#কাছে_দূরে ♥️
#muhtarizah_moumita
#পর্ব_১২♥️
সকাল ৮টা। হীরের কেবিনে ঢুকতেই প্রথমে যে জিনিসটা সাবাবের পথ আটকায় সেটা হলো একটা সোফা। তার নরম গদিতে যে আসে সেই একবার আয়েস করে জিরিয়ে নিতে ভুলে না। কিন্তু এখনও অব্দি সেই নরম গদিতে বসতে দেখা যায়নি সাবাবকে। গতকাল নার্সের লজ্জা পাওয়ার কাহিনি বেশ কিছুক্ষন চললেও শেষ অব্দি সাবাবের আর রিপোর্ট করা হয়ে উঠল না তার বিরুদ্ধে। সে মনে মনে ভেবে নিয়েছে এটা একটা নরমাল ব্যপার। যা প্রতিনিয়ত খুব স্বাভাবিকভাবে তার সাথে ঘটতে থাকে। মেয়েটাও সেরকমই একজন। তাকে নিয়ে এতো গুরুত্ব দিয়ে ভাবার কিচ্ছু হয়নি। তাই সেসব ভুলেই ফ্রেশ মনে ঢুকে আসছিলো হীরের কেবিনে। কিন্তু প্রতিবারের মতো সোফার শক্ত পায়া এবারও সাবাবের পথ আটকালো। দরজা ডিঙিয়ে ভেতরে পা রাখতেই সোফার শক্ত পায়ায় তার পা আঁটকে গেলো। যার দরুন সে আকস্মিক হোঁচট খেয়ে পড়তেই সামনে এসে মূর্তিমান হয়ে দাঁড়ালো সেই নার্স মেয়েটা। তার ধারনা ছিলো সাবাব হোঁচট খেয়ে পড়তেই সে তাকে ধরে ফেলবে আর এখানে তৈরি হবে একটা রোমান্টিক মুহুর্ত। যাতে করে তাদের একটা চোখাচোখির ব্যাপার ঘটার অনেক সুযোগ আছে। আর যদি আরেকটু গভীরে ভাবা হয় তবে হৃদয়ঘটিত ব্যাপারটায় দু’জনেই আঁটকে যাওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু লোকমুখে একটা কথা হয়, ‘তুমি যা ভাবো সেটা কখনও তোমার সাথে ঘটবেনা। বরং যা ঘটবে সেটা তুমি কখনও কল্পনাও করতে পারবে না।’
নার্স মেয়েটার বেলাতেও বিপরীত কিছু ঘটেনি। সাবাব তার উপর পড়ল ঠিকই কিন্তু বেচারি হ্যাংলা পাতলা শরীর নিয়ে সাবাবের ভার সামলাতে পারল না। দু’জনেই খুব বিশ্রীভাবে নীচে পড়ে গেলো। ছ’ফুট লম্বা সেই সাথে সুঠাম দেহের অধিকারী একটা ছেলে নার্স মেয়েটার মতো এমন চিকনেশ্বরী কোনো মেয়ের উপর পড়লে খুব স্বাভাবিক ভাবেই চ্যাপ্টা লেগে যাওয়ার ভয় আছে। মেয়েটা নীচে পড়তেই মৃত্যুর দুয়ার কেমন ভয়ংকর বুঝে এসেছে। নীজের উপর সাবাবের ভার সইতে না পেরে বিকট চিৎকার দিয়ে পুরো হসপিটাল মাথায় তুলে ফেললো। সাবাব আতংকিত নয়নে পরিস্থিতির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। অসহায় মুখ করে তার নীচে আঁটকে যাওয়া বেচারী নার্স মেয়েটার দিকে তাকিয়ে লাফ মেরে উঠে গেলো! মেয়েটার থেকে দশহাত দূরত্ব নিয়ে ছুটে গেলো মায়ের কাছে। মায়ের পেছনে দাঁড়িয়ে অসহায় কন্ঠে বলল,
—-” আমি কিছু জানিনা মা।”
