#কাছে_দূরে
#muhtarizah_moumita
#পর্ব___৬৮
বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে আছে সানিয়া। তার মুখ শুঁকনো। ঘন্টা খানিক আগে ডাক্তার এসেছিলেন। ততক্ষণে তার জ্ঞান ফিরেছে। ডাক্তার তার নার্ভ চেক করে হাসিমুখে বললেন, ‘সুখবর আছে।’ সানিয়ার বুঝতে আর বাকি ছিলো না ডাক্তার সাহেব কোন সুখবরের কথা বলেছেন। বাবার মৃত্যুশোকে তার এই সুখবরে কোনো আনন্দই হচ্ছে না! কেবল বুক জুড়ে চাপা বেদনা হচ্ছে। নেহাল এই খবরটা শুনে খুশিতে পাগল প্রায়। দুঃখের মাঝে সুখের বেদনা যেন। সানিয়ার মনের কষ্ট দেখে সুখের খবরেও বুক ব্যাথা করছে নেহালের। নাজমা বেগম, হীর-সাবাব এবং রোজ সবাই-ই ভীষণ খুশি। নাজমা বেগম মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললেন,
—-‘ মানুষ তো চিরকাল থাকবে না মা। আজ আছে তো কাল নেই। সময়ের স্রোতে আমরা স্বজন হারানোর বেদনা ভুলে আবার নতুন করে বাঁচতে শিখে যাই। তুইও শিখবি। এভাবে মন মরা করে থাকিস না মা। যে আসতে চলেছে তার জন্য প্রার্থনা কর রবের কাছে। আর যে চলে গেছে তার জন্যও প্রার্থনা কর। যেন তিনি ভালো থাকেন। রবের কত নেয়ামত দেখ মা?তোর এক বাবাকে তিনি নিয়ে গেছেন হয়তো আরেকটা বাবা ফিরিয়ে দিতে।’
সানিয়া অন্যমনস্ক হয়ে মায়ের কথা গুলো সব শুনেছে। তবে মাকে বুঝতে দেয়নি। তার মা কথা গুলো বলে যখন চলে গেলো তখন সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে। কেউ জানুক বা না জানুক, তার বাবা তো তার জান ছিলো।
।
।
।
।
—-‘ আসব আন্টি?’
নাজমা বেগম নামাজের পাটি বিছিয়ে বসলেন। এর মাঝে রোজের কন্ঠ পেলেন দরজার কাছ থেকে। তিনি ঘাড় ফিরিয়ে দেখলেন রোজকে। নাজমা বেগম তাকাতেই রোজ ঠোঁট টেনে হাসার চেষ্টা করল। নাজমা বেগম লম্বা হাসি দিয়ে বললেন,
—-‘ রোজ যে। এসো মা।’
রোজ ঠোঁটে হাসি রেখেই নির্দ্বিধায় পা রাখল নাজমা বেগমের ঘরে। ঘরের প্রতিটা জিনিসের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নাজমা বেগমের পাশে বিছানার উপর এসে বসল। বলল,
—-‘ নাজাম পড়ছেন?’
নাজমা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়লেন। বললেন,
—-‘ নামাজ পড়ছিনা। একটু তেলওয়াত করব। আর কিছুক্ষণ দোয়া-দরুদ পড়ে আল্লাহর কাছে সকল পাপের ক্ষমা চাইব।’
রোজ ভ্রু জুগল কুঁচকে নিয়ে বলল,
—-‘ এই সময়? এখন তো সন্ধ্যা।’
—-‘ আল্লাহর কাজ করতে সন্ধ্যা আর সকাল লাগে নাকি? তোমার যখন খুশি তুমি তখনই করতে পারো। শুধু মনটা পরিশুদ্ধ হওয়া চাই।’
রোজ নাজমা বেগমকে ভালো করে পরখ করে দেখলো তার গায়ের পরিপাটি পোশাকটাকে তাকে কি অসাধারণ লাগছে। মুখ জুড়ে যেন অসম্ভব মায়া আর নূরের খেলা চলছে। রোজ একবার নিজেকে দেখল। স্লিভলেস জামা আর হাঁটু থেকে একটু নীচে তার প্যান্টের এরিয়া। সে উপলব্ধি করল তার খোলামেলা পোশাকের চেয়ে নাজমা বেগমের ওল্ড ফ্যাশনের সুন্নতি পোশাকটাই অধিকতর সুন্দর। রোজ ভাবুক কন্ঠে বলল,
—-‘ আন্টি? আপনার কাছে কি এই পোশাকের অনুরূপ আর কোনো পোশাক আছে? থাকলে আমাকেও দিন না? আমিও আপনার সাথে দোয়া শিখব।’
নাজমা বেগম চিকতে তাকালেন রোজের দিকে। নিজের দিকে একবার তাকিয়ে ফের রোজের আগ্রহী মুখের দিকে দেখে অমায়িক হেসে বললেন,
—-‘ হ্যাঁ আছে তো। তুমি সত্যিই আমার সাথে দোয়া শিখবে?’
