#এটা গল্প হলেও পারতো
#পর্ব ২১(প্রথম অংশ)
মানব চরিত্র বড়োই জটিল, কারোর তুচ্ছ আঘাতেই বিরাট পরিবর্তন হয়, কারোর আবার হাজার