মেয়েটা এখনও চ্যাপ্টা লেগে নীচে পড়ে আছে। নাজমা বেগম এমন কান্ডে হাসবেন নাকি কাঁদবেন বুঝে উঠতে পারলেন না। কিন্তু সানিয়া নিজের হাসিটাকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারল না। পুরো ঘর কাঁপিয়েই হেসে ফেললো সে। হীরকে ঔষধ দিতে নেওয়া অন্য নার্স মেয়েটা নীচে পড়ে থাকা মেয়েটার অবস্থা দেখে চোখ জোড়া রসগোল্লা করে তাকিয়ে আছে। কয়েক মুহুর্তের মধ্যে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পটা এখনও সে তার মাথায় ধারন করে উঠতে পারল না। তাই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েই আছে। হীর কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে নার্স মেয়েটার দিকে। বেশি আলগা ভালোবাসা দেখানোর ফল কি হতে পারে সেটা অবশ্যই এবার এই মেয়ের শিক্ষা হয়েছে। শিক্ষা হয়ে থাকলে আর কখনও সে সাবাবের সামনে আসবে না। গাল ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ফেলল হীর। পরিস্থিতিটা সামাল দেওয়ার জন্য নাজমা বেগম দাঁড়িয়ে থাকা নার্স মেয়েটার উদ্দেশ্যে বললেন,
—-” দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি দেখছো? মেয়েটাকে তুলো? আর দেখো ক’খানা হাড়-গোড় আস্ত আছে আর ক’খানা গিয়েছে।”
মায়ের কথা শুনে আবারও হাসিতে ফেটে পড়ল সানিয়া। হাসতে হাসতে বলল,
—-” দাঁড়াও আমি হেল্প করছি তোমায় গুনতে… না মানে ওকে তুলতে।”
সানিয়া আর অন্য নার্স মেয়েটার সাহায্যে হাত ধরে নিজের ভাঙাচোরা হাড়গুলো জোড়াতালি দিয়ে কোনো রকমে উঠে দাঁড়ালো। কাঁদো কাঁদো মুখ করে সবার দিকে একবার তাকিয়ে বলল,
—-” আমার কোমরের হাড়গুলো বোধহয় সব গুঁড়িয়ে গিয়েছে। কেউ প্লিজ আমায় একটু এক্স-রে রুমে নিয়ে চলো। বেঁচে থাকতে একটা এক্স-রে করিয়ে দেখি।”
সানিয়া মুখ টিপে হাসতে লাগল। মেয়েটা কাঁদো কাঁদো মুখ করে সানিয়ার দিকে তাকাতেই সানিয়া হাসি থামাতে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
—-” আমি তোমায় নিয়ে যাচ্ছি চলো।”
মেয়েটা ঘাড় কাত করল। অন্য নার্স মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল,
—-” তুইও একটু চল প্লিজ!”
অন্য নার্স মেয়েটা ফিসফিস করে বোকা গলায় বলল,
—-” বেশি ফালালে এই হয়। বলেছিলাম না তোকে।”
মেয়েটার কথা সানিয়ার কান অব্দি ঠিক ভাবে না এলেও নার্স মেয়েটা বুঝল। তাই ঠোঁট কুঁচকে অসহায় কন্ঠে বলল,
—-” যা বলার বেঁচে থাকলে আরেকদিন বলিস। এবার তো চল।”
অন্য নার্স মেয়েটা আর কথা বাড়ালো না। সানিয়া আর সে মিলে মেয়েটাকে ধরে ধরে নিয়ে গেল এক্স-রে রুমে।
তাদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে নাজমা বেগম হেসে উঠে বললেন,
—-” মেয়েটা দেখি তোকে দেখে আর চোখ ফেরাতে পারেনা!”
