#কাছে_দূরে ??
#muhtarizah_moumita
#পর্ব___৬১
—-‘ আ,,ম আমাকে ছেড়ে দাও হীর! ম,,মনিকা ম্যাডামের এসবের পেছনে আমার কখনই কোনো ভূমিকা ছিলো না!’
শিলার আকুতি ভরা থেমে থেমে আসা কন্ঠে হীর লম্বা করে নিঃশ্বাস নিলো। যেন শিলার কষ্টে হীরের শান্তি লাগছে। ভীষণ আনন্দ হচ্ছে তার। হীর ঠোঁটের কোনে বাঁকা হাসি এঁটে এগিয়ে গেল শিলার পানে। হীরের মুখের হাসি আর তার এগোনে দেখে শিলার আত্না চিরচির করে উঠলো। শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল কিছু নেমে গেলো। শিলা মনে মনে মেনে নিলো সে আর বাঁচবে না। হয়তো হীর তাকে এক্ষনি মেরে ফেলবে। শিলা আতংকে থরথর করে কাঁপছে। হীর শিলার মুখোমুখি হয়ে তার চেয়ারের উপর দু-হাত দিয়ে ভর দিয়ে দাঁড়ালো। শিলা ঢোক গিলে গলা ভেজালো। ভয়ে তটস্থ হয়ে উঠলো শিলা। হীরকে কি করে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ওর হাত থেকে বাঁচা যায় তার একটা পাকাপোক্ত বুদ্ধি বের করতে হবে।
—-‘ ওহ,তাই নাকি! কিন্তু আমার জানামতে তো তুমি মনির ছোট থেকেই তার প্রত্যেকটা খারাপ কাজে সঙ্গ দিয়ে এসেছো। ইভেন, নানাভাই আর নানুমনি যখন মা আর মনিকে মালয়েশিয়া পাঠাচ্ছিলো পড়াশোনা করার জন্য তুমি তখনও মনির সাথে ছিলে। মনির সাথে মালয়েশিয়া অব্দি চলে এলে। মনির সাথে তোমার অ্যাটাচমেন্ট এতোইটাই ডিপ ছিলো যে মনি রিয়াদ আহমেদকে তার ছোটবোনের প্রেমিক হিসেবে সহ্য করতে পারতোনা সে খবরও তোমার জানা ছিলো। প্রত্যেকটা ক্রাইম মনি তোমায় না জানিয়ে করত না। আর একমাত্র তুমিই ছিলে যে কিনা কখনও মনির কোনো ক্রাইম কে ক্রাইম ভাবতে না। তুমি মনিকে আরও উৎসাহ দিতে। আচ্ছা আমায় একটা কথা বলোতো, এসব করে তোমার কি মিলতো? তোমার প্রাপ্তি কি ছিলো? মনি কি তোমাকে এর জন্য টাকা দিতো? উঁহু! টাকা তো দিতো না! তাহলে? কি ছিলো তোমার প্রাপ্তি? বলো?’
হীর শেষ কথাটা দাঁতে দাঁত চেপে বলতে বলতে শিলার বাঁধা হাতে বল প্রয়োগ করে। শিলা ব্যাথায় মুচড়ে যাচ্ছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে চেষ্টা করছে,
—-‘ আ,,মার ক,,ককোনো প্রাপ্তি ছিলো নাহহ! আ,,মার শুধু মনিকার কাজ গুলো করতে ভালো লাগতো। মনিকা কাজের শেষে আমাকে যে বাহবা দিতো আমার স,,সেটাই ভালো লাগতো।’
হীর শিলাকে ছেড়ে দিয়ে হুহা করে হেসে উঠলো। শিলা চোখ বুঁজে নিয়ে নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো। তার শরীরে আর এই অত্যাচার কুলচ্ছে না। আর তারউপর শান্তশিষ্ট ভদ্র স্বভাবের একটা মেয়ের এমন ভয়ানক রূপ! সেটাই শত্রুকে অর্ধেক কাবু করে ফেলতে পারে।
হীর হাসি থামিয়ে রোজের দিকে তাকালো। রোজ অবাক চোখে হীর আর শিলার কথা শুনছে। আচমকা হীরকে হাসতে দেখে তার বিস্ময় বেড়ে গেলো। প্রশ্নবিদ্ধ মুখ করে হীরের দিকে তাকাতে হীর বলে উঠল,
—-‘ কি ভাবছিস বোন? শিলা সত্যি সত্যি এসব কিছু তোর মমের খুশির জন্য করত?’
