে রাখতেই বাহিরে শোরগোল শোনা গেলো, ‘বর এসেছে’ ‘বর এসেছে’। হুমায়রা ঘাপটি মেরে বসে রইলো খাটের এক কোণে। সে এই বিয়েতে মোটেও রাজি না। কারণ পাত্র বেদ্বীন। তার খুব ইচ্ছে ছিলো একজন দ্বীনদার পাত্রকে বিয়ে করবে। সে যদি দিনমজুরও হয় তাতেও সমস্যা ছিলো না হুমায়রার। বেশ কয়েকবার বলেছে ভাইকে। তার ভাই বউয়ের ভয়ে চুপ করে ছিলো।
যথাসময়ে বিয়ে পড়ানো শেষ হয়ে গেছে। পাত্র কে? দেখতে কেমন? কিছুই জানে না হুমায়রা। হুমায়রা নিরবে কাঁদে। মা থাকলে মায়ের কাধে একটু মাথা রেখে কাঁদতে পারতো। কিন্তু সেটাও নেই। বাবা-মা যে সেই কবেই আল্লাহর মেহমান হয়ে চলে গেছেন।
বিদায়ের বেলায় এমন কাউকে পেলো না যাকে জড়িয়ে ধরে একটু কেঁদে মন হালকা করবে। মাথা নিচু করে ছিলো প্রতিটা সময়। চুপচাপ এসে গাড়িতে বসলো তার ভাইয়ের হাত ধরে। গাড়ি ছাড়ার আগে একপলক ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বললো,
— “বাবা-মা থাকলে হয়ত আমাকে এমন দায়সারা ভাবে পার করে দিতো না। সুখে থেকো ভাই।”
হুমায়রার ভাই রফিক মাথা নিচু করে নিরবে চোখের পানি ফেললো। রাণীকে খুব ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো। সেই এখন বাঘিনী হয়ে উঠেছে। একটা কিছু বললেই যখন তখন বাঘের মতো গর্জন শুরু করে। তার সিদ্ধান্তেই বিয়েটা হয়েছে। এই জন্যে সে পঁচিশ লাখ পেয়েছে।
___________________
একটা সুবিশাল কক্ষের ফুলে সাজানো খাটে হুমায়রা মাথা নিচু করে বসে আছে। বারবার ভয়ে কেঁপে উঠছে৷ তার স্বামী নামের লোকটা কেমন হবে? তার সাথে কেমন আচরণ করবে এসব ভেবে ভয়ে কাঁপছে। সতেরো বছরের হুমায়রা যে বিয়েটাকে একটা আতংক ভাবে। তার এক বান্ধুবির কাছ থেকে শুনেছে, প্রথম রাতেই নাকি খুব অমানুষিক অত্যাচার করেছে বেচারিকে। তার স্বামীও বেদ্বীন ছিলো। ইসলামের ধারে কাছেও ঘেষতো না। তাই হুমায়রা সবসময় দ্বীনদার পাত্র চেয়েছিলো। কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা যে অন্য কিছু ফয়সালা করে রেখেছেন। ‘নিশ্চই আল্লাহ উত্তম ফয়সালাকারী।’
আল্লাহর এই গুণের কথা মনে পড়তেই হুমায়রার মন একটু শান্ত হয়। কিন্তু কিছুটা হলেও ভয় জেঁকে আছে মনে। মাথা তুলে আশেপাশে তাকালো। রজনীগন্ধা ফুলের ঘ্রাণে চারিদিকে মৌ মৌ করছে। পায়ের গোড়ালিতে হাত বুলালো হুমায়রা। তখনই একটা গম্ভীর ভরাট কণ্ঠের পুরুষালি আওয়াজ পেলো। হুমায়রা চমকে যায়। মনে হলো হৃদপিন্ড লাফ দিয়ে মুখে চলে এসেছে। হুমায়রা মাথা তুলে এক নজর তাকিয়ে আবার মাথা নামিয়ে নিলো।
— “আসসালামু আলাইকুম।” মৃদু কণ্ঠে সালাম দিলো হুমায়রা।
— “ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কেমন আছেন?”
— “জ্বী আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপ..আপনি?”
— “এতক্ষণ মোটামুটি ছিলাম এখন আলহামদুলিল্লাহ খুব বেশিই ভালো আছি।”
হুমায়রা মাথা তুলে ভালো করে তাকালো তার স্বামীর দিকে। লোকটার মুখের হাসি দেখে হুমায়রার অন্তর-আত্মা কেঁপে উঠে। হাসিটা খুব রহস্যময়ী লাগে হুমায়রার কাছে। হুমায়রা চোখ নামিয়ে নিয়ে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো,
— “আপনার নাম জানতে পারি?”
— “হুম অবশ্যই। নাম তো জানবেই। আরো অনেক কিছুই জানবে।”
— “অনেক কিছু ম..মানে?”
