#কাছে_দূরে ♥️
#muhtarizah_moumita
#পর্ব___১৯
বিয়ে কোনো কমিউনিটি সেন্টারে নয় আহমেদ ভিলাতেই হবে। তাই বাড়ির আগাগোড়া সবই ঝাঁক ঝমক করে সাজানো হচ্ছে। বাড়ির পেছনের গার্ডেন থেকে শুরু করে সামনের পাঁচ-সাত বাড়ি এগিয়ে গেট করা হয়েছে। রাস্তার দু’পাশে মরিচ বাতি দিয়ে সব এলাহি কান্ড হয়েছে। মরিচ বাতি গুলোর সাথে স্থান পেয়েছে ছোট ছোট ঝাড়বাতি। সন্ধ্যা কাটতেই তারা আলোকিত করে তোলে চারপাশের অলিগলি গুলোকে। রাস্তা চিনতে সোডিয়ামের আলো না পড়লেও চলে। সারারাত ধরে একই ভাবে জ্বলতে থাকে তারা।
দুপুরের প্রখর রোদ প্রায় অনেকটাই মিইয়ে এসেছে পড়ন্ত বিকেলের কাছে। চারপাশে রোদ এখনও উঁকি ঝুঁকি দিলেও তার তেজ নিতান্তই শূন্য। প্রকৃতি সূর্যের তেজ থেকে গা বাঁচাতেই মৃদু তালে বাতাস দিচ্ছিলো। রোদ মিইয়ে আসতে তা এখন বেশ শরীর ঠান্ডা করে দিয়ে যাচ্ছে। নীচে প্যান্ডেল সাজানো নিয়ে কোলাহল বাঁধিয়েছে লোকজন। ছাদের কার্নিশে হাত দিয়ে তাদের কোলাহল দেখছে হীর। আবার বারে বারে তার সুক্ষ্ম চাহনি উত্তর দিকটাতেও নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। উত্তরে কালো মেঘেদের হাট বসেছে। যেকোনো মুহুর্তে চারপাশ জড়িয়ে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে যাবে। বৃষ্টি নিয়ে হীরের গবেষণা কখনও ভুল প্রমানিত হয়না। আজও হবে না সে জানে।
—-” কোলাহল তো থেমে গিয়েছে! এখনো দাঁড়িয়ে কি দেখছিস বলতো?”
এশার গলা ভেসে আসল। হীর ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। পাটি বিছিয়ে মেয়েদের জমজমাট আড্ডা চলছে। আড্ডা রেখেই সে হঠাৎ ছুটে এলো লোকজনের কি নিয়ে কোলাহল বেঁধেছে তা দেখতে। সানিয়া তার মনের কথা পড়ে নিয়ে হাসতে হাসতে বলল, ‘তোর ছেলেমানুষী আর গেলো না’। হীরও হাসল। সে কখনও বড় হতে চায়না। সবসময় ছোট থাকারই ফন্দি করে। হীর দু’ধাপ এগিয়ে সানিয়ার পাশে গিয়ে বসল। সবার হাতে কফির মগ। কফি খেতে খেতেই আড্ডা হচ্ছে। সানিয়া নিজের মগটা পাটিতে রেখে হীরের মগটা উঠিয়ে আনলো। হীরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
—-” ঠান্ডা হয়ে গেলে খেয়ে কি মজা?”
হীর কিছু না বলে কফির মগটা দু’হাতে মুঠো করে ধরল। কিছুক্ষন মগটার গায়ে কারুকার্য নিয়ে গবেষণা করে সবার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
—-” আদ্ররা এখনও ফিরেনি?”
আদ্ররা বলতে এর মাঝে সাবাবের নামটা লুকানো। সানিয়া ধরে ফেললো হীরের কথার মানে। মিলি আর এশার বুঝতে বেগ পেতে হলো। সানিয়া মিটমিটিয়ে হেসে বলল,
—-” না সোনা আসেনি। আদ্রও আসেনি আর ভাইও আসেনি।”
হীর অনিচ্ছাকৃত হাসল। সানিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
—-” ন,,না! আমি তো শুধু আদ্রর কথাই জানতে চেয়েছি আপি!”
