এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ৪২

0
617

#এ_শহরে_তুমি_নেমে_এসো 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৪২

জানালা পাশে বসে রাতের আকাশ দেখছি। পাখি তার ভাই বোনের সাথে আছে। এখন পর্যন্ত চুপ করে আছি। ভালো লাগছে না কিছু। তিস্তা আপু, শেফালী আর তুর এলো ঘরে। একবার তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। তিস্তা আপু পাশে বসে হাতটা টেনে নিলেন। বিনীত সুরে বললেন, “আরু আমাকে ক্ষমা করে দিস। আমার জন্য তোর জীবন থেকে এতটা দিন হারিয়ে গেছে। অপূর্ব ভাই হাসপাতালের কোমায় ছিলেন। পাখি বাবা মা ছাড়া ছিল।”

বলেই তিস্তা আপু কেঁদে দিলেন। আমি বিছানা ছেড়ে উঠে গেলাম। বলতে ইচ্ছে করে, “যাওয়ার সময় কেন তুমি আমাকে সাথী করে নিয়েছিলে? তুমি না নিলে মামা আমাকে বাবার হাতে তুলে দিতেন না। আমার জীবনটা অগোছালো হয়ে যেতো না।”
বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। বারান্দাটা অনেক সুন্দর। পেছনে পেছনে এলো তাঁরা। তিস্তা আপু আবার বললেন, “ক্ষমা চেয়ে কোনো লাভ নেই আমি জানি। আমি তোকে এতো কিছু ফিরিয়ে দিতে পারব না। বিশ্বাস কর, আমি পাখিকে তার মায়ের অভাব বুঝতে দেই নি। নিজের ছেলে আর তোর মেয়েকে একা হাতে মানুষ করেছি। ঘর জামাই হয়ে আমি আর সুজন এখানেই ছিলাম।”

তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই থেমে গেল তিস্তা আপু। আঙুল তুলে বললাম, “আমার সামনে একদম ভালো সাজতে আসবে না, বলে দিলাম। আমার মেয়েকে তুমি মায়ের অভাব বুঝতে দাওনি। কিন্তু আমি মেয়ের অভাব বোধ করেছি। জন্মের পর ওকে একবার ছুঁয়েও দেখতে পারি নি। এক ঝলক দেখেছি শুধু। আমার জীবনে যা কিছু ঘটেছে তার জন্য তুমিই দায়ী। একমাত্র তুমি। কখনো আমি তোমাকে ক্ষমা করব না। বের হয়ে যাও।”

চিৎকার করে বললাম শেষের কথাটা। তিস্তা আপু, শেফালী আর তুর হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ থেকে অশ্রু ঝরছে। তিস্তা আপু রিনরিনে গলায় বলে, “তুই ঠিক হয়ে গেছিস আরু?”

“আমার মাথা গরম আছে, কথা বলিও না। যাও এখান থেকে।”
অপূর্ব পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। আমার কথা বোধহয় শুনেছেন। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলে, “কী হয়েছে এভাবে কথা বলছিস কেন?”

“পা/গ/ল করতে বাধ্য করেছো, পা/গ/ল হয়েছি। পা/গ/লদের মাথায় সেন্স থাকে না, জানো না? কি বলে তারা নিজেরাই জানে না।” মাথা চেপে চ্যাঁচিয়ে বললাম। অপূর্ব ভাইয়ের আমাকে ধরলেন। ওদের ইশারা করলেন চলে যেতে। অবিলম্বে চলে গেল তারা। গালে হাত দিয়ে বলে, “ওদের সাথে এমন করছিস কেন? (ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই প্রসঙ্গ পাল্টে বলে) চুলের কী অবস্থা আল্লাহ। মেয়েটাকে টাকা দিতাম তোর যত্ন নিতে। আমার প্রিয় চুলগুলোর এই অবস্থা। অথচ সে যত্ন নেয় নি।”

“নিতে দিলে তো দিবে?”