রোজ সন্দিহান চোখে শিলার দিকে তাকিয়ে বলল,
—-‘ না আপু। আমার কেন যেন শিলার কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না। কারন ওরা প্রত্যেকে স্বার্থের জন্য সবটা করছে। আর তার মধ্যে শিলা একা নিঃস্বার্থ হতে পারেনা।’
রোজের কথা শুনে হীর হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। ঠোঁটের কোনে বাঁকা হাসি এঁটে বলল,
—-‘ ওর এসব করার পেছনে কারন ছিলো ফরহাদ রেজা। তাই না শিলা?’
হীরের মুখে ফরহাদ রেজার নাম টা শুনতেই পিলে চমকে উঠলো শিলার। তার শান্তিতে নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় যেন ফুরিয়ে এসেছে। রোজ আর সাবাবের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। কি বলল এটা হীর। মনিকার ডান হাত শিলার নজর কিনা মনিকার হাজবেন্ডের দিকে। কি করে সম্ভব!
রোজ বিস্ফোরিত চোখে তাকালো শিলার দিকে। আগুন ঝরা কন্ঠে বলল,
—-‘ কালপ্রিট!’
হীর রোজ কে থামিয়ে দিয়ে বলল,
—-‘ রিলাক্স বোন। কাহানী মে টুইস্ট হ্যায়!’
সাবাব আর রোজ একসাথেই বলে উঠলো,
—-‘ টুইস্ট!’
হীর শিলার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
—-‘ হ্যাঁ টুইস্ট। বড়সড় রকমের টুইস্ট। শিলা রেজাকে প্রথম থেকেই পছন্দ করত। কিন্তু নিজের সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে কখনও এই কথা সে কাউকেই বলতে পারেনি। না মনিকে আর না রেজাকে। শিলা জানত সে সৎ পথে থেকে কখনই রেজাকে কাছে পাবেনা। তাই শিলা অসৎ পথটাই বেছে নিলো। মনি আর রেজার বিয়ের পর শিলা তার বিকৃত মস্তিষ্কের দ্বারা রেজাকে কব্জা করে নেয়। রেজাও ছিলো মেয়ে পিপাসু রাক্ষস। তাই শিলার কুপ্রস্তাব তার কখনও মন্দ লাগেনি! রেজাও শিলার কুপ্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়। শিলা এবং রেজা মনির আড়ালেই ওদের এসব নোংরামি চালিয়ে আসছে বছরের পর বছর। মনি কখনও এর আন্দাজও করতে পারেনি। আর মনি যেন সন্দেহও না করতে পারে তারজন্য শিলা তারপর থেকে আরও বেশি করে মনির সঙ্গ দিতে থাকে। শিলা ভাবত মনির এসব কুকর্মের জন্য মনি একাই ফেঁসে যাবে। তার পেছনে কে বা কারা কলকাঠি নাড়ে সেটা হয়তো সামনে আসবেনা।’
শিলার চোখ জোড়া কোটর ছেড়ে বেড়িয়ে আসতে চাচ্ছে অতিরিক্ত ভয়ে। হীর এতসব কিছু কি করে জানলো! যে কথা আজ অব্দি স্বয়ং মনিকা জানতে পারল সে কথা অব্দি এই পুঁচকে মেয়ে কি করে জানতে পারে?