সানিয়া চোখ জোড়া সরু করে বলল,
—-” হ্যাঁ আমিও তো সেটাই বললাম! তুই যেমন প্রশ্ন করলি আদ্ররা এখনও আসেনি? তাই আমিও উত্তর দিলাম না আদ্রও আসেনি আর ভাইও আসেনি!”
হীর এবার কেশে উঠল। প্রশ্নটা সে ঘুরিয়ে করলেও পারত। খামখা লজ্জায় পড়তে হতো না! মিলি আর এশা কিছু একটা নিয়ে জোড়ালো ্আলোচনা জুড়ল ফিসফাস আওয়াজে। সানিয়া আর হীর একসাথেই তাদের দু’জনকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। হীর মিলির পেটে খোঁচা মেরে বলে উঠলো,
—-” কি আলোচনা করছিস দুটিতে? আপির বরকে নিয়ে ভেগে যাওয়ার প্ল্যান করছিস না তো?”
হীরের হাতে খোঁচা খেয়ে ফড়িং এর মতো লাফিয়ে উঠল মিলি। হীরের দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে বলল,
—-” আমি না এশা!”
হীর এবং সানিয়া দু’জনের দৃষ্টিই তীক্ষ্ণ হলো। সানিয়া টানটান কন্ঠে বলল,
—-” আমার বরকে নিয়ে ভেগে যাওয়ার প্ল্যানিং?”
এশা জিহ্বা কেটে মাথায় হাত চাপিয়ে তড়িঘড়ি না সূচক মাথা নাড়ল। অন্য হাতের সাহায্যে মিলির মাথায় একটা গাট্টা মেরে বলল,
—-” না গো আপু! তোমার বর না…”
হীর নির্লিপ্ত চাহনি দিয়ে বলল,
—-” তাহলে নিশ্চয়ই অন্যের বর!”
এশা উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
—-” না!”
মিলি দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
—-” তাহলে কি?”
এশা অসহায় চোখে সবার দিকে দৃষ্টিপাত করে বলল,
—-” আরে বাবা কারোর বর নয়।”
তিনজনেই টানটান উত্তেজনা নিয়ে একসাথে বলে উঠলো,
—-” তাহলে কি কারোর বউ!”
এশা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে উঠলো,
—-” ধ্যাৎ! কিছু না।”
তিনজনেই এবার হু হা করে হেসে উঠলো। মিলি হাসতে হাসতে এশাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,
—-” কনফিউজড হয়ে গিয়েছো বেবি?”
এশা ফ্যাকাসে মুখে বলল,
—-” তোরা সবাই মিলে আমায় কনফিউজডের উপর কনফিউজড করে যাচ্ছিস। এখন তো মনে হচ্ছে আমি নিজের নামই ভুলে গেছি!”
আবারও একদফা হাসির রোল পড়ল। এশা বেচারিও না পেরে এবার হাসতে শুরু করল সবার সাথে।
________________♥️
বৃষ্টি মাথায় করে বাড়ি ফিরল আদ্র আর সাবাব। পরনে লাল শার্টটা ঝাড়তে ঝাড়তে ড্রয়িং এসে দাঁড়াতেই রান্মাঘর থেকে শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে ছেলের কাছে এগিয়ে এলেন নাজমা বেগম। দৃষ্টি মেলে একবার দেখলেন ছেলেকে। প্রায় অর্ধেক গা তার ভিজে আছে। একই অবস্থা আদ্ররও। নাজমা বেগম হাঁক ছেড়ে রুবিকে ডেকে পানি দিতে বললেন। রুবি হাতে পানির গ্লাস নিয়ে এগিয়ে আসতে খেয়াল করল পানি দু’জনের জন্য দরকার। তাই ঐ গ্লাস টা হাতে নিয়েই আবার রওনা হলো আরেক গ্লাস পানি আনতে। নাজমা বেগম শাড়ির আঁচল তুলে ছেলের মাথা মুছে দিতে দিতে বললেন,
—-” বৃষ্টিতে ভিজে বাসায় ফিরতে হলো কেন? কিছুক্ষণ বাদে ফিরতে পারলি না?”
