#এ_শহরে_তুমি_নেমে_এসো 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০৭
“অপূর্ব ভাই, সাপটা আমাদের খেয়ে খেলবে এটা সিউর। সাপকে কেউ আঘাত করলে, সাপ তাকে পাল্টা আঘাত করবেই।” আঙুল তুলে সিরিয়ার ভঙ্গিতে বললাম। ততক্ষণে তুর শেফালী এসে দাঁড়িয়েছে। চালতায় ভাগ বসিয়ে বলে, “দাদি মা গল্পে বলেছেন, একজন পুরুষ একটি সাপের লেজ কে/টে ফেলেছিল। সে সোনার সিন্দুকে লুকিয়েও বাঁচতে পারে নি। সাপ ঠিকই ছো/বল দিয়েছে।”
তুর বলে, “আজ আমরা তিনজন বড়োদের সাথে ঘুমাব। সাপ যদি আমারে ছো/বল দেয় তখন?”
আমরা বইখাতা রেখে পোশাক নিয়ে অগ্রসর হলাম দিঘির দিকে। ক্লাসে যাওয়ার পূর্বে মামি আধ গ্লাস খেজুরের রস খেতে দিয়েছিলেন। শীত লাগবে না, বরং গরম লাগছে। তাই গোসল করতে গেলাম। পাড়ে পোশাক রেখে পানিতে নামলাম। আমাদের হাঁসগুলো চক বেঁধে সাঁতার দিচ্ছে।
কাঁদার ভেতরে পায়ে বাঁধল কিছু। একটু নুয়ে হাতের স্পর্শে অনুভব করলাম কী? ব্যর্থ! হাতে নিয়ে ভেসে উঠলাম। হাতের ডিম। অন্যহাতে শেফালীর দিকে পানি ছুড়ে বললাম, “দেখ ফালি, পানিতে হাঁসের ডিম।”
তুর শেফালী একসাথে সাঁতার দিয়ে আমার নিকট এলো। ডিমগুলো নিয়ে বলে, “সত্যি তো, কিন্তু হাঁসের ডিম পানিতে কেন?”
তুর ভয়ে ভয়ে বলে, “এটা সাপের ডিম না-তো?”
আমার হাত রীতিমতো কাঁপছে। ডিমগুলো হাত ফসকে পরার উপদ্রব হলো। চ্যাঁচিয়ে বললাম, “সাপের ডিম পেয়েছি, কে কোথায় আছো এদিকে এসো।”
ওদিকে দোলনার দিকে বসে আছে সবাই। আমার চিৎকারে ছুটে এলো। গলা পর্যন্ত পানিতে ডুবে হাত উপরে তুলে বললাম, “দেখো, সাপের ডিম।”
“নিয়ে আয়।” বলে মামি দু সিঁড়ি নিচে নামল। শেফালী ডিম নিয়ে গেল। পর্যবেক্ষণ করে বললেন, “এটা হাঁসের ডিম। ঠ্যাঁং ভাঙা হাঁসটা প্যাক প্যাক করে ডাকছে। এদিকে আমি আশায় আছি ‘কবে ডিম দিবে’ ওদিকে পানিতে ভেসে ভেসে ডিম পাড়ছে। ডুব দিয়ে দেখ তো, আর আছে কি-না।”
আমি ডুব দিয়ে চারটা ডিম পেলাম। সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার পূর্বেই একটা সাপ দেখতে পেলাম। জমে গেলাম পানিতে। ঠান্ডার চেয়ে ভয়ে হাঁটু কাঁপছে। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে অস্ফুট স্বরে বললাম, “মামি, দেখো ঐ সাপটা আমাকে ছো/বল দিতে হাজির হয়েছে। আমাকে বাঁচাও। বিশ্বাস করো, আমি ইচ্ছে করে চাপা দেই নি।”