রোজ উৎফুল্ল সহিত উপর নীচ মাথা নাড়ল। অর্থাৎ ‘হ্যাঁ।’ নাজমা বেগম হেসে পড়লেন আনন্দে। দ্রুত উঠে গিয়ে আলমারি থেকে সানিয়ার মাপের একটা ড্রেস আর তার পরনের অনুরূপ একটা সুন্নতী পোশাক বের করে আনলেন। এগিয়ে এসে রোজের হাতে দিয়ে বললেন,
—-‘ অযু কিভাবে করে জানো?’
রোজ ভাবনায় পড়ে গেলো। নাজমা বেগম রোজের মুখভঙ্গিমা দেখে বুঝতে পারলেন শব্দটা রোজের জন্য একদমই নতুন। তিনি রোজের গালে হাত রেখে বললেন,
—-‘ না জানলেও সমস্যা নেই। আমি শিখিয়ে দিবো। তুমি আগে চেঞ্জ করে নাও। তারপর আমি তোমায় সবটা এক এক করে শিখিয়ে দিচ্ছি।’
রোজ খুশিতে আচমকা নাজমা বেগমকে জড়িয়ে ধরে বলল,
—-‘ থেংক্যু বড় মা। থেংক্যু- আচ্ছা আমি তোমায় বড় মা ডাকতে পারি তো?’
রোজের কান্ড দেখে নাজমা বেগম চমকে উঠেও অমায়িক হাসলেন। রোজের মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে কন্ঠে বললেন,
—-‘ কেন নয়। অবশ্যই ডাকতে পারো আমার লক্ষি মা।’
রোজ নাজমা বেগমকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
—-‘ তোমার শরীর থেকে একটা মা মা গন্ধ আসছে, জানো তো।’
নাজমা বেগম খিলখিল করে হেসে উঠে বললেন,
—-‘ পাগলি। আমি তো মা-ই। আর মায়ের শরীর থেকে তো মা মা গন্ধই আসবে।’
রোজ আচমকা নাজমা বেগমকে ছেড়ে দিলো। মুখ তুলে তার দিকে তাকিয়ে মলিন মুখে বলল,
—-‘ তুমি আমারও মা হবে বড় মা?’
নাজমা বেগম রোজের আকুতিভরা চাহনি দেখল। ম্লান হেসে রোজের কপালে চুমু খেয়ে বললেন,
—-‘ আমি আমার রোজেরও মা। খুশি।’
নাজমা বেগমের কথায় খুশির ঝিলিক খেলে গেলো রোজের মুখে। রোজ ফের নাজমা বেগমকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী কন্ঠে বলল,
—-‘ তুমি আমারও মা।’
।
।
।
।
সূর্য মামা ডুবেছে। সঙ্গে সঙ্গেই মাগরিবের আজান পড়ল। সাবাব রুমে ঢুকেই লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। হীর আলমারির থেকে নতুন জামাকাপড় বের করতে করতে আঁড়চোখে দেখলো সাবাবকে। হঠাৎ শুয়ে পড়তে দেখে ভ্রু কুঁচকে কোমড়ে হাত চেপে বলল,
—-‘ ঐ দিকে আজান হচ্ছে আর তুমি শুয়ে পড়লে! টের পাচ্ছো না আজানের ধ্বনি?’
সাবাব ক্লান্তিতে চোখ জোড়া বন্ধ করে রেখেছে। চোখ বন্ধ রেখেই হীরের কথার জবাব তৈরি করল,
—-‘ শুনতে পাচ্ছি তো! কিন্তু শরীর যে সঙ্গ দিচ্ছে না সুন্দরী।’
‘সুন্দরী’ ডাকটা সাবাবের মুখে একদম নতুন। হীর কোমরে হাত চেপেই এগিয়ে গেলো সাবাবের দিকে। বিছানার পাশে এসে বলল,
—-‘ সুন্দরী! এটা কেমন ডাক? এটা তো বখাটে ছেলেরা মেয়েদের ইভটিজিং করার সময় বলে!’
