#কাঁচের_চুড়ি
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
শেষ পার্ট
“সিরাজুল ভাই তোমাকে বিশ্বাস করে নিজেদের বাড়িতে থাকতে দিয়েছিলাম, থাকা খাওয়া বাবদ কখনোও একটা পয়সাও চাইনি। এই তার প্রতিদান?”
” তুমি ওর মতো মানুষকে ভাই বলো না, সবার ভাই হওয়ার যোগ্যতা থাকে না। ”
সিরাজুল অন্যদিকে তাকিয়ে আছে, এদের মতো লোকের লজ্জা, অনুতাপ কিছু নেই। সেদিন কাকি মা’কে সিরাজুল জড়িয়ে ধরে বসে ছিলো, কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। হয়তো সত্যিই সান্ত্বনা দিচ্ছিলো। এখন এসব বললে জসিম কাকার মনে সন্দেহ ঢুকে যাবে। মেয়ে হারিয়ে এমনিই দু’জন অনেক ভেঙে পড়েছে, এখন সম্পর্কে ফাটল ধরলে বেঁচে থাকা মুশকিল । মানসিক অশান্তি বড্ড ভ”য়া”ন”ক!
থানার সবাই বেশ প্রশংসা করলো আমার, খুব খুশি লাগছে, শেষ পর্যন্ত আমি তিন্নির খু**নিকে ধরতে পেরেছি। মানিকের বাবা ঠিক কথা বলেছিলেন, সকল অপরাধী কোন না কোন ভুল নিশ্চয়ই করে, সিরাজুল অতিরিক্ত আবেগ দেখিয়ে ফুফুর থেকে একটা চুড়ি নিয়ে নিজের কাছে রেখে ছিলো। ভালোলাগা থেকেও নিতে পারে আবার ফুফুকে ইমপ্রেস করার জন্যও এমনটা করতে পারে। কিন্তু এটা ছিলো তার প্রথম ভুল। এ ব্যাপারে ফুফু বলে ছিলেন আমাকে, সে-ই চুড়ি আবার উনার বিছানার নিচে দেখেছি আমি। সিরাজুলের দ্বিতীয় ভুল ছিলো আমাকে কবরের কাছে দেখে ওভাবে তেড়ে আসা, যদিও সে জানতো না আমি তাঁকে স”ন্দে”হ করি, তাঁর এ কাজ আমার সন্দেহকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
মানতে হবে সিরাজুল গভীর জলের মাছ। কিন্তু খারাপ পথে কখনো ভালো কিছু হতে পারে না। অটোরিকশায় বসে আছি সবাই, কাকার চোখে পানি, কাকি মা তো সেই তখন থেকে একভাবে কাঁদছে।
” কাকি মা, এভাবে কাঁদবেন না। এভাবে কাঁদলে শরীর খারাপ হবে। ”
” কি করবো বাবা? আমার ভুলের জন্য মেয়েটা শেষ হয়ে গেলো। এ দুঃখ রাখবো কোথায়!”
জসিম কাকা উনার হাত চেপে ধরলেন।
” এতে তোমার তো কোন দোষ নেই, কপালে যা ছিলো তাই হয়েছে। তুমি আর নিজেকে দোষ দিও না। ”
কাকি মা উনার কাঁধে মাথা রাখে, আমি বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি। সব খুশির মাঝেও হতাশা রয়ে গেছে আমার। মা’কে শাড়ি কিনে দিতে পারলাম না। অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু কোথায় কাজের সন্ধান পায়নি। এই শহরের হালাল উপার্জন করা বড্ড কঠিন!
