#কাছে_দূরে ??
#muhtarizah_moumita
#পর্ব___৫৯
রাত মধ্যপহরে এসে ঠেকলো। ঘন্টার পর ঘন্টা পেরিয়ে গেলো পেটে একটা দানাও পড়লো না হীরের। এতঘন্টা যাবত একই ভাবে বেঁধে থাকায় শরীর বিষ করতে লাগলো। তারউপর হাতে, গালে, কপালে কাটার ব্যাথা তো আছেই। মনিকার হাতে চড় খেয়ে তখনই ঠোঁট কেটে রক্ত ঝড়েছে। উত্তেজনার বসে তখন কিছুই মনে হয়নি। হাতের ছিলে যাওয়া জায়গাটায় রক্ত শুকিয়ে টনটন করছে। সর্বোপরি শরীরে তাপমাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে জ্বর এসেছে। চোখ দুটো ঝাপসা লাগছে। ঝাপসা দৃষ্টিতেই বন্ধ দরজাটার দিকে তাকিয়ে রইল। মন বলছে এখনই কেউ আসবে এ-ঘরে। কারোর উপস্থিত ধরার শক্তি আপাতত তার শূন্য হলেও মনের কথাই মিললো। সবার চোখের আড়ালে নিঃশব্দে ঘরে প্রবেশ করলো রোজ। সঙ্গে আরও কেউ আছে। তবে হীরের শূন্য দৃষ্টি বারবার মিলিয়ে আসতে চাইলে রোজকে ব্যতীত আর কাউকে দেখার ইচ্ছা হলো না। রোজ ভেতরে ঢুকতেই বাইরের মানুষটা রোজের ইশারায় দরজাটা বাইরে থেকে লক করে দিলো। রোজের একহাতে প্লেট ভর্তি খাবার। আর অন্য হাতে তার ফোন। ফোনে কিছু একটা টাইপ করে সেন্ট অপশনে ক্লিক করে পাশের বিছানার উপর রেখে দিলো। হীরের ক্লান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে ফ্যাকাসে মুখে হাসল। হীর হাসতে চেষ্টা করলো রোজের ন্যায়। কিন্তু ঠোঁট টেনে হাসতে নিলে টনটনে ব্যাথা করে ওঠে কাটা জায়গায়। তাই হাসার চেষ্টা বৃথা হয়। রোজ হীরের মুমূর্ষু অবস্থায় ব্যথিত হলো ভীষণ। সে আহত নয়নে হীরের আপাদমস্তক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। ঠিক পরীর মতো দেখতে মেয়েটাকে ওরা আঘাত করলো কেমন করে? ওদের কষ্ট হলো না একটুও? নিজের মনকে নিজেই এমন প্রশ্ন করে মনেমনেই আবার হাসল রোজ। মনকে বুঝালো ওরা মানুষ নাকি?
হীর শুঁকনো গলায় ঢোক গিলল। রক্ত শুঁকিয়ে টনটন করতে থাকা ঠোঁট দুটো জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে বলতে চেষ্টা করল,
—-‘ এ এএতো রাতে-
রোজ খাবারের প্লেট টা বিছানায় উপর রেখে একপ্রকার ছুটে এসে হীরের পায়ের কাছে বসে পড়লো। সাবধানী কন্ঠে বলল,
—-‘ শশশ.. কথা বলো না একদম। বাইরে ওরা পাহারা দিচ্ছে। বারবার এদিকটাতে এসে দেখে যাচ্ছে। আমাদের কথা শুনতে পেলে কিন্তু কেলেঙ্কারি ঘটে যাবে। প্লিজ কথা বলো না!’
