এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক❤️পর্ব-৮
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
কয়েকমূহর্ত চোখে চোখেই কেটে গেলো।রাত্রির আঁখিপল্লব থেমে গেছে।মায়াবী চোখজোড়া যেনো পলক ফেলতে ভুলে গেছে অকালেই।নিভ্রানের কালো চোখের মনিতে সম্মোহন লেগে যাচ্ছে।নিয়ন বাতির হলদে আলোতে মেয়েটার দৃষ্টি কেমন ঘোলাটে দেখাচ্ছে।যেনো অসচ্ছ অনুভূতিদের আস্ত এক সাম্রাজ্য।নিভ্রান পলক ফেললো।একবার,দুইবার,পরপর তিনবার।রাত্রি মধ্যে কোন পরিবর্তন দৃষ্টিগোচর হলোনা।নিভ্রান হাসলো।কিন্তু নিশব্দে।সোজা হয়ে রাত্রির বামগালে হাল্কা চাপড় মেরে বললো,
—“আরে,পলক তো ফেলুন,চোখে পানি এসে যাচ্ছে আপনার।”
সম্ভিৎ ফিরলো রাত্রির।একাধারে এতক্ষণ চেয়ে ছিলো বলে চোখ জ্বালা করছে।পানিও এসে পরেছে অল্প।মাথা নামিয়ে পলক ঝাপটিয়ে পানিগুলো সামলে নিলো সে।নিভ্রানের দিকে চোখ পড়তে নিমিষেই গুমড়ে গেলো।গায়ের কাঁটা দিয়ে উঠলো।লজ্জায় দ্রুত অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে অস্থিরভাবে রাস্তায় চোখ বুলাতে লাগলো।লোকটা কিভাবে এত ভয়ংকর একটা কথা এতটা অকপটে বলে ফেললো?
নিভ্রান হাসলো।আবারো ঝুঁকে কন্ঠে হাসির রেশ টেনেই বললো,
—“এতক্ষণ তো চোখই ফেরাতে পারছিলেন না।এখন কি হলো?”
রাত্রি একপলক তাকালো।কিছু একটা বলতে যেয়েও থেমে যেতেই নিভ্রান বললো,
—“থামলেন কেনো?বলুন।”
আমতা আমতা করলো রাত্রি।একটু সহজ হয়ে যেতেই অসাবধানতায় নিভ্রানের কাঁধ থেকে হাত নামিয়ে বললো,”আপনি এটা কি বললেন?”
রাত্রির হাতের অবস্থানটা লক্ষ্য করতেই খুব সন্তর্পণে রাত্রির কোমড়ে হাত গলিয়ে একটু সামনের দিকে টেনে নিলো নিভ্রান।রেলিংটা অতোটাও মোটা না।বলতে গেলে বেশ সরুই।একটু বেসামাল হলেই পড়ে যাবার সম্ভাবনা শতভাগ।রাত্রি উওরের আশায় চেয়ে আছে।নিভ্রান শ্বাস ফেলে বললো,
—“ভুল কিছুতো বলিনি।”
ফর্সা গালে টকটকে লালাভ আভা।রাত্রি ঠোঁট কামড়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলো।বারবার চোখের পলক ফেলাটাই তার অনুভূতিগুলোর নিরব বহি:প্রকাশ।নিভ্রান কাছে আসলো আরো একটু।নিশ্বাসের বহর রাত্রির ছাড়ামুখে ছড়িয়ে দিয়ে বললো,
—“আপনি লজ্জা পাচ্ছেন রাত।কেনো পাচ্ছেন জানেন?”
উওর দিলোনা রাত্রি।নিভ্রানের উষ্ণ নিশ্বাসের ঝড়ে ভেতরের উত্তাল তোলপাড়টা বেড়ে যাচ্ছে।রাত্রির উশখুশানি লক্ষ্য হতেই নিভ্রান সরে গেলো।রাত্রি ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করলো।অত:পর
ঘাড় বাকিয়ে ব্রিজের নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর কালো পানির দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যর সুরে বললো,
—“সত্যিকার অর্থে এসব কথার কোনো মানে নেই মিস্টার।এসব মানুষ শুধু বলার জন্যই বলে।বাস্তবতাটা একেবারে ভিন্ন।খুব কঠিন।সেখানে এসব আবেগি উক্তির মূল্য নেই।বুঝলেন?”
