#এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক❤️পর্ব-৪১
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
নদীর পানি ঠান্ডা। পায়ের আঙ্গুল ডুবানো হিমজলের অতলে। বাতাসে গা শিরশির করছে। চোখের মনিতে ভাসছে স্রোতের প্রতিচ্ছবি। পেট থেকে মুখ সরিয়ে মাথা সোজা করলো নিভ্রান, একাধারে চোখ ডুবালো প্রিয়তমার অবাধ্য চুলে, মায়াবী মুখশ্রীতে, হৃদয় কাঁপানো চোখের মনিতে।
নওশাদ সাহেবের কানে খবরটা পৌছালো নিশাদের মাধ্যমে। রাত্রির প্রেগনেন্সি সিম্টমস্ দেখা দিয়েছে অথচ তার ছেলে একবার জানালোনা পর্যন্ত। তাকে জানায়নি ঠি ক আছে কিন্তু নাহিদাকে তো অন্তত জানাতে পারতো। রিপোর্টে কি এসেছে তাও জানালোনা। আর সেই খবর নিশাদও জানেনা। শুধু বললো, টেস্ট করতে দিয়েছে।
সাতপাঁচ না ভেবে তিনি আচমকাই ফোন লাগালেন নিভ্রানের নাম্বারে। বিগত কয়বছরে প্রথমবারের মতো।
শেষ কললিস্ট টা নেই। তারিখ টাও নেই। কতআগে কথা হয়েছিলো এই নাম্বারে তা যন্ত্রটাও ভুলে গেছে। তিনি তো মানুষ। তবু ভুলেননি। দিনটা ছিলো নিভ্রান বাড়ি ছেড়ে যাবার তিনদিন আগে। রাতে ফিরতে খুব দেরি করেছিলো ছেলে। নাহিদা কেঁদেকেটে অস্থির। তখন বাসায় আসার জন্য ফোন করেছিলেন তিনি।
ধ্যান ভাঙলো। রিং হচ্ছে। এক একটা শব্দতরঙ্গ যেনো অভিমান ধুলিস্যাৎ করার ধারালো ফলা। সব কাঁটাতার, বাধাবিগ্রহ ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিবে।
নিমগ্ন প্রণয়বিলাসের মাঝে হঠাৎ শব্দটা একেবারেই সহ্য হলোনা নিভ্রানের। মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। কপালে ভাঁজ পরলো। রাত্রি আস্তে করে বললো,
—“ফোন বাজছে আপনার।”
নিভ্রান ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লো। পকেট হাতরালো। ফোন বের করে স্ক্রীনের দিকে অদ্ভুত চোখে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। ইংরেজি অক্ষরে “Baba” দিয়ে সেভ করা নাম্বারটা। সে তো অন্য কোনো নাম্বার সেভ করেনি এই নামে। তবে? ফোনটা কি তারই? অবিশ্বাস নিয়ে হাত উল্টে ব্যাককভার দেখলো। হ্যাঁ, তারইতো। রাত্রি তাড়া দিলো,”ধরুন।”
নিভ্রান একপলক তাকিয়ে বললো,”তোমার ফোন কোথায়?”
রাত্রি এদিকওদিক তাকিয়ে দেখলো। সাথে ব্যাগ নেই। গাড়িতেই রয়ে গেছে। ফোন ব্যাগের ভিতরেই। নিভ্রানের প্রশ্নাত্বক চাহনীর বিপরীতে শূন্য মস্তিষ্কে সে বললো,
—“আমার ফোন? গাড়িতে মনেহয়।”
নিভ্রানের জট পাকানো চাহনী ধাতস্থ হলো এতক্ষণে,
—“তোমার সাথেই কথা বলতে চাইছে তাহলে। ফোনে পায়নি তাই আমাকে দিয়েছে। ধরো।”
—“উফফো, নাহ।” বলে নিজেই হাত বাড়িয়ে স্লাইড করে রিসিভ করে দিলো রাত্রি। শক্ত করে হাতটা টেনে নিভ্রানের কানে চেপে ধরলো ফোনটা। ওপাশ থেকে চেনা গলার স্বর,”হ্যালো”। নিভ্রান অপ্রস্তুত বোধ করলো। কিছুক্ষণ স্তব্ধ চেয়ে থেকে কোল থেকে মাথা উঠিয়ে বসতে বসতে বললো,”জি…বলেন।”
নওশাদ সাহেব এদিক ওদিক গেলেন না। সোজা প্রশ্ন করলেন,”রিপোর্ট হাতে পেয়েছো?”
নিভ্রান আবারো বিব্রত হলো। উনি জানেন বিষয়টা? অগোছালো স্বরে বললো,”পেয়েছি।”
নওশাদ সাহেবের তৎক্ষনাত পাল্টা প্রশ্ন,
—“কি এসেছে?”