নার্স মেয়েটা সানিয়ার সাথে বাইরে চলে গেছে নিশ্চিত হতেই মায়ের পেছন থেকে সরে এসে পাশে দাঁড়ালো সাবাব। নিশ্চিন্ত কন্ঠে বলল,
—-” এখন থেকে আর ভুলক্রমেও তাকাবে না দেখে নিও।”
ফিক করে হেসে দিলেন নাজমা বেগম। হীরের মুখে আরেক চামচ স্যুপ তুলে দিয়ে বললেন,
—-” যে কান্ড ঘটল।”
সাবাব মায়ের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলো। আঁড়চোখে একবার হীরের দিকে তাকাতেই সর্ব-পরিচিত হীরের কুঁচকানো কপালের সুক্ষ ভাজের দেখা মিলল। হীরের মনে কি চলছে ব্যাপারটা আরেকটু ভালো ভাবে খতিয়ে দেখার জন্য তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো হীরের দিকে। নাজমা বেগম কথায় কথায় আবারও এক চামচ স্যুপ হীরের মুখের সামনে ধরতেই হীরে বাঁধ সাধল। খাবেনা বলে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। সাবাব ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মনে মনে বলে উঠলো,
—-” আর ইউ জেলাস হীরপরি?”
নাজমা বেগম অধৈর্য্য গলায় বললেন,
—-” খাবেনা কি বলছো? তুমি জানো তোমার সুস্থ হতে এই মুহুর্তে তোমার শরীরে কতটা এনার্জি দরকার? আর সেই এনার্জি গুলো পেতে হলে তো খেতে হবে মা? না করে না লক্ষিটি। এই টুকুতো শেষ করতে হবে!”
—-” খেতে ইচ্ছে করছে না।”
হীরের মনের মধ্যে আগুন জ্বলছে। সেটা বুঝতে পেরেই সাবাব মিটমিটিয়ে হাসতে লাগল। মাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
—-” মা না খেতে চাইলে রেখে দাও না। নার্স এসে না হয় কিছুক্ষণ বাদে আবার ওকে খাইয়ে দিবে। তুমি এক কাজ করো। এটা রাখো আর আমার সাথে এসো। কাল রাতে আমার হোয়াটসঅ্যাপে একটা মেয়ের ছবি পাঠিয়েছে। মেয়েটা দেখতে মাশাআল্লাহ। আমার ভালোই লেগেছে। দেখোতো তোমার কেমন লাগে?”
সাবাবের কথায় যেন শরীরের মধ্যে আগুন জ্বলে উঠলো হীরের। নাজমা বেগম ছেলের ডাকে উঠে যেতে নিলেই হীর শক্ত গলায় বলে উঠলো,
—-” আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে বড় মা! আমাকে না খাইয়ে কোথায় যাচ্ছো তুমি? স্যুপটা খাওয়া শেষ হলেই কিন্তু আমি ফ্রুট জুসটা সব খাবো। আর তারপর ঐ যে আপেল রাখা, কমলা রাখা, আর ওটা কি….”
—-” আনারস!”
