কাঞ্জি #পর্ব-২৯ #সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)

0
15

#কাঞ্জি
#পর্ব-২৯
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)

পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের এবং গভীরতম সম্পর্ক হচ্ছে ভাই বোনের সম্পর্ক। একই মায়ের গর্ভে জন্ম নেওয়া মানুষের এই সম্পর্কটা সময়ের কালস্রোতে হয়ে যায় সবচেয়ে বিষাক্ত একটি সম্পর্ক। যেখানে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কথা না বলে, কারোর মুখ না দেখে দিব্যি কাটিয়ে দেয়। সামান্য বিষয় নিয়ে ভাই ভাই কিংবা ভাই বোনের মাঝে তৈরি হয় আকাশ সম দূরত্ব। শাহরিয়ার এবং ওয়াজিফার বিয়েটা কোনো সামান্য বিষয় না থাকলেও শাহরিয়ারের মা এবং মামার মাঝে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হলো।এর সম্পূর্ণ রাগ গিয়ে পড়লো আবৃতির উপর।এমনিতেই আবৃতি বিয়ের পর সবার সাথে নতুন করে তৈরি হওয়া সম্পর্ক নিয়ে চিন্তিত ছিল। উপরন্তু শ্বাশুরির এমন ব্যবহারে আর মিইয়ে গেল।শাহানা বেগম প্রথমে আবৃতির যখন তখন ফ্ল্যাট থেকে বের হওয়া বন্ধ করলো।ইচ্ছে হলেও সে নিচে আসতে পারে না। শাহরিয়ার এবং তার বাবা অধিকাংশ সময় বাসার বাইরেই থাকে।এটার সুযোগ নিয়েই গৃহ বন্দী করে ফেলল মেয়েটাকে।পাছে তার জন্য মা ছেলের সম্পর্কের আরো অবনতি হয়, এমন ভেবে আবৃতি নিজেও চুপ করে রইল।

একদিন বিকেল বেলা বাইরে যখন আধার ঘনিয়ে এসেছে, বর্ষার মেঘ জমেছে আসমানের বুকে ঠিক সেই মুহুর্তে আবৃতি বেরিয়ে এলো ফ্ল্যাট থেকে।শাহানারা বেগম তখন ঘুমোচ্ছিলেন। নিজ ফ্ল্যাটে তালা দেখে নিচে নেমে এলো।
নিচে দাদীর কাছে এসে জানতে পারলো রত্না বেগম নিজের বাবার বাড়িতে গিয়েছেন অদিতিকে সাথে নিয়ে।দাদীর পাশে বসে টুকটাক কথা বলছিল।মেয়েটার এলোমেলো চুল দেখে তার দাদী তেলের বোতল নিয়ে এসে বললেন,

“এখানে এসে বোস দেখি।চুলের কি হাল করেছিস?শোন প্রতি রাতে বেণী করে ঘুমাবি।”

কুসুম কুসুম গরম তেল এবং দাদীর আহ্লাদে ভীষণ ঘুম পেয়ে গেল তার। বাইরে তখন ঝুম বৃষ্টি। দাদীর কোলে মাথা রেখে বেশ কিছু সময় ঘুমিয়ে উঠলো সে। হাতের ব্যথাটা যেন টনটন করে উঠেছে। আজ পুরো ফ্ল্যাটের ফ্লোর নিজ হাতে দুই বার করে মুছতে হয়েছে। কাপড় দিয়ে বালতিতে পানি নিয়ে। একবার হলে সমস্যা হতো না কিন্তু দুই বার করে একই কাজ করার কারণে বেশ ক্লান্তি লাগছিল তার।

দাদীর থেকে বিদায় নিয়ে শাহরিয়ারের ফ্ল্যাটের সামনে এসে দাঁড়াতেই সেখানে তালা দেখতে পেল।ভ্রু কুঁচকে গেল তার। এই ঝুম বৃষ্টির মাঝে শাহানা বেগম কোথায় যেতে পারে?তাছাড়া শাহরিয়ারের আসার সময় হয়ে গেছে। খেয়াল করে দেখলো নিজের ফোনটাও তার কাছে নেই।পরবর্তীতে মনে হলো ফোন চার্জে ছিল।হঠাৎ করে ভয় লাগতে শুরু করলো তার। কিছু হয়নি তো? শাহানা বেগমের স্পষ্ট আদেশ ছিল যেন সে না বের হয়।তার কথার কারণেই প্রায় মাস খানেক বের হয়নি মেয়েটা। কিন্তু কতদিন বন্দী অবস্থায় থাকবে?