—-” কিছুক্ষণ বাদেই ফিরতাম মা কিন্তু মাঝপথে একটা ঝামেলা হয়েছে। তাই ভিজে বাসায় ফিরতে হলো!”
—-” ঝামেলা! কি ঝামেলা? আবার কি ঝামেলা হলো?”
—-” আহ্ এতো চিন্তায় ডুবে যাচ্ছো কেন? ঝামেলা বলতে সেরকম ঝামেলা না! সব জায়গায় কার্ড দিয়ে বাসার উদ্দেশ্যেই ফিরছিলাম! সাথে তো গাড়িও ছিলো…”
নাজমা বেগম ছেলের কথা বলার মাঝেই বলে উঠলেন,
—-” সাথে গাড়ি থাকলে ভিজলি কেমন করে?”
—-” সেই কাহিনীই তো বলছি। বাসার উদ্দেশ্যে খালেক ভাই গাড়ি স্টার্ট দিতেই দেখলাম ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। খালেক ভাই বলল, ‘বৃষ্টির বাতাসে নাকি বন্যা বন্যা ভাব আচ করা যাচ্ছে। খবরেও নাকি সেরকমই বলছে। দূরে দূরে বন্যাও নাকি হচ্ছে। এমন সময় দেখি দু’জন বুড়ো-বুড়ি! হাত ধরাধরি করে এই বৃষ্টির মধ্যে রাস্তা পার হতে যাচ্ছে। তারউপর দেখো, একদম মেইন রোড। শা শা করে গাড়ি যাচ্ছে। আর সেটা দেখেই ভয় হলো! পাছে এক্সিডেন্ট করে না বসে! তাই গাড়ি থেকে বের হয়ে তাঁদের কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম কোথায় যাবে? ঠিকানাও ঠিকঠাক বলতে পারছিলো না! হাতে ধরে রাখা একটা ভেজা কাগজ দেখিয়ে বলল এই ঠিকানায় যাবে। তাই আমি ভাবলাম আমাদের গাড়িতেই লিফ্ট দেই। খালেক ভাইকে ঠিকানা দেখিয়ে বললাম উনাদের ঠিক জায়গায় পৌঁছে দিতে। আর আমরা বাসা থেকে পাঁচ মিনিট দূরেই ছিলাম বলে আর তাঁদের সাথে যায়নি। একটা টেক্সি ধরে চলে এসেছি। আর তখনই একটু ভিজেছি!”
কথাগুলো একসাথে বলে দম ছাড়ল সাবাব। এর মধ্যে পানি নিয়ে হাজির হলো রুবি। সাবাব আদ্র একসাথেই গ্লাস নিয়ে পানি খেলো। শেষ হতেই নাজমা বেগম বলে উঠলেন,
—-” খালেক কে বলেছিলিস উনাদের পৌঁছে দিয়ে কল করতে?”
সাবাব হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে বলল,
—-” হ্যাঁ মা বলেছি। তুমি চিন্তা করো না আমি বরং রুমে যাচ্ছি। ফ্রেশ হয়ে এসে খাবো! খুব ক্ষিদে পেয়েছে কিন্তু! পেট জ্বালা করছে!”
ছেলের কথা শুনে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন নাজমা বেগম। তড়িঘড়ি করে বললেন,
—-” হ্যাঁ বাবা আমি এক্ষনি খাবার দিচ্ছি টেবিলে তুই তাড়াতাড়ি যা। ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে নীচে আয়। আদ্র?”
নাজমা বেগমের ডাকে জবাব দিলো আদ্র,
—-” হ্যাঁ বড় মা?”
—-” তুমিও যাও বাবা ফ্রেশ হয়ে জামাকাপড় পাল্টে এসো। সেই সকালে এসেই তো আবার বের হয়ে গেলে। তোমারও তো খাওয়া হয়নি মনে হয়।”
আদ্র লজ্জায় মাথা নুইয়ে বলল,
—-” একটু তো পেয়েছে বড় মা!”