হীরের কথার মাঝে বা হাত ঢুকিয়ে বলে উঠলো সাবাব। হীর জলন্ত চোখে সাবাবের দিকে তাকাতেই সাবাব দাঁত কেলিয়ে হাসল। যা দেখে হীর আরও জ্বলে উঠলো। সাবাবকে পাত্তা দিবে না এমন একটা ভঙ্গিমা করে আবারও বড়মার উদ্দেশ্যে বলতে লাগল,
—-” হ,,হ্যাঁ আনারস…. সব খাবো কিন্তু আমি। তাই তুমি আপাতত কোথাও যাবে না।”
হীরের হঠাৎ খাওয়ার প্রতি এতো আগ্রহ দেখে খুশিতে চকচকে দাঁতের হাসি দিলেন নাজমা বেগম। স্যুপের বাটিটা আবারও হাতে তুলে হীরকে খাওয়াতে ব্যস্ত হয়ে ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
—-” আমার এখন সময় নেই তোর হোয়াটসঅ্যাপের ছবি দেখার। আমি এখন আমার মেয়েকে খাওয়াবো। তুই যা তো। গিয়ে দেখে আয় নার্স মেয়েটার কি হলো? ঠিক আছে নাকি সত্যি সত্যিই হাড়গোড় ভেঙ্গেছে।”
সাবাব নার্সের কাছে যাবে শুনেই আবারও জ্বলে উঠল হীর। মনে মনে রাগে ফুঁসতে লাগল সে। এবার কি করে আঁটকাবে সে। স্যুপটা কোনো রকম গিলে আমতাআমতা করে বলে উঠলো,
—-” য,,যাওয়ার দরকার কি বলোতো? আপি আছে না ও ঠিক ম্যানেজ করে নিবে। দ,,দেখে নিও।”
সাবাব হাসতে লাগল মনে মনে। সাবাবের সাথে জড়িয়ে যাবে এমন কোনো মেয়েকেই যে হীর সহ্য করতে পারছে না সেটা বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারল সাবাব। আঁড়চোখে হীরের মুখের ভাবভঙ্গি দেখে বাকিটাও নিশ্চিত হয়ে গেলো। তাই তাকে আর না জ্বালিয়ে ঔষধের বক্স নিয়ে বসে পড়ল ছোট্ট মোড়াটায়। ঔষধ গুলো উল্টে পাল্টে তার লাস্ট ডেট এবং পাওয়ার চেক করতে লাগল। হাঁটুর উপর ঔষধের বক্সটা রেখে বেশ মনোযোগ দিয়ে ঔষধ গুলো দেখার মাঝে হীরের মনোযোগ বাধ্য হলো সাবাবের উপর আটকাতে। সাবাব পুরো পরিপাটি হয়েই এসেছিলো হসপিটালে। হলুদ রঙের শার্টের শর্ট হাতা টাইট হয়ে চেপে আছে সাবাবের শক্ত পেশীতে। বোতামগুলো বেশ ভদ্র ভাবে আঁটকে আছে লোমশ বুকে। মাথার উপর ঘোরা সিলিং ফ্যানের বাতাসে বারবার উঁকি ঝুঁকি মারে তারা। হীর আচমকা লজ্জায় পেলো। তার বুকের ভেতরটা হঠাৎই কেঁপে উঠলো। একটা মানুষকে এভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা মোটেও উচিৎ নয়! যাকে দেখা হচ্ছে সে যদি ভুলবসতোও বুঝতে পারে তাহলে লজ্জায় কখনও তার মুখোমুখি হতে হবে না আর।
—-” সাবাব? বাবা ফ্রুটসটা ভেঙে গ্লাসে ঢালতো। আমি একটু আসছি বাইরে থেকে। মেয়েটার জন্য এবার চিন্তা হচ্ছে। একবার দেখেই এসে পড়ছি। মামনি? আমি একটু যাচ্ছি আর আসছি কেমন?”
হীর মাথা নেড়ে সম্মতি দিতেই উঠে বাইরে চলে গেলেন নাজমা বেগম। সাবাব মায়ের আদেশে ফ্রুটস ভেঙে গ্লাসে ঢালতে লাগল। হীরের ইচ্ছে হলো সাবাবকে হোয়াটসঅ্যাপের মেয়েটা সম্মন্ধে জিজ্ঞেস করতে। কিন্তু সাহসে কুলালো না। শুঁকনো মুখে ঢোক গিলে চুপচাপ বসে রইল। সাবাব গ্লাসে ফ্রুটস ঢেলে বলল,
—-” হাত দিয়ে তো খেতে পারবি না। আমি খাইয়ে দিবো?”