রাত দশটা পার হলেও যখন কেউ ফিরলো না তখন আবৃতির ভয় বাস্তবে রূপান্তরিত হলো। দাদীর ফোন দিয়ে শাহরিয়ারকে কল দিলো সে। দুই বার রিং হওয়ার পর শাহরিয়ার রিসিভ করলো।

“দাদী মা কে নিয়ে হাসপাতাল থেকে ফিরছি।এসে কল দিচ্ছি।”

আবৃতি এপাশ থেকে জবাব দেওয়ার পূর্বে কল কেটে গেছে।মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতে লাগলো মেয়েটা। এক অজানা ভয়ে তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।মনে হচ্ছে অদৃশ্য কোনো কিছু শুষে নিচ্ছে তার শরীরের সকল শক্তি।

গরম দুধ হাতে এবং পায়ে লেগে অনেকটা পুড়ে গেছে শাহানা বেগমের।ডাক্তার বলেছে ভাগ্যিস পানি দিয়েছিল না হলে গুরুতর ক্ষতি হতে পারতো। মাকে দুই হাতে ঝাপটে ধরে নিয়ে এসেছে শাহরিয়ার। প্রায় সবাই এখন শাহরিয়ারদের ফ্ল্যাটে দাঁড়ানো। অজানা কোনো এক ভয়ে আবৃতি দূরে দাঁড়িয়ে আছে।তার কথা বেমালুম ভুলে বসেছে শাহরিয়ার। মায়ের জন্য একরাশ চিন্তা তার চোখে মুখে ঘুরঘুর করছে।টাইয়ের নবটা ঢিলে গেছে। শার্টের হাতা গোটানো। এক গ্লাস পানি মায়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে তাকে নিজ হাতে ঔষধ খাইয়ে দিলো সে। শাহানা বেগম ঘুমিয়ে যেতেই সবাই এসে বসলো ড্রয়িং রুমে।আবৃতি তখনো দূরে দাঁড়িয়ে। ফয়সাল সাহেব শাহরিয়ারের বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন,

“কি করে এসব হলো?”

“চা বানাতে গিয়েছিল।ওটা গায়ে পড়েছে।”

“চা বানানোর জন্য দুই কেজি দুধ চুলাতে বসিয়েছিল?”

“ফ্রিজে না কি এমনি দুধ ছিল না। ডিপ করা প্যাকেটের দুধ ছিল। ওটা পুরোটাই চুলোয় বসিয়েছিল।এরপর না কি পাতিল কিছু হয়ে সব দুধ গায়ে লেগেছে।”

“তোরা হাসপাতালে নিয়ে গেলি অথচ বাসার আর কেউ জানলো না?”

“আবৃতিকে জিজ্ঞেস করেন দাদা।ওর তো বাসায় থাকার কথা ছিল।”

মায়ের এমন খবর শুনে শাহানারা ছুটে এসেছে। এসেই তার ক্ষোভ গিয়ে পড়লো আবৃতির উপর। ভয়ে মেয়েটার চেহারা পাংশু বর্ণ ধারণ করেছে। আবৃতিকে কিছু বলার পূর্বে শাহরিয়ার বলল,

“আমি বাসায় ফিরে দেখি মায়ের সারা গায়ে দুধ লেগে আছে।সে পা ধরে বসে বসে কান্না করছে।পায়েও বেশ লেগেছে।তোমাদের ডাকার মতো সময় হয়নি।মনে হয়েছে মায়ের চিকিৎসা আগে প্রয়োজন।”

“বেশ ভালো করেছিস।কিন্তু এখানে আবৃতির দোষ নেই।ও তো তখন তোর দাদুর সাথে ছিল।”

“কেন ও দাদুর সাথে থাকবে? মায়ের ছেলেকে পছন্দ অথচ মাকে পছন্দ না কেন?”