— “সাদমান রায়হান সাকিব। সবাই সাদ বলেই ডাকে। আমি তোমার কপালে হাত রেখে দোয়া পড়ছি।”
— “জ্বী। ঠিকাছে।”
সাদ আলতো করে হুমায়রার কপালে হাত রাখলো। সাদের স্পর্শে হুমায়রা কেঁপে উঠে কিছুটা। দোয়া পড়া শেষে সাদ বললো,
— “অজু আছে?”
— “জ্বী।”
— “আসো নামাজ পড়ে নি। তারপর বাকি কথা পরে হবে।”
হুমায়রা খাট থেকে নামতে গিয়ে পায়ের গোড়ালির ব্যাথায় দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে পরে যাচ্ছিলো। চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলে। কিন্তু না, কোমড়ের কাছে ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেলো। হুমায়রা চোখ খুলে নিজেকে সাদের বুকের মাঝখানে পেলো। মাথা তুলে তাকালো সাদের দিকে। চোখ চোখ পরতেই হুমায়রা থমকে যায়। হালকা নীলচে মায়াবী দুটো চোখ। এতোটা মায়া এই চোখে, হুমায়রা এভাবে চোখের দিকে তাকিয়েই পুরো মুহুর্ত কাটিয়ে দিতে পারবে। সাদ গলা খাকাড়ি দিলো। হুমায়রার ধ্যান ভাঙতেই লজ্জা পেলো ভীষণ। সরে এলো সাদের বুক থেকে।
দুটো জায়নামাজ বিছালো সাদ। দুজনে নামাজ পরে নেয়। নামাজ শেষে একটা সূতির শাড়ি এগিয়ে দিলো হুমায়রার দিকে। বললো,
— “এই শাড়ি পরে নাও। কিছুটা আরাম পাবে। তাছাড়া একটু পর খুব আরামেই কাটবে।”
হুমায়রা লজ্জা পেয়ে গেলো। শাড়িটা নিয়ে ওয়াশরুমে গেলো। মনে মনে খুশি হলো। এতক্ষণ লোকটাকে মনে মনে যতটা সৈরাচারী ভাবছিলো লোকটা তেমন নয়। ভালো মনের মানুষ। হুমায়রা এসব সাত পাঁচ ভেবে কাপড় বদলাচ্ছিলো আর লজ্জা পাচ্ছিলো। তখনও হুমায়রা জানতো না এর পরের মুহুর্তে তার জন্য কি অপেক্ষা করছে।
হুমায়রা বের হতেই আবন্ধ হলে সাদের বাহুবন্ধনে। হুমায়রা লজ্জায় গুটিয়ে গেলো। এভাবে বেশকিছু সময় থাকার পর মনে হলে শ্বাস আটকে আসছে হুমায়রার। সাদকে বললো,
— “আপনার বন্ধন একটু শিথিল করুন। আমার শ্বাস আটকে আসছে।”
— “(—–)”
— “শুনছেন আপনি? একটু ছাড়ুন। সত্যিই আমার শ্বাস আটকে আসছে।”
— “তোমার নাম যেনো কি?”
— “হুমায়রা জান্নাত।”
— “তো মিসেস হুমায়রা জান্নাত এখন দম বন্ধ হয়ে আশার কারণ কি? আমি ধরেছি বলে?”
— “ম..মানে? ক..কি বলছেন? প্লিজ ছাড়ুন।”
সাদ হুমায়রাকে ছেড়ে দূরে দাড়ালো। হুমায়রা জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। সাদ পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো। কোনোকিছু চিন্তা না করেই সব পানি ঢকঢক করে খেয়ে নিলো। কিছুটা শান্ত হয়ে সাদের দিকে তাকালো। তারপর?…….গালটা জ্বলে উঠে। হুমায়রা মেঝেতে ছিটকে পরে। ‘মাগো’ বলে আর্তনাদ করে উঠে। তখনই সাদের কণ্ঠে শুনতে পেলো,
— “নষ্টা মেয়ে মানুষ। একজনের সাথে শুবি আর বিয়ে করবি আরেকজনকে? এইজন্য পঁচিশ লাখ নিয়েছিস? এতো চাহিদা তোর পঁচিশ লাখেও মন ভরেনি। আবার আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিস।”
কথাগুলো বলেই অনেকগুলো ছবি ছুড়ে মারলো হুমায়রার মুখে। হুমায়রা এতোক্ষণ মাথা নিচু করে ছিলো। ছবিগুলো হাতে নিয়ে কেঁপে উঠে। এতো বাজে ছবি। ছিহ্! কিন্তু এভাবে কোনোদিন হুমায়রা তো ছবি তুলেনি। তাহলে এসব আসলে কোথা থেকে? আর ছবির ছেলেটা।