হীর তাকালো না সাবাবের দিকে। আর জবাবও দিলো না। সাবাব হীরের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত স্বরে বলল,
—-” কি হলো? কথা বলছিস না কেন? এই এক্ষনি মায়ের সাথে তো দিব্যি কথা বললি! তাহলে আমার বেলাতেই এমন চুপচাপ ভাব কেন?”
হীর শুঁকনো গলায় ঢোক গিলল। মনে মনে বেশ সাহস জুগিয়ে কাচুমাচু করে বলল,
—-” ম,,মেয়েটাকে কি তোমার সত্যি খুব ভালো লেগেছে ভাইয়া?”
আচমকা এমন প্রশ্নে সাবাব কিছু টা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। একটু আগে নিজের মুখেই বলা কথা গুলো সব গুলিয়ে খেয়ে ফেলে অবাক কন্ঠে বলল,
—-” কোন মেয়েটাকে?”
হীর শুঁকনো ঠোঁট জোড়া একবার জিহ্বা দিয়ে ভেজালো। অতঃপর সাবাবের দিকে একবার তাকিয়ে পূনরায় দৃষ্টি মাটিতে রেখে বলল,
—-” হোয়াটসঅ্যাপের মেয়েটাকে!”
হীরের অস্বস্তি মাখানো কন্ঠে বলা কথাটায় সাবাবের টনক নড়ল। হঠাৎই মনে পড়ল সে হীরকে আরেকটু জেলাস ফিল করাতেই মাকে মিথ্যে কথা বলেছিলো। যেটা শুনতেই হীর আরও জ্বলে উঠে পুরে স্যুপটা খাওয়া সম্পূর্ণ করে আরও অনেক খাবার খাবে বলে আস্বস্ত করে মাকে যেতে দেয়নি তার সাথে। হীর সেই হোয়াটসঅ্যাপেওয়ালির কথা বলছে। সাবাব মনে মনে হেসে উঠল। হীরের সামনে থেকে মুখের ভাব স্বাভাবিক রেখে বলল,
—-” হ্যাঁ। খুব পছন্দ হয়েছে। ভেবেছি সানির বিয়েটা হতেই আমিও বিয়েটা সেরে ফেলব। জানিস তো, মেয়েটার পরিবার অনেক সুন্দর। এক পরিবারের একটাই মেয়ে। ঐ যেমন এক রাজার মাত্র একটাই রাজকন্যা ওমন টাইপ। সেই সুন্দরী। ইশ, একবার দেখলে আর চোখই ফেরানো যায় না। ইচ্ছে করে সামনে বসিয়ে রেখে শুধু দেখেই যাই আর দেখেই যাই।”
হীরের আগ্রহী মুখটা চুপসে গেলো মুহুর্তেই। চোখ জোড়াও শান্ত হয়ে গেলো। সাবাবের মুখে কোনো মেয়ের প্রশংসা সে যেন এই মুহুর্তে বিষপানের চেয়েও ভয়ংকর লাগছে তার কাছে। ইচ্ছে করছে এখনি চলে যেতে ঐ মেয়ের কাছে। আর কোনো কারন না বলেই কতক্ষণ তার সুন্দর চেহারায় কাঁদা পেটি মাখামাখি করে আসতে। মেয়েটা নিশ্চয়ই রূপের অহংকারী। মেয়েটা নিশ্চয়ই খুব খারাপ। রূপ দেখিয়ে সাবাবের মন গলিয়েছে। এসব মেয়েরা এমনই হয়। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান হলে যা হয়। কখনও কোনো শাসন বারন করে না কেউ। তাই প্রথম থেকেই মানুষের মাথায় উঠে নাচা তাদের স্বভাব হয়। এরকম অনেক ভাবনা হীরের মাথায় পাকাতে লাগলেই অসহ্য হয়ে উঠলো হীর। খানিকটা চেঁচানোর সুরেই সে সাবাবের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
