#কহিনুর
কলমে: লাবন্য ইয়াসমিন
পর্ব:১৫
পথিব সকল পাপের মূল হচ্ছে লোভ। ভালো থাকার লোভে মানুষ কতকিছু করে। খারাপ কাজ করতেও পিছপা হয়না। আমি সুলতান রশীদ ফারুকীর একমাত্র পুত্র সুলতান ফারাবি ফারুকী। আমি বাবা মায়ের একমাত্র পুত্র সন্তান যদিও আমার আরেকটা বোন আছে। আমার বাবা বেশ প্রভাবশালী জমিদার ।।উত্তরাধিকারসূত্রে আমি বাবার সকল সম্পত্তির একমাত্র ওয়ারিশ। বোনের জন্য ছিল কিছু নগদ অর্থ আর বক্স বন্ধি স্বর্ণালঙ্কার। এটা নিয়ে বোন বা আমার কোনো অভিযোগ ছিল না। এটাইযে নিয়ম।।আমার বোন আঞ্জুমান ফারুকী যেনো আসমান থেকে নেমে আসা এক টুকরো চাঁদের কণা। প্রণাধিক প্রিয় ছিল আমার ভগ্নি। জলন্ত আগ্নি পিণ্ডের মতো ঝাঝালো ছিল ওর সৌন্দর্য। কন্ঠ ছিল ততধিক মধুর। আমাদের দু’ভাইবো মানুষ হয়েছিলাম কাজের মহিলা রহিমা খালার কাছে। আম্মা বহুকাল ইহজগৎ ছেড়েছেন। বাবা ছেলেমেয়ের মুখের দিকে তাঁকিয়ে আর দ্বিতীয় বিবাহের ঝামেলায় যাননি। ধীরে ধীরে আমরা দু’ভাইবোন বড় হলাম। বোনটা আমার থেকে বেশ ছোট। পরিণত বয়সের আগেই হঠাৎ বাবা আমার বিয়ে ঠিক করলেন উনার বন্ধুর মেয়ের সঙ্গে। বাবার কথা আগ্রহ করার ক্ষমতা কোনকালেই আমার ছিল না। তাছাড়া বিয়ে করবো না বলার মাতো তেমন কোনো কারণও তখন হয়ে উঠেনি। নতুন বধূকে পেয়ে খুব একটা মন খারাপ হয়নি। লাজুক ভঙ্গিতে নব বধূকে বরণ করে নিয়েছিলাম নিজের বক্ষপিঞ্জরে। বেশ ভালোভাবেই চলছিল আমাদের দিনকাল। সারাক্ষণ বউয়ের দুষ্টু মিষ্টি ভালোবাসা সহসা দক্ষিণা দোলা দিতো হৃদয়ে।কিন্তু ভালো মূহুর্তগুলো চোখের নিমিষে পার হয়ে যায়। বাবা অসুস্থ হলেন,তাঁর জমিদারির ভার আমার উপরে এসে পড়লো। বিয়ের বছর খানিক হয়নি তখনও। খাজনা আদায় করতে আমাকে বিভিন্ন গ্রামগঞ্জে যাওয়া আসা লাগতে থাকলো। আমি দক্ষ হাতে সবটা সামলাতে থাকলাম। বাবা ভরসাস্থল পেয়ে সুস্থ হয়েও আর কাজকর্ম করলেন না। ছেড়ে দিলেন আমার হাতে। আমি একজন দক্ষ জমিদার বনে গেছি। কোন এক গ্রীষ্মকালের সকালবেলায় বাড়ি থেকে রওনা হলাম দূরের এক গঞ্জে। কয়েকদিনের সফর। সঙ্গে নিয়েছি লাঠিয়াল বাহিনী পালকী আর আমার একমাত্র বিশ্বস্ত কর্মচারী জাফরুল্লাহ শেখরকে। লোকটা আমার নায়েবের কাজ করতো। একদম খাস কর্মচারী যাকে বলে। যখন যা বলেছি প্রশ্ন ছাড়া হাজির করেছে। এমন ছেলেকে পেয়ে আমি সত্যিই সৌভাগ্যবান ছিলাম। যাইহোক টানা একদিন চলল আমাদের পালকী। রাতে তাবু ভিড়িয়ে নিলাম একটা পদ্ম দিঘি সামনে রেখে। যদিও সামান্য দুরুত্ব ছিল তবুও অসুবিধা কিছু হতো না। গ্রামের প্রথমেই পুকুরটা পড়েছে। ভাবলাম পানির অসুবিধা থেকে বাঁচতে এটাই আমাদের উপযুক্ত স্থান। সেদিন রাতটা বেশ ভালোভাবে পার করলাম। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে আমি লাঠিয়াল বাহিনীকে পাঠিয়ে দিলাম গঞ্জের হাট থেকে খাবার কিনে আনতে। চাল ডাল এনে ওরা রান্না বসিয়ে দিলো। আমি তাবুতে থেকে অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। জানিনা কিসের এত ছটফটানি। কোন সর্বনাশের ঈঙ্গিত। আমি তাবু থেকে বেরিয়ে আসলাম। হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেলাম পুকুরের কিনারে। হঠাৎ পানির ঝপঝপ তরঙ্গে আমার দৃষ্টি সেদিকে পতিত হলো। ক্ষণিকের জন্য আমি থমকে গেলাম। দৃষ্টি স্থির হলো। আকাশ থেকে নেমে আসা কোনো হুর পদ্ম দীঘির পানিতে নেমে এসেছে। আমি দিসা হারা পথিকের ন্যায় এলোমেলো পা ফেলে সেদিকে এগিয়ে চললাম। হৃদয় পুলকীত হলো মেয়ের রূপের বাহার দেখে। আমি মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় মেয়েটার সম্মুখীন গিয়ে উপস্থিত হলাম। মেয়েটা ততক্ষণে কন্ঠ অবধি পানিতে নিজেকে নিমজ্জিত করে ফেলেছে। ভেজা কাপড় আর দীর্ঘ কেশ পল্লব গায়ের সঙ্গে লেপ্টে আছে। অবশিষ্ট পোশাক পানিতে ভাসমান। মেয়েটা দু’হাতে শরীর ঢাকায় চেষ্টা করছে কিন্তু ব্যার্থ। দীঘির স্বচ্ছ কাচের ন্যায় পানিতে আমি ওর ঠিকরে পড়া রূপের যাদুতে ঘায়েল । মেয়েটার মিষ্টি কন্ঠস্বরে আমার ধ্যান ভাঙলো,
> কে আপনি? এখানে কোন সাহসে এসেছেন? জানেন না এই পুকুরের আশেপাশে পুরুষের আসা নিষেধ?
মেয়েটা একদমে কথাগুলো বলে থামলো। আমি ফিচেল হাসলাম। জমিদার ফারাবি ফারুকীকে আটকাবে এমন সাহস এই এলাকায় কার আছে? আমি জমিদার পুত্র নিজের সয়ং জমিদার। যা আমার পছন্দ যা আমি নিতে আগ্রহী সেটা শুধুই আমার। আমি উপলব্দি করলাম দীঘির পানিতে অবস্থান করা ওই জলপরি শুধু আমার সম্পত্তি। শুধুই আমার। ঘরে যে স্ত্রী আছে সেটা বেমালুম ভূলে গিয়ে এই রূপসীর প্রেমে আমি হাবুডুবু খেলাম। মনে হলো আমি মদ্যপান করেছি। এতো নেশা আগে কখনও বুঝিনি। একেই বলে হৃদয়ের রক্তক্ষরণ। আমার সমস্ত ভাবনার অবসান ঘটিয়ে সামনের মেয়েটাকে বলে উঠলাম
> এহেন সময়ে তুমি দীঘিতে গোসল করছো মেয়ে? যদি পুরুষেরা আসে তখন? সমাজে মুখ দেখাতে পারবে? একঘরে করবে যে লোকে!
