#এ_শহরে_তুমি_নেমে_এসো 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২৫
আড়চোখে তাকাতেই দেখলাম দাদি জান দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে বিয়ের কার্ড। অপূর্ব ভাই তখনও দাঁড়িয়ে আছে নিকটে। ক্রমাগত ঘামছি আমি। দাদি জান চশমা খুলে চোখ পরিষ্কার করে তাকালেন। পুনরায় আবার পরিধান করলেন। অপূর্ব ভাইকে দেখিয়ে বললেন, “ইনি কে আরু? আমাদের দাদি নাতনির ঘরে কী করছে?”
আমি জবাব খুঁজে পেলাম না। আমতা আমতা করে কিছু বলার পূর্বেই অপূর্ব ভাই মুখ খুললেন, “আরু, আপনি কি তার জন্যই আমাকে আসতে বলেছিলেন?”
“মানে?” দ্বিধান্বিত কণ্ঠস্বর। অপূর্ব দাদিজানের অগোচরে আমার হাতে একটা চিমটি দিলেন। ‘আহ’ করতে গিয়েও থেমে গেলাম আমি। পুনরায় তিনি বললেন, “এটা কোন ধরনের মজা? আপনার দাদির মনের অসুখ করেছে বলে আমাকে ফোন করে আসতে বললেন, এখন বলছেন মানে? এটা কোন ধরনের অস/ভ্য/তামি?”
অপূর্ব সামলে নিলেন সবটা। আলগোছে হেসে বললাম, “হ্যাঁ, কিন্তু আপনাকে প্রথম তার জন্য আসতে বলেছি। (দাদি জানকে উদ্দেশ্য করে) ঐ বাড়ি থেকে আসার পর থেকে কিছু ভালো লাগছে না। তাই ডা. অপূর্বকে ফোন দিয়েছি। তিনি মনোচিকিৎসক। ঢাকাতে চেম্বার আছে। ফুফুকে তিনিই চিকিৎসা দেন।”
দাদি জান অবিলম্বে বিশ্বাস করে নিলেন এবং অপূর্ব ভাইকে চিনতে পারলেন। ডা অপূর্ব হিসেবে এই বাড়িতে তার যাতায়াত রয়েছে। কারণ ফুফুজান মনোচিকিৎসকের পরামর্শ নিতেন। দাদি জান বললেন, “তা এতো রাতে কেন এসেছেন? এখন সবাই শুয়ে পড়েছে।”
“আসলে আমি শহরে থাকি। ট্রেনে ফিরতে ফিরতে দেরি হয়ে গেছে।” অপূর্ব ভাইয়ের উত্তরে দাদি জান বললেন, “আগের মতো এখন আর খেয়াল রাখতে পারি না। তা কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো, আপনি কেমন আছেন?”
“আলহামদুলিল্লাহ। তা এখন কি বাড়িতে যাবে? না গেলে এখানে থাকো। কাল সকালে আরুকে দেখে একসাথে বাড়িতে যেও।”
অপূর্ব ভাই রাজি হলেন। মনে মনে যেন এটা তিনি চেয়েছিলেন। আমাদের বাড়িতে অপূর্ব ভাইকে একমাত্র বাবা চিনে, এছাড়া কেউ চিনে না। তাই স্বস্তি পেলাম। বাবা বাড়িতে নেই। প্রায় দিনেই বাড়ির বাইরে থাকেন।
___
বাঁশির সুর কানে পৌঁছে গেল।
ঘুম থেকে জেগে দেখলাম অপূর্ব ভাই নিচে দাঁড়িয়ে দাঁত ব্রাশ করছেন। এমন সময়ে কেউ উঠে না সচরাচর। এইমাত্র আমিই উঠেছি। ধীর পায়ে নেমে গেলাম নিচে। আকাশে হবে সূর্য উদিত হয়েছে। অপূর্ব ভাইয়ের পিছনে গিয়ে ‘ভাউ’ করে উঠলাম। তিনি স্বাভাবিক ভাবেই আমার দিকে তাকিয়ে ব্রাশ করতে ব্যস্ত হয়ে গেল। আমি মন খা/রা/প করে বললাম, “ভয় পেলেন না কেন?”
“আমি কি মেয়ে মানুষ, যে ভয় পাবো? আশ্চর্য!”
“এতো সকালে একা বসে আছেন। যদি শাতচুন্নিতে ধরে।”
“শাতচুন্নি এতোদিন বাড়িতে ছিল। সেই তো ধরে ছিল। শাতচুন্নিটা বাড়িতে নেই, পরিবেশ ফাঁকা লাগছে। কারো মন ভালো নেই। তাই তাকে ফিরিয়ে নিতে এসেছি।” তার কথায় মাথা নেড়ে ‘হম’ বললাম। ব্রাশটা হাত থেকে নিয়ে ব্রাশ করতে যাবো এমন সময়ে ধমকে উঠলেন, “এটা কি করছিস তুই? ওয়াক থু। আমার ব্রাশ দে।”
ভেংচি দিয়ে বললাম, “এইযে ব্রাশটা দেখছেন। এটা আপনার হতে পারে কিন্তু এটা দিয়ে আমিও ব্রাশ করেছি। তাই এটা আমারও ব্রাশ।”
আমি জোর করলাম। অপূর্ব হাত থেকে টেনে নিলেন ব্রাশটা। ছুড়ে দিলেন দূরে। আমার মুখ ভার হলো। কালো হলো মন। উঠে গেলাম জায়গা ছেড়ে। দুকদম ফেলতেই হাতটা ধরে ফেললেন অপূর্ব ভাই। না তাকিয়েই বললাম, “হাত ছাড়ুন। একদম আমার সাথে কথা বলবেন না, হাতও ধরবেন না।”
“আরু, বাবা তুরের বিয়ে ঠিক করেছে।” চমকে উঠলাম আমি। আমি শেফালী আর তুরের বয়স একই। এসএসসি পরীক্ষার এখনো অনেক সময় বাকি। তুরের বিয়ে কীভাবে সম্ভব। উত্তেজিত হয়ে বললাম, “আপনি আমার সাথে মজা করছেন, তাই না?”
