#এ_শহরে_তুমি_নেমে_এসো 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৪১
‘মাটিতে, হাতে, পোশাকে’ সব জায়গাতে লেখা অপূর্ব আহসান। দেয়ালটাও আমার অ/ত্যা/চা/রে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। মুক্তি চাই তার। কিন্তু আমি তাকে মুক্তি দেবো না। ইটের কুঁচো দিয়ে বিরতিহীন ভাবে লিখে চলেছি। আমার পাশেই একটা মেয়ে বসে আছে। লেখা থামিয়ে মেয়ের কাছে গিয়ে বললাম, “শোনো, তুমি কি আমার ছোটো বাচ্চাটাকে দেখেছ? আমার বাচ্চা। ডাক্তার আমার পেট কে/টে ওকে বের করেছে। তারপরে নিয়ে গেছে। আমি এক নজর তাকে দেখেছি। আর দেখিনি, কোথায় আছে আমার সেই রাজকুমারী? তুমি জানো?”
মেয়েটা আমাকে ধাক্কা দিল। আমি পরে গেলাম মাটিতে, উঠলাম না। তোমরা জানো, আমার একটা মেয়ে আছে। তার নাম আমি জানি না।
নার্স মেয়েটা এলো আমার কাছে। ধীর গলায় বলে, “আপনার স্বামী আপনার সাথে দেখা করতে এসেছে। আপনাকে ডাকছে। চলুন।”
হঠাৎ করেই অভিমান জমে উঠল। মৃদু স্বরে বললাম, “যাবো না, আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। আপনি তাকে যেতে বলুন।”
“তার নাম অপূর্ব আহসান।”
চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি পড়ল। অপূর্ব ভাইয়ের সাথে আমার প্রায়ই দেখা হয়। তিনি আসেন আমাকে দেখতে। সাথে একটা মেয়েও আছে। আমাকে মা মা বলে ডাকে। আমার খুব কষ্ট হয়, ইচ্ছে করে বুকে জড়িয়ে নিতে। কিন্তু আমি পা/গ/ল বলে কেউ সেই মেয়েটিকে আমার কোলে দেয়না। ভয় পায় দিতে। মাটিতে শুয়ে পড়লাম। হাত পা মেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললাম, “আমি কোথাও যাবো না।”
“তিনি আপনাকে একবারের জন্য নিয়ে যাবেন। কাগজপত্র তৈরি করা হয়ে গেছে। (একটু বিরতি দিয়ে আবার বলে) আগে অপূর্ব নামটি শুনলে তাকে দেখার জন্য আপনি পা/গল হয়ে যেতেন। এখন তেমন করেন না কেন?” বলেই মেয়েটি আমাকে ধরে ধরে উঠালো। হাত ধরে নিয়ে যেতে লাগল অফিস কক্ষের দিকে। যেখান থেকে পা/গ/লদের শুরু ও শেষ হয়। খুব করে বলতে ইচ্ছে করছিল, “আগে অপূর্ব ভাই আমার ছিল। তাই অপূর্ব অপূর্ব করতাম। এখন তিনি আছে। কিন্তু আমার খোঁজ নেওয়ার জন্য তিনি নেই।”
নার্স আমাকে চেয়ারে বসিয়ে সভাপতি সহ বেশ কয়েকজন ডাক্তারকে বলে, “আরু এখন আর অপূর্ব শুনে আসতে চায় না। জোর করে নিয়ে এসেছি।”
আমার পাশেই আমার স্বামী অপূর্ব বসে আছেন। তার কোলে একটা ফুটফুটে মেয়ে। সৌজন্য হেসে বলে, “হয়তো ভালোবাসা ফিকে হয়ে গেছে।”
“না, এই ভালোবাসা কখনো ফিকে হয়ে যায় না। আপনি প্রতিবার এসে চলে যান। আরু তখন প্রচণ্ড কেঁদেছে। আপনার উপর অভিমান করে হয়তো যেতে চাইছে না। একবার মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখুন না, সব জায়গায় আপনার নাম লিখে রেখেছে। পা/গ/ল হলেও আপনার উপর অভিমান করে আছে।” ডাক্তারের কথাতে অপূর্ব ভাই আমার দিকে তাকালেন। আমার হাত ধরে কাছে টেনে নিলেন। চুলের ভাঁজে স্পর্শ করলেন অধর। বললেন, “আমিও আরুকে আমার কাছে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। বাড়ির কেউ রাজি ছিল না। প্রথমত, তারা আরুর পরিবারকে ভয় পাচ্ছিল দ্বিতীয়ত, আরুকে সামলাতে গেলে আমার মেয়ে পাখিকে কেউ সামলাতে পারতো না। আরু তার ক্ষ/তি করে ফেলতে পারে। তাই। পাখি একটু বড় হয়েছে। এখন সে বুঝবে। এবার আরুকে ভালো করার দায়িত্বটা আমি নিলাম।”
আমার হাত ধরে উঠলেন অপূর্ব ভাই। ছোটো পাখি বাবার গলা জড়িয়ে রেখেছে। অপূর্ব পাখিকে নামিয়ে দিয়ে বলেন, “পাখি সোনা, তুমি একটু হেঁটে চলো। তোমার মা যেতে চাইছে না, তাকে একটু কোলে নেই।”