আমার প্রশ্ন শুনে মেয়েটা ভড়কে গেলো। নেত্র পল্লবে নেমে আসলো অশ্রুকণা। দীঘির পানিতে তা মিলেমিশে একাকার। আমি হাসলাম। এটাইতো চেয়েছিলাম আমি। আমাদের মুসলমান সমাজের মেয়েদের বাইরে গোসল করা তো দূর লেখাপড়া করার নিয়ম পযর্ন্ত নেই। উচ্চবিত্তরা খুব সখের বসে বাড়িতে মাস্টার রেখে শেখাতে পারে তবে সেটা খুব সৌখিন। বাংলা উপ্যাস বা গল্প আর আরবি জানতে পারলেই সে উচ্চতর শিক্ষিত মেয়ে। বিয়ের বাজারে এহেন মেয়ের দাম নেই বললেই চলে। মেয়েরা হবে পানির মতো স্বচ্ছ আর তরল । যেখানে রাখবে তেমনি চলতে হবে। যথেষ্ট কারণ আর পর্দা নিয়ে বাইরে যাওয়ায় যায়। কিন্তু এই মেয়েটা এত বাধা নিষেধ অবজ্ঞা করে কিভাবে দীঘিতে নেমেছে বুঝলাম না। কৌতূহল দমিয়ে রেখে বললাম,
> আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর দিলে আমি চলে যাবো। তোমার বলার উপরে নির্ভর করছে আমার যাওয়াটা। যদি ঝটপট না বলো তাহলে এখুনি আমি লোকজন ডেকে তোমাকে দেখাবো।
মেয়েটা চরম ভয়ে মুখটা কুকড়ে ফেলেছে। মেয়েটার মুখ দেখে আমি পৈশাচিক আনন্দ পেলাম। ওই নেত্রের জ্বল শুধু আমার কারণে ঝরবে আর আমার কারণেই বিলুপ্ত হবে। মেয়েটা আমার কথার উত্তর দিতে বাধ্য। আমি দ্বিতীয়বার কিছু বলার আগেই মেয়েটা উত্তর দিলো,
> জ্বী বলুন?
আমি বাঁকা হেসে জিঞ্জাসা করলাম,
> নাম কি তোমার?
> চন্দ্রিমা প্রিয়জনেরা সবাই চন্দ্র বলেই ডাকে।
> বাবার নাম? এই গায়ের কার মেয়ে তুমি?
> আমার বাবা ফকির নিজাম উদ্দিন শেখ। উনি ফকির সন্যাসী মানুষ।
মেয়েটার কথা শুনে আমার হাসিটা আরও দীর্ঘ হলো। সামান্য নিজাম শেখকে হাতের মুঠোয় নিতে আমার তো বাম হাতের খেল। আমি আর অপেক্ষা করলাম না। উঠে আসার সময় বললাম,
> চন্দ্র তুমি আর কখনও খোলা দীঘির পানিতে ভিজতে আসবে না। তোমার জন্য কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো।আমার চোখ ঝলসে গেছে তাঁর দায়ভার কে নিবে চন্দ্র? বাড়িতে যাও।
কথাটা বলে আমি পিছনে ফিরলাম না। দ্রুতগতিতে ফিরে এলাম নিজের তাবুতে। নায়েবকে ডেকে নিজের সর্বনাশের কাহিনি বর্ণনা করে বলে দিলাম, পদ্ম দীঘির পানিতে থাকা ওই ভেজা পদ্মটিকে আমার চাই। যেভাবেই হোক ওর বাড়িতে প্রস্তাব পাঠাও। আমার কথা আগ্রহ করার সাধ্য ছিল না। প্রস্তাব নিয়ে তখনই বেরিয়ে পড়লো নায়েব। চন্দ্রের বাবা ফকির সন্যাসী মানুষ জমিদারের পুত্রের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার মতো সাহস ছিল না। গ্রহণ করে নিলেন। আমি পেয়ে গেলাম আমার হৃদয় পটভূমিতে বাসা বাঁধা নতুন পুষ্পকে। সেরাতে আমাদের বিয়ে হলো। ভোরবেলা চন্দ্র কে নিয়ে ফিরলাম কিন্তু ওকে নিজের বাস ভূমিতে তুলতে পারলাম না। জমিদার হওয়ার