হুমায়রা নিরবে কাঁদে। মনে মনে বললো, ‘ভাবি তুমি সত্যিই খুব বড় খেলোয়াড়।’ কোনোরকমে উঠে দাঁড়িয়ে সাদের দিকে তাকিয়ে বললো,
— “আ..আমি এসবের কিছুই জানি না। বিশ্বাস করুন।”
— “বিশ্বাস তাও তোমাকে? তোমার মতো চরিত্রহীনকে? ইমপসিবল।”
হুমায়রা থমকে যায়। কিছু মুহুর্ত আগে যার চোখের মায়ায় পরেছে সেই মানুষটা তাকে ‘চরিত্রহীনা’ বলছে। এটা মানা যায় না। হুমায়রা এটা মানতে পারছে না। সতেরোটা বসন্ত পার করেছে, এই সতেরো বছরে নিজের উপর কোনো আঁচড় লাগতে দেয়নি। নিজেকে পবিত্র রেখেছে শুধুমাত্র স্বামী নামক ব্যক্তিটার জন্য। আর সেই স্বামীই তাকে অপবাদ দিচ্ছে। সাদ রেগে বললো,
— “রবিন আমার ফ্রেন্ড। সব বলেছে আমাকে। কিভাবে ওর সাথে প্রেমের অভিনয় করে টাকা হাতিয়ে নিয়েছো তুমি। নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে টাকা নিতে এতটুকু লজ্জা করেনি? আবার আমার কাছে এখন? প্রথমে তো মায়ের কারণে রাজি হয়েছি। রবিন যখন আমাকে সব বলেছে তখন জেদ চেপেছিলো। তোমাকে বিয়ে করে হারে হারে বোঝাতে চেয়েছি এসব নষ্টামির শাস্তি কেমন। এন্ড আই ডিড ইট। তুমি এখন এখানে বন্ধী। আজ থেকে, এই মুহুর্ত থেকে তোমার খারাপ থাকা শুরু। গেট রেডি ফর ইউর পানিশমেন্ট।”
হুমায়রা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। নিরবে কাঁদে। হুমায়রা বরাবরই নিরব শ্রেণির নারী। যে যত যাই বলুক সবসময় নিরব থাকে। মারলেও নিরব থাকবে। প্রতিবাদ করে না কখনো। সে আসলে পারেনা এসব। হুমায়রা ভাবে এসব অবহেলা, অপমান, কটুকথা, মারধর শুধু তারজন্যেই। তাই সবসময় চুপ থাকে।
হাতের কব্জিতে চাপ অনুভব হওয়ায় ধ্যান ভাঙলো হুমায়রার। খেয়াল করে দেখলো সাদ তার হাতের কবজি খুব শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছে। তাই এই ব্যাথা অনুভব হচ্ছে। বারান্দার দরজার সামনে এসে সাদ ধাক্কা দিলো হুমায়রাকে। হুমায়রা সোফার উপর পরেছে। সাদ চলে গেলো। হুমায়রা সোফায় শুয়ে থাকে। শরীরটা ভীষণ ব্যাথা। ব্যাথা করারই কথা। মারের দাগগুলো তো বেশি পুরানো নয়।
এই গত পরশুদিনই মার খেয়েছে ভাবির হাতে। বিয়েতে রাজি হচ্ছিলো না বলে, কাঠের পিড়ি দিয়ে ভাবি তাকে পিটিয়েছে। তখনও চুপ করে ছিলো মেয়েটা।
কপালে হাত রেখে চোখ বুজে হুমায়রা। চোখের কোণ থেকে পানি গড়িয়ে পরে। মনে মনে বললো,
“তোমার কি ক্ষতি আমি করেছি? যার কারণে হাত ধুয়ে পিছনে পরে আছো ভাবি। বিয়ে তুমিই দিলে, আর প্রথম রাতে সংসার তুমিই ভাঙলে। এসব করে কি পেলে ভাবি? আমাকে কেনো এতো ঘৃণা করো বলোতো? কিসের এতো ক্ষোভ আমার উপর? তুমি সুখে থাকো ভাবি। আমি নাহয় দুঃখের সাগরে ডুবে থাকি। ভাবি, যাই করো না কেনো মনে রেখো আল্লাহ একজন আছেন। তিনি সব দেখছেন। তোমাকে ছাড় দিয়েছে তার মানে এই নয় যে, আল্লাহ তোমার ব্যাপারে উদাসীন। বিচার হবে একদিন। এই দুনিয়ায় নাহলে ওই দুনিয়ায়।”
.