—-” দেখেছো কান্ড! খাবারের কথা বলতে ছেলেটা লজ্জা পাচ্ছে। সাবাব ওকে নিয়ে যা। তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করে খেতে আয়।”
সাবাব স্মিত হেসে আদ্রর কাঁধে হাত রাখল। যাওয়ার উদ্দেশ্যে ইশারা করে বলল,
—-” চলো ভাই। ভেজা শার্ট-প্যান্টে তো ঠান্ডা লেগে যাবে।”
আদ্রও হাসল সাবাবের ন্যায়। অতঃপর বড় বড় ধাপ ফেলে দু’জনেই রুমে চলে গেলো।
সাবাব ড্রয়ার খুলে টি-শার্ট আর শর্ট প্যান্ট বের করে নিতে হঠাৎ মনে পড়ল হীরের কথা। এমন ঝুম বৃষ্টি তাতে হীর নিশ্চয়ই রুমে নেই। তার ধারনা ভুল না হলে হীর এখন ছাদে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে। সাবাব টি-শার্ট আর প্যান্ট বিছানার উপর ফেলে চলে গেলো ছাদে। সিঁড়ি ভেঙে উঠতে উঠতে মনে হলো ছাদে কেউ নেই! হীর তবে একাই আছে। সাবাব উঠে গেলো ছাদে। বৃষ্টির ছোট বড় ফোঁটা গুলোও চারপাশটা বেশ ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। সাবাব ঝাপ্সা চোখেই এগোলো সামনের দিকে।তিন কোন খালি রেখে হীর পূর্ব পাশে দাঁড়িয়ে নেচে নেচে বৃষ্টিতে ভিজছে। সাবাব হীরকে দেখতেই বুকের ভেতরটায় শীতল হাওয়া বয় গেলো। তার মনে হলো তার থেকে কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে কোনো এক জলপরী। কি চমৎকার তার রুপের বাহার। চোখ জুড়িয়ে আসল সাবাবের। ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো হীরের কাছে। হীর নিজের আনন্দে ভিজে চলেছে বৃষ্টিতে৷
বৃষ্টি নামার মাঝেই পাটি গুটিয়ে ছুটে গেলো এশা,মিলি আর সানিয়া। হীর নিজের অজান্তেই থকমে গেলো ছাদের মাঝখানে। বৃষ্টির কনা গুলো তার শরীর আঁচড়ে পড়তেই এক অদ্ভুত অনুভূতি নেচে উঠল তার মন। পেছন থেকে ডাক এলো সানিয়ার। কিন্তু হীরের কানে সে ডাক পৌঁছালো না! সে নিজেকে বিলিয়ে দিলো ঝুম বৃষ্টির মাঝে। তার কিশোরি মন চঞ্চল হয়ে উঠলো বৃষ্টির কনা গুলো গায়ে মেখে গা ভেজাতে। সানিয়া বুঝতে পারল হীরকে আর ডেকে কোনো কাজ হবে না। সে আসবে না। তাই তারা নীচে নেমে গেলো। আর হীর পড়ে রইল ছাদে। ঘুরে ফিরে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগল।
হীর তার ভেজা চুল গুলো পিঠ থেকে সরিয়ে কাঁধে তুলে আনতেই সাবাবের বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল। হীরের ভেজা জামা লেপ্টে আছে ভেজা পিঠে। সাবাব চোখ নামিয়ে নিলো একবার। আবার কি মনে হতেই চোখ তুলে তাকালো হীরের পিঠে। হীর দু’হাত দু’দিকে মেলে ধরেছে। মাথাটা পেছন দিকে খানিকটা নুইয়ে মুখ তুলে আছে আকাশের পানে। যার দরুন বৃষ্টির ছোট বড় কনা গুলো আঁচড়ে পড়তে লাগল হীরের মুখে। সাবাব শান্ত চোখে দেখছে হীরকে। আর ক্রমশ ঘোরে তলিয়ে যাচ্ছে। সাবাব আরেকপা এগোতেই হীরের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। পেছনে কারোর অস্তিত্ব প্রগাঢ় ভাবে উপলব্ধি হতেই সে হাত গুটিয়ে নিলো। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে পেছনে তাকাতেই কেঁপে উঠলো আরেকদফা। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা টাকে এই মুহুর্তে কিছুতেই আশা করতে পারেনি হীর। বৃষ্টির মাঝেই দমকা হাওয়া ছাড়তে ঠান্ডায় কেঁপে উঠলো হীরের শরীর। চোখ জোড়া পিটপিট করে সে সাবাবকে দেখতে লাগল। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বুলি আওড়ানোর চেষ্টা করল,
—-” ব,,বৃষ্টি হ,,চ্ছে!”