সুবাদে আমাদের বেশ কিছু মহল ছিল। আমার পছন্দসই এক মহলে ওকে নিয়ে উঠলাম। লাঠিয়াল বাহিনী আর নায়েব কে কঠোর ভাবে নিষেধ করলাম বাড়িতে গিয়ে পাঁচকান না করতে। আমি মেতে উঠলাম চন্দ্রকে নিয়ে। আমার হৃদয় বক্ষের রাণী। যাকে ছাড়া আমি নিশ্বাস নিতেও ভূলে যায়। প্রথম স্ত্রীর কন্দনরত পত্র বাবার আদেশ অবজ্ঞা করে আমি পড়ে থাকলাম চন্দ্রের কাছে। ওর রূপের যাদুতে ঝলসে তখন আমি দিসাহারা। তবে অনুধাবন করলাম এভাবে আর কতদিন? চন্দ্রের জন্য হলেও জমিদারিটা ধরতে হবে। ভালোভাবে বাঁচতে হলে টাকার প্রয়োজন। আমি ওকে রেখে ফিরে এলাম প্রথম স্ত্রীর কাছে। মেয়েটার হাসিখুশি মুখটা ততদিনে মলিন হয়েছে। চোখের নিচে কালি পড়েছে। আমাকে একান্তে পেয়েই লজ্জায় নেত্রদ্বয় বন্ধ করে শুনিয়ে দিলো আমাদের জমিদারিতে নতুন বংশধর আসতে চলেছে। কথাটা আমার কাছে কি যে বিষাদের ছিল সেটা যদি লিখে বোঝাতে পারতাম।আমার চোখের আগুনে মনে হলো সে ভস্মীভূত হয়ে যাবে। পায়ে ঠেলে বেরিয়ে আসলাম অনাগত সন্তানের মাকে। আমার চন্দ্র ছাড়া এমন অধিকার কারো হতে পারে মানতে পারলাম না। চলে এলাম চন্দ্রের কাছে। দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলো। বাবা আর বোনের দীর্ঘ পত্রের ঘনঘটা লেগেই থাকলো। বোনের পত্রের প্রতিটা লাইন জুড়ে ছিল তাঁর ভাবিমায়ের বিষাদঘন চোখের পানির বর্ণনা। সেসব আমার হৃদয় কুঞ্জে কোনো চিহ্ন আঁকতে পারেনি। সুখের সমুদ্রে গা ভাসিয়ে চন্দ্রকে নিয়ে আমি চন্দ্র বিলাসে মেতে থাকি। চমৎকার মেয়ে ছিল চন্দ্র। সর্বদা সে আমাকে নতুন নতুন রূপে চমকে দিতো। আমি থমকে যেতাম। কিন্তু অচিরেই আমার সমস্ত সুখের অবসান ঘটিয়ে বাবা জেনে গেলেন সবটা। এসব কথা যে ঝড়ো হওয়ায় আগুনের ফুলকির মতো উড়ে বেড়ায়। ধামাচাপা দিতে পারলাম না। বাবা ছিলেন শক্ত ধাচের মানুষ। শক্ত হাতে জমিদারি সামলেছে। উনি পত্র আর লোক পাঠালেন আমার দুয়ারে। হুমকি দিলেন চন্দ্রকে ত্যাগ দিয়ে ফিরে যেতে। নয়তো চন্দ্রের ক্ষতি করতে উনি দু’বার ভাববেন না। আমি থমকে গেলাম। বাবা এক কথার মানুষ। যা ইচ্ছা করে বসবে। উপায়ন্তর না পেয়ে আমি চন্দ্রেকে আমার প্রথম স্ত্রীর কথা বলে দিলাম। চন্দ্র বিচক্ষণ মানুষ দক্ষ হাতে আমাকে সামলে নিলো। আমাকে বোঝালো। আমি চন্দ্রের জয় জয়কার করলাম। আহা এমন স্ত্রী পেয়ে আমি ধন্য। কিন্তু বাবাকে কি বলে বোঝাই? সেদিন রাতে চন্দ্রের কোলে মাথা রেখে আকাশের দিকে তাঁকিয়ে চন্দ্র বিলাস করছিলাম। মনে শতশত ভয় আর অশান্তি দানা বেঁধেছে। সেই মূহুর্তে চন্দ্র আমাকে বলে বসলো,
> আমি জানতাম আপনি সেদিন সেই দীঘির পাড়ে আপনি আসবেন। আপনার হৃদয় বক্ষের এইখানটাতে হাত রাখার অধিকার দিবেন।
আমি চমকে উঠে জিঞ্জাসা করলাম,