হীর শিলার গতিবিধি নিরীক্ষন করতে করতে তার কপালে রিভলবার ঠেকালো। শিলা আতংকে কেঁপে উঠে চিৎকার করতে নিলেই হীর শিলার দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে বলল,
—-‘ চেঁচালো একটার জায়গায় দুটো গুলি বের হবে। আর দুটোর জায়গায়? চারটা!'(ফিসফিসিয়ে)
প্রান সংকটে পড়ে শিলার মুখের রং পাল্টে গেলো। সে চেঁচাতে গিয়ে একশবার ভাবতে লাগলো। সে এখন যাই করবে হীর তাকে সেটার জন্যই শাস্তি দিবে। আর একমাত্র শাস্তি হলো তার মৃত্যু।
—-‘ হ,,হীর! হ,,হীর আমায় ছেড়ে দা—
লোড করা রিভলবার চালিয়ে দিলো হীর! পরপর তিনটে গুলি বেরিয়ে ঝাঁঝড়া করে দিলো শিলার কপাল। রোজ এবং সাবাব দু’জনেই চমকে উঠল হীরের কাজে। কারন তারা এই মুহুর্তে এমন কাজের সাক্ষী হওয়ার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। শিলার কপালের রক্ত ছিটকে এসে হীরের শরীর মাখামাখি করে দিলো। শিলাকে মৃত অবস্থায় দেখে হীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুরে দাঁড়ালো। এখনও তিনটে খুব বাকি! কিন্তু নিজেকে এখনই বড় ক্লান্ত লাগছে হীরের। হীর দু-কদম ফেলে আকস্মিক ধপ করে বসে পড়লো ফ্লোরে। হীরকে বসে পড়তে দেখে রোজ আর সাবাব দৌড়ে এসে ধরলো তাকে। হীর ক্লান্ত দৃষ্টি মেলে দেখলো সাবাবের অস্থির দৃষ্টি। সাবাব হীরের দুর্বল চাহনি দেখে অসহায় কন্ঠে বলল,
—-‘ তোমার রেস্ট দরকার হীরপাখি।’
পেছন থেকে রোজও কিছু একটা বলল। কিন্তু হীরের কানে এসে সে কথা পৌঁছালো না। তার শরীর ক্লান্তিতে ভেঙে আসতেই সাবাবের বুকে মাথা ঠেকালো। অতঃপর আর কিছু মনে নেই।
____________
ভোরের আলো ফুটতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল মনিকা। ঘুমের ঘোরেও কেমন অস্বস্তিতে হাসফাস করছিলো তার শরীর-মন। মনে হচ্ছিল যেন সবটা শেষ হতে চলেছে। তার মৃত্যু ঘনিয়ে আসতে চলেছে। হীর যা ভয়ানক আচরন করেছে তাতে যা কিছু হওয়া সম্ভব। মনিকা নিজের মনকে বুঝিয়ে বিছানা ছাড়লো। কোনোমতে ফ্রেশ হয়ে বাংলাদেশে কল করল। আজিম সাহেব কল তুললেন। আজিম সাহেবকে সবটা বলে মনিকা মালয়েশিয়া আসতে বলল। আজিম সাহেব সবটা শুনে ঘাবড়ে গেলেন। এবার কি সে তার ছেলের হাতে ধরা পড়বে? তিনি মনে মনে প্রার্থনা করলেন এমন কাজ হওয়ার আগে যেন তার মৃত্যু হয়।