সকালে আজানের মিষ্টি সুরে ঘুম ভেঙে গেলো হুমায়রার। আস্তে করে উঠে বসে। কাল রাতের কথা মনে হতেই ভেতরের রুহুটা কেঁদে উঠে। বারান্দা ত্যাগ করে রুমে এসে দাড়ালো হুমায়রা। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো। খাটের দিকে চোখ গেলো। সাদ ঘুমিয়ে আছে। ধীর পায়ে হেটে সাদের দিকে গেলো। সাদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কয়েক মিনিট। লোকটা ঘুমিয়ে থাকলেও খুব মায়াবী লাগে। সাদের নড়াচড়া দেখে ভয় পায় হুমায়রা। তাড়াতাড়ি সরে যায়। ওয়াশরুম থেকে ওজু করে আসে। খাটের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবে সাদকে কি একবার ডাকবে? ডাক দিলে যদি রেগে যায়? রেগে গেলে রাগবে তারপরেও নামাজের জন্য ডাকবে। আর এটা তো স্ত্রীর কর্তব্য। হুমায়রা মৃদু স্বরে সাদকে ডাক দিলো।
সাদ নড়েচড়ে আবার ঘুমে তলিয়ে যায়। হুমায়রা আবার ডাকলো,
— “এইযে, শুনছেন? নামাজের সময় চলে যাচ্ছে মসজিদে যাবেন না?”
সাদকে নির্বিকার দেখে হালকা ধাক্কা দিয়ে বললো,
— “মসজিদে যাবেন না?”
সাদ চোখ মেলে হুমায়রাকে নিজের পাশে দেখে রেগে গেলো। হুমায়রার একহাত নিজের বুকের উপর দেখে আরো রেগে গেছে। বাজখাঁই কণ্ঠে বললো,
— “তোমার এই অপবিত্র হাতে আমাকে স্পর্শ করার দুঃসাহস করবে না।”
হুমায়রা নিজের হাত সরিয়ে নিলো। কান্না পায় খুব। কিন্তু কাঁদে না। মাথা নিচু করে বললো,
— “দুঃখিত এই ভুল আর হবে না।”
— “কিসের জন্য ডেকেছো আমায়?”
— “জ্বী। নামাজের জন্য। আযান দিয়েছে অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। আপনি নামাজে যাবেন না?”
— “তোমার মতো নষ্টা মেয়ে আবার নামাজও পড়ে নাকি?”
হুমায়রা কষ্ট পায়। কিন্তু কিছু বলে না। সাদ উঠে বসে। ওয়াশরুম থেকে অজু করে এসে পাঞ্জাবি আর টুপি পরে নেয়। হুমায়রা জিজ্ঞেস করলো,
— “জায়নামাজ টা কোথায়?”
— “ওইখানে ড্রয়ারে আছে।”
হুমায়রা জায়নামাজ বিছাতে বিছাতে বললো,
— “একশত খুন করা বনী ইসরাঈলের সেই খুনি যদি ভেতরে অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর মাফ পায় তবে আমি কেন পাবো না? মদিনায় বিবাহিত সেই যীনাকারী নারী যদি অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর মাফ পায় আমি কেন পাবো না? আমি তো দোষ না করেও দোষী। চরিত্রের হেফাজত করেও চরিত্রহীন হয়েছি। তাহলে আমি নষ্টা মেয়ে নামাজ পড়লে সমস্যা কি?”
হুমায়রা আর কোনোদিকে তাকালো না। নিজের মতো করে নামাজে মন দিলো। সাদ একবার হুমায়রাকে দেখে বেরিয়ে যায় মসজিদের উদ্দেশ্যে। মনে মনে ভাবছে কোনো ভুল হলো নাতো? আবার ভাবছে তার বন্ধু রবিনই বা কেনো মিথ্যে বলবে? আর যদি হুমায়রা সত্যিই বলে থাকে তাহলে পঁচিশ লাখ টাকা নেয়ার কারণ? উহু..! এই নারীই ছলনাময়ী।
সাদ নামাজ শেষে বাসায় ফিরে দেখলো হুমায়রা তার রুম গুছিয়ে ফেলেছে। তার কাপড় চোপড় গুছিয়ে রাখছে। সাদ দ্রুত এসে হুমায়রার হাত থেকে কাপড় নিয়ে নিলো। সাদকে দেখে হুমায়রা মিইয়ে গেলো। সাদ শক্ত কণ্ঠে বললো,
— “আমার কাপড়চোপড় ধরার সাহস কোথায় পেলে তুমি? আমার কাবার্ডে কোন সাহসে হাত দিয়েছো?”
— “অগোছালো ছিলো তাই গুছিয়ে রাখছিলাম।”
— “আমি বলেছি গুছিয়ে রাখতে? আগ বাড়িয়ে কিছু করবে না। আমার এসব একদম সহ্য হয়না। আর তোমাকে তো একদমই না।”
— “তাহলে আমাকে বিয়ে কেনো করেছেন?”