> চন্দ্র হেয়ালি করো না। বুঝিয়ে বলো।
> আপনাকে দেখেছিলাম মোড়লের কাচারীতে কোনো একদিন। আমি থমকে গিয়েছিলাম। এমন সুদর্শন যুবককে পাওয়ার লোভ আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো। কিন্তু বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানোর সাহস করা যে বড্ড অন্যায়। কি করবো মাথায় কিছু আসছিল না। বাবা সন্যাসী মানুষ নানারকম বই আর মানুষের যাতায়াত ছিল বাড়িতে। কাকতলীয় ভাবে একটা বই আমার হাতে আসলো। আমি বইটা পড়তে শুরু করলাম। খুব আর্কষণ করেছিল বইটা আমাকে। কালো যাদুর বইটা। আমি শুরু করলাম সাধনা করা। বইয়ের নির্দেশ অনুযায়ী সব কিছু যখন শেষের পথে সেই সময়ে একজন লোক আমার নিকট উপস্থিত হলেন। জানিনা সে কে?কোনো মানুষ নাকি জ্বীন বা শয়তান! আমাকে একটা পাথর দিয়ে বললেন এই পাথর কোনো সাধারণ পাথর না। এর থেকে যা ইচ্ছা তাই পাওয়া যাবে। তবে এটার বিনিময়ে কিছু খোয়াতে হবে। এই পাথরের গুণে আমি আপনার উপস্থিতি আগেই টের পেয়েছিলাম। চাইতে হলো না কিছুই। উনি আরও বলেছিলেন পাথরের অভিশাপ কাটাতে হলে পাথর মানবির জন্য অপেক্ষা করতে হবে। সব কিছুই ধবংস হয় তেমনি এই পাথরও হবে। তখন জন্ম নিবেন সে।।আমি এখন অবধি কিছুই চাইনি। আপনি চাইতে পারেন। সব বিপদ কেটে যাবে।
চন্দ্রের কথা আমার বিশ্বাস হলো না। অদম্য কৌতূহল আমাকে পেয়ে বসলো। ওকে নিয়ে আসতে বললাম পাথরটা। ও নিয়ে আসলো। চেয়ে বসলাম নিজের যত ইচ্ছে চাওয়া পাওয়া ছিল। চন্দ্র আমার হাতে একটা কাগজ তুলে ধরলো। সেখানে লেখা ছিল আমার সকল চাওয়ার বিনিময়ে খোয়াতে হবে আমার বংশের সকল মেয়েদের কন্ঠের ভাষা। বছরের পর বছর জন্ম নিবে অপরূপা সুন্দরী কন্যা। তাদের রূপে ঝলসে যাবে যেকোনো যুবকের হৃদয় কিন্তু তাঁরা হবে বোবা বধির। কোনো যুবক ইচ্ছা করলেই তাদেরকে নিজের আয়ত্বে নিতে পারবে না। মানব নিষিদ্ধ মানবী হবে তাঁরা। আমি রাজি হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম কিছু হবে না।
কিন্তু কাকতলীয়ভাবে পরদিন বাবা আসলেন আমার দুয়ারে। আমাকে আর চন্দ্রকে ফিরিয়ে নিতে। প্রথমে খুব খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু দ্বিতীয় খবরগুলো শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমার প্রথম স্ত্রী সন্তান প্রসবকালে ইহ জগতের মায়া ত্যাগ করেছে। জন্ম নিয়েছে এক ছেলে। আমি প্রাণাধিক প্রিয় বোনটা হঠাৎ বাক শক্তি হারিয়ে ভেঙে পড়েছে। তাঁর মুখের মিষ্টি কন্ঠে ভাইজান ডাকটা শোনার সৌভাগ্য থেকে আমি বঞ্চিত হয়েছি। আমি চমকে উঠলাম। কিন্তু চন্দ্র ছিল স্বাভাবিক। কি সর্বনাশীনির মোহ মায়ায় জড়িয়ে আমি নিজের ক্ষতি করেছি হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। বাড়িতে ফিরে ছুটে গিয়ে নিজের সন্তানকে জড়িয়ে ধরলাম। স্ত্রীর মুখটা দেখার সৌভাগ্য হলো না। বেচারী স্বামীর দেওয়া লাঞ্ছনা গঞ্জনা হৃদয়ে ধারণ করে পথিব মায়া ত্যাগ করেছে। কি যে কষ্ট হলো। হারিয়ে যাওয়ার পরেই আমি সেই রত্নের মূল্য বুঝতে পারলাম।। চন্দ্রকে দেখলেই তা হুড়মুড় করে বাড়তে থাকলো। বোনটা চুপসে গেছে।একদিন আত্মহত্যা করে বসলো। আমি চন্দ্রকে তাড়িয়ে দিতে পারিনি কারণ ততদিনে সুলতান বংশের অনাগত বংশধরের মা সে। দিন যেতে লাগলো আমার মধ্যে তিক্ততা বাড়লো। ছেলেকে বুকে নিয়ে নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম। জন্ম নিলো আমার দুই রাজকন্যা। খুশী হওয়ার বদলে আমি হতাশ হলাম। ওদের কন্ঠ যে আমি জন্মের আগেই কেড়ে নিয়েছি। সহ্য করতে পারলাম না। সিদ্ধান্ত নিলাম এবার আমার পাপের শাস্তি পাওয়া উচিৎ। ভেঙে পড়া মন আর শরীর নিয়ে আমি এই পথিব জগতে থাকতে চাইনা। পাথরটা গহিন অরণ্যে সমাধিত করলাম। দরকার নেই ওই সর্বনাশিনী পথর আর চন্দ্রের মতো মেয়েকে। ও আমার কাছে বিষাক্ত। কত বছর এভাবে সকলের অভিশাপ কুড়াতে হবে আল্লাহ্ ভালো জানেন।
অধরা এই পযর্ন্ত এসে থামলো। ডাইরীতে লোকটার লেখা শেষ হয়েছে। পরবর্তী পৃষ্ঠাতে জুবায়েরের দাদুর লেখা। উনার বাবা সুইসাইড করেছিলেন। ডাইরীটা উনার সেই চন্দ্র মায়ের থেকে প্রাপ্ত ছিল। জুবায়েরের বাবারা দুই ভাই জমজ। দেখতে হুবহু এক। জমিদারদের আমল ছিল না তবে বেশ জমিজমা অর্থসম্পদ ছিল সুলতানদের কাছে। জুবায়েরের বাবা বেশ ভালো মানুষ ছিলেন অন্যটা ছিল বেয়াড়া। জুবায়েরের বাবা জার্মানিতে এসেছিলেন যুবক বয়সে। এখানে এসে ব্যবসা করতে শুরু করেন। অল্পদিনের মধ্যে ভালো উন্নতি করেন। বিয়ে করেন। আরেকজন তখন বুদ্ধি করতে থাকে কিভাবে ভাইকে সরিয়ে নিজে দখল নিবেন। তাছাড়া উনার ঘরে তখন জন্ম নিয়েছে দু জোড়া বোবা বধির কন্যা। সুলতান বংশের অভিশাপ আর অর্থের লোভেই উনি কালো যাদুর বইটা নিয়েছিলেন।। ডাইরীতে উল্লেখ নেই উনি কালো যাদু শুরু করেছেন। এটা খুঁজে নিতে হবে। হয়তো উনি এসব করে অধরার সম্পর্কে জেনেছেন। ।অধরা ভ্রু কুচকে ফেলল ডাইরী পড়ে। মনে হচ্ছে কোনো রূপকথার গল্প পড়লত। মাথাটা ভনভন করে ঘুরছে। জুবায়ের এখনো ফিরে আসেনি। ওর জন্য চিন্তা হচ্ছে। অধরার ধ্যান ভাঙলো জুবায়েরের আগমনে। ছেলেটার চোখেমুখে রাগ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। ডান হাতের মুঠোয় চকচক করছে ধাঁরালো খঞ্জর। লোকটা ওর দিকে একটু একটু করে এগিয়ে আসছে। অধরার সারা শরীর বেয়ে শীতল শিহরণ বয়ে গেলো। মনে হলো এখনো বুঝি জুবায়ের খঞ্জরটা নিয়ে ওর উপরে ঝাপিয়ে পড়বে।
চলবে