হীর কিছু বলতে নিয়েও চুপসে যায়। ঢোক গিলে বন্ধ দরজার দিকে একবার তাকায়। তার শরীর আর তার সঙ্গ দিচ্ছে না। বারেবারে ঢলে পড়ছে। তবুও শক্ত থাকার চেষ্টা করছে। রোজ হীরের অবস্থা দেখে হাত বাড়িয়ে তার কপালে রাখল। মুহুর্তেই চমকে উঠে বলল,
—-‘ ও গড! তোমার তো খুব জ্বর।’
রোজের চমকে ওঠার ভঙ্গিতে হীরও চমকে উঠলো। রোজ দ্রুত হীরের বাঁধন খুলে দিতে লাগলো। হীর অবাকের শীর্ষে পৌঁছে কিছু বলতে নিলেই রোজ তার শরীরে সব বাঁধন খুলে দেয়। হীর মুক্ত হতেই ঢলে পড়লো রোজের দিকে। রোজ হীরকে ঝাপটে ধরে সামলে নিলো। কোনো রকম ধরে ধরে হীরকে বিছানার কাছে নিয়ে আসতেই হীরের ক্লান্ত শরীর ভর ছেড়ে দিলো। হীর চোখ বুঁজে নিলো। রোজ চমকে উঠলো এই ভেবে যে হীর অজ্ঞান হয়ে গেলো কিনা? কিন্তু না। রোজের ভয় কাটিয়ে হীর চোখ মেলে তাকালো রোজের দিকে। মৃদুস্বরে বলল,
—-‘ শরীরের আঘাতের থেকে মনের আঘাত বেশি রোজ। তাই শরীর টা এমন মিইয়ে পড়েছে। যখন মনিকে দেখিনা? ঠিক মাকে মনে পড়ে যায়! মনে হয় এই মানুষ টা আমার মা। আর আমার নিজের মা আমার উপরে এতটা টর্চার করছে সেটা ভাবলেই আমি ভেতর ভেতর নিঃশেষ হয়ে যাই। উপরওয়ালার কাছে আমার ভীষণ অভিযোগ, আমার মায়ের খুনিকেই কেন আমার মায়ের রূপ দিয়ে পাঠালো? কেন?’
রোজ হীরের মাথায় হাত রাখল। হীরের প্রত্যেকটা কথা তার বুকের ভেতর ঝড় তুলে দিয়ে যাচ্ছে। সত্যিই তো, কনিকার খুনিকে কেন কনিকার রূপই দেওয়া হলো? যখন দেওয়াই হলো তখন দুটো মানুষের চরিত্র কেন একই রকম হলো না? আর যখন চরিত্রও এক হলো না তখন কেন একজনের মৃত্যুর কারন অন্যজন হলো?
হীরের চোখের কোন চিকচিক করে উঠলো নোনাজলে। হীর কান্নাগুলো গিলে খেতে ঢোক গিলল। তার গলা কাঁপছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে! এই মুহুর্তে তার প্রিয় মানুষ টাকে ভীষণ প্রয়োজন। সাবাবকে তার ভীষণ প্রয়োজন। সাবাব একমাত্র ভরসা তার। সাবাব পাশে থাকলে সে সব কিছু করতে পারবে।
রোজের চোখের কোনটাতেও চিকচিক করছে জলে। হীর লক্ষ করলো রোজও কাঁদছে। হীর অবাক চোখে তাকালো রোজের দিকে। রোজের থুঁতনি কাঁপছে। সে হয়তো এখনই ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে ফেলবে। কিন্তু না, রোজ কাঁদল না। কান্নার বেগ চাপতে সে ঠোঁট কামড়ে ধরলো। ঢোক গিলে এদিকে ওদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে টেনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। হীর তার হাতের উপর হাত রাখতেই সে হাসার চেষ্টা করে বলে উঠলো,
—-‘ খ খাবার! তোমার জন্য খাবার এনেছি। খেয়ে নাও।’
হীর পাশেই রাখা প্লেট ভর্তি খাবার দেখে মৃদু হাসল। বলল,
—-‘ রোজ খেয়েছে?’
রোজ আকস্মিক বিস্ময় নিয়ে তাকালো হীরের দিকে। যেন হীর বড় কোনো ভুল করে ফেলেছে। হীর রোজের এমন দৃষ্টিতে ভড়কে গেলো। অপরাধী দৃষ্টিতে রোজের মুখ চেয়ে কিছু বলতে নিলে রোজ তার মুখের কথা কেঁড়ে নিয়ে বলল,
—-‘ ক কি বললে?’
হীর বিস্মিত কন্ঠে বলল,
—-‘ না মানে.. তুমি খেয়েছো কি না জানতে-
রোজ হেসে পড়লো। উত্তেজনায় তার শরীর কাঁপছে। দু-হাতে মুখ ঢেকে পুরো মুখ একবার মালিশ করে বলল,
—-‘ আমি তোমায় খাইয়ে দিবো আপু?’
‘আপু’ ডাকটা হীরের মস্তিষ্ক স্পর্শ করতেই এক অদ্ভুত কাঁপন সৃষ্টি হলো হীরের শরীরে। হীর চোখ দুটো বড় বড় করে তাকিয়ে বলল,
—-‘ রোজ..ত তুমি আমাকে আপু বলে ডাকলে?’