“না। সত্যি। প্রয়াস ভাইয়ের সাথে। প্রয়াস ভাইয়ের বাবা আমার বাবাকে হুমকি দিয়েছে তিস্তা আপুকে এনে দিতে। কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি। আর পাওয়া গেলেও বিয়ে হতো না। তাই বাবা নিজের সম্মান রাখতে তুরের সাথে বিয়ে ঠিক করেছে। আজ তুরের বিয়ে। পরীক্ষার পর তুলে নিয়ে যাবে। হঠাৎ করেই আমাদের পরিবারটা কেমন অগোছালো হয়ে গেল।”
চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলাম। তুরের শুভ পরিণয় অথচ আমি তার পাশে বোন বা বন্ধু হিসেবে থাকতে পারব না। এমন সময়ে অপূর্ব ভাই আশ্বাস দিলেন, “আমি তোকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছি। তুই বরং একটা বোরখা পড়ে তৈরি হয়ে নে।”
অপূর্ব ভাই ব্রাশ করতে করতে দিঘির দিকে গেলেন। আমি সেখানেই কিছুক্ষণ বসে রইলাম। এই বাড়িতে একটা কুকুর আছে, তার নাম রিংকু। মৃধা বাড়ির বিদেশি কুকুর। একটা পাতা পড়লেও রাতে ঘেউ ঘেউ করে উঠে। প্রচণ্ড ভালোবাসে সবাই। বেশ কিছুদিন আগের কথা। শখের তাড়নায় দিঘির পাড়ে ছিপ ফেলে মাছ ধরতে বসেছিলাম। ছিপে গরুর মাংসের টুকরো দিয়েছি। রিংকু ছুটে এসে ঘেউ ঘেউ করা লেজ নাড়ালো। লোকে বলে কুকুরের ঘ্রান শক্তি বেশি। তা সেদিন আমি লক্ষ্য করেছিলাম। কুকুরটি আমার থেকে গোস্তের টুকরোগুলো কে/ড়ে খেয়ে নিয়েছিল। ওড়না পেঁচিয়ে পাক করে কুকুর তাড়ানোর চেষ্টা করেছিলাম। কুকুরটি সরে নি। বরং সবগুলো খেয়ে নিয়েছিল। খাওয়া শেষ হতেই তাড়া করল আমায়। আমি ছুটে গিয়েছিলাম বাড়িতে। লাফ দিয়ে দাদি জানের কোলে উঠে বলেছিলাম, “দেখো দাদি জান, কু/ত্তা আমাকে লড়াচ্ছে।”
দাদি জান একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, “ও রিংকু। আমাদের বাড়ির সদস্য। ওকে কু/ত্তা বলবে না।”
আমি ভেংচি দিয়েছিলাম সেদিন। আমার থেকে কুকুরটার বয়স অনেক বেশি।
___
মাটির রাস্তা দিয়ে চিরচেনা সেই বাড়িতে ফিরে যাচ্ছি কিছুক্ষণের জন্য। দাদি জান অনুমতি দিয়েছেন। অপূর্ব ভাই বলেছেন, আমাকে জরুরি হাসপাতালে কিছু টেস্ট করতে হবে। তাই অনুমতি দিয়েছেন। আবুল চাচাকে পাঠিয়েছেন সাথে। হাঁটতে হাঁটতে অপূর্ব ভাই বললেন, “আবুল চাচা আমাকে একটু সাহায্য করতে হবে তোমাকে।”
“কী সাহায্য ডাক্তার সাহেব?” আবুল চাচা উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন।
“আরুকে আমি আমার সাথে নিয়ে গেলাম। তিন ঘণ্টা পর ওকে নিয়ে এখানে আসবো। তুমি কিন্তু না করতে পারবে না।” আড়ালে আবুল চাচার হাতে টাকা গুঁজে দিলেন অপূর্ব ভাই। তা আমার দৃষ্টি থেকে এড়িয়ে গেল না। তিন রাস্তার মোড়ে আসতেই আবুল চাচা অন্য পথ ধরলেন। অপূর্ব ভাই নামলেন ঝোপঝাড়ে। একটি বাইক লুকিয়ে রেখেছিলেন তিনি। দু’জনে বাইকে উঠে চললাম আহসান বাড়ির উদ্দেশ্যে। চিরচেনা সেই হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল। ধুক ধুক করে ছন্দ তুলে চলেছে। পেছন থেকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বললাম আমি, “আপনি কাছে এলে আমার হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক থাকে না। আমি অনুভব করতে পারি আমার রক্তচাপ রয়েছে। আপনি তো মনোচিকিৎসক, আমার মনের এই অসুখ সারিয়ে দিন না? আমি ঐ বাড়িতে এক দন্ড থাকতে পারি না।”
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]
[রেসপন্স করার অনুরোধ রইল]