“মানে, বুঝলাম না। এই আরু, আমি কিছু বুঝতে পারছি না। তুই কী স্বাভাবিক হয়ে গেছিস।” তার কথাতে আমি জবাব দিলাম না। অপূর্ব বসলেন আমায় নিজে। নিজের হাতে তেল মাখিয়ে দিতে লাগলেন। তেল দেওয়া শেষ করে দুই পাশে দুই বেনুনি করে দিলেন। বেনুনি টেনে বললেন, “একদম বাচ্চা আরু। ঠিক আগের মতোই আছে। পিয়াসের কে/টে দেওয়া চুল কতো বড়ো হয়েছে। দাঁড়া আমি খাইলে দিচ্ছি।”

ওয়াশরুমে গেলেন। হাত ধুয়ে ফিরে এলেন। খাবার নিয়েই এসেছিলেন। হাত ধুয়ে বসলেন খাইয়ে দিতে। আমি মুখ সরিয়ে ফেললাম। অপূর্ব বুঝলেন আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। তবুও বললেন, “হা কর, খেয়ে নেয়। খেয়ে ওষুধ খেতে হবে। নাহলে হবি কীভাবে?”

আমি হাঁ করলাম। নিজের হাতে লোকমা তুলে দিলেন মুখ। অনেক কষ্টে চোখের অশ্রু সংযত করলাম। আর কিছুক্ষণ আরু, পাঁচ বছর তো অনেক অভিনয় করেছিস। আর কিছুক্ষণ কর।
খাওয়ার পর্ব শেষ করে আলো নিভিয়ে দিলেন। শুয়ে পড়লাম দু’জনে। ললাটের মাঝ বরাবর অধর স্পর্শ করলেন। জড়িয়ে ধরে বললেন, “আজ আমি একটু শান্তিতে ঘুমাবো আরু। একটু নয় অনেক অনেক শান্তি নিয়ে ঘুমাবে।”

মৃদু স্বরে বললাম, “পাখি? ও আসবে না?”

“না, ভাই বোনেদের সাথে থাকবে এমনই। দুই বোন মিলে তিহানকে (তিস্তার ছেলে) জ্বালাবে।”

অপূর্ব থামার পূর্বেই দরজা খুলে গেল। পাখি এসেছে। বাচ্চা বাচ্চা কণ্ঠে বলে, “তোমরা আমারে রেখে শুয়ে পড়েছো?”

“হ্যাঁ, তুমি তো তোমার ভাই বোনদের সাথে থাকবে।” অপূর্ব বললেন।

“আজ তো মা আছে। ওদের সাথে কেন থাকব?”

“তাহলে এতক্ষণ ওদের সাথে কেন ছিলে?”

“মা যদি আমাকে মা/রে বা ব/কে, তাই দূরে ছিলাম। এখন ঘুমিয়ে গেছে। তাই কিছু বলতে পারবে না।”

পাখির কথাতে আমি চোখ বন্ধ করে রাখলাম। পাখি এসে আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিল। বাবা মেয়ের মাঝে আমি অসহায় হয়ে পড়েছি। তবে এই দুষ্টু দুষ্টু মিষ্টি মিষ্টি ভালোবাসা আমার অনেক অনেক প্রিয়।

___
সকাল এগারোটা পনেরো মিনিট। আমরা সবাই আদালতে বসে আছি। আমার দুই পরিবার আজ আদালতে উপস্থিত। পাখি তার বাবার কোলে বসে আছে। দুই পক্ষের উকিল নিজেদের মতো যুক্তি দিয়েছেন। আবার আদালতের রায় দেওয়ার পালা। বিচারপতি তিনবার আঘাত করে বলেন, “অর্ডার, অর্ডার, অর্ডার। পাঁচ বছর ধরে দুই পক্ষের উকিল তর্ক বিতর্ক করেছেন। আদালত আজ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে..

আমি আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। উচ্চ অথচ সম্মানের সাথে বললাম, “আমার কিছু বলার আছে। আমি কি অনুমতি পেতে পারি।”

সবাই হতভম্ব দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বিচারপতি নিজেরও। পুনরায় বললাম, “আমি কি অনুমতি পেতে পারি?”