কাকতালীয় ভাবে সাপটা আমার চারপাশেই ঘুরঘুর করছে। শেফালী তুর দু’জনে উপরে উঠে গেছে। উচ্চশব্দে কেঁদে উঠলাম আমি। মামি চিৎকার করে বললেন, “আরে পা/গ/ল, এই সাপে ছো/বল দিলে কিছু হবে না। তুই যেটাকে চাপা দিয়েছিস, সেটা বোরা সাপ। এটা গোবুরে সাপ।”
আমি পর্যবেক্ষণ করে দেখলাম। হ্যাঁ! এটা গোবুরে সাপ। গোবরে এদের বসবাস। এদের বিষ গোবরে থাকে। কাউকে ছোবল দিলে কোনো রুপ ক্ষতি হয় না, তবে গোবরে পরলে বিষ শরীরের প্রবেশ করে। আমরা যেহুতু গরু পুষি, সেহেতু গোবরের স্পর্শ অস্বাভাবিক কিছু নয়।
বোরা সাপটা নির্ঘাত গোবুরে সাপকে পাঠিয়েছে। চোখজোড়া খিঁচে বন্ধ করে নিলাম। পানির শব্দ পেলাম। তাকাতেই নিবদ্ধ হলো অপূর্ব ভাইকে। পানিতে নেমেছেন তিনি। সাপটা পানিতে তলিয়ে গেছে। ভয়টা দৃঢ় হলো। তার অবস্থান সম্পর্কে অবগত হওয়ার উপায় নেই। অপূর্ব ভাই একদম নিকটে এলেন। তাড়া দিয়ে বললেন, “তাড়াতাড়ি চল।”
“না, সাপে পা পড়বে। আমাকে খেয়ে ফেলবে।”
“বলছি তো, চল। কিছু হবে না।”
“না! আমি আপনার কথা শুনব না।” অপূর্ব ভাই ঠোঁট চেপে অন্যদিকে তাকালেন। আশেপাশে তেমন কেউ নেই। ভয় লাজ লজ্জা সবকিছু পিছু ঠেলে কোলে তুলে নিলেন আমায়। আচমকা ঘটা ঘটনায় তাজ্জব বনে গেলাম আমি। অপূর্ব ভাই কাঁধ জড়িয়ে ধরলাম। অস্ফুট স্বরে বললাম, “সাপে ছো/বল দিলে?”
“তোর পা আর পরছে না। দিলে আমাকে দিবে, আমি সয়ে নিবো।” বলেই অগ্রসর হলেন। তার মুখ মণ্ডলে ছিটে আসা জলকণা গুলো সূর্যের হালকা রোদ্দুরে চিকচিক করে উঠছে। কিছুটা পিঞ্চ করে বললাম, “অপূর্ব ভাই ধরুন, সাপটা আপনাকে ছো/বল দিল। অতঃপর আপনি আমাকে ছুঁয়ে দিলেন। আপনি তো আমাকে গরু বলেন। বলেন আমার মাথাটা গোবরে ভর্তি। মাছি ভনভন করে। সেই গোবরের থাকা সাপের বিষে আপনি মা/রা যাবেন।”
“তুই তো শান্তি পাবি।” কথাটা হৃৎপিণ্ডে আঘাত হানল। তার মুখশ্রী দেখতে ব্যস্ত হলাম।
___
চাঁদের স্নিগ্ধ আলো পতিত হচ্ছে পৃথিবীতে। আজ নয় জ্যোস্না, তবুও আলোকিত। অর্ধ চন্দ্র। অবেলায় ভিজে হালকা ঠান্ডা লেগেছে অপূর্ব ভাইয়ের। মামি আদা দিয়ে কড়া এক কাপ চা করে দিয়েছেন। চায়ের চাপ নিয়ে হাজির হলাম অপূর্ব ভাইয়ের ঘরে। সবকিছু গোছগাছ করা। আগামীকাল তিনি চলে যাবেন। চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস নিলাম। অতঃপর চায়ের কাপ রাখলাম। অপূর্ব ভাই ওয়াশরুমে আছেন। পানির শব্দ শুনা যাচ্ছে। বিছানার পাশে টাকার থলে। ভেতরে অনেক টাকা। নিঃশব্দে দুইশত টাকা লুকিয়ে রাখলাম। অপূর্ব ভাই পেছন থেকে ডেকে উঠলেন। “ওখানে দাঁড়িয়ে কী করছিস?”