সাবাব তপ্ত শ্বাস ছেড়ে জবাব দিলো,
—-” হ্যাঁ বৃষ্টি হচ্ছে।”
—-” আ,,মি একটু ভিজ,,ভিজেই চলে যেতা…”
—-” একঘন্টা যাবত বৃষ্টি হচ্ছে!”
হীরের বুকের ভেতর কেঁপে উঠলো। ভিজতে ভিজতে তো তার খেয়ালই হয়নি সময় কতখানি পেরোলো। সাবাবের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিকে এড়াতেই হীর নড়েচড়ে উঠল। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা তার জন্য হিতকর হবে না বলেই চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো সে। সাবাব হীরের গতিবিধি মাপছে। বৃষ্টির মাঝেও ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। দু’জনের দেহই কাঁপছে উষ্ণতায়। হীর ঢোক গিলল। সাবাবকে পাশ কাটিয়ে যেতে নিলেই সাবাব তার হাত ধরে ফেলে। যার দরুন মুহুর্তেই হীরের ভয় আরও দুইগুণ বেড়ে যায়। হীর নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেওয়ার সাহস পাচ্ছে না! তার বুক কাঁপছে! সাবাব তাকে চড় মারবে না তো?
হীরের নরম হাতটা নিজের হাতের ভাজের চেপে রাখতেই বিদ্যুৎ খেলে গেলো সাবাবের শরীরে। তার মনটা বড্ড অবাধ্য হয়ে উঠছে ক্রমশই। হীরকে খুব কাছে টেনে এনে মোহাচ্ছন্ন কন্ঠে বলতে ইচ্ছে করছে, ‘ভালোবাসি হীরপাখি, খুব ভালোবাসি তোমায়!’ সাবাব বলতে পারল না একথা! নিজের মনের অজান্তেই সে হীরের হাত ধরে হেঁচকা টান মেরে সামনে এনে দাঁড় করালো। তার চোখ বলে দিচ্ছে কতটা গভীর এই নেশা! হীর ভয়ে কেঁপে উঠল। হেঁচকা টান খেয়ে নীচে পড়তে পড়তেও পড়ল না। ভয় হচ্ছে তবে অদ্ভুত এক অনুভূতিও হচ্ছে। এই অনুভূতির নাম হীরের জানা নেই! সব সময় এই অনুভূতি উপলব্ধি করতে পারেনা হীর। কেবল তখনই পারে যখন সাবাব তার আশেপাশে থাকে! এখনও সেই অদ্ভুত অনুভূতিতে তার শরীর,মন থেকে থেকে কাঁপছে। ভয়ংকর অনুভূতিতে তার অসহ্য লাগছে খুব। সাবাব আচমকাই এক অদ্ভুত কান্ড করে বসল। হীরের কোমরে হাত রেখে তাকে কাছে টেনে আনল। সাবাবের এহেম আচরণের জন্য হীর কোন কালেও প্রস্তুত ছিলো না! কেমন অদ্ভুত সাবাবের চাহনি! হীরের বুকের ভেতর ধক ধক আওয়াজ করছে। হীর তা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। এই প্রথম হীর সজ্ঞানে সাবাবের এতোটা কাছে! সে ভাবতে পারছেনা। সাবাব কি এসব ইচ্ছে করে করছে? হীর বুঝতে পারছে না। সাবাবকে আটকানোর উপায় হীরোর জানা নেই। ভয়ে তার নিঃশ্বাস আঁটকে আসছে। সাবাবের হাতের বাঁধন শক্ত হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। সাবাব একহাতেই এবার শক্ত করে হীরের কোমর জড়িয়ে ধরল। আর অন্যহাতে তুলে হীরের গালের উপর রাখল। শীতল উষ্ণতায় কাঁপছে দু’জনেরই ওষ্ঠদ্বয়! হীর