বিচারপতি নিজেকে সামলে বললেন, “অবশ্যই আসুন। সবাই বলছে আপনি পা/গ/ল। কিন্তু আপনার কথা বলার ধরণ, আচার দেখে মনে হচ্ছে না তেমন।”

“কাঠগড়ায় এসে বলি।”

“আসুন।”

আমি কাঠগড়ায় গিয়ে দাঁড়ালাম। নম্র গলায় বলতে শুরু করলাম, “আমি আরু। এই মা/ম/লা/র বাদিনী। সবার ধারণা আমি পা/গ/ল ছিলাম। আমি কোনো কালেই পা/গ/ল ছিলাম না। আমি শুধু অভিনয় করেছি। নিজের স্বামীকে বাঁচানোর, নিজেকে বাঁচানোর, নিজের ছোট্ট পাখিকে বাঁচানোর। শুরুটা প্রথম থেকেই করি। আমার জন্ম আমি দেখেছি, কিন্তু মনে নেই। তখন আমার খেয়াল শক্তি নেই। জ্ঞান হওয়ার পর আমার মাকে দেখেছি। শয্যা সাহী হিসেবে, প্যারালাইউড ছিলেন তিনি। আমাকে কখনো আরু বলে ডাকে নি জানেন। আমি কখনো মায়ের ভালোবাসা পাইনি। তবে মামিরা আমার কোনো কমতি রাখেনি। সবসময় আমাকে আগলে রেখেছে। তবুও মায়ের ভালোবাসাটা মিস্ করেছি। সবার মুখে শুনেছি আমার মায়ের এই অবস্থার জন্য দায়ী আমার বাবা‌ বাড়ির লোকেরা। তারাই মায়ের এই অবস্থা করেছে। তাই বড়ো মামা মাকে নিয়ে এসেছেন তাদের কাছে। মায়ের বাকশক্তি না থাকলেও, মা মাই হয়। আমি আ/গু/নে পু/ড়ে/ছি বলে তিনি হার্ট অ্যাটাক করছেন। অথচ আমি বেঁচে গেলাম, কিন্তু তিনি চলে গেলেন। আমাকে সবাই সামলে নিয়েছে। পেরিয়ে গেল কিছু মাস। তিস্তা আপু আমাদের লজিং মাস্টার সুজন ভাইকে ভালোবাসতেন। আমাকে অপ/রা/ধী করে তিস্তা আপু পালিয়ে গেলেন সুজন ভাইয়ের সাথে‌। অথচ তাদের সম্পর্কের ব্যাপারে আমি তেমন কিছু জানতামই না।

মামা আমাকে অনেকে কিছু বললেন। কেউ বাদ রাখেনি। চ/ড় খেয়েছি। আমি পর, গোবরে ফোঁটা পদ্মফুল সহ কত কী? বাবাকে ফোন করে আনলেন। বাবার সাথে আমার প্রথম পরিচয়। অবশ্য আগেও একবার দেখা হয়েছে, তখন আমি চিনতাম না। আমার বাবা বেঁচে আছে, এটাও জানতাম না।
প্রথম যাওয়া হলো আমার নিজের বাড়িতে। সেখানে সবাই আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসলেন। কিন্তু আমার পরিবার তো ছিল আহসান পরিবার। মামির সাথে দেখা করতে গিয়ে আরও একদফা অপ/মা/নিত হলাম। অপূর্ব আমাকে ঢাকাতে নিয়ে বিয়ে করলেন। বাবা চাচাদের হাত থেকে বাঁচতে চলে গেলাম গ্রামে। তবুও পিছু ছাড়লে না তারা, চলে গেলেন গ্রামে। অপূর্বকে মারতে মা/র/তে মে/রেই ফেললো প্রায়। চিৎকার করে কাঁদলাম। বিশ্বাস করুন স্যার, কেউ আমাকে সাহায্য করতে এলো না। আমাকে ভয় দেখিয়ে বাড়িতে নিয়ে এলো। আমার ধ্যান জ্ঞান সব পড়ে রইল সেখানে..
ডাক্তার জানালেন আমি প্রেগন্যান্ট, এদিকে বাবা বিয়ে ঠিক করলেন। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, আমাকে অ্যা/ব/শ/ন করাবেন। উদাসীন হয়ে পড়লাম আমি। খবর পেয়েছিলাম অপূর্ব হসপিটালে ভর্তি। কোমায়। বাঁচবে কি ম/রবে তার ঠিক নেই।আমি সত্যি তখন পা/গ/ল হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর..

একটু থামলাম। গলা ধরতে আসছে। একটু শ্বাস নেই, তারপরে নাহয় আবার শুরু করব। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। নয়না চাচি কাছে এলেন। আমাকে আশ্বাস দিলেন। অপূর্ব ভাই-ও ছুটে এসেছেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে চোখ মুছে দিলেন।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here