কাজললতা পর্ব ২৩

0
634

#কাজললতা
#লেখিকা_ইভা_আক্তার
#পর্ব_২৩

———————————————————————-
দেখতে দেখতে আজ আমার আর ইফতি ভাইয়ার বিয়ের এক সপ্তাহ হয়ে গেলো। আজ আমার আর ইফতি ভাইয়ার বিয়ের অনুষ্ঠান করা হয়েছে। অর্থাৎ আজ আমি আমার শশুড় বাড়ি তথা বড় চাচ্চুর বাড়ি চলে যাবো। বিয়ের অনুষ্ঠানটা মূলত সেন্টারে করা হয়েছে। সকল কাজিনরা মিলে পার্লারে এসেছি সাজতে। আমার পাশের চেয়ারে ইলমা বসে আইলাইনার দিচ্ছে। ইলমার ইচ্ছাতেই ও মেয়ে পক্ষ হয়ে যাবে বলেছে। আর ছোটো চাচ্চু ও নাহিল ভাইয়া বর পক্ষের সাথে আসবে। পার্লারের মেয়েরা আমাকে লিপস্টিক দিয়ে দিচ্ছিল তখনই আমার মোবাইল হাতে নিয়ে বসা তানিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে বললো,
– ইভা আপু ইফতি ভাইয়া কল করেছে বলছে তোমার ইভা আপুকে কলটা দাও।
ইফতি ভাইয়া কল করেছে শুনেই ইলমা আইলাইনার সড়িয়ে বলতে লাগলো,
– কিরে ইভা তুই দেখি আমার ভাইকে জাদু করেছিস। সারাটাক্ষন খালি ইভা আর ইভা। আর আজ তোদের বিয়ে তুই আমাদের বাড়ি চলে আসবি তবুও ভাইয়া তোকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে গেছে। বাহ কি ভালোবাসা।
ইলমার কথায় সকল কাজিনরা হাসতে লাগলো। আর এদিকে লজ্জায় আমার নাক মুখ লাল হয়ে গেছে। ফোনটা কানে নিয়ে “হ্যালো” বলতেই ওপাশ থেকে ইফতি ভাইয়া বললো,
– কেমন আছো কাজললতা?
– আলহামদুলিল্লাহ তুমি কেমন আছো?
– আলহামদুলিল্লাহ। তোমাদের সাজ শেষ হয়েছে?
– নাহ আর কিছুটা বাকি আছে।
– ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি চলে যেও।
– হুম তুমিও।
– ভালোবাসি কাজললতা।
– আমিও
– তুমিও কি?
– ওইযে যা বললে।
– কি বললাম?
বুঝতে পারছিলাম ইফতি ভাইয়া কি শুনতে চাচ্ছে। কিন্তু এতো এতো কাজিনদের মাঝে কি করে বলি সেটাই মাথায় আসছিলো না।
– আরে ইভা বলে দে তুইও ভালোবাসিস ভাইয়কে।
কানের কাছে ইলমার গলার স্বর পেতেই লাফিয়ে উঠলাম। ইলমার কথায় ইফতি ভাইয়াও হুট করে কলটা কেটে দিলো। হয়তো বা ইফতি ভাইয়া প্রচন্ড লজ্জা পেয়েছে।
– তু-তুই এখানে কি করছিস? তারমানে তুই এতোক্ষণ ধরে সব শুনছিলি?
– হ্যা রে। শুনছিলাম যে সদ্য বিবাহিত স্বামী-স্ত্রীরা ফোনে কি কি কথাবার্তা বলতে পারে। আর বুঝতে পারলাম বিয়ে করলে গম্ভীর আর জল্লাদ মানুষরাও রোমান্টিক হয়ে যায় যেমনটা আমার ভাই হয়ে গেছে।
ইলমার কথায় আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে রাখলাম। মেয়েটা যে এতোটা ঠোঁটকাটা স্বভাবেও হয়ে যাবে তা ভাবতেও পারি নি।
—————————————————————————-
সকলকে নিয়ে সেন্টারে উপস্থিত হলাম। ইলমা আর বাকি কাজিমরা আমাকে নিয়ে স্টেজে বসিয়ে দিলো। ভারি লাল রঙের লেহেঙ্গাটা পড়ে আমাকে যেমন গর্জিয়াস লাগছিলো তেমনি সুন্দর লাগছিলো। জানি ইফতি ভাইয়াকে দেখতে কেমন লাগছে।
– ইলমা দেখো বর এসে গেছে। তারাতাড়ি চলে এসো।
বর এসে গেছে শুনতেই চেহারাটা রক্তিম আকার ধারণ করলো। ইলমাও বর এসেছে শুনেই দৌড়ে গেটের সামনে চলে গেলো। স্টেজ থেকে গেটের সামনের জায়গাটা বেশ ভালো করেই বোঝা যাচ্ছিল। বরের গাড়ির পিছনেই প্রায় দশ-বিশটা বাইক দেখে সকলেই অবাক হয়ে গেলো সাথে ছিলো প্রায় দশটার মতো প্রাইভেট কার। বুঝতে পারলাম না এতোগুলো গাড়ি আর বাইক ইফতি ভাইয়াদের সাথে কি করে আসলো? বরের গাড়ি থেকে নামলো ব্ল্যাক কালারের সুট-প্যান্ট পড়া ইফতি ভাইয়া যাকে দেখে আমার নজর সেখানেই আটকে গেলো। সুট-প্যন্ট পড়ায় ইফতি ভাইয়াকে এতোটাই সুন্দর লাগছিলো যে আমার নজর সরছিলোই না। ইফতি ভাইয়াও কি আমাকে দেখে এভাবেই তাকিয়ে থাকবে? ইফতি ভাইয়ার পাশেই ছিল ছোটো চাচ্চু আর তার পাশে নাহিল ভাইয়া যার মুখোমুখি ছিল ইলমা। নাহিল ভাইয়াকে দেখার পর থেকেই ইলমা তার দিক এক পানে তাকিয়ে রয়েছে যা আমার চোখ থেকে এড়ায় নি। বাকি বাইক আর গাড়ি থেকে নামলো ইফতি ভাইয়ার মেডিকেলের সেই বন্ধুরা। বর পক্ষকে দেখেই কনে পক্ষের লোকেরা গেট আটকে ধরলো।
– দাড়াঁন দাড়াঁন। ভেতরে যাওয়ার আগে আমাদের মূল্যটা দিয়ে যান (খালাতো বোন)
– মূল্য? কিসের মূল্য? (ইফতি ভাইয়া)
– ওমা। আগে কখনো বুঝি বিয়েতে যান নি দুলাভাই?
– গিয়েছি কিন্তু নিজের বিয়েতে এই প্রথমই এসেছি একারণে মূল্যর কথাটা ঠিক জানিনা।
ইফতি ভাইয়ার কথায় উপস্থিত সকলে ভ্যবাচ্যাকা খেয়ে গেলো।
– হয়েছে হয়েছে। কারো গুণগাণ শুনতে আমরা চাই নি। এখন তারাতারি দশ লাখ টাকা বের করে আমাদের মূল্যটা দিয়ে দাও (ইলমা)
ইলমাট কথায় বর পক্ষের সকলের হার্ট অ্যাটাক করার অবস্থা হয়ে গেলো। ছোটো চাচ্চু তো বুকে হাত দিয়ে ধরলো।
– আয়হায় ভাতিজি এটা কি বললা?নাহিল এখনই প্রেস মিডিয়াকে কল করো। আমার এখনই চৌধূরী বাড়িট নামে মামলা করবো বিয়ে বাড়িতে চৌধুরী বাড়ির লোকেরা বর পক্ষের কাছ থেকে যৌতুক দাবি করছে।
ছোটো চাচ্চুর কথায় সকলে হাসতে হাসতে গরাগড়ি খেলো।
– এসব রং-ঢঙের কথা শুনতে চাই নি ছোটো চাচ্চু। এক্ষনি নগদে দশ লাখ টাকা বের করো নাহলে কনেকে শশুড় বাড়ি নিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা তার ধারে কাছেও ঘেষতে দেবো না (ইলমা)
– আচ্ছা দেব। দশ লাখ টাকাই দেব আর তার সাথে নগদে দশটা চরও দেব (নাহিল ভাইয়া)
নাহিল ভাইয়ার কথায় ইলমা দুই গালে হাত দিয়ে বললো,
– আমাকে চর দেবে? কবে থেকে নারী নির্যাতনের কাজ করা শুরু করেছো নাহিল ভাইয়া? (ইলমা)
– করি নি। কিন্তু এখন থেকে করবো ভাবছি।
– তাই নাকি? তাহলে আমিও দেখিয়ে দেব দেশে শুধুমাত্র নারী নির্যাতন নয় বরং পুরুষ নির্যাতনও হওয়া উচিত।
এভাবে কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে ইলমা আর নাহিল ভাইয়া একপাশে দাঁড়িয়ে ঝগরা করতে লাগলো আর বাকি কাজিনরা ঝগড়া করতে লাগলো বর পক্ষের লোকেদের সাথে।
– চর একমাত্র তুমিও না আমিও দিতে পারি মনে রেখো নাহিল ভাইয়া।
– তাই নাকি? দে। দিয়ে দেখ একবার।
– আমি কিন্তু সত্যি সত্যি চর বসিয়ে দেব বলে দিচ্ছি।
– ঠিক আছে দে। আমিও দেখিয়ে দেব কত ধানে কত চাল।
নাহিল ভাইয়ার কথা শেষ হতেই হুট করে ইলমা সকলের অগোচরে নাহিল ভাইয়ার গালে চুমু বসিয়ে দিলো। যেটা দেখে আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। আশেপাশে তাকিয়ে দেখি সকলেই বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত। নাহিল ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখলাম নাহিল ভাইয়া চোখ বড় করে একবাট আশেপাশে আরেকবার ইলমার দিকে তাকাচ্ছে।
– তুমি আমার বড়। একারণে চর তো দিতে পারি না তাই চুমু দিয়ে দিলাম।
কথাটা বলেই ইলমা সেখান থেকে দৌড়ে আমার পাশে বসে পড়লো। ইলমার মুখে ছিলো লজ্জামিশ্রিত হাসি।
– হাসছিস কেনো? (আমি)
– তেমন কিছু না। এমনি আর কি (ইলমা)
– ওহহ।
কনে পক্ষের সকলকে টাকা পরিশোধ করে অবশেষে ইফতি ভাইয়ারা ভেতরে ঢুকলো। ইফতি ভাইয়া এসে আমার পাশে বসতেই আমার সারা মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। ইফতি ভাইয়া আমার দিকে এক নজরে তাকিয়ে আছে। ইশশ লোকটার কি লজ্জা নেই? এভাবে সকলের সামনে কি কেউ তাকিয়ে থাকে?
ক্যামেরাম্যানরা বিভিন্ন পোজে আমার আর ইফতি ভাইয়ার ছবি তুলছে। সকলের অগোচরে ইফতি ভাইয়া আমার কানে ফিসফিস করে বললো,
– আমার কাজললতার মুখ থেকে তো আমি চোখ ফেরাতেই পারছি না। কি করি বলো তো? আমাকে এতোটা নির্লজ্জ বানানো কি তোমার ঠিক হলো?
ইফতি ভাইয়ার কথায় আমি লজ্জায় দ্বিগুণ লাল হয়ে গেলাম। সামনে তাকিয়ে দেখি নাহিল ভাইয়া একটা চেয়ারে বসে আছে। হুট করেই ইলমা নাহিল ভাইয়ার পাশের চেয়াের বসে পড়তেই নাহিল ভাইয়া জড়োসড়ো হয়ে বসে যায়। নাহিল ভাইয়া যে বেশ ইতস্তত বোধ করছিলো তা তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল।
– ওদের দুজনকে কতো সুন্দর লাগছে তাই না?
– হু হু
– ইশশ কবে যে আমিও আমার বরের সাথে এভাবে ছবি তুলবো কে যানে?
– হু হু
– আমারো খুব ইচ্ছে আমি আমার বরের হাত ধরে স্টেজে ছবি তুলবো।
– হু হু
– কি হু হু করে যাচ্ছো?
– না মানে ভালোই। একদিন হবে চিন্তা করিস না।
হুট করে ইলমা নাহিল ভাইয়ার হাত ধরে বললো,
– কিন্তু কবে হবে? কবে সে বুঝবে আমার মনের কথা? কেনো সে এতো বোকা?
ইলমার কথাগুলো নাহিল ভাইয়ার কানে ঢুকলেও মাথায় ঠিক ঢুকলো না।
-কার কথা বলছিস?
নাহিল ভাইয়ার কথায় কোনো উত্তর না দিয়ে ইলমা আমাদের ছবি তোলার দিকে তাকিয়ে বললো,
– একদিন সে বুঝবে আমি জানি। একদিন সে আমাকে খুব করে চাইবে। আর সেদিন আমাদের দুজনের মিলন হবে। আমাদের জীবনের নতুন পথ শুরু হবে ঠিক ওদের মতো।
নাহিল ভাইয়া ইলমার দিকে এক নজরে তাকিয়ে রয়েছে। আজ প্রথম হয়তো নাহিল ভাইয়া ইলমাকে এতোটা গভীরে পর্যবেক্ষণ করছে। এ্যাশ রঙের গাউনে ইলমার ফর্সা শরীর হয়তো বা একটু বেশিই সুট করেছে। ইলমার সৌন্দর্যে যেনো তার ওই বাদামী রঙের খোলা চুলও নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। ইলমার সৌন্দর্যে নাহিল ভাইয়াও নিজের অজান্তেই একটা হাসি দিয়ে দিলো।
—————————————————————————–
ছবি তোলা শেষ হতেই আমি আর ইফতি ভাইয়া বডলাম খাবার খাওয়ার জন্য টেবিলে। আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সকল কাজিনরা যারা আমাদের ছবি এবং ভিডিও করছে। ওয়েটাররা আমার আর ইফতি ভাইয়ার জন্য দুটো প্ল্যাটে খাবার দিতেই ইলমা চিৎকার করে উঠলো,
– আরে,,,,,,,,
ইলমার চিৎকারে আমরা সকলে ওর দিকে হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলাম।
– কি হয়েছে তোর এতো জোড়ে রাক্ষসের মতো চিৎকার করে উঠলি কেনো? (নাহিল ভাইয়া)
– আপনি বরং একটা প্লেটেই দুজনের খাবার বেড়ে দিন। ভাইয়া ইভাকে খাইয়ে দিবে (ইলমা)
ইলমার কথায় সকলে মুচকি হাসতে শুরু করলো। ওয়েটার ইলমার কথা অনুযায়ী একটা প্লেট ইফতি ভাইয়ার সামনে রাখতেই ইফতি ভাইয়া আমার মুখে এক নেলা খাবার তুলে ধরলো। আমি প্রচন্ড লজ্জামিশ্রিত মুখ নিয়ে খাবারটা মুখে নিলাম। আশেপাশের সকলে আমাদের দিকে মুগ্ধ নজরে তাকিয়ে রয়েছে আর বাকি সকল কাজিনরা ভিডিও আর ছবি তুলছে।
– নাহিক ভাইয়া শুনো (ইলমা)
নাহিল ভাইয়া আর ইলমা দুজনেই ভিডিও করছিলো তখনই ইলমা ফিসফিস করে নাহিল ভাইয়াকে ডাকে।
– হুম বল শুনছি।
– আমার বিয়েতে আমার হাসবেন্ডকেও কিন্তু ঠিক এভাবেই আমাকে খাইয়ে দিতে হবে নাহলে কিন্তু আমি শশুর বাড়ি যাবোই না।
-বেশ ভালো তো। তো সেটা তোর জামাইকে বলিস আমাকে বলছিস কেনো?
– জামাইকেই তো বলছি।
ইলমার কথায় নাহিল ভাইয়া অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। আর ইলনা আমাদের দিকে তাকিয়ে ভিডিও করেত থাকে।
তাহলে কি এবার আরে দুজনের মিল হবে? যারা একে অপরকে বুঝাট চেষ্টা করছে কিন্তু ঠিক খুঁজে পাচ্ছে না।
—————————————————————————
ইফতি ভাইয়ার বাড়িতে এসে ড্রেস চেন্জ করে ছাদে বসে আছি দোলনায়। বাবা- মার থেকে আজ সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে গেলাম। ভাবতেই বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। রাত প্রায় দেড়টার কাছাকাছি। আকাশের পানে চেয়েছিলাম তখনই ইফতি ভাইয়া এসে আমার পাশে বসলো।
– কি হয়েছে? মন খারাপ?
আমি মাথা নাড়িয়ে ইফতি ভাইয়ার কাঁধে মাথা রাখলাম।কেননা বাবা-মা ব্যতীত আমার পাশে বসে থাকা এই ব্যাক্তিটি যে আজ আমার জীবনের সবকিছু।
– আজ থেকে কাজললতার সকল দায়িত্বই তো আমার। তার হাসি-কান্না সবকিছুই তো আমার জীবনের সাথে মিশে রয়েছে। তাহলে কি করে কাজললতা নিজেকে একা ভাবলো?
– আমি নিজেকে কখনোই একা ভাবি না। আমার পাশে তুমি আছো। আর এটাই আমার সবচেয়ে বড় শক্তি
– তোমাকে অনেক বড় হতে হবে কাজললতা। তোমাকে একজন ডাক্তার হতে হবে। সকলের মাঝে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে। পাড়বে তো?
আমি ইফতি ভাইয়ার কাঁধ থেকে মাথাটা তুলে তার দিকে তাকিয়ে বললাম,

“ওহে মোর প্রেমিক পুরুষ,
তোমার সুখেই আমার সারাজীবনের সুখ।
যদি সুখে নাহি থাকতে পারি,
তাহলে এ কেমন ভালোবাসার রূপ!”

চলবে,,,,,,,,,,,,💜

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here