ঘোলাটে চোখে সাবাবের কম্পিত ওষ্ঠদ্বয়ের হদিশ চালিয়ে চোখ বুঁজে নিলো। আর সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতির তেজও যেন বৃদ্ধি পেয়ে গেলো। আকাশের বুক চিঁড়ে বৃষ্টির কনা গুলো দিগুণ গতিতে ঝড়ে পড়ছে দু’জনের উপর! হীরকে চোখ বুঁজে নিতে দেখেই সাবাবের বুকে তীর বিঁধল। আরেকটু বেহায়া হলো তার অবাধ্য মন আর নির্লজ্জ চাহনি! সে তার কম্পিত ওষ্ঠদ্বয়কে আরেকটু প্রশ্রয় দিয়ে হীরের উষ্ণতায় ঘেরা ওষ্ঠদ্বয়কে আঁকড়ে ধরল। হীর অজানা ভয়ে কেঁপে উঠে খামচে ধরল সাবাবের শার্ট। সাবাব আরেকটু প্রশ্রয় পেলো! তার তপ্ত শ্বাস আরেকটু ভারী হলো! তার হাতজোড়ায় হীরকে আরেকটু জড়ালো! বৃষ্টির কনাগুলোর সাথের হীরের চোখের দু’ফোটা নোনাজলও গড়িয়ে গেলো! তা আর জানা হলো না সাবাবের!
তাদের অতৃপ্ত মনের বাসনা আজ তৃপ্ত নিয়ে পূরন হতেই রুশে উঠল মেঘরাজ! বিকট শব্দে গর্জে উঠলো খন্ড খন্ড মেঘেরা! যার শব্দে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে গেলো হীরের! মুহুর্তেই চেতন ফিরল কতবড় অঘটন ঘটিয়ে ফেলেছে দু’জনে। সাবাবকে দু’হাতে ধাক্কা মেরে নিজেও পিছিয়ে গেলো চার-পাঁচ কদম। ধাক্কা খেয়ে সাবাবও নিজের মধ্যে ফিরে এলো। অপরাধী দৃষ্টিতে হীরের দিকে তাকাতেই হীরের কান্নাভেজা মায়াবী চোখ জোড়ার আবিষ্কার করল। বুকটা কেঁপে উঠলো সাবাবের। জড়ানো গলায় বলতে চেষ্টা করল,’সরি হীরপাখি!’
কিন্তু বলা হয়ে উঠলো না! হীর বাতাসের গতি নিয়ন্ত্রণ করে ছুট্টে পালালো মুহুর্তেই! হীর চলে যেতেই শো শো করে বাতাসের গতি বেড়ে গেলো। সাবাব এক মিনিট দাঁড়িয়ে বাতাসের বেগ আটকালো। বুক ফুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেও চলে গেলো রুমের উদ্দেশ্যে।
হীর দাঁড়িয়ে আছে শাওয়ারের নীচে। দু’হাতে চোখ মুখ চেপে ধরে মাথা ঠেকালে দেয়ালের বুকে। আর ঠিক তখনই কেউ নক করল বাথরুমের দরজায়। মুহুর্তেই মনে হলো সাবাবের কথা। কিন্তু তার ভুল ভাঙিলে সুরেলা কন্ঠে ডেকে উঠল রুবি,
—-” আফা, আফনে এই বেলায় গোসল করতাছেন? খালাম্মায় জানলে তো বকবে আফনেরে!”
—-” কি চাই?”
কড়া গলায় প্রশ্ন করল হীর। রুবি দমে গেলো। নীচুস্বরে বলল,
—-” খালাম্মায় ডাইকা পাঠাইছে আফনারে।”
—-” কেন?”
—-” দুপারের খাওন তো আফনের থালাতেই শুগাইছে! খাইতে ডাকতাছে।”
হীর ফুস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। জবাবে ‘না’ মত পোষণ করতে গিয়ে মনে হলো ক্ষিদেয় তার পেট জ্বলছে। এখন আর না করা সম্ভব না। তাই ছোট্ট করে জবাব দিলো,
—-” আসছি।”
রুবি আর দাঁড়ালো না। হীরের জবাব পেয়ে সে নিজের কাজে চলে গেলো।
#চলবে_ ♥️