রোজ হেসে পড়ে আমোদিত কন্ঠে বলল,
—-‘ তুমি তো আমারই বোন। আমার বড় বোন। বড় বোনকে তো আমরা বাঙালিরা আপু বলেই ডাকি। কি তাইতো?’
হীর তার সমস্ত ব্যাথা ভুলে লাফিয়ে উঠে বসল। রোজকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেয়ে হাসতে হাসতে বলল,
—-‘ একদমই তাই। তুই তো আমারই বোন। আমার নিজের বোন।’
রোজ হীরের কপালে কাটা স্থানে চুমু খেয়ে আহত কন্ঠে বলল,
—-‘ জানো আপু? এই যে এক্ষনি তুমি আমাকে প্রশ্ন করলে না, আমি খেয়েছি কি না? এই ছোট্ট প্রশ্নটা কতগুলো বছর ধরে মম আর ড্যাডের থেকে আশা করতাম। সামান্য একটা প্রশ্ন! কিন্তু কখনও এই সামান্য একটা প্রশ্নই ঐ মানুষ দুটো আমাকে করতে পারেনি। আরে আমি এই কথা কেন বলছি? ওরা তো কখনও আমাকে এই প্রশ্নটাই করেনি যে, আমি ভালো আছি কি না? কখনও কাছে টেনে মায়ের মমতা,বাবার স্নেহ দেয়নি। কেবল আমায় তারা জন্ম দিয়েছে। তবে সেটাও অবৈধতার মধ্যে দিয়ে।’
শেষ কথাটা বলেই হেসে পড়ল রোজ। হীরের ভ্রু যুগল কুঁচকে এলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রোজের মুখের ভাবভঙ্গি মাপলো। ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
—-‘ অবৈধ ভাবে! মানে? এসব তুই কি করে জানলি?’
রোজ নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বলল,
—-‘ আমি আরও অনেক কিছু জানি। তোমায় সব বলবো। আগে খেতে হবে তোমায়। এসো আমি খাইয়ে দেই।’
হীর জবাব দিলো না। সে কেবল তাকিয়ে রইলো রোজের রক্ত শূন্য মুখের দিকে। রোজ বেশ উৎসাহ নিয়ে নিজের হাতে খাবার তুলে দিলো হীরের মুখে। হীর নিঃশব্দে খেতে লাগলো। হীর শক্ত চোয়ালে খাবার চিবোতে চিবোতে ভাবল, সত্যিইতো! রোজ মনি আর রেজার অবৈধ সন্তান। এখানেও তাদের ভয়ানক একটা প্ল্যান ছিলো! একজনকে ফাঁসাতে গিয়ে তারা নিজেদের ফাঁদে নিজেরাই পা দিলো। অতঃপর ফেঁসেও গেলো। আর শেষ অব্দি এসে তাদের উদ্দেশ্য যখন একই ছিলো তখন দু’জনে মিলে গিয়ে এক হয়ে গেলো। মনি যখন জানতে পারল সে প্রেগন্যান্ট তখন তারা দু’জনে বিয়ে করে নেয়। ন’মাস ঘুরতে রোজের জন্ম হয়। মনি সব ক্ষেত্রে অমানবিক কাজ করলেও রোজের বেলায় তা করেনি। টানা দুটো বছর সে রোজকে লালনপালনে সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করে। রোজের যখন দু’বছর বয়স তখন মালয়েশিয়া রোজকে শিলার ভরসায় রেখে গিয়ে রিয়াদ, কনিকা,তাইয়্যেবা আর মালিকে খুন করে আসে।
খাবার শেষ করে হীরকে জল দিলো রোজ। হীর জল খেতে খেতে রোজকে প্রশ্ন করল,
—-‘ আমার বাবাকে তুই কি করে চিনলি? বাবা-মা যখন খুন হয় তখন তো তুই খুব ছোট। দু-বছর চলে তোর। আর আমি তখন চারবছরের ছিলাম। মনি,রেজা আর আজিম আহমেদ বাবা-মা,তাইয়্যেবা ম্যাম আর মালিকাকাকে যখন খুন করে তখন তো তুই এখানেই ছিলি। শিলার কাছে। আর তখন তুই- মানে তখন জানলিই বা কি করে? আর জানলেই কি? তোর সেই দু-বছর বয়সের কথা মনে থাকবে কি করে?’