নিভ্রান চমকালো না।অপ্রতিভও হলোনা।খুব স্বাভাবিকভাবেই কথাটা হজম করে নিলো।রাত্রির থেকে এমন কিছুই আশা করেছিলো।মেয়েটা অন্যরকম।ঠোঁটের কোণ প্রসারিত করে সে বললো,
—“আপনাকে একদিন এই উক্তির মূল্য বুঝিয়ে দিবো রাত।”
—“সেই একদিনের অপেক্ষায়…”মুচকি হেসে বললো রাত্রির কন্ঠে ছাড়া ছাড়া ভাব।
নদীর পানিতে রং নেই।আকাশে চাঁদ থাকলে হয়তোবা ঝলমল করতো।বেশ কিছুক্ষণ দুজনের দৃষ্টিই নিরবে সেই পানির দিকে নিবদ্ধ হয়ে রইলো।মধ্যকার দুরত্ব খুব কম।পরিবেশটা আচ্ছন্ন হতেই ধ্যান ভেঙে গলা ঝাড়লো রাত্রি।ঘাড় ফিরাতেই নিভ্রানকে নিজের খুব কাছে পেলো।শুকনো একটা ঢোক গিললো সে।কন্ঠ খাদে নামিয়ে বললো,
—“সরুন,নামি।বাসায় যেতে হবে।”
নিভ্রান সরে গেলো।রাত্রি হাল্কা লাফে রাস্তায় নেমে এলো।জামার ধুলো ঝাড়ছে তখনই নিভ্রান বললো,
—“আপনার বাসার না গেট আটকে দিয়েছে?”
রাত্রি ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,
—“সমস্যা নেই।একটু অনুরোধ করলেই ঢুকতে দিবে।বেশি হলে দু-চারটা কথা শোনাবে।এই আরকি।”
নিভ্রানকে অসন্তুষ্ট দেখালো।
—“আপনি অকারণে কথা শুনবেন কেনো?”
রাত্রি জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললো,
—“অকারণ কোথায়?এইযে দেরি করে ফেলেছি।এটাই তো মূল কারণ।”
—“আপনার কথা শুনতে হবেনা।আমার ফ্ল্যাটে চলুন।সকালে আপনাকে বাসায় পৌছে দিবোনে।”
—“পাগল হয়েছেন?”চমকানো গলায় প্রশ্ন করলো রাত্রি।
—“পাগল হওয়ার কি আছে?আপনি আমাকে বিশ্বাস করেন না রাত?”ব্যাথিত কন্ঠে বললো নিভ্রান।
—“বিশ্বাস অবিশ্বাস নিয়ে তো কিছু বলিনি।”
নিভ্রান রাত্রির হাত টেনে ধরলো।একরোখা গলায় বললো,
—“তবে চলুন।”
রাত্রি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।হতাশ গলায় বললো,
—“আপনি পাগলামো করছেন।”
_________________
অন্ধকার রুম।বিছানায় বসে আছে নিভ্রান।রাত্রি আসেনি সাথে।মেয়েটা খুবই সচেতন এসব ব্যাপারে।
হাজার বলেও সাথে আনতে পারেনি শেষমেষ বাড়িতে পৌছে দিয়ে ফিরে এসেছে।সে নিজেও খুবই একরোখা,জেদি স্বভাবের।যা একবার বলে তাই করে।সেই যে বাবার সাথে মনমালিন্যর জের ধরে বাড়ি ছেড়ে একা থাকতে শুরু করেছে তো করেছেই।এখন অবধি সে নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল।মায়ের শতবার ফিরে যাওয়ার কথা বলাও তাকে বাড়ি ফেরাতে পারেনি।আজও ভেবেছিলো মেয়েটাকে সাথে নিয়েই ফিরবে।কিন্তু রাত্রি তার স্বভাব উল্টে দিলো।তার একরোখা আবেদনকে ছাপিয়ে দিয়ে নিজেকে জয়ী করে নিলো।এলোনা তার সাথে।
পড়ার টেবিলে বসে একদৃষ্টে স্টিলের গ্লাসটার দিকে চেয়ে রয়েছে রাত্রি।আজ আসার পথে না বলতেই তিনটে কদম ছিঁড়ে হাতে ধরিয়ে দিয়েছে নিভ্রান।রাত্রি সযত্নে সেগুলো গ্লাসের পানিতে ভিজেয়ে রেখেছে।লোকটাকে আজ ভরপুর পাগলামিতে জেঁকে বসেছিলো।তাকে বেশ কষ্টের সাথেই সামাল দিতে হয়েছে।বোঝাতে বেগ পেতে হয়েছে।
কদমগুলার উপর হাত বুলিয়ে টেবিলে হাত রেখে সেই হাতের উপর কাত করে মাথা রাখলো রাত্রি।উদাসমুখে কদমের দিকে মায়াভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভাবলো,যা হচ্ছে তা কি আদৌ ঠি ক হচ্ছে?তার কি নিজেকে প্রশ্রয় দেয়া উচিত?নাকি এই উথালপাথালের জীবনে একটুখানি সুখের লোভটা সামলানো উচিত?