সাবাব এক চোখ মেলে হীরের দিকে তাকালো। হীরকে জ্বালানোর উদ্দেশ্যে বলল,
—-‘ হ্যাঁ বখাটেদেরই তো। আর আমি কি সুপুরুষ নাকি হু? আমিও তো ওমনই ছেলে। যে ছেলেরা মেয়েদের ইভটিজিং করে। তুমি জানো? আমেরিকা থাকার সময় আমি হেই সুইটু,কুইটু,মুইটু এসব বলে কত মেয়েদের সাথে ইভটিজিং করেছি! ওরাও হেব্বি পটে যেতো। আহহা- আআআ মাআআ-
সাবাব কথাটা শেষ করার মাঝেই হীর তার পেটের উপর কিল-ঘুষি যা পারলো একটানা বসিয়ে দিলো। হীরের আক্রমণ সাবাব আকস্মিক আশা করতে পারেনি। প্রথমে বাঁধাও দিতে পারেনি। অতঃপর ব্যাথা হজম করতে না পেরে চেঁচিয়ে উঠলো। হীর অনবরত আরও কিছুক্ষন মারতে মারতে সাবাব হীরের হাত চেপে ধরে। কিন্তু শক্তিতে পেরে উঠে না। ওদিক থেকে তার চেঁচানোর শব্দ পেয়ে ছুটে আসেন নাজমা বেগম। আর তার পেছন পেছন রোজ আর রুবি। তারা রুমে ঢুকে মারামারির এমন দৃশ্য দেখে বোকা বনে গেলো। রোজ ছুটে এসে হীরকে পেছন দিকে টেনে নিলে হীরের হাত থেকে রক্ষা পায় সাবাব। নাজমা বেগম হীরের পানে এগিয়ে এসে দু’জনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে বললেন,
—-‘ কি হচ্ছে কি? দু’জনে মারামারি করছিস কেন?’
সাবাব বারবার দম নিতে লাগল। হীর ফুঁসতে ফুঁসতে সাবাবের দিকে আবারও তেড়ে যেতে নিলে রোজ তাকে ঝাপটে ধরে রাখে। যা দেখে সাবাব লাফিয়ে বিছানা ছেড়ে মায়ের পেছনে গিয়ে লুকোয়। নাজমা বেগম হীরের গালে কপালে হাত ঠেকিয়ে বলতে লাগলেন,
—-‘ বাপরেহ্! হীরপরি এতো রেগে গেছে কেন? এই সাবাব কি করেছিস তুই? কেন রাগিয়েছিস আমার মেয়েকে?’
সাবাব মায়ের দিকে ফিরে ইনোসেন্ট মার্কা ফেস করে বলল,
—-‘ বিশ্বাস করো মা। আমি রাগিবতীকে কিছুই বলিনি! ও শুধু শুধু ক্ষেপেছে-
—-‘ আচ্ছা? তুমি কিছু বলো নি তাই না? আমি শুধু শুধু ক্ষেপেছি?’
হীর রেগেমেগে কথা গুলো বলে সাবাবের দিকে এগিয়ে আসতেই সাবাব ‘ও মাগো’ বলে চেঁচিয়ে উঠে মাকে আড়াল করে দাঁড়ালো। হীর নাজমা বেগমের সামনে এসে সাবাবকে ধরার চেষ্টা করে। নাজমা বেগম দু’জনের কান্ড দেখে ভড়কে গিয়ে বললেন,
—-‘ আরে আরে_ করিস কি দুটিতে!’
—-‘ বড় মা, বড় মা তুমি সরে যাও। আজ ওর একদিন কি আমার একদিন।’
—-‘ মা! মা মা মা! ভুলেও সরবে না মা। তাহলে তোমার এই পরী রাক্ষস হয়ে আমাকে গিলে খাবে!’
সাবাবের কথা শুনে ফিক করে হেসে দিলো রোজ। হাসতে হাসতে বলল,
—-‘ তোমার বউ! সে তোমায় রাক্ষস হয়ে খাক আর পেত্নী হয়ে খাক আমরা কি করতে পারি? তাই না বড় মা? শুনো বড় মা, আমরা এক কাজ করি। আমরা বরং চলে যাই ওরা দু’জন মারামারি করুক। কে উইন হবে পরে এসে জেনে যাবো।’
নাজমা বেগম অতিষ্ঠ হয়ে উঠে বললেন,
—-‘ হ্যাঁ সেই বরং ভালো। এই সর সর! ছাড় আমায়।’
নাজমা বেগম নিজেকে ছাড়াতে গেলে সাবাব তাকে যেতে দেয়না। আকুতিভরা কন্ঠে বলে,
—-‘ মা সত্যি বলছি আমি কিছু করিনি। তুমি আমাকে এভাবে বাঘের থাবায় ফেলে দিয়ে যেওনা মা।’
হীর ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে নাজমা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল,
—-‘ জানো বড় মা কি বলেছে তোমার ছেলে?’
