এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক❤️পর্ব-২৪
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
নিভ্রান অবাকচোখে ক্রন্দনরত মেয়েটার দিকে চেয়ে রয়েছে শুধু। চোখে বিস্ময়। রাত্রি হাউমাউ করে কাঁদছে। কান্নার দমকে শ্বাস আটকে আটকে আসছে। কয়েকবার মুখ হা করে দম নিতে হচ্ছে। নিভ্রান বিহ্বল চোখে চেয়ে দীর্ঘ:শ্বাস ফেললো। মেয়েটাকে এতোটা ভেঙে পড়তে দেখেনি কখনো। এমন পাগলের মতোকাদতে দেখেনি। রাত্রি আবারো মুখ হা করে শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করলো। এবার তাকে বুক থেকে সরালো নিভ্রান।
গালে হাত রেখে চোখমুখ মুছিয়ে দিলো।লাভ হলোনা, পানি গড়িয়েই চলেছে।অবিশ্রাম, অনবরত।
রাত্রি থমকে থমকে বললো,”আ..আমার…মা..মাকে..ওরা..”উত্তেজনায় বাকিটা উচ্চারিত হলোনা।কন্ঠ আটকে গেলো।চিবুক উঁচিয়ে হেঁচকি তুললো সে।
নিভ্রান ফের চোখ মুছিয়ে দিলো। দু’গালে হাত রেখে মুখ বরাবর ঝুঁকে বোঝানোর মতো করে বললো,আচ্ছা ঠি কাছে,আমার কথাটা শুনো।এভাবে কাঁদলে হবে?বলেছিলাম না তোমাকে কান্না মানায় না।শান্ত হও,কাঁদেনা।দেখি।আর কাঁদেনা রাত,হয়েছে।”
রাত্রি মাথা নুয়ে ফেললো। থুতনির সাথে গলা ঠেকে গেছে। জোরে জোরে শ্বাস টেনে কান্না থামানোর চেষ্টা করলো সে। ভয়ে আৎকে উঠছে মন। কখন যেনো মামা ফোন করে খারাপ সংবাদ শোনায়। এই মাকে ঘিরেই তো তার যতো উথাল পাথাল। জীবনযুদ্ধের উত্তাল ঢেউয়ে সে তো মা নামক খুঁটি টাকে ধরেই আটকে আছে। মা না থাকলে আর কি নিয়ে বাঁচবে?
রাত্রিকে কিছুটা শান্ত হতে দেখে নিজেকেও ধাতস্থ করলো নিভ্রান। গাল থেকে হাত সরিয়ে কপালের চুল সরিয়ে দিলো। সিটবেল্ট বেঁধে দিলো। ততক্ষনে কান্নার শব্দ থেমেছে রাত্রির। চোখের মনি লাল। গোলাপি ঠোঁট ফুলে মনে হচ্ছে টোকা দিলেই রক্ত গড়িয়ে পড়বে।যেনো কোনো রক্তে ভেজা লাল পাপড়ি।
নিভ্রান স্বস্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।কোমলস্বরে বললো,
—“কি হয়েছে আন্টির?খুলে বলো।এভাবে কাঁদলে হবে?আমাকে বলতে হবে তো রে বাবা..”
রাত্রি ফোঁপানো কন্ঠে উওর দিলো,”মা..মা হসপিটালে।”
—“হসপিটালে কেনো? কি হয়েছে?”
—“আমি জানিনা। আমি..”কথা শেষ হলোনা। চোখ বন্ধ হয়ে গেলো। পাপড়িগুচ্ছ ভিজে উঠছে আবারো।
নিভ্রান স্হির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। পকেট থেকে ফোন বের করলো। সময় দেখলো।ড্ রাইভ করে চট্রগ্রাম পৌছাতে পৌছাতে কম করে হলেও পাঁচ-ছয় ঘন্টা লেগেই যাবে। ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লো সে। গাড়ির চাবি ঘুরিয়ে ব্রেকে হাত চালাতে চালাতে বললো,
—“আচ্ছা ঠি কাছে,জানতে হবেনা।তুমি চুপ করে বসো।আমরা পৌছে যাবো সময়মতো।”
রাত্রি চোখ মুছলো।নাক টেনে ক্ষীণ কন্ঠে বললো,”আপনাকে বিরক্ত করলাম।”
নিভ্রান আড়চোখে তাকিয়ে গাড়ি চালানোয় মনোযোগ দিলো।দাঁতে দাঁত চেপে ঠান্ডা গলায় বললো,
—“কান্না না করলে ঠাটিয়ে দুটো চড় লাগাতাম গালে। আমি কি মারা গেছি? এমন একটা সময় একা না এসে আমাকে বলা যেতোনা? যদি কিছু হয়ে যেতো? খারাপ মানুষের অভাব আছে পৃথিবীতে? ফোন পেয়ে কিভাবে এসেছি তা শুধু আমি জানি।”
নিভ্রানের কন্ঠে তীব্র ক্ষোভ,চাপা অভিমান,প্রিয়জনের চিন্তায় অস্থির হওয়া প্রেমিকের হাহাকার।রাত্রি প্রত্যুওর করলোনা।চুপটি করে বসে ব্যাগ থেকে ফোন বের করলো।কয়েকবার ফোন দিলো মামার নাম্বারে।ওপাশ থেকে রিসিভ হলোনা।
নিভ্রান লক্ষ্য করলো পুরোটাই। কিছু একটা ভেবে ভ্রু কুঁচকে বললো,
—“আন্টি না তোমার মামার বাসায় থাকেন?উনারা আছেনা সাথে?”