—-” আমি কি তোমার থেকে মেয়েটার রূপের প্রশংসা শুনতে চেয়েছি নাকি। যাও তো তুমি। চলে যাও এখান থেকে।”
হীর হঠাৎ এমন হাইপার রিয়াকশন দিবে তা সাবাবের কল্পনাতীত ছিলো। হঠাৎ চমকে উঠলো সে। চোখ দুটো রসগোল্লা পাকিয়ে গেলো মুহূর্তেই। কিন্তু এমন একটা একান্ত মুহুর্ত সে হাত ছাড়া করতে চায়না। হীর কখনও তার সাথে এক কথার বেশি দুই কথা বলেনা। কিন্তু আজ বলছে। কেন বলছে? কারন হীর জেলাস। তার মুখে অন্য কোনো মেয়ের প্রশংসা শুনে হীরের ভীষণ হিংসা হচ্ছে। হিংসায় তার মন জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। সাবাব আচমকাই হীরের খুব কাছে চলে এলো। হীর ব্যাপারটা বোঝার আগেই সাবাবের গভীর চোখের গাঢ়তায় আঁটকে গেলো সে। মনে ভয় কিন্তু চোখে নেশা। সাবাব হীরের মুখের সামনে মুখ এনে শান্ত কন্ঠে বলল,
—-” আমার সাথে কেউ এভাবে চেঁচিয়ে কথা বলেনা হীর।”
হীর ঢোক গিলল। বুঝতে পারল উত্তেজনার বসে সে চেঁচিয়ে উঠেছে সাবাবের উপর। এবার যে তার আর রক্ষা নেই। সাবাব তাকে কাঁচা চিবিয়ে খাবে। হীরের চোখের ঘন পাপড়িগুলো কাঁপছে। সে চাইছে চোখ বুঁজে নিতে। তাতে যদি সে সাবাবের গাঢ় চাহনি থেকে নিজেকে সংযত করতে পারে। কিন্তু সে চোখ বুঝতে পারছেনা। চোখ বুঝলেই যেন এই মুহুর্তটা হারিয়ে যাবে। যা হীর চায় না।
সাবাব ঘোর লাগা কন্ঠে বলে উঠলো,
—-” আর ইউ জেলাস?”
আচমকাই চোখের পলক পড়ল হীরের। সাবাবের কথাটা মস্তিষ্কে বাঁধা হানতেই তার চোখের নেশা কেটে গেলো। আর সঙ্গে সঙ্গে চোখের মাঝে ঢেলে পড়ল একরাশ ভয়। সাবাবের কথাটা আরেকবার মাথার মধ্যে বেজে উঠতেই হীর শক্ত গলায় জবাব দিলো,
—-” তোমার বউ আমার ভাবি হবে। তাতে জেলাস কেন হবো।”
কি আলুপোড়ার মাঝে কচু পোড়া ঢুকিয়ে দিলো হীর। বেচারা সাবাব ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বোকা চাহনি দিলো হীরের পানে। হীর গাল ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
—-” ফ্রুটসটা দাও।”
সাবাব মুখ কুঁচকে তাকালো নিজের হাতের দিকে। গ্লাসে অর্ধেক ফ্রুটস ঢেলেছিলো সে। বাকি অর্ধেক পূরন করতে ফ্রুটস ঢালতেই হীর আবারও বলে উঠলো,
—-” আর ঢালতে হবেনা। এটুকুতেই হবে।”
সাবাব মুখ উঁচিয়ে তাকালো হীরের দিকে। আবারও গ্লাসের দিকে তাকাতেই মনে হলো মা আর সানিয়া চলে এসেছে। তাদের কথার শব্দ কানে ভেসে আসতেই ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ছাড়লো সাবাব। হীরের মনে পুনরায় ভালোবাসা জাগাতে হলে তার যে ভীষণ পরিশ্রম করতে হবে সেটুকু সে আন্দাজ করে নিলো। সবসময় একা থাকতে থাকতে মেয়েটার বদঅভ্যেস হয়ে গিয়েছে।
—-” ওকে ফ্রুটসটা এখনও দিতে পারলিনা?”