” কাকা একটা অনুরোধ ছিলো আপনাদের কাছে।”
” বলো। ”
” ফুফুর ব্যাপারটা কাউকে বলবেন না দয়া করে। ফুফু অনেক কষ্টে আছে। ”
জসিম কাকা আমার হাত চেপে ধরলেন।
” বাবা রে তোমার জন্য আমার মেয়ের খুনি ধরা পড়েছে। এই ছোট্ট অনুরোধ রাখতে বলে লজ্জা দিও না। কথা দিচ্ছি এ ব্যাপারে কাউকে কিছু বলবো না। ”
কাকিও উনার কথায় সম্মতি জানালেন। বাড়িতে সবাই খুব খুশি, বিশেষ করে মা, তাঁর ছেলে এতো বড় একটা কে*স সমাধান করেছে। এতো খুশির মাঝেও কিছু একটা নেই, তিন্নির খু*নিকে শাস্তি দিয়ে হয়তো ন্যায় বিচার করা যাবে কিন্তু তিন্নি কি আর কখনো ফিরে আসবে! বাদশা ভাই ডাকটা আর কখনও শোনা হবে না।
সকাল বেলা তিন্নির ক”ব”রে”র পাশে দাঁড়িয়ে আছি।
” বোন তোকে বাঁচাতে পারিনি, তবে দেখ সিরাজুলকে ধরিয়ে দিয়েছি। আল্লাহ তোকে খুব ভালো রাখুক। এই নি”ষ্ঠু”র পৃথিবীতে নিষ্পাপদের জন্য আলাদা মায়া নেই রে। স্বার্থের কাছে সবাই পরাজিত! ”
ওপাশ থেকে কোন উত্তর আসে না। আর কখনো উত্তর আসবেও না, আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে স্বজন হারানোর বেদনা। হয়তো সময়ের সাথে ভুলে যাবো, নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে যাব, তেমন মনে পড়বে না। কিন্তু তুই আমার স্মৃতিতে আজীবন আমার বোন হয়ে রয়ে যাবি।
সময় বহমান, নিজের মতো চলতে থাকে। দেখতে দেখতে ঈদ চলে এলো, কাল ঈদ। আজ শেষ ইফতার বিলি করছি, পকেটে সেই একশো টাকা রয়ে গেছে, এই শহরে কেন একশো টাকায় শাড়ি পাওয়া যায় না? তাহলে মা’য়ের জন্য খুব সুন্দর একটা শাড়ি কিনতাম। মা নিশ্চয়ই খুব খুশি হতো। তামিম ভাইদের সাথে ইফতার করতে হবে, সকলকে ইফতারে আগে মসজিদে পৌঁছাতে বলেছে।
আজ শেষ রমজান, সকলে মিলে ইফতার করছি, আগামী বছর আমি নাও থাকতে পারি। যেমন তিন্নি আজ নেই, গতবার আমাী হাত ধরে ঈদের মাঠে গেছিলো। একটা লাল ফিতা কিনে দিয়ে ছিলাম। যদিও ফিতা বাঁধার মতো চুল ছিলো না, তবুও খুব খুশি হয়ে ছিলো।
নামাজ শেষ দাঁড়িয়ে আছি। তামিম ভাই নয়-দশজন ছেলেকে অপেক্ষা করতে বলেছে। তাঁদের মধ্যে আমিও একজন। অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ভাইয়া আসলো।
” এই তো তোরা সবাই আছি, এদিকে আয় তো। ”
তামিম ভাই আমাদের সকলের হাতে একটা করে খাম ধরিয়ে দিলেন, তারপর পকেট থেকে টাকা বের করে সবাইকে একশ টাকা করে দিলেন।
” এই খামের ভিতর তোদের পুরষ্কার আছে, আর এইটা আমার তরফ থেকে ঈদ সালামি। তোরা না থাকলে এই সুন্দর পরিকল্পনা কখনো সফল হতো না। ”
খাম খুলে দেখলাম ভিতরে অনেকগুলো টাকা।
” এতো টাকা কেন দিয়েছো তামিম ভাই?”
” আরে এগুলো তোদের ইফতার বিক্রির টাকা। সকলের থেকে পাঁচ টাকা করে আনতে বলেছিলাম মনে নেই। সেই সব টাকা ছোটদের ভিতর ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। ”
সকলের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। তবে আমি মনে হয় সব থেকে বেশি খুশি হয়েছি। বাইরে এসে টাকাগুলো গুনে দেখলাম। পাক্কা তিন হাজার। মা’য়ের জন্য খুব সুন্দর দেখে একটা শাড়ি কিনবো। দেরি না করে মার্কেটে চলে এলাম। মা’য়ের নীল রং খুব পছন্দের! নীল রঙের শাড়ি কিনবো, সে-ই সাথে নীল চুড়ি আর একটা মেহেদী। মা কত্ত খুশি হবে! ভাবলেই মনটা আনন্দে নেচে উঠেছে।
শাড়ি কিনতে কিনতে রাত এগারোটা। যে শাড়িগুলো পছন্দ হয় তার অনেক দাম। বাজেটের ভিতর পছন্দ মতো শাড়ি কিনতে সবগুলো দোকান ঘুরতে হয়েছে।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় বারোটা বেজে গেলো। সবাই খেয়ে ঘুমিয়ে গেছে হয়তো। খুব খিদে পেয়েছে, খাওয়ার ঘরে গিয়ে দেখলাম টেবিলের উপর খাবার সাজানো। হয়তো মা সাজিয়ে রেখে গেছে। এতো রাতে মা’কে বিরক্ত করলাম না। নিজের মতো খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লাম।
” এই ঈদের দিনেও ছেলেটা পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে! এই বাদশা উঠবি না নাকি?”
” মা আর একটু ঘুমাতে দেও, কয়টা বাজে সকাল?”