—“আছে।”
—“তবে?এত ভয় পাচ্ছো কেনো?”
রাত্রি ধীর গলায় উওর দিলো,
—“উনারা আছে দেখেই ভয় পাচ্ছি।”
—“মানে?”
কিছুক্ষণ চুপ!নিভ্রান উওরের অপেক্ষায়। রাত্রি মুখ তুলে কাতর চোখে তাকালো। একপলক সেই চোখে চোখ পড়তেই বাকিটা বুঝে ফেললো নিভ্রান। রাত্রি চোখ নামিয়ে নিলো। আচমকাই করে বসলো এক অদ্ভুত আকুতি,”আমার হাতটা একটু ধরবেন প্লিজ?”
নিভ্রান থতমত খেলো।শূন্যচোখে তাকালো।উতলা অবিশ্বাস ঘন্টা বাজাচ্ছে।মেয়েটা কি সত্যিই নিজ থেকে হাত ধরতে বলছে?নিজের কানকে মিথ্যাবাদির তকমা লাগিয়ে দিয়ে ভ্রু উচিয়ে সে বললো,”হু?”
রাত্রি আবার বললো,”ধরুননা।”কন্ঠে কাতরতা,অধৈর্য আবদার,আদুরে মিনতি।
প্রেমানুভূতিরা সাদরে অভিবাদন জানিয়ে আলিঙ্গন করে গেলো। নিভ্রান হাসলো মনে মনে। আলতো করে রাত্রির ছোট্ট নরম হাতটা টেনে নিলো নিজের শক্তপোক্ত হাতের মধ্যিখানে। আঙ্গুলে আঙ্গুল ডুবিয়ে ঠোঁটের কাছে এনে আচমকাই তপ্ত এক চুমু খেলো উল্টোপিঠে। বললো,
—“কিছু হবেনা রাত।”
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। রাত্রির চোখে ঘুম নেই। চাতক পাখির মতো সূদুর রাস্তার পানে চেয়ে আছে নির্ঘুম নয়ন। নিভ্রান একমহূর্ত বিরতি নেয়নি। গাড়ি থামায়নি। অবসন্ন হাত অবিরাম গাড়ির চাকা ঘুরিয়ে যাচ্ছে রাস্তার বাঁকে বাঁকে। বৃষ্টির সুরের তাল কেটেছে। আকাশের মেঘ ফুরিয়ে গেছে। জলপাতে বিঘ্ন ঘটেছে।
নিভ্রান দেখলো রাত্রির চোখে দীর্ঘকায় ক্লান্তি। মেয়েটা তবুও চোখের পাতা বুজতে নারাজ।
—“রাত,ঘুমাও একটু।পৌছাতে আরো অনেকক্ষণ।”
—“ঘুম আসছেনা।”বাইরের দিকে তাকিয়েই নির্বিকার উওর দিলো রাত্রি। কন্ঠই বলে দিচ্ছে সে কিছুতেই ঘুমাবেনা।নিভ্রান শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলো পাগল এক সন্তানের মায়ের প্রতি অগাধ ভালবাসা।
________________
হাসপাতালে পৌঁছালো সকাল ন’টা নাগাদ। এদিকের পথঘাট নিভ্রানের চেনা নেই। রাত্রি দেখিয়ে দেখিয়ে নিয়ে এসেছে। মামাকে ফোনে পেয়েছিলো একবার। সদর হাসপাতালে এডমিট আছে তার মা। কেবিন নাম্বার জেনে নিয়েছিলো তখনই বিধায় খুঁজে পেতে সমস্যা হয়নি।
রাত্রির ডানহাত নিভ্রানের শক্তমুঠোয় আবদ্ধ। কেবিনের সামনে যেতেই মামা লিয়াকত হোসেনকে দেখা গেলো। সাতসকালে রাত্রিকে দেখে তিনি যথেষ্ট স্বাভাবিক থাকলেও নিভ্রানকে তার পাশে দেখে মূহুর্তেই চেহারার আকার বদলে গেলো। কুন্চিত হয়ে গেলো চোখ। কাছাকাছি আসতেই বাঁকা গলায় প্রশ্ন ছুড়লো,
—“এ কে?”