এবার যেনো লজ্জার অথৈ সাগরে ডুবে গেলো নিভ্রান। শব্দভান্ডার ফুরিয়ে গেলো। কন্ঠনালি তে অপরাধবোধের বিদ্রোহ। তার আগেই জানানো উচিত ছিলোনা? প্রথমবার বাবা হবে। বাবাকেই জানানো হয়নি? ধুর, তাকে কেনো ফোন দিলো? রাত্রিকে দিলেইতো পারতো। নওশাদ সাহেব উওর না পেয়ে বললেন,”হ্যালো?”
নিভ্রান নিচু গলায় উওর দিলো,
—“জি, পজিটিভ।”
ওপাশে নিরবতা। তারপর খুব নরম গলার অতিপ্রসন্ন স্বর,”আগে জানাবেনা?”
নিভ্রানে চাঁপা হাসলো। মনে মনে হয়তো বিস্তর হাসলো। খুব গোপনে হাসি লুকিয়ে অন্যপাশের তুলনায় আরো কোমল গলায় বললো,
—“এখনো বাসায় পৌঁছিনিতো, পৌঁছেই জানাতাম।”
কথা শেষ হলো ভালোভাবেই। তার সাথে কথা বলে রাত্রির সাথেও কথা হলো। এতদিনে এই প্রথম বোধহয় কোনরকম আগ্রাসী, বাকবিতন্ডতাহীন কথোপকোথন হলো বাবা-ছেলের।
______________
নিভ্রান মিষ্টি নিয়ে গেলো ব্যাকসিট পুরো ভর্তি করে। নিশাদ নওশাদ সাহেবের কাছ থেকে খবর পেয়ে আগে থেকেই দ্বিগুন উৎসাহ নিয়ে মিষ্টি দিয়ে বাসাভর্তি করে রেখেছে। শেষমেষ মিষ্টিতে মিষ্টিতে টি কতে না পেরে রাতেই পুরো বিল্ডিংয়ের প্রতিটা ঘরে ঘরে দেয়া হলো। আশেপাশের পরিচিতদের বাসায় বিতরণ করা হলো। রাত্রি বসে বসে আগাগোড়া তব্দা মেরে দেখেই গেলো দুই ভাইয়ের পাগলামি।
সেখানে থেমে গেলেও হতো। পরেরদিন নাহিদা, নওশাদ সাহেব দুজনই এলেন। তাদের আরেকদফা পাগলামি। নাহিদা হাতের চুড়ি খুলে রাত্রিকে পড়িয়ে দিয়ে গেলেন। নওশাদ সাহেব হাতে উপহার গুঁজে দিয়ে গেলেন। নিভ্রান মানা করলোনা কোনোকিছুতেই। প্রথমবার মা- বাবা হবার অনুভূতি তবে এতোই সুখের, আনন্দে ঠাসা?
সময় পেরোলো নিয়ম মেনেই। দিনের পর রাত। রাতের পর দিন। পেরিয়ে গেলো মাস। বদলে গেলো ঋতু, প্রকৃতি, জীবনধারা।
______________
দিনটা মঙ্গলবার। রাত্রির শরীরটা ভালো থাকেনা ইদানীং। তিনমাসে পেট উঁচু হয়েছে খানিকটা। শাড়ির উপর থেকে অবশ্য বোঝা যায়না তেমন। বারান্দার সন্ধ্যামালতী গাছে নতুন দুটো ফুল ফুটেছে। সাদা রং। সূর্যের আলোয় কী রুপ তাদের।
বুকের উপর বই রেখে ঘুমিয়ে পড়া রাত্রির হাত থেকে বইটা ছাড়িয়ে নিলেন নাহিদা। পাশে রেখে গায়ে চাদর টেনে দিলেন। আগামী সপ্তাহ থেকে পরীক্ষা। পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে যায় খালি। মেয়েটা ঘেমে গেছে এসির মধ্যেও। শাড়ির আচঁল দিয়ে গলা মুছিয়ে দিলেন তিনি। শেষমেষ ফুলগাছে পানি দিয়ে পর্দা টেনে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে। এখানে এসেছে দু’সপ্তাহ হলো। রুবিনা নিজেই অসুস্থ। চাইলেও মেয়ের খেয়াল রাখাটা হয়ে উঠেনা তার। ওষুধের ডোজে বিছানায়ই পড়ে থাকেন সারাদিন। নিভ্রান অফিসে থাকে। ক’দিকে খেয়াল রাখবে সে?