— “শাস্তি দিতে। যাতে নেক্সট টাইম আর কারো সাথে এসব করতে গেলে দুইবার ভাবো।”
— “শাস্তি তো অন্যভাবেও দিতে পারতেন। বিয়ে না করলেও হতো।”
— “তোমার থেকে আমি সাজেশন চাইনি। যদি কাজ করার বেশি ইচ্ছে হয় তাহলে রান্নাঘরে যাও। ওটাই তোমার জন্য উপযুক্ত স্থান।”
হুমায়রা এক পলক সাদের দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। এমন সময় ফোন বেজে উঠে সাদের। তড়িঘড়ি করে কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। সাদ অপরাধীর মতো চুপ হয়ে যায়। ওপাশ থেকে কান্না মিশ্রিত নারী কণ্ঠে বলে উঠলো,
— “এটা তুমি করতে পারলে? আমার কথা একবার ভাবলে না?”
— “(——)”
— “কি হলো চুপ করে আছো কেনো? ওহ কথা বলার জন্য কিছু পাচ্ছো না বুঝি?”
— “এভাবে বলো না প্লিজ। আমার কথাটা শুনো।”
— “কি শুনবো তোমার কথা? আর কি বাকি রেখেছো তুমি?” কিছুটা রেগে বললো ওপাশের নারী।
— “আচ্ছা আমরা দেখা করি। তারপর বিষয়টা নিয়ে কথা বলবো। প্লিজ না করো না।”
— “(—–)”
— “আমরা যেখানে দেখা করতাম সবসময়। সেখানেই দেখা করবো দশটায়। তাড়াতাড়ি চলে এসো। এখন রাখছি।”
সাদ তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিলো। রুম থেকে বেরিয়ে ড্রয়িং রুমে আসতেই ডাইনিং-এ হুমায়রাকে দেখলো কাজ করতে। হুমায়রা সাদের দিকে তাকিয়ে বললো,
— “নাস্তা বানানো শেষ। আপনি কি আমার হাতের নাস্তা খাবেন? নাকি এতেও ঘৃণা হবে?”
সাদের এমনিতেই মাথা খারাপ হয়ে আছে। বারবার খাদিজার কান্না মিশ্রিত কণ্ঠ কানে প্রতিধ্বনি হচ্ছে। হুমায়রার এমন কোথায় আরো রেগে গেলো। চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
— “যে নারী নিজেকে ভোগের পণ্য বানাতে পারে তার হাতের কিছু খেলেই গা গুলাবে এটা স্বাভাবিক নয় কি?”
— “হু…। ঠিক বলেছেন আপনি।”
তারপর আর একটা কথাও বলেনি হুমায়রা। নিজের কাজে মন দিলো। সাদ বেরিয়ে গেছে। হুমায়রা একা একাই খেয়ে নিয়েছে। সাদের মা বিয়ে শেষ হবার সাথে সাথেই আবার গ্রামে চলে গেছেন। উনার এখানে ভালো লাগে না নাকি। তাই আর এখানে এলেন না। তবে হুমায়রাকে উনার খুব পছন্দ। অনেকদিন পর হুমায়রা পেট ভরে তৃপ্তি করে খেলো। ভীষণ ক্ষুদা থাকায় সাদের কোনো কথা মনে রাখেনি। মনে রেখেই বা লাভ কি? সাদ কি আসবে তার রাগ, অভিমান ভাঙাতে? না, কখনোই না। হুমায়রা এসব কারো কাছ থেকে আশাই করে না৷ এই সৃষ্টিকূলের সবার থেকে তার আশা উঠে গেছে। তার একমাত্র আশা, ভরসা তার রব।
দুপুরের রান্নাবান্না শেষে গোসল করে নামাজ পড়ে নিলো। তারপর একা একা দুপুরের খাবার খেলো। এখন একা একা লাগছে পুরো ঘরটায়। একবার ভাবলো ঘরটা ঘুড়ে দেখবে। পরে ভাবলো সাদ যদি এসে দেখে সে পুরো বাড়ি ঘুড়ে দেখছে তাহলে কি বকবে না? আবার ভাবলো সাদ আসলে রুমে চলে আসবে।