” সাতটা বেজে গেছে অনেক সময়, উঠে গোসল করে আয়। আবার ঈদের নামাজ পড়তে যাবি, কিছু খাওয়ার সময় পাবি না। ”
” আচ্ছা যাচ্ছি। ”
গোসল সেরে খাবার টেবিলে চলে গেলাম। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে মা নিজের হাতের সেমাই, পায়েস, নুডলস রান্না করেছে, সকলে মিলে খাওয়া শুরু করলাম। দাদি, ফুফু, আমি আর মা-বাবা, দাদি সকাল সকাল গোসল করে নতুন শাড়ি পরে নিয়েছে, ফুফুর পরনে সেই জামদানী, হয়তো সেলাই করে নিয়েছে। আমিও নতুন কাপড় পরেছি, শুধু মা-বাবা পুরনো কাপড় পরে আছে। উঠে ঘরে চলে এলাম, রাতে কিনে আনা জিনিসগুলো নিয়ে খাবার ঘরে ফিরে গেলাম।
” মা এই শাড়িটা তোমার জন্য। তামিম ভাইদের সাথে কাজ করেছিলাম, সবাইকে তিন হাজার টাকা দিয়েছে। সে-ই টাকা দিয়ে এনেছি। তুমি গোসল করে এইটা পরে আসো তো। ”
সকলে আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। কেউ হয়তো এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না ব্যাপারটা। মা’য়ের অন্যদিকে তেমন খেয়াল নেই এক দৃষ্টিতে শাড়িটা দেখে চলেছে।
” মা তোমার পছন্দ হয়েছে ? তোমার তো নীল রং খুব পছন্দের, তাই নীল রঙের শাড়ি এনেছি। ”
মা কথা বলতে পারছে না, মাথা নেড়ে হ্যাঁসূচক জবাব দিলো। মায়ের চোখের কোণে অশ্রুকণারা ভীড় করেছে। হয়তো এ কান্না সুখের! সব খুশি তো হাসিতে প্রকাশ পায় না। মা’কে শাড়িটা দিয়ে আব্বুর দিকে একটা শপিং ব্যাগ এগিয়ে দিলাম।
” আব্বু এইটা তোমার জন্য এনেছি। ”
” আমার জন্য আবার কি? ”
” আরে খুলেই দেখো না। ”
” তুই আমার জন্য পাঞ্জাবি কিনে এসেছিস? ”
” মা’কে যেমন কিছু কিনে দেননি, তেমনই নিজের জন্য কিছু কেনেননি। আমার আব্বা কি পুরনো পাঞ্জাবি পরে ঈদের নামাজ পড়তে যাবে! সেজন্য কাল রাতে কিনেছি এগুলো। ”
মা-বাবা কেউ কথা বলতে পারছে না, দু’জনের চোখের কোণে আনন্দ অশ্রু টলটল করছে। আব্বা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, ” দেখেছ বাদশার মা আমাদের ছেলেটা কত বড় হয়ে গেছে। ”
প্রতিত্তোরে মা শুধু মুচকি হাসলেন। মা এখন শাড়ি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছে। হয়তো এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না তাঁর ছেলে তাঁকে নতুন শাড়ি কিনে দিয়েছে।
” আব্বু একটা কথা বলবো?”
” হ্যাঁ বলো। ”
ফ
” আপনি দাদি ফুফুকে যা খুশি কিনে দিতে পারেন, এই আমার কোন সমস্যা নেই। তাই বলো সকলের মন রাখতে গিয়ে আমার মা বাবাকে বঞ্চিত করবেন এমনটা তো ঠিক না। বড় ফুফুকে ঈদের কাপড় চোপড় কিনে দিবেন, আপত্তি নেই, তাই বলে তার শশুর বাড়ির সবার জন্য উপহার কিনবেন আর মা বাদ পড়ে যাবে এটা তো ঠিক না। আপনি চাইলে সামান্য একটু কমদামি কাপড় সবাইকে দিতে পারতেন। ”
” সত্যিই তুই অনেক বড় হয়ে গেছিস! ভুলগুলো ধরিয়ে দেওয়ার জন্য তোর কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো রে বাবা। সত্যিই আমি অনেক অন্যায় করে ফেলেছি।”
” আব্বু এমনভাবে বলো না। ”
” না রে বাদশা, যে মানুষগুলো তোর ভুলগুলো ধরিয়ে দিবে তারা তোকে শুধরে দিতে চায়, তাঁরাই তোর প্রকৃত আপন লোক। আর যারা তোর ভুল কাজকে প্রস্রয় দেয় তাঁরা তোর ভালো চায় না। অন্ধ ভালোবাসা জীবনের জন্য ক্ষতিকর!”
কথাগুলো বলে আব্বা নিজের ঘরে চলে গেলেন। আজ মা বাবা দু’জনে খুব খুশি, আব্বাও নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। আমার কাছে এর থেকে বড় পাওনা কিছুই নেই। আব্বার সাথে ঈদের নামাজ পড়তে যাচ্ছি, রাস্তায় চেনা পরিচিত সকলে পাঞ্জাবির কথা বলছে। তাঁর ছেলে অনেক বড় হয়ে গেছে, মা বাবাকে ঈদের কাপড় কিনে দিয়েছে। আব্বা কত গর্ব করে সকলকে এসব কথা বলছে, দেখলে মনটা ভরে যায়। বাড়ি থেকে আসার সময় দেখলাম মা গোসলে গেলো, বাড়ি ফিরে নিশ্চয়ই মা’কে নতুন শাড়িতে দেখতে পাবো।
বড্ড খুশি লাগছে , সত্যিই আজ আমার ঈদ।
সমাপ্ত