মায়ের দিকে অসহায় চোখে তাকালো সাবাব। ফ্রুটস আর গ্লাস দুটোই মায়ের হাতের ধরিয়ে দিয়ে বলল,
—-” নাও তুমি দাও।”
বলেই সাবাব উঠে দাঁড়ালো। ঔষধের বক্সটার মধ্যে পূনরায় ছানমান মেরে হাতে তুলল হীরের খাওয়ার পরের ঔষধ গুলো। চোখ মুখের ঘা শুকাতে যে মলমটা দেওয়া হয়েছে সেটা হাতে নিয়ে একবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে বলল,
—-” আমি রিসেশনে গিয়ে নার্স চেঞ্জ করে দেওয়ার জন্য কথা বলছি। মা, এই ঔষধ গুলো ওকে খাইয়ে দাও।”
সানিয়া ভাবুক কন্ঠে বলল,
—-” হঠাৎ চেঞ্জ করতে হবে কেন?”
সাবাব বিরক্ত গলায় বলল,
—-” চেঞ্জ করব না। বসে বসে তাদের প্রেমকাহিনী দেখবো তাই তো? অদ্ভুত মেয়ে বটে নার্সটা। কোথায় তাকে রাখা হয়ে পেসেন্টকে স্পেশাল ট্রিটমেন্ট দিয়ে সুস্থ করে তোলার জন্য আর কোথায় সে প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে মরে যাচ্ছে।”
হীরের হাতে ঔষধ দিতে নিয়ে ফিক করে হেসে দিলেন নাজমা বেগম। আজ ছেলের এই নাজেহাল অবস্থা দেখে তার ভীষণ হাসি পাচ্ছে। তার মনে হয় নার্স মেয়েটার কোনো দোষ নেই। তার ছেলেই এতো হ্যান্ডসাম দেখতে যে মেয়েরা আগেপিছে লাইন দিয়ে বসে থাকে। তাতে মেয়েদের কি দোষ? আজকালকার যুগের মেয়েরা তো বিয়ের জন্য নিজেদের পছন্দেরই ছেলে খোঁজে। এখন তো আর আগের জামানা নেই যে বাবা ম যাকে বলল তাকে না দেখে বিয়ে করে ফেললো। এখন জামানার নিয়ম হলো ছেলে-মেয়েরা যাদের পছন্দ করে নিয়ে আসে বাবা-মা তাদের সাথেই বিয়ে দেন। বেচারা মাঝখান থেকে তার ছেলেটা পড়ে গেলো টানাটানিতে। যে মেয়ে দেখে সেই মেয়েই টানাটানি শুরু করে দিতে চায়।
মাকে হাসতে দেখে সানিয়াও হেসে উঠলো। সাবাব মায়ের দিকে তাকিয়ে অসহায় কন্ঠে বলল,
—-” হেসো না মা। পরে কিন্তু ঐ পেত্নী পেত্নী দেখতে মেয়েগুলো তোমার সংসারে এসে তোমার সোনার সংসার তামার সংসারে রূপান্তরিত করবে। তখন বুঝবে!”