বাড়িটা বিশাল বড়। দুইতলা বিশিষ্ট ডুপ্লেক্স বাড়ি। নিচতলায় ড্রয়িংরুম, ডাইনিং স্পেস, কিচেন, গেস্টরুম দুইটা। আর উপরের তলায় চারটা বেডরুম। একটা বিশাল আকারের লাইব্রেরি। হুমায়রা লাইব্রেরি রুমে ঢুকে বুকসেল্ফের কাছে দাঁড়িয়ে খুশি হয়ে যায়। অনেক উপন্যাস, ইসলামিক বই আছে। হুমায়রার বই পড়ার খুব সখ। কিন্তু ভাবির কারণে সেসব কোনোদিন সম্ভব হয়ে উঠেনি। ক্লাস নাইন পাস করার পর ভাবি তার পড়ালেখা বন্ধ করে দিয়েছে। তারপর আর পড়া হয়নি। তবে হুমায়রা বাংলা পড়তে পারে গড়গড় করে। কুরআন তিলাওয়াত করে খুব মধুর সুরেলা কণ্ঠে। ইংলিশটা মোটামুটি পারে।
হুমায়রা আসরের নামাজ পড়ে আবার লাইব্রেরি রুমে ঢুকলো। সেল্ফের উপরের দিকের একটা বই ভীষণ পছন্দ হয়েছে তার। বইটার নাম হলো ‘নবীজির সংসার’। হুমায়রার অনেকদিনের ইচ্ছে ছিলো বইটা পড়ার। কিন্তু সুযোগ হয়ে উঠেনি। আর আজ যখন সুযোগ পেয়েছে হাত ছাড়া করতে চায়না। একটা চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে বইটা নিলো। নামার আগেই বাজখাঁই কণ্ঠের ধমক শুনে চেয়ার থেকে পড়ে গেলো হুমায়রা। পায়ের গোড়ালিতে আবার ব্যাথা পেয়েছে। কোনোরকমের উঠে বসে পায়ের গোড়ালি ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে। সাদ ভেতরে এসে বললো,
— “আমার কোনো জিনিসে হাত দিতে মানা করিনি তোমাকে? তাও কোন সাহসে তুমি এখানে এলে? আবার আমার সেল্ফের বইও নিলে।”
— “(——)”
— “চুপ করে আছো কেনো? কথা বলো ইডিয়ট।”
— “(—–)”
হুমায়রাকে চুপ দেখে সাদ রেগে ভালো করে তাকালো হুমায়রার দিকে। লক্ষ করলো মেয়েটা পায়ের গোড়ালি ধরে ফুপিয়ে কাঁদছে। সাদের মনটা একটু নরম হলো। হুমায়রা বুকসেল্ফ ধরে উঠে দাঁড়ায়। চোখের পানি মুছে সাদের দিকে তাকিয়ে বললো,
— “এতোবড় বাড়িতে একা একা ভালো লাগছিলো না তাই ভাবলাম এখান থেকে নিয়ে একটা বই পড়ি। বই পড়ার খুব সখ তো তাই। ক্লাস নাইনের পর আর পড়তে পারিনি। এসব বই পড়ে খুব আনন্দ পাই। তাই ভাবলাম….। দুঃখিত সাহেব। ভুল করে ফেলেছি। আর কোনোদিন আপনার অনুমতি ব্যতীত আপনার কোনো জিনিস স্পর্শ করবো না।”
হুমায়রা খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেটে বের হয়ে আসে লাইব্রেরি রুমটা থেকে। বারান্দায় নিজের নির্ধারণ করা সেই সোফায় গিয়ে বসে। ভীষণ ব্যাথা হচ্ছে গোড়ালিতে। ভাবি সেদিন যখন মারছিলো একটা পিড়ির বাড়ি পড়েছিলো পায়ের গোড়ালিতে। হুমায়রা সোফায় শুয়ে পরে। চোখ বন্ধ করে নিঃশব্দে কাঁদে। এই পৃথীবিতে সে বড় একা। দুই কাধের ফেরেস্তা আর আল্লাহ ছাড়া কেউ নেই তার।
পায়ের কাছে শক্ত হাতের স্পর্শে তন্দ্রা ছুটে যায় হুমায়রার। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। সাদকে তার পায়ের কাছে বসা দেখে অবাক হয়। দ্রুত পা গুটিয়ে নিতে চাইলে সাদ পা ধরে ফেলে। হুমায়রা ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে,
— “কি করছেন আপনি? পা ছাড়ুন। এভাবে পা ধরেছেন কেনো?”
— “তোমাকে ঘৃণা করি ঠিক কিন্তু মনুষ্যত্ব মরে যায়নি আমার। তাই মলম লাগিয়ে দিচ্ছিলাম।”
— “(——–)”
— “পায়ে এমন আঘাত লাগলো কি করে? দেখে তো মনে হয়না চেয়ার থেকে পরার কারণে এমন হয়েছে।”
— “(——)”
— “কি হলো চুপ কেনো? বাসায় ধরা পরে যাওয়ায় পা ভেঙে দিয়েছে তোমার মা তাইনা?”
— “আপনি কি আমার সম্পর্কে কিছু জানেন? নাকি না জেনে শুধু প্রতিশোধর নেশায় বিয়ে করেছেন?”