রাত্রি বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা করলোনা। মানুষের উল্টো কথাবার্তাকে সে ইহজনমে দাম দেয়নি আর না এখন দিবে। নিভ্রানকে নিয়েও সে বিন্দুমাত্র বিচলিত না। কাঠকাঠ কন্ঠে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়লো,
—“মা কেমন আছে? ভেতরে ঢোকা যাবে? ডাক্তার কি বলেছে? আর হয়েছিলো কি? আমি তো গতপরশুও কথা বললাম তখনতো দিব্যি ভালোমানুষ। একদিনে তো কেউ এত অসুস্থ হয়ে যায়না মামা?”
লিয়াকত হোসেন কপালের ভাঁজের পরত বাড়িয়ে বললেন,
—“তুমি সঙ্গে পোলা মানুষ নিয়া আইসো কেন? এইসব কেমন বেহায়াপনা?”
—“যেটা বলেছি সেটার উওর দিন। কাকে নিয়ে এসেছি সেটা তো আপনার দেখার বিষয় না নিশ্চয়?”
লিয়াকত হোসেন দমে গেলেন। নিভ্রান তখন মনোযোগ দিয়ে ফোনে কাজ করছে। আজকে অফিসে যেতে পারবেনা। তাছাড়া সে যে রাতে বাসা থেকে বেরিয়েছে কেউ জানেনা। সময় নিয়ে নিশাদকে লম্বা টেক্সট করে ফোন নামালো সে। রাত্রির আর ভদ্রলোকের কথা কানে এসেছে। কিন্তু মাঝে একহাত বাড়িয়ে কথা বলেনি। সে জানে তার রাত একাই যথেষ্ট উল্টাপাল্টা মানুষের মুখ বন্ধ করার জন্য। রাত্রির কথার আকারে ইঙ্গিতে বোঝা হয়ে গেছে সামনের লোকটা অতি সম্মানীয় কেউ নন। সুতরাং শ্রদ্ধাভক্তির কোন মানে হয়না। কেবিন থেকে একজন নার্স বেরিয়ে এলো।নিভ্রান তাকে থামিয়ে বললো,
—“এক্সকিউজ মি? এই কেবিনের পেশেন্টের সাথে দেখা করা যাবে?”
নার্স সম্মতি দিলো।বললো পেশেন্টের জ্ঞান নেই তবে ভেতরে গেলে সমস্যা হবেনা।নিভ্রান আলতো করে রাত্রির হাতে টান দিলো,
—“আসো,আন্টির কাছে চলো।”
রাত্রি নামানো গলায় বললো,”বাকি বিষয়ে পড়ে কথা বলছি মামা। আগে মা কে দেখে আসি।”
বলে একপা বাড়িয়ে যেতে গিয়েও থেমে গেলো সে।ব্যাগ খুলতে খুলতে বললো,”কত টাকা খরচ হয়েছে আপনার?”
লিয়াকত সাহেব চড়া গলায় উওর দিলেন,”সাতহাজার গেছে।”
রাত্রি মনে মনে শ্বাস ফেললো। গোলমেলে চিন্তাযুক্ত শ্বাস। তবে বাইরে একেবারেই প্রকাশ পেলোনা কিছু। ব্যাগ থেকে পাঁচহাজার টাকা বের করে লিয়াকত সাহেবের দিকে এগিয়ে দিয়ে স্পষ্টভাষায় বললো,”বাকি দু’হাজার পরে দিবো।আমাকে রিসিপ্টটা দেখাবেন।আপনি আদৌ সত্যি বলছেন কিনা আমারতো তা জানা নেই।”
নিভ্রান শুধু দাড়িয়ে দাড়িয়ে মত্ত হয়ে শুনলো তার প্রেয়সীরূপী শান্তশিষ্ট বাঘিনীটার তলোয়ারের মতো ধারালো শব্দবাচন।কে বলবে এই মেয়েটা কয়েকঘন্টা আগেও তার বুক ভাসিয়ে কাঁদছিলো?
~চলবে~
[অনেকের অভিযোগ পর্ব ছোট হয়। আপনারা জানেন আমার পরীক্ষা চলছে। সকালে অনলাইন ক্লাস,বিকালে পরীক্ষা। তারপর গল্প লিখে আবার এডিট করতে হয়। বানান চেক করতে হয়। ভুলভাল বানান লিখলে আমার নিজেরই পড়তে ইচ্ছে করে না। পর্ব ছোট হলেও আমি রেগুলার দিতে চেষ্টা করি। তাই একয়টা দিন আপনাদের একটু ধৈর্য ধরার অনুরোধ রইলো❤️]