#কলা_পাতায়_বাঁধিব_ঘর
#জিন্নাত_চৌধুরি_হাবিবা
#পর্ব_০৬
বউয়ের ডাকে সাড়া দিতে এসেই চমকে গেলো রাউফুন। বিড়বিড় করে বলল,
-“কি সাংঘাতিক! কি সাংঘাতিক! বউ দেখছি আমাকে পুড়িয়ে মা’রার সমস্ত বন্দোবস্ত করে রেখেছে।”
পুষ্প মিষ্টি হেসে বলল,
-“খাবার কি দেবো?”
রাউফুন মেকি হেসে বলল,
-“না থাক, আমার পেট মনে হয় ভরে যাচ্ছে।”
পুষ্প ঠোঁট কামড়ে হাসলো। রাউফুন ঢোক গিলে এদিকওদিক তাকিয়ে বলল,
-“আমাকে একটু শান্তিতে খেতে দাও। তুমি আপাতত রুমে যেতে পারো।”
পুষ্প গেলোনা। বরং রাউফুনের পাশের চেয়ারে বসে পড়লো। শাড়িতে নিজেকে আকর্ষণীয় করে সাজিয়েছে। রাউফুনের উদ্দেশ্য বলল,
-“আমি কিন্তু খাইনি, আপনার হাতে খাবো বলে।”
রাউফুন বিড়বিড় করে বলল,
-“এই মেয়ে তো দেখছি আজ আমায় জ্বালিয়ে খাবে।”
অগত্যা পুষ্পকে খাইয়ে দিতে হলো। খাওয়া শেষে ন্যাপকিনে মুখ মুছে রাউফুন বলল,
-“আমি কি চলে যাব?
কিন্তু আমি তো যেতে চাইছিনা।”
পুষ্প রাউফুনের সামনে দাঁড়ালো। দৃষ্টিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে মিটিমিটি হেসে বলল,
-“দেখুন তো আমাকে কেমন লাগছে? লাল রং টাতে ভালোলাগছে না?”
রাউফুন পুষ্পের হাত চেপে ধরে বলল,
-“পুষ্প ঘরে আসোতো। আজ কেনো? আগামী একবছরেও আমি শশুর বাড়ি থেকে যেতে রাজি নই।”
ঘরে গিয়ে পুষ্প এক ভয়ানক কাজ করে ফেললো। রাউফুনের গালে নরম ঠোঁট জোড়া ছুঁইয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। হতভম্ব রাউফুন ভেবে কূল করতে পারলোনা তার সাথে আজ সাংঘাতিক ব্যাপারগুলো কেনো হচ্ছে। বিষ্ময়ভাব কাটিয়ে পাশে শুয়ে পড়লো। সিলিং এ দৃষ্টি রেখেই বলল,
-“আমাকে মেসেজ করার উদ্দেশ্য কী ছিলো? এত এত সাজুগুজু করে নিজেকে আকর্ষণীয় করার কারণ কী?”
পুষ্প কথা বলতে পারলোনা। শুধু রাউফুনের দিকে ফিরে দু’হাতে তার গলা জড়িয়ে ধরলো। মিটিমিটি হাসলো রাউফুন।
★★★
ভোরটা ছিলো স্নিগ্ধময়, মিষ্টি রোদ ক্ষণে ক্ষণে উত্তাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে। খোলা জানালার পর্দাগুলো সরিয়ে দিতেই মিটিমিটি রোদ হেসে খেলে গড়িয়ে গেলো রঙিন কার্পেটে। রাউফুনের হসপিটাল যেতে হবে। তাড়াতাড়িই ঘুম থেকে উঠলো সে। একহাতে জড়িয়ে রাখা পুষ্পর দিকে কোমল দৃষ্টি ফেলে তার কপালে, গালে, নাকে অধরের ছোঁয়া বসিয়ে দিলো। একটু খানি উষ্ণ ছোঁয়ায় আরেকটু মিশে গেলো পুষ্প। রাউফুনের আগেই তার ঘুম ভেঙেছে। উঠে জানালা খুলে পর্দাগুলো সরিয়ে দিয়ে আবারও শুয়ে পড়েছে। সদ্য ঘুম থেকে জাগা ভাঙা ভাঙা গলায় পুষ্প বলল,
-“আপনি ছয়দিন আমাকে কোনো কল বা মেসেজ করেননি। একবার আসলেন ও না। কি সাংঘাতিক কঠিন মানুষ আপনি?”