টাকার ব্যাগটা রেখে আমতা আমতা করে বললাম, “কিছু না। এমনি দেখছিলাম সবকিছু।”
অপূর্ব ভাই ব্যাগ সরিয়ে রেখে বললেন, “সরাস নি তো?”
“না।”
“সিউর?”
“হম।”
চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বললেন, “কাল ফিরে যাচ্ছি। বেশ কয়েকদিন থাকলাম। এবার যেতে হবে।”
ফট করে বললাম, “সুজন স্যার আমাদের আর পড়াবেন না? তিনি যে আসছেন না।”
“ফেব্রুয়ারি থেকে পড়াবে। পৌষ মাস। ধান আছে, ক্ষেতে সবজি ফলন। তুই আজকাল তার খবর নিচ্ছি? ব্যাপার কী বল তো?”
“কী যে বলেন আপনি? এখন থেকে প্রচুর পড়তে হবে।”
অপূর্ব ভাই বিছানায় রাখা এক গাদা কাগজ সামনে রাখলেন। চট করে বুঝে ফেললাম এগুলো কী? বর্ষ পরীক্ষার খাতা। গম্ভীর গলায় বললেন, “তোর সব খাতা। দেখব কী লেখেছিস।”
মাথা নিচু করে বেরিয়ে এলাম। ঘরে গিয়ে খুলে বললাম সবটা। তুর একটু রাগান্বিত হলো। তার ভাইয়ের টাকা নিয়েছি বলে। তবে শেফালী সেই খুশি। গার্ডদের দিয়ে তিনটা মোজো আর বিস্কুট, কেক, চানাচুর এনেছি। ওড়নাটা কোমরে বেঁধে মা/তা/লের মতো অভিনয় ধরে গান ধরলাম,
“মুই এক নে/শা-খোর
ভাইয়ের টাহা, চু/রি হইরা
মুই হইছি যে চো/র! চো/র! চো/র!
মুই এক নে/শা খোর!”
“কত টাকা চু/রি করেছিস?” বাক্যটা কর্ণপথে শ্রবণ হওয়া মাত্র থেমে গেলাম। কোমর থেকে ওড়না খুলে দাঁড়ালাম। কাঁচুমাচু করে বললাম, “এটা তো গান। কাবিলা গেয়েছিল।”
অপূর্ব ভাই একটা পানি ভর্তি জগ টেবিলে রেখে বললেন, “সাত মিনিটের মাথায় পানি টুকু শেষ করবি। এক ফোঁটা পানিও যাতে জগে না থাকে।”
“আমি কী করেছি?”
“প্রথমত, আমার কাছে পাঁচ হাজার তিনশত আঠাশ টাকা ছিল। দুইশত টাকা নেই। গেল কোথায়?”
কাঁচুমাচু করে ওড়না টেনে অকপটে উত্তর দিলাম, “আমি জানি কোথায়?”
“চুপ! ভয় করে না তোর? দ্বিতীয়, তোর ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ খাতা দেখেছি। প্রশ্নে লেখা ‘মাথা পিছু আয় কাকে বলে?’ উত্তরে লিখেছিস, ‘যাদের মাথা পিছনে। এক কথায় বিকলাঙ্গ। তারা যা আয় করে তাকে মাথাপিছু আয় বলে।’ এবার কী বলব তোকে বল?”
অস্ফুট স্বরে বললাম, “মাথা মানে মাথা। পিছু মানে পেছনে। আয় মানে উপার্জন। অর্থাৎ মাথা পিছনে থাকা মানুষের আয়।”
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]