শাহানারার কথার ধরণে কিছুটা বিরক্ত বোধ করলেন ফয়সাল সাহেব। গলার স্বর কিছুটা উঁচু করে বললেন,

“শাহানারা, এটা কেমন কথার ধরন তোমার?ভদ্রতা সব ভুলে বসেছো?সম্পর্কে ও তোমার বড় ভাইয়ের স্ত্রী।”

“এজন্যই বলছি দাদা। ও যদি বাসায় থাকতো তাহলে তো মা নিজ থেকে চা বানাতে যেত না।এত কিছু হতোও না। চা না বানিয়ে দিলেও অন্তত মা যখন ব্যথা পেয়েছিল তখন সাহায্য করতে পারতো।কিন্তু ও ছিল না।বিকেলবেলা মা চা খায় এটা সবাই জানে। কি প্রয়োজন ছিল ওর তখন বাইরে যাওয়ার?আমাকে একটু বলবে?”

নাতনীর কথার কোনো জবাব দিতে পারলো না ফয়সাল সাহেব। ভদ্রলোক আবৃতির দিকে তাকিয়ে শাসনের সুরে বললেন,
“তুমি কেন বাইরে গিয়েছিলে?”

নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছিল মেয়েটার।দাদার ধমক শুনে প্রায় কেঁদে ফেলল সে। এক মন বলছিল শাহরিয়ার তাকে ভুল বুঝবে না। সবার প্রশ্নের মাঝে সে নিজে উত্তর হয়ে দাঁডাবে।আবার অন্য মন বলছিল আজকের এই ঘটনার জন্য তৈরি হবে দূরত্ব। আবৃতির ঋনাত্নক চিন্তাকে জিতিয়ে দিয়ে শাহরিয়ার বলল,

“এখন এসব কথা থাকুক।মা ঘুমাচ্ছে।দাদু তুমি বরঙ কয়েক দিন আবৃতিকে তোমার কাছেই রাখো।এখানে থাকার প্রয়োজন নেই।”

দাদু কিছুটা অবাক হয়ে বলল,

“বাড়ির বৌ শাশুড়ী অসুস্থতায় না থাকলে লোকে কি বলবে?তাছাড়া তোদের খাবার ব্যবস্থা কে করবে?দেখাশোনা কে করবে?”

“আমরা ম্যানেজ করে নিবো।তুমি ওকে নিয়ে যাও।”

আবৃতি কোনো প্রশ্ন উত্তর কিছুই দিতে বা করতে পারেনি।সে কেবল খেয়াল করছিল একটা মানুষের উপেক্ষা। শাহরিয়ার নামক মানুষটা কতোটা যত্ন নিয়ে তাকে উপেক্ষা করে চলেছে। একটা বার তার দিকে তাকালো না অবধি।কথা তো দূরে থাক। রত্না বেগম দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সবটা দেখলেন।এগিয়ে এসে মেয়ের হাতটা নিজের হাতে নিলেন।ধীরে ধীরে তাকে নিয়ে বেরিয়ে লিফটের দুইয়ে চাপলেন। নিজ ড্রয়িং রুমে মেয়ের মাথাটা নিজ বুকের সাথে ঠেকিয়ে কান্না জড়িত কণ্ঠে বললেন,

“আমি আজকের এই দিনটার ভয় পেয়েছিলাম। এ বাড়ির ছেলেরা যে খুব যত্ন করে কষ্ট দিতে জানে। তোর নিয়তিও কেন আমার পথে হাঁটছে?অথচ আমি তোকে বার বার নিষেধ করেছিলাম।মা হিসেবে আমি কি ব্যর্থ?”

চলবে (এডিট ছাড়া।দীর্ঘ দিন অসুস্থ এবং জন্ডিস রোগে আক্রান্ত। আপনারা হয়তো অনেকেই জানেন।নানান কারণে নিয়মিত হতে পারি না।তাই যারা গল্প পড়েন তারা রেসপন্স করবেন।অনুরোধ রইল)

#ছবিয়াল: ankitaww

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here