— “(—–)”
সাদের নিরবতা দেখে হুমায়রা বললো,
— “আমার বাবা-মা নেই। থাকলে হয়ত এমন দায়সারা ভাবে আমাকে…..। এই আঘাতের অন্য কারণ।”
হুমায়রা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সাদ কথা না বাড়িয়ে মলম লাগিয়ে দেয়। মলম লাগানো শেষে বললো,
— “কাল রাতের থাপ্পড়ের জন্য সরি। আমি কোনো নারীর গায়ে হাত তুলি না।”
— “কিন্তু কাল তুলেছেন। জীবনে প্রথম মনে হয় আমার গায়েই হাত তুলেছেন৷ যাই হোক আমি কিছু মনে করিনি। আর আমার মনে হয়না, আমার মনে করাতে কিছু যাবে আসবে।”
— “খেয়ে এই ওষুধ খেয়ে নাও। আর শাস্তির জন্য প্রস্তুত হও। এতো সহজে মাফ পাবেনা।”
— “কোনদিন আপনার প্রতিশোধর আগুন ঠান্ডা হবে জানতে পারি?”
— “সেসব তোমার না জানলেও চলবে।”
হুমায়রা কথা বাড়ায় না। সাদকে পাশ কাটিয়ে ডাইনিং রুমে চলে আসে। কিছু নাস্তা খেয়ে ওষুধ খেয়ে নেয়। মাগরিবের আযান পরতেই সাদ বেরিয়ে যায়। হুমায়রা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নামাযে দাঁড়িয়ে যায়। নামাজ শেষে সোফায় বসে হুমায়রা। সাদ আসলে বললো,
— “আমি কি আপনার বাসার কোর’আন পড়তে পারি?”
— “হ্যাঁ পারো। এখানে অনুমতি নেয়ার কি আছে?”
— “আপনিই তো বললেন আপনার কোনো জিনিস যেনো স্পর্শ না করি। তাই অনুমতি নিয়ে নিলাম।”
হুমায়রা উঠে কোর’আন নিয়ে বারান্দায় চলে গেলো। গুণগুণ করে কোর’আন তেলাওয়াত শুরু করে। সাদ বিছানায় শুয়ে ফেসবুক স্ক্রল করছিলো আর খাদিজার সাথে চ্যাটিং করছিলো। হুমায়রার তেলাওয়াত শুনে মোবাইল রেখে চুপ করে শুয়ে থাকে।
ঘুম থেকে উঠে নিজেকে বিছানায় পেলো সাদ। ঘড়ি দেখলো। সাড়ে আটটা বাজে। জামা’আত মিস হয়েছে। হুমায়রার মধুর কণ্ঠের তেলাওয়াত শুনতে শুনতে কখন চোখ লেগে এসেছে বুঝতেই পারেনি সাদ। সাদের মনের ভেতর প্রশ্ন জেগে উঠে,
— “সত্যিই কি এই মধুর কণ্ঠের তেলাওয়াতকারী নারী ছলনাময়ী? আমার কি কোথাও ভুল হচ্ছে? বিনা দোষে শাস্তি দিচ্ছি না তো মেয়েটাকে? কিন্তু রবিন যে বললো? ও কি মিথ্যে বলেছে তাহলে? উফ পাগল হয়ে যাবো।”
সাদ বিছানা থেকে নেমে পুরো ঘরে চোখ বুলালো। হুমায়রার কোনো অস্তিত্ব পেলো না। বারান্দায়ও পেলো না। রুমের বাইরে এসে দেখলো হুমায়রা বড় জানালাটার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। চেহারাটা খুব মলিন। মনে হয়, অনেক দুঃখ চেপে রেখেছে নিজের ভেতর। সাদের মনটা হাহাকার করে। কোন দিকে যাবে? কাকে বিশ্বাস করবে বুঝতে পারছে না। সাদের এক মন বলে উঠে,
— “প্রতিশোধ নেয়াটা কি খুব জরুরি? রাসূল (সাঃ) তাঁর জীবনে এতো কষ্ট পেয়েও কারো থেকে প্রতিশোধ নেননি। মুচকি হেসে ক্ষমা করে দিয়েছেন। সেই জায়গায় তুই তো সিউর না হুমায়রা এমন কাজ করেছে কিনা? অপর মন প্রতিবাদ করে বলে উঠল, আলবাত সে অপরাধী। তার থেকে প্রতিশোধ নেয়ার সিদ্ধান্তই উত্তম সিদ্ধান্ত। নাহলে এসব মেয়েরা পরে আরো বাড় বাড়বে।”
সাদ নিজের মাথা চেপে ধরে। মেজাজটা খিটখিটে হয়ে গেছে৷ সাদ এসব চিন্তা সাইডে রেখে এগিয়ে গেলো হুমায়রার দিকে। একটু দূরত্ব রেখে দাড়াতেই হুমায়রার কণ্ঠের তেলাওয়াত আবার শুনতে পেলো। হুমায়রা ‘সূরা মূলক’ তেলাওয়াত করছে। কি অমায়িক সেই কণ্ঠ। সাদ মনোযোগ দিয়ে শুনে তেলাওয়াত।
কারো উপস্থিতি টের পেয়ে চমকে তাকায় সেদিকে। সাদকে তার পাশে দেখে ভড়কে যায়। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। সাদ বললো,
— “এশারের ওয়াক্তের সময় আমাকে ডাকো নি কেনো?”