“আচ্ছা বাবাই।” পাখি কোল থেকে নেমে হাঁটতে লাগল। অপূর্ব আমাকে কোলে নিল। এগিয়ে গেল সামনে। কী সুন্দর গাড়ি? এমন গাড়িতে আমি আগে কখনো চড়ি নি। অপূর্ব ফন্ট সিটে আমাকে বসিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। পাখিকে কোলে নিয়ে বসলেন ড্রাইভিং সিটে। গাড়ি চলতে শুরু করল। দীর্ঘ পর পেরিয়ে আমরা পৌঁছে গেল ‘সাত ভাই চম্পা’ নিবাসে। ভেতরে তাকাতেই হতভম্ব হলাম। আমাদের সেই টিনের ঘর নেই। বড়ো বাড়ি। দাদা বাড়ির মতো রাজকীয়। গাড়ি দেখে হামলে পড়ল সবাই। বড়ো মামি গাড়ির দরজা খুলে বের করলেন আমায়। বললেন, “আমার সেই ছোটো আরু।”
আড়চোখে ঝোপঝাড়ের দিকে তাকাতেই দেখলাম মায়ের সেই কবরটি বাঁধনো হয়েছে বড়ো করে। তুরের কোলে ছোট্ট একটি মেয়ে, তিস্তা আপুর কোলেও একটি ছেলে। শেফালী পেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অন্তঃসত্ত্বা সে। তিয়াস ভাইয়ের পাশে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে। নিঃসন্দেহে তার বউ। মামাদের চুল পাকতে শুরু করেছে। আমাকে ছাড়াই সবকিছু বদলে গেছে। ভালো আছে সবাই। কারো অনুপস্থিতিতে কিছু আঁটকে থাকে না।
একঝাঁক ময়না পাখি এসে থামলো সামনে। গুনে শেষ করতে পারলাম না তাদের অগনিত সংখ্যা। তার ভেতর থেকে একটি পাখি উড়ে এসে আমার কাঁধে বসল। আমার গালে দুটো ঠোকর দিয়ে বলে, “আরুপাখি আরুপাখি আরুপাখি।”
আমার চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ল। ময়না পাখি তার পুরু ঠোঁট দিয়ে চুষে নিল সেই জল। অতঃপর সব পাখিরা একসাথে ডেকে উঠল, “আরুপাখি আরুপাখি আরুপাখি।”
পাখি অপূর্ব হাত টেনে বলে, “বাবাই! তুমি তো বলেছিলে, আমার নাম আরুপাখি। তাহলে ময়নারা আমাকে আরুপাখি না বলে মাকে কেন আরুপাখি ডাকছে? বলো? বলো?”
“কারণ তুমি ছোটো আরুপাখি আর সে বড়ো আরুপাখি। বড়ো আরুপাখিকে দেখে সবাই খুশি হয়েছে।” অপূর্বর কথাতে পাখি চুপ করে আছে। মামি এগিয়ে এসে আমাকে বলে, “এগুলো সব তোর ময়না পাখির বাচ্চা। গত পাঁচ বছরে যত ডিম দিয়েছে কিছু ‘তা’ দিয়েছি। বাকিটা তোর মেয়েকে খাইয়েছি।”
আমি জবাব দিলাম না। আমি বড্ড স্বা/র্থপ/র। শুধু নিজের স্বার্থের কথা ভেবে পাখিকে দূরে সরিয়ে দিয়েছি। চাইলেই তাকে কাছে রাখতে পারতাম।
সাইকেলের টুং টাং শব্দ শুনতে পারলাম। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম একজন ডাক টিকেট দাঁড়িয়ে আছে। কত শত চিঠি তার কাছে। একটি চিঠি বের করে ঠিকানা দেখল। তারপরে উচ্চ স্বরে বলে, “আদালত থেকে আপনাদের চিঠি এসেছে। গ্ৰহণ করুন। আমাকে যেতে হবে।”
আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। এই আধুনিক যুগেও চিঠি এসেছে। বড়ো মামা গ্ৰহণ করলেন চিঠি। সই করলেন কাগজে। চলে গেল ডাক টিকেট। বড়ো মামা চিঠিটা খুলে পড়লাম। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, “পাঁচ বছর আমাদের পরিবারটাকে অশান্তি দিয়েও শান্তি হয়নি মৃধা পরিবারের। আরুর ফেরার খবর শুনে আদালতে আগের মা/ম/লা রি ওপেন করেছে।”
অপূর্ব বললেন, “আমি কালকে আরু আর পাখিকে নিয়ে আদালতে যাবো। আরু আমার বিবাহিত স্ত্রী। সব প্রমাণ আছে। দেখি আরুকে কীভাবে নিয়ে যায়।”
“আমিও যাবো। আদালতে যাবো। আমার জীবনের পাঁচটি বছরের হিসাব চাইবো। চাইবো আমার সুখ, শান্তি।” মনে মনে বললাম। এক দমকা হাওয়া এসে লাগল বুকে। মায়ের মতো গন্ধ ভেসে এলো কাছে। মা তুমি বড্ড দেরি করেছ আসতে। তোমার আরু আরও আগে এসেছে। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম মায়ের কবরের সামনে। পেছন থেকে মামী বলে উঠলেন, “অপু আরুকে এত স্বাভাবিক, এত শান্ত কেন লাগছে? কোনো পা/গ/লামি কেন করছে না? ও কী ঠিক হয়ে গেছে?”
“জানি না, হতেও পারে। আবার নাও হতে পারে। আদালত থেকে বাড়িতে ফেরার সময় আরুকে একটা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। কথা বলে রেখেছি।”
আমি এগিয়ে গেলাম। বসলাম মাটিতে। কিছুক্ষণ নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে লুটিয়ে পড়লাম মাটিতে।
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]