মনিকা কল কেটে নীচে চলে গেলো। রাতে খাওয়াদাওয়া না করেই ঘুমিয়ে গেছে। এখন কিছু না খেলেই নয়। মনিকা ডাইনিং এ এসে ফলপাকড় কিছু কেটে খেতে খেতে রান্না ঘরে চলে গেলো। রান্না ঘরে পা রাখতেই যেন ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। রান্নাঘরের বেসিনে দাঁড়িয়ে কফি বানাচ্ছে হীর। মনিকা গগনবিদারী চিৎকার করে দেয়ালের সাথে লেপ্টে গেলো। তাড়াহুড়ো করে এখান থেকে দৌড়ে বেরিয়ে যেতে নিলেই হীর হাতের গরম কফিটা ছুঁড়ে দেয় মনিকার দিকে। গরম কফিটা মনিকার গালে লাগতেই ঝলসে যায় তার মুখের একপাশ মনিকা প্রচন্ড জ্বালাপোড়ায় হুমড়ি খেয়ে নিজে পড়ে যায়। তার শরীর অবস হয়ে আসতে শুরু করে। নীচে পড়ে কাতরাতে লাগল সে। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পুরো বাড়ি মাথায় করে ফেললেও তার চেলারা কেউ এসে তাকে সাহায্য করছেনা। বরং এক এক করে তার সামনে এসে দাঁড়ায় মীর,তরী,কিরন,আভিক,মাহদী, ইভান এবং সাবাব। আর তাদের পেছনে এসে দাঁড়ায় রোজ এবং আদ্রিক। সামনের মানুষ গুলোকে দেখেই মনিকার রুহু বেরিয়ে আসার উপক্রম তাই পেছনের দু’জনকে আর দেখতে পেলো না। তরী আর কিরন মনিকাকে হেঁচকা টেনে দাঁড় করায়। মনিকা আকুতি ভরা কন্ঠে তাকে ছেড়ে দিতে বলে কিন্তু কেউ আর তার আকুতি মিনতি শোনার ইচ্ছে প্রকাশ করেনা। সবাই মিলে মনিকাকে নিয়ে একটা রুমে চলে যায়। সেখানেই মনিকাকে বেঁধে রেখে বেরিয়ে যায় সবাই। বাইরের থেকে দরজায় তালা দিয়ে সবাই আরেক রুমে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।
খানিক বাদে রেজাও নেমে আসে নীচে। মনিকার চিৎকার অবশ্য সে শুনেছে। মনিকাকে নিয়ে সে চিন্তিত না হলেও ফর্মালিটির জন্য তাকে খোঁজ করতেই হবে। হাতে চশমাটা মুছতে মুছতে চোখে পড়ে বার কয়েক হাক পাড়ল ‘মনি’ বলে। কিন্তু কোন সাড়াশব্দ পেলো না। তাই একটু চিন্তা হতে লাগলো। চারপাশে চাতক পাখির মতো দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখলো মনিকা কোথাও নেই। আস্তেধীরে হেঁটে এসে ডাইনিং টেবিলের কাছে দাঁড়ালো। সব কিছু যেন স্তব্ধ হয়ে আছে। কিছু হচ্ছে না তবুও যেন মনে হচ্ছে চোখের আড়ালে অনেক কিছু হয়ে যাচ্ছে। রেজা জগ থেকে জল ঢালল গ্লাসে। গ্লাস টা হাতে উঠাতে উঠাতে চারপাশে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতে লাগল। জলটা মুখে নিয়ে কয়েক ঢোক গিলতেই ঘাড়ের মধ্যে ফ্যাচ করে শব্দ করে কিছু একটা বিঁধে গেলো যেন। রেজার দম বন্ধ হয়ে গেলো। শরীরের ভার ছেড়ে দিলো। নীচে গড়িয়ে পড়তেই পেছন থেকে সামনে এসে দাঁড়ালো হীর। রেজার মুখোমুখি বসে ফিসফিসিয়ে বলল,
—-‘ হ্যাপি বার্থডে রেজা।’
রেজা দম ছেড়ে দিলো। চোখ থেকে গড়িয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়তেই চোখ বুঁজে নিলো সে। হীর হাসতে হাসতে হাসতে উঠে গেলো। পেছন থেকে আভিক,মাহদী আর ইভান এসে তাকে তুলে নিয়ে গেলো।
#চলব___