রাউফুন আলতো হেসে বলল,
-“মাঝেমাঝে গুরুত্ব বোঝাতে দূরত্ব বাড়াতে হয়। তবে খুব বেশি দূরত্ব বাড়াতে গেলেও সম্পর্ক টেকে না। তুমি যদি মেসেজ নাও করতে, আজ আমি নিজ থেকেই আসতাম। তোমার যে এত সহজে বুদ্ধি হবে ভাবিনি আমি।”
একটু থেমে রাউফুন আতঙ্কিত গলায় বলল,
-“পুষ্প আমি বাইরে বের হবো কিভাবে? লোকে আমায় লজ্জা দেবে। লজ্জায় ম’রি ম’রি হয়ে আমি ঘরেই থেকে যাবো। আজ আর চিকিৎসা করতে হবেনা।”
পুষ্প অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“আজব তো, লজ্জা পাবেনই বা কেনো?”
রাউফুন বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে অবাক গলায় বলল,
-“কি সাংঘাতিক পুষ্প, তুমি তো দেখছি গতরাতের কথা ভুলেই গেলে। নিজেই তো সেজেগুজে কত রোমান্টিকতা দেখালে।”
রাউফুনের হাত সরিয়ে উঠে পড়লো পুষ্প। মুখে কিছুই আটকায়না এই লোকের। ওয়াশরুমের দরজার কাছাকাছি যেতেই শুনতে পেলো,
-“নিজের সংসারে ফিরছো কবে? আমায় বিয়ে করবেনা বলে বাহানা দিয়েছিলে তুমি বিয়ের জন্য প্রস্তত নও। এবার কৃপা করে স্বামী-সংসারে ফিরুন। আপনার শশুর-শাশুড়ি, ননদ আমার কানের পোকা মে’রে ফেলছে আপনার ফেরা নিয়ে।”
পুষ্প উত্তর না দিয়েই দরজা আটকে দিলো।
★★★
নাস্তার টেবিলে একজোট হয়ে সবাই উপস্থিত হয়েছে। নাবিল রাউফুনকে দেখতেই লাফিয়ে এসে দুলাভাইয়ার কোলে উঠেছে। রাউফুনের দুষ্টুমি করে বলল,
-“শালাবাবু তোমাকে বড় একটা মেয়ে দেখে বিয়ে করিয়ে দেবো। তখন বউয়ের কোলে চড়ে ঘুরতে পারবে।”
নাবিল বিয়ের কথা শুনে লজ্জা পেয়ে মুখ গুঁজে নিলো। রাউফুন চোখ ঈষৎ বড় করে বলল,
-“বাব্বাহ্ বিয়ের কথা শুনে দেখছি লজ্জা ও পাও।
তা কাকে বিয়ে করবে?”
পুষ্প খেতে খেতেই বলল,
-“রিশার তো নাবিলকে বেশ মনে ধরেছে। কি বলিস নাবিল, বিয়ে করবি আমার ননদকে?”
রাউফুন মাঝখানে কথা বলল,
-“তাহলে তো ভালোই হয়। আমি নাবিলের দুলাভাইয়া, তখন নাবিল হয়ে যাবে আমার দুলাভাইয়া। এখন নাবিল আমার কোলে চড়ে, তখন আমিও আমার দুলাভাইয়ার কোলে চড়বো।”
নাবিল চোখ বড় বড় করে বলল,
-“আমি তোমাকে কোলে নিতে পারবোনা দুলাভাইয়া। তুমি আপুর কোলে উঠিও।”
খাবার টেবিলে নাবিলের কথা শুনে সবাই একদফা হাসলো। রাউফুন মুখ ছোট করে বলল,
-“কিন্তু তোমার আপু নাকি আমায় কোলে নেবেনা। তাই আমি তোমার কোলেই চড়বো।”
নাবিলের বাবা এবার বললেন,
-“নাবিল এবার নেমে এসো। ভাইয়াকে খেতে দাও ঠিক করে।”
নাবিল নামতে চাইলোনা। রাউফুন ও নামার জন্য জোর দিলোনা। তাই আর কেউ বাড়াবাড়ি করলোনা।
সকাল থেকেই রেহানা খালা ফুলে আছেন। মূল সমস্যা হলো পুষ্পর দাদু। এই মহিলার জন্য ব্রাশ রাখা যায়না। রেহানা খালা রাতের বেলা এবাড়ি থাকলে পুষ্পর দাদুর সাথেই ঘুমায়। তাই ব্রাশ ও তেনার ওয়াশরুমে রাখে। কিন্তু পুষ্পর দাদু সকালে নামাজ পড়তে আগে উঠলেই রেহানা খালার ব্রাশ দিয়ে দাঁত মেজে বসে থাকে। কিছু বললেই খিটখিট করেন।
আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে রেহানা খালা দেখলেন তার ব্রাশ ভেজা। তিনি বুঝে গেলেন কাম সারছে। পুষ্পর দাদুকে বললেন,
-“এই বুড়ি, আপনি আমার বেরাশ দিয়া দাঁত মাজলেন ক্যান? ওয়াক থু, পান খাওয়া লাল লাল দাঁত গুলা দিয়ে আমার বেরাশের ইজ্জত শেষ করলেন।”
পুষ্পর দাদু তেতে উঠে বলল,
-“এক চটকনা মাইরা দাঁত ফালাই দিমু। তুই আমার বেরাশের লগে বেরাশ রাখোস ক্যান?”
রেহানা খালা দ্বিগুণ তেতে বললেন,
-“বুড়া মানষ, কয়লা বা ছাঁই দিয়ে মাজলেই পারেন। আবার বেরাশ ও লাগে।”
পুষ্পর দাদু লাঠি হাঁকিয়ে বললেন,
-“তোগোই খালি বেরাশ কইত্তে মন চায়। আমার মন চায় না? ঘর থেইকা বাহির হ। নইলে লাঠি দিয়া বাইড়াইয়া তোর কোমর ভাঙুম।”
রেহানা খালা ভাব দেখিয়ে বেরিয়ে এসেছেন। এ দুজন মানুষের মাঝে সাপে নেউলে সম্পর্ক। অথচ দাদু কিছু খাওয়ার আগে চুপে চুপে বউদের জিজ্ঞেস করবে “রেহানা চেমরিডারে দিছো?”
রোহানা খালাও দাদির সব এগিয়ে রাখেন। দাঁত নড়বড়ে বলে পান চিবুতে কষ্ট হয়। পান গুলো চেঁচে রেখে কৌটো ভরে রাখেন।
রেহানা খালার থমথমে চেহারা নজরে পড়তেই পুষ্পর মা জিজ্ঞেস করলেন,
-“রেহানা কি হয়েছে তোমার?”
রেহানা খালা চায়ের কাপ শব্দ করে রেখেই বললেন,
-“আপনেগো ঘরের এই আলাদিনের চেরাগের ভিরের জ্বীনটা আইজ আবার আমার বেরাশ দিয়া দাঁত মেজেছে। এই বাড়িত রাখতে হইলে আমার ঘর পাল্টান।”
পুষ্পর দাদু খ্যাঁক করে উঠলেন,
-“দূর কর এই হারামজাদিরে, নষ্ট করছে, ধ্বংস করছে। পায়খানার গন্ধ ছাড়াচ্ছে। শয়তান দূর হ, দূর হ শয়তান।
বলেই বিড়বিড় করে দোয়া দূরদ পড়তে লাগলেন।
রেহানা খালার রাগ কমাতে নাবিলের বাবা বলল,
-“আম্মা থামুন তো। কি শুরু করলেন দুজনে?”
সব চুপ হয়ে গেলো।
রাউফুন হসপিটালে যাওয়ার আগে বলল,
-“আমি বাসায় ফিরে যাবো। ঠিকঠাক মতো নিজের খেয়াল রাখবে।”
পুষ্প পরিপাটি কলারটি আরেকটু হাত বুলিয়ে ঠিক করে দিলো। রাউফুন একটু কাছে ঘেষে দু,কপোলে চুম্বন করে বেরিয়ে পড়লো।
★★★
দুদিন পরই পুষ্প রাউফুনকে ডেকেছিলো তার বন্ধুদের সাথে দেখা করার জন্য। দেখা হওয়ার পর থেকেই প্রিয়া বলছে,
-“ইশ্! কি হ্যান্ডসাম ডাক্তার। এই ডাক্তার আমার হলেও পারতো।
জীবনে করলাম কী? প্রথমে জাবেদ স্যারের উপর ক্রাশ খেলাম। ক্রাশ খাওয়ার পর জানলাম স্যারের বউ প্রেগন্যান্ট। এখন ডাক্তারের উপর ক্রাশ খেলাম, অথচ ডাক্তার ও বিয়ে করে বসে আছে। কি ফুটো কপাল আমার।”
বিনিময়ে পুষ্প চোখ রাঙিয়ে বলল,
-“আমার ডাক্তারের দিকে নজর দিলে তোর চোখ গে’লে দেবো।”
ক্লাস শেষ করে বাড়ি ফিরতেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো পুষ্প। এই মুহূর্তে এই অনাকাঙ্ক্ষিত পুরুষকে সে আশা করেনি। যে অবহেলা দিয়ে চলে যায়, গুরুত্ব দেয়না, তাকে আমরা জীবনের বিশেষ মুহুর্তে আশা করিনা। পুষ্প সোজা নিজের ঘরে ফিরে দরজা আটকে দিলো। কিছুতেই সে বের হবেনা আজ।
#চলবে……
(যারা গল্পটি পড়ছেন সবাইকে রেসপন্স করার অনুরোধ রইলো। হ্যাপি রিডিং।)