নাজমা বেগম হাসতে হাসতে না সূচক নাথা নাড়লেন। বললেন,
—-” বললেই হলো নাকি? আমার সোনার সংসার ওতটাও নড়বড়ে নয় যে যেকোনো পেত্নী এলেই তা ভেঙে পড়বে। আমার সোনার সংসারে তোরা হলি ঢাল। আর তোরা যতদিন ঠিক থাকবি ততদিন আমার সোনার সংসারও সোনায় মুড়িয়ে থাকবে।”
—-” আর মাঝখান থেকে এসব হ্যাংলা মেয়েদের জন্য আমার জীবনটা অতিষ্ঠ হবে তাই তো।”
শব্দ করে হেসে উঠলেন নাজমা বেগম। ছেলেকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোনো মিথ্যে বানি তার জানা নেই। বরং এটাই সত্যি সারাজীবন তাকে মেয়েদের থেকে জ্বালাতন সহ্য করই কাটাতে হবে। যেমন সহ্য করতো হতো হীরের বাবা রিয়াদ আহমেদকে। সাবাবের চেয়েও ভয়ংকর সুন্দর ছিলেন রিয়াদ আহমেদ। একদম ছোট থেকেই তার বাহারি রূপের প্রসংশা করেননি এমন কম লোকই আছে। বড় হওয়ার সাথে সাথে মেয়েদের সে কি পাগলামি। ভয়ে বেচারা বাসা থেকেই বের হতে চাইতো না। সারাক্ষণ ঘরবন্দী হয়ে চুপচাপ বসে থাকত। স্কুল বা কলেজ যেকোনো জায়গাতেই রিয়াদের পাদচারণ খুব কমই ছিলো। সে বাসায় বসেই তার পড়াশোনা এগিয়ে নিয়ে গেছে। তাতেও অশান্তি কম ছিলো না তার। মেয়েরা বাড়িতে পর্যন্ত এসে তাকে হানা দিতো। সে এক বিশ্রী কান্ড ছিলো। আর এ সবকিছুরই সাক্ষী ছিলেন নাজমা বেগম। নাজমা বেগম ছিলেন আজিম সাহেব’দের প্রতিবেশীর মেয়ে। ছোট থেকেই নাজমা বেগমের আসা যাওয়া ছিলো আজিম সাহেব’দের বাসায়। আর সেখান থেকে রিয়াদের খুব ভালো সম্পর্ক হয়ে উঠেছিলো নাজমা বেগমের সাথে। রিয়াদ লোকজনের সাথে মেলামেশা খুব কম করত। সেই সূত্রে তার বন্ধুবান্ধবও ছিলো বেশ নগন্য। রিয়াদের বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো নাজমা বেগম। রিয়াদের থেকে নাজমা বেগম দু-তিন বছরের বড় হলেও তাদের সখ্যতা বরাবরই বেশ অটুট ছিলো। আর রিয়াদের সাথে এই ঘটনা গুলো পর্যায়ক্রমে ঘটত বলেই নাজমা বেগম তাকে প্রটেক্ট করত। বাড়িতে মেয়েদের হানা পড়লেই গিন্নিদের মতো কোমরে কাপড় পেঁচিয়ে সবগুলোকে তাড়ানোর মহান কাজ তিনিই করতেন। বহু বছর পর আজ আবারও যখন নাজমা বেগম এই একই ঘটনার স্বীকার তখন হঠাৎই রিয়াদের জন্য মনটা কেমন করে উঠল তার। তার ছেলের মাঝে এমন সব গুনই আছে যা রিয়াদের মাঝে অবশিষ্ট ছিলো। সাবাব আর সানিয়া যখন জন্মেছিলো তখন সবচেয়ে বেশি খুশি রিয়াদ ছিলো। তখন সাবাবকে কোলে নিয়ে সে বলেছিলো দেখো ভাবি এই তোমার আরেক রিয়াদ হবে। যার তেজ এই রিয়াদের থেকেও আরও দশগুন বেশি। যার গুন,বুদ্ধী সবটাই অনেককে ছাড়িয়ে থাকবে। ও জীবনে অনেক দূর পর্যন্ত যাবে। যাকে কেউ কখনও থামাতে পারবেনা। সদ্য জন্ম নেওয়া একটা বাচ্চার মুখ দেখে সেদিন রিয়াদ কেন এবং কিসের ভিত্তিতে কথা গুলো বলেছিলো জানা নেই নাজমা বেগমের। তবে সে এটুকু জানে সাবাব রিয়াদের মতোই সৎ উদ্দেশ্যে সৎ পথে এগোচ্ছে।
#চলবে____________________