— “ডেকেছি আপনি উঠেন নি। খুব গভীর ঘুমে ছিলেন।”
— “হালকা ধাক্কা দিলে না কেনো?”
— “দিতে চেয়েছি। পর মুহুর্তে মনে হয়েছে আমার হাত আপনাকে স্পর্শ করার যোগ্যতা রাখে না।”
হুমায়রা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। সাদ হুমায়রার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে বললো,
— “অভিমান করতেও জানে। তোমার এই মায়াবী মুখটার পেছনের অস্তিত্ব এতো বিষাক্ত কেনো? এমন না করলে তোমাকে এই নরকে আনতাম না। এখানে তুমি শুধু দগ্ধ হবে। প্রস্তুত হও আঘাতের জন্য।”
নিরবতা কাটিয়ে সাদ বললো,
— “রাতের আয়োজনে কি আছে?”
হুমায়রা অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো,
— “আপনি কি বাসায় খাবেন?”
— “বাসায় না খেয়ে কোথায় খাবো?”
— “না সেটা নয়। আমার হাতের রান্না খেতে তো আপনার ঘৃণা হবে। তাই বলছিলাম।”
— “দুপুরে কি রেধেছো?”
— “শুটকির ভর্তা আর বেগুন রেধেছি।”
— “এখন মাংস রাধো। দেখি তোমার রান্না কেমন। একটু ঊনিশ বিশ হলে খবর আছে।”
— “খবর আর কি-ই বা করবেন৷ ওই মারধর।”
শেষের কথাটা বলে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেললো হুমায়রা। রান্নাঘরের দিকে হাটা ধরলো। সাদও পেছন পেছন গেলো। হুমায়রা ফ্রিজ থেকে মাংস বের করে ভিজিয়ে রাখলো। মসলা প্রস্তুত করলো। সাদ খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে রান্না। মাংসগুলো দই, আদা-রসুন বাটা, লবণ, মরিচ এবং অল্প লেবুর রস দিয়ে মেখে কিছুক্ষণ রেখে ভাজতে শুরু করলো। এরমাঝেই সাদের দিকে তাকিয়ে বললো,
— “আপনি এশারের নামাজ পড়বেন না?”
— “খেয়ে তারপর পড়বো। বেশ ক্ষুদা লেগেছে। ‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ তোমাদের কারো সামনে রাতের খাবার এসে গিয়েছে সলাতের ইক্বামাত হয়ে গিয়েছে। এমন অবস্থা হলে সে খাবার দিয়েই শুরু করবে। (অর্থাৎ- প্রথমে খাবার খেয়ে নিবে) আবার খাবার খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত সলাতের জন্য ব্যস্ত হবে না।'[১]
হুমায়রা আর কিছু বললো না৷ মন দিয়ে নিজের রান্না শেষ করলো। সবকিছু পরিবেশন করলো ডাইনিং টেবিলে। সাদ তাড়াতাড়ি হাত ধুয়ে খেতে বসে পরেছে। হুমায়রা সার্ভ করে দিলো। সাদ এক লোকমা মুখে দিয়েই বললো,
— “মাশাল্লাহ। দারুণ হয়েছে।”
সাদ খাচ্ছে। হুমায়রা দাঁড়িয়ে আছে। এটা সেটা এগিয়ে দিচ্ছে সাদকে। হুমায়রার দিকে তাকিয়ে বললো,
— “তুমিও বসে পরো। দাঁড়িয়ে থেকে এতো ফর্মালিটি মেইনটেইন করতে হবে না।”
— “না না ঠিকাছে। আপনি আগে খেয়ে নিন…।”
— “চুপ মেয়ে। যা বলেছি করো। আমার ঘরে আমার আদেশ চলবে। বসো তাড়াতাড়ি।”
হুমায়রা কথা না বাড়িয়ে সাদের অপর পাশে চেয়ারে বসে পরে। দুইজনে একসাথে খেয়ে নিলো। খাওয়া দাওয়া শেষে সাদ উপরে চলে গেলো নামাজ পড়তে। হুমায়রা সব কাজ শেষে রুমে গেলো। সাদের দিকে একবার তাকিয়ে ওয়াশরুমে গেলো। অজু করে বারান্দায় চলে গেলো। সোফায় শুতেই ঘুমিয়ে যায়।
নিজেকে শূন্যে অনুভব করে। চোখ মেলে তাকিয়ে আঁতকে উঠে হুমায়রা। নিজেকে সাদের এতো কাছাকাছি দেখে পুরো শরীর কেঁপে উঠে।
চলবে,,
~ “সতীন”
® “নাহার।”
_________________________
[১] রেফারেন্স, সহিহ মুসলিম ১১৩১।