মাথায় আসছেনা।সবকিছুতেই এত প্রশ্নবোধক চিহ্ন কেনো?
_________________
ঝকঝকে সকাল।ভার্সিটির জন্য বেরোচ্ছে রাত্রি।চোখেমুখে অস্থিরতা।আজ পরীক্ষা অথচ তার দেরি হয়ে গেলো।কাঁধে ব্যাগ চাপিয়ে যেইনা সিড়িভেঙে নিচে নামছে তখনই বাড়িওয়ালি রাহেলার ডাক।থেমে গেলো রাত্রি।সদর দরজা খোলা।রাহেলা দরজার সামনেই ছিলো বিধায় রাত্রিকে তার সহজেই চোখে পড়েছে।
রাত্রিকে কাছে এসে দাড়াতে বললেন উনি।উদ্দেশ্য কিছু কথা শোনানো।কালরাতে বেশ রাত হওয়ার কিছু বলতে পারেনি।তারউপর তার স্বামীও থামিয়ে দিয়েছিলো।মেয়েটা নিয়ম ভেঙেও খুব সহজেই পার পেয়ে গেছে।
রাত্রি দরজার সামনে দাড়াতেই সে কন্ঠে হাল্কা ঢং ঢেলে বললো,
—“তুমি যে কাইল এতো রাইতে ফিরলা আমাদের মান সম্মানের তো একটা ব্যাপার আছে।তাইনা?”
রাত্রি রাগে কটমট করলেও দোষটা নিজের হওয়ার দমে গিয়ে বললো,
—“ক্ষমা করবেন আন্টি।”
—“এই রাত বিরেতে গেছিলা কই?খোজখবর তো নেয়া লাগবে তাইনা?একা থাকো।একাই যাও,একাই আসো।কোথায় কি করে বেড়াও তারপর শেষমেষ আমার বাড়ির বদনাম হইবো।”
প্রচন্ড বিরক্ত হলো রাত্রি।এই মহিলার কথাবার্তা গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেয়।রাগ উতলে আসে।তবু চাপে পরে চুপ থাকে।এই ভাড়ায় এমন বাসা আর পাওয়া মুশকিল।তাই সে যথাসম্ভব ঠান্ডা গলায় বলার চেষ্টা করলো,
—“আপনি কি বলতে চাচ্ছেন?আমি বাইরে গিয়ে উল্টাপাল্টা কাজ করি?আমি সারাটা দিন টিউশনি করি আন্টি।”
—“এত কথা কও কেন মুখে মুখে?মাইয়া মানুষ নরম কইরা কথা বলবা।”
—“আমি এমনই আন্টি।শক্তের ভক্ত,নরমের জম।যাই হোক,আর কখনো দেরি হবেনা।আসছি তবে।আমার পরীক্ষা আছে আজ।দেয়া করবেন।”বলে স্হান ত্যাগ করে রাত্রি।রাহেলার ভেতরের চাপা রাগটা বাড়লো আরো খানিকটা।
রাস্তায় জ্যাম।রিকশা নিলে আরো দেরি হবে বিধায় হেঁটেই যাত্রা শুরু করেছে রাত্রি।হাঁটতে হাঁটতে গলির মোড়ে এসেই থমকে দাড়ালো সে।বাঁক ঘুরে একটু সামনে আগালেই মতিন মিয়ার দোকান পড়বে।কালরাতের ঘটনার পর ওই লোকটা কি এখনো তার দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকাবে?হয়তো কিছু করার সাহস পাবেনা কিন্তু নিরবে তাকে চোখ দিয়ে গিলে তো ঠি কই নিবে।হয়তো এতোদিনও একই কাজ করেছে কিন্তু সে তো আর জানতোনা।কয়েকমূহুর্ত থম ধরে দাড়িয়ে থেকে চোখ বুজে জোরে একটা শ্বাস নিলো রাত্রি।কানে বাজলো নিভ্রানের কালরাতের বলা একটি কথা”আপনিতো এতো দুর্বল নন”।চোখ খুললো রাত্রি।বুকের কোনো এককোঁণে যত্নে বেড়ে উঠা ভয়টাকে নিশ্বাসের সাথেই নির্গত করে দিয়ে হনহন করে হেঁটে পাশ কাটিয়ে গেলো মতিন মিয়ার দোকান।
~চলবে~