নাজমা বেগম না এপাশ ওপাশ করে মাথা নেড়ে বললেন,
—-‘ কি বলেছে?’
হীর কোমরে হাত চেপে সাবাবের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বলল,
—-‘ তোমার ছেলে নাকি আমেরিকায় বসে মেয়েদের সাথে ইভটিজিং করত। আর কি বলে ইভটিজিং করত জানো?’
নাজমা বেগম চোখ দুটো বড়বড় করে আবারও এপাশও ওপাশ করে মাথা নাড়লেন। অর্থাৎ ‘না’
হীর চোখ দুটো সরু করে সাবাবের দিকে তেড়ে যেতে নিয়ে ব্যঙ্গ করে বলল,
—-‘ হেই সুইটু,কুইটু,মুইটু___ আর তাতে নাকি মেয়েরা হেব্বি পটতো!’
হীরের ভাবভঙ্গিমায় হু হা করে হেসে পড়লো সবাই। সাবাব ঠোঁট কামড়ে হীরের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিলো। হীর রেগেমেগে আগুন হয়ে বলল,
—-‘ দেখো বড় মা এখনও সে অসভ্যতামি করছে! তুমি ওকে কিছু বলবে না?’
হীরের অভিযোগে নাজমা বেগম বেশ সিরিয়াস মুড নিয়ে তাকালেন সাবাবের দিকে। আচমকা সাবাবের কান টেনে ধরে মিছে মিছে মার দেওয়ার ভঙ্গিমা করলেন। শাসন করে বললেন,
—-‘ খুব অসভ্য হয়েছিস তো তুই। আমেরিকায় থেকে এসব করতিস হু?’
সাবাব কানমলা খেয়ে চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নিয়ে বলল,
—-‘ নো ওয়ে মা! ওখানে এসব এতো ইজি নাকি? কোনো মেয়ের দিকে তাকালেও আমায় জেলে পুরে দিতো!’
—-‘ আচ্ছা! তাহলে শুধু শুধু বদমাইশি করে আমার পরীটাকে জ্বালাচ্ছিস কেন?’
সাবাব এক চোখ বুঁজে অন্য চোখে খুলে হীরকে দেখতে দেখতে বলল,
—-‘ আচ্ছা বাবা আম সরি! আজ থেকে আর নিজের বউ না। অন্যের বউকে জ্বালাবো খুশি?’
সাবাবের উক্তিতে উপস্থিত সকলের মুখই হা হয়ে গেলো। হীর কোমরে হাত চেপে বলল,
—-‘ কি বললে তুমি।’
সাবাব ফট করে কথাটা বলে হীরের রিয়াকশনের অপেক্ষায় ছিলো। হীর যেই না তার দিকে তেড়ে আসতে নিলো অমনি সে এক ছুটে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। পেছন মুড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
—-‘ নিজের বউকে জ্বালাতে না পারলে তো পরের বউকেই জ্বালাবো তাই না?’
হীর তেতে উঠে তার দিকে তেড়ে আসতে আসতে বলল,
—-‘ দাঁড়াও দেখাচ্ছি তোমার মজা।’
—-‘ সরি সুন্দরী! স্লিপ অফ টাঙ।’
এই বলেই আবারও ছুটলো সাবাব। আর তার পেছন পেছন হীরও ছুটলো।
রোজ হাসতে হাসতে গিয়ে নাজমা বেগমকে জড়িয়ে দাঁড়াল। নাজমা বেগমও হাসতে লাগলেন তার কলিজার টুকরো দুটোকে এভাবে মজা করতে দেখে।
তিনি অমায়িক হেসে মনে মনে দোয়া করলেন,
—-‘ ছেলে-মেয়ে দুটো সারাজীবন যেন ঠিক এমনই হাসিখুশি থাকে। কোনো দুঃখ যেন তাদের আর স্পর্শ করতে না পারে।’
#চলব___
[ বিঃদ্রঃ গঠনমূলক মন্তব্য আশা করতে পারি??]