রাত্রি উঠলো বিকেলের দিকে। চোখে তখনো ঘুমের রেশ। ক্লান্তি কাটেনি। ভার্সিটি বন্ধ এ সপ্তাহে। এতেই যেনো একটু স্বস্তি। টি উশনি ছেড়েছে আজ একমাস। আস্তেধীরে উঠে বাইরে গেলো সে। নাহিদা তখন রুবিনার রুমে বসা। গল্প করছে দুজনে। ঘরের দরজা খোলা বিধায় সহজেই রাত্রিকে চোখে পড়লো। নাহিদা তড়িঘড়ি করে এগোতে এগোতে চেঁচিয়ে উঠলো,”আহা! একা একা আসলে কেনো? ধুরো! মেয়ে আমার কথা শোনেনা একদম। দাড়াও, দাড়াও ওখানেই।”
রাত্রি চেয়ার ধরে দাড়িয়ে গেলো। মাথাটা আসলেই ঘুরাচ্ছে। দুপুরে যা খেয়েছিলো তা সঙ্গেসঙ্গেই বমি করে ফেলে দিয়েছে। তারপর আর পেটে কিছু পরেনি। নাহিদা এসে ধরলেন। চেয়ার টেনে বসালেন। পানি খাওয়াতে গেলেই রাত্রি বললো,”না না, বমি হয়ে যাবে। খাবোনা।”
নাহিদা গ্লাসটা ঠোঁটের সাথে ঠেকিয়ে একরোখা কন্ঠে বললেন,”এটা পানি। পানি খেলে বমি হয়না।”
—“হবে মা, বিশ্বাস করেন।”
তার কাতর কন্ঠে হেরে গেলেন নাহিদা। পানিটা নামিয়ে রাখলেন টেবিলে। মাথার চুলে আঙ্গুল বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
—“বমির জন্য না খেয়ে থাকবে?”
রাত্রি ছোট্ট গলায় উওর দিলো,”নাহ্, খাবোতো। পরে।”
আটটা দশ।
কোলের উপর বালিশ রেখে খাতায় কি যেনো লিখছে রাত্রি। সামনে পড়ার বই খোলা। সেখান থেকে দেখে দেখেই কিছু একটা লিখছে সে। নাহিদা ঢুকলেন। ড্রেসিং টেবিল থেকে তেল নিলেন। বিছানায় উঠে পিছে বসে তালুতে ঘঁষতে গেলেই রাত্রি আৎকে বললো,”না, তেল না। মা, কেমন চটচটে লাগে, প্লিজ।”
নাহিদা শুনলেন না। এত্তগুলো ঢেলে দিয়ে হাত দিয়ে ঘঁষে দিয়ে বললেন,
—“চুপ, পাজি মেয়ে। মাথাব্যাথা করবে খালি। তেল দেয়না একটু। এতসুন্দর চুলগুলো সারাক্ষণ জট পাকিয়ে রাখে। চুপ করে লিখো। আমি তেল দিবোই।”
রাত্রি চোখমুখ কুঁচকে বসে রইলো। নাহিদা তেল মাখালেন আচ্ছামতো। বিলি কেটে কেটে গোড়ায় গোড়ায় ডলে দিলেন। রাত্রি মাথা পিছে ঠেলে নাহিদার পেটে ঠেকিয়ে চোখ বুজে রইলো। হাল্কা গলায় বললো,
—“আপনার ছেলে কখন আসবে মা? আমার ভালো লাগছেনা।”
নাহিদা ভেতরে ভেতরে হেসে ফেললেও মুখে রাগ দেখিয়ে বললেন,
—“খাবেনা দাবেনা। ছেলে আসলেই ভালো লাগবে নাকি?”
—“লাগেতো। আপনার ছেলে আসলে আমার খুব ভালোলাগে।”
—“আসবে মা, ওরোতো কাজ থাকে তাইনা?”
রাত্রি উওর দিলোনা সাথেসাথেই। তবে কিছুক্ষণ পেরোতেই অবুঝের মতো কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
—“ফোন দিননা মা। আসছেনা কেনো? এতক্ষণে তো চলে আসেন উনি।”
নাহিদা উপায় না পেয়ে ফোন দিলেন। মেয়েটা যখন তখন মন খারাপ করে ফেলে আজকাল। নিভ্রান ধরলো প্রথমবারেই। অস্থির গলায় বললো,”কি হয়েছে মা? রাত ঠি ক আছে?”
নাহিদা ফোঁস করে বললেন,
—“তুই ওকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারিসনা? জানিসইতো দেরি হলে কান্নাকাটি করে। এত দেরি হয় কেনো তোর? ফাজিল ছেলে।”
নিভ্রান স্বস্তির শ্বাস ফেলে বললো,”আবার কান্নাকাটি করছে? আচ্ছা, দাও ওকে। আমি বুঝাই। দাও।”
~চলবে~