রোজ হীরকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
—-‘ আরে অতটুকু বয়সে আমি এতসব জানলেও কি মনে রাখতে পারবো নাকি?’
—-‘ এক্স্যাক্টলি-
—-‘ হুম। আমি জেনেছি অনেক পরে। তখন আমি মোটামুটি একটা পরিপূর্ণ বয়সে উঠেছি। চারপাশে কি হয়, কি চলে সবটাই মাথায় ধারন করার বুদ্ধি আমার তখন হয়েছিলো। রিয়াদ স্যার ড্যাডের খুব ক্লোজ ফ্রেন্ড ছিলেন। সব সময় দেখতাম ড্যাড বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে একটা এওয়ার্ড ফাংশনে যেতো। মমও যেতো বাবার ওয়াইফ হিসেবে। সেখানে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রিয়াদ আহমেদকে প্রতিবছর এওয়ার্ড দেওয়া হতো। এজ আ বেস্ট ব্রিগেডিয়ার হিসেবে। আর তার প্রতি যে অন্যায় হয়েছে, তাকে যেভাবে মার্ডার করা হয়েছে সবটাই তার সিনিয়ররা জানতেন। তাই পরে তারা দিগুন সম্মান দিতেন। উনাকে বেস্ট সম্মাননায় ভূষিত করতেন তারা। আর ড্যাড যেহেতু তার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো তাই রিয়াদ স্যারের নামের যত এওয়ার্ড হতো সবই ড্যাডকে দেওয়া হতো। ড্যাডও ইমোশনাল হয়ে কিছু স্পিচ দিতো স্টেজে দাঁড়িয়ে। আর বাকিরা সেই ইমোশনাল স্পিচ শুনে ইমোশনাল হয়ে পড়তে। এমন টা আমি ছোট থেকেই দেখতে দেখতে বড় হয়েছি। তাই কেবল একটা নাম আমায় সারাজীবন ধরে তাড়না করে বেড়াতে লাগলো। মন শুধু প্রশ্ন করতো কে এই রিয়াদ আহমেদ। যাকে পুরো মালয়েশিয়া বলতে গেলে এক নামে চেনে। আমি নিজের কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আদ্রিক কে জানাই। আদ্রিকের পরিবার বাংলাদেশে থাকে। আদ্রিক পড়াশোনার জন্য মালয়েশিয়া আসে। আমি তখন সেভেন স্ট্যান্ডার্ড। তখন ওর সাথে আমার পরিচয়। আমরা খুব ক্লোজ ছিলাম। আদ্রিক ওর সব কথা আমাকে বলত আর আমার সব কথা আমি ওকে বলতাম। আদ্রিক আমার পারিবারিক কথা শুনে আমার সাথে আরও ক্লোজ হয়ে পড়ে। আদ্রিক যবে থেকে আমার লাইফে এসেছে তবে থেকে আমি আর একা নই। রিয়াদ স্যারের ব্যাপরটা আমি ওকে টেন স্ট্যান্ডার্ডে উঠে বলি। ও আমাকে সব ধরনের সাহায্য করতে শুরু করে। রাতের পর রাত খেটে আমরা জানতে পারি রিয়াদ স্যারের মার্ডার হওয়ার পেছনে আমার নিজের মম ড্যাড জড়িত। সেদিন আমি বেঁচে থেকে যেন মরে গেছিলাম আপু। আমার মম ড্যাড এত বড় একটা ক্রাইম করেও কেমন স্বাভাবিক ভাবে চলাফেরা করছে সেটা ভাবতেই আমি বাকরূদ্ধ হয়ে পড়তাম। তাদের মাঝে কোনো অপরাধ বোধ ছিলো না। তাই ভাবলাম ওদের সাথে এই ব্যাপারে কোনো কথা বলে লাভ নেই। বরং আমি এটা খুঁজে বের করি যে কেন তারা রিয়াদ স্যারকে মেরেছে? আমি আবারও কাজে লেগে পড়ি। কারন উদঘাটন করতে থাকি কেন তারা মরলো। একটা সময় পর জানতে পারি মম রিয়াদ স্যারকে ভালোবাসত। ভালোবাসা না পাওয়ার কারনে তারা তাকে মেরে ফেলেছে। এর থেকেও বড় ধাক্কাটা খাই তখন যখন জানতে পারি মম ভালোবাসা না পাওয়ার ক্ষোভে নিজের বোনকেও মেরেছে। একটার পর একটা সিক্রেট সামনে আসতে লাগল। আর আমি নিজেকে তাদের দু’জনের থেকে গুটিয়ে নিতে লাগলাম। জানোতো আপু, প্রায়ই মম আর ড্যাডকে তর্কাতর্কি করতে দেখতাম একটা নাম নিয়ে। ‘হীর’! ওরা হীর নামে কাউকে নিয়ে প্রচন্ড ঝগড়া করতো। আমি কান পেতে শুনতাম। মম বলতো সে হীরকে বাঁচতে দিবে না আর ড্যাড বলতো সে হীরকে এতো সহজে কিছুতেই মরতে দিবেন না। বুঝলাম এখানেও দু’জনের ভয়ানক স্বার্থ লুকিয়ে আছে। কথা শুনে যা বুঝলাম হীর নামের মানুষ টা এখনও বেঁচে আছে। তাই প্রানপন চেষ্টা করতে লাগলাম হীরকে বাঁচাতে। তোমার নামে ইন্টারনেটে এত এত খোঁজ করার চেষ্টা করেছি যে হিসেব নেই। কখনও একটা সেকেন্ডের জন্যও কোনো তথ্য বের করতে পারিনি। এদিকে মম ড্যাডের সাথে তুমুলঝগড়া করে বাংলাদেশে গিয়েছে তোমার ক্ষতি করার জন্য। ড্যাড চেয়েও মমকে আটকাতে পারেনি। অবশেষে আমি উপায় অন্তর না দেখে ইচ্ছে করে এক ভয়ানক এক্সিডেটন্ট করলাম। যেন মম ফিরে আসে বাংলাদেশ থেকে। যেমন ভাবলাম ঠিক তেমনটাই হয়েছিল। মমকে ফিরিয়ে আনতে পেরেছি। জানিনা এর মধ্যে মম তোমার কতগুলো ক্ষতি করতে পেরেছে। মম মালয়েশিয়া ফিরে আবার ছক কষতে বসে তোমাকে মারার। তবে এবার আর কিছু করলো না। ড্যাড মমকে বুঝালো, ‘রিয়াদ স্যারের বংশের সকল গুপ্তধন,সোনা-দানা, সম্পত্তি সব এখন হীরের কাছে। হীরকে তো অবশ্যই মারবো কিন্তু তার আগে এসব হাসিল করে নেই তারপর তোমার যেভাবে ইচ্ছে তুমি ওকে মেরো। আমি বাঁধা দিবো না’। মম মেনে নিলো ড্যাডের কথা। এরই মধ্যে খবর এলো সাবাব নামে কেউ তাদের ডিটেইলস নেওয়ার জন্য পাঁচ জন ব্রিগেডিয়ারকে মালয়েশিয়া পাঠিয়েছে। এই খবর পেয়ে ড্যাড নতুন প্ল্যান করলো। ফাঁদ পাতল। আর সেই ফাঁদে ঐ মেয়ে দুটোকে আঁটকে কিডন্যাপ করে নিয়ে এলো। প্ল্যান মতো তোমায় মালয়েশিয়া আনালো। আর অবশেষে তাদের প্ল্যান সাকসেসফুল করতে তোমাকেও কিডন্যাপ করল। হয়তো কালই তোমার থেকে সব কিছু আদায় করে নিয়ে তোমাকেও মনির মতো মেরে ফেলবে। কিন্তু আমি থাকতে ওদের এই মনস্কামনা কখনও পূরন হতে দিবো না। দরজার বাইরে আদ্রিক আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে আপু। আদ্রিক কে রেখে এসেছি আমি। তুমি চলো আমার সাথে। আমি তোমাকে এখান থেকে মুক্ত করবো। আর শুনো,এখান থেকে মুক্ত হয়ে এখনি বাংলাদেশের ফ্লাইট ধরবে। ফিরে যাও আপু। বাংলাদেশে ফিরে যাও তুমি।’
হীর এতক্ষণ যাবত রোজের কথা গুলো নির্বিকার ভঙ্গিতে শুনলো। কিন্তু কিছু বলল না। তবে শেষের কথাটা শুনে স্মিত হাসল হীর। রোজের দুগালে হাত রেখে আদুরে কন্ঠে বলল,
—-‘ বোনের প্রতি এতো ভালোবাসা হু?’
রোজ হীরের কথায় আহত চোখে তাকালো। হীরের হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
—-‘ তোমাকে কোনোদিন না দেখে যতটা ভালোবেসেছি আপু, ততটা বোধহয় আজ অব্দি মম-ড্যাডকে বাসতে পারিনি। তুমি, মনি আর রিয়াদ স্যার! তোমাদের তিনজনকেই আমি ভীষণ ভালোবাসি আপু। তোমাদের জন্য যদি আমার জীবনটাও উৎসর্গ করে দিতে হয় আমি দিবো। তবুও কোনোদিন মম ড্যাডের হাতে তোমাকে বলি হতে দিবো না। তুমি চলো আমার সাথে।’
এই বলে হীরের হাত ধরে টানতে লাগলো রোজ। রোজের কান্ড দেখে হীর রোজকে থামাতে চেষ্টা করে বলল,
—-‘ না রোজ। এভাবে হবে না। আমি এতদূর এসে এভাবে মুখ লুকিয়ে চলে যেতে পারবো না। আমাকে যে প্রতিশোধ নিতেই হবে। তুই যদি আমাকে সত্যি সাহায্য করতে চাস তবে আমি যা বলি তোকে তাই করতে হবে।’
—-‘ আমি তোমাকে সব ভাবে সাহায্য করবো আপু কিন্তু আমি তোমাকে এই নরকে আর এক মুহূর্তও রাখবো না। কিছুতেই না। দেখো ওরা তোমার কি হাল করেছে! তুমি এভাবে অত্যাচার সইতে থাকলে তো-
—-‘ মরব না রে পাগলি। তুই তো আছিস। তুই থাকতে আমি মরবো না। পারবি না বোনকে একটু প্রটেক্ট করতে?’
—-‘ জান দিয়ে প্রটেক্ট করবো আপু। বলো কি হেল্প করতে হবে? ‘
হীর স্মিত হেসে রোজের মাথায় হাত বুলিয়ে আহ্লাদী কন্ঠে বলল,
—-‘ এই তো আমার লক্ষী বোন। শোন, তুই এখন আমায় পুনরায় চেয়ারে বেঁধে দিবি। ঠিক আগে যেমনটা ছিলো।’
—-‘ নো ওয়ে আপু! আমি তোমায় আবারও-
—-‘ উফ! কথার মাঝে কথা বলছিস কেন? কি বলি আগে পুরোটা তো শোন। এমন ভাবে বাঁধবি যেন মনি আর রেজার কোনো ভাবে সন্দেহ না হয়। তবে এর মধ্যে একটা টুইস্ট থাকবে। আমাকে উপর থেকে দেখলে মনে হবে, ঠিক আগের অবস্থাতেই আমি আছি। কিন্তু আসলে সেরকমটা থাকবে না। বরং আমাকে তুই বাঁধবিই না। এর মধ্যে যেকোনো একজনকে এ-ঘরে পাঠাতে হবে। হয় মনি নয়তো রেজা। যেই না কেউ এ-ঘরে প্রবেশ করবে তুই বাইরে থেকে দরজাটা লক করে দিবি। আমি ভেতর থেকে আচমকা তার উপর এট্যাক করে আমার জায়গায় তাকে বেঁধে ফেলব। আর তার মাধ্যমে অন্যজনকে ফাঁদে ফেলে তাকেও বাঁধব। আর তারপর হবে আসল খেলা। কি? পারবি তো?’
হীরের প্রশ্নে রোজ হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে কাজে লেগে পড়ল। হীরকে আবারও চেয়ারে বেঁধে দিল। রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নিলে হীর রোজকে ডেকে উঠে বলল,
—-‘ রোজ! তোকে আরেকটা কাজ করতে হবে!’
রোজ পেছন মুড়ে বলল,
—-‘ কি কাজ?’
—-‘ তরী আর কিরন কে যেকোনো ভাবে এখান থেকে মুক্ত করতে হবে। আর ওর টিম মেম্বারদের কাছে ওদের পৌছে দিতে হবে।’
রেজ হীরকে আস্বস্ত করে বলল,
—-‘ এক্ষনি কাজে লেগে পড়ছি আপু। ততক্ষণ তুমি নিজের খেয়াল রেখো।’
হীর স্মিত হেসে বলল,
—-‘ সাবধানে বোন।’
রোজ হীরের ন্যায় স্মিত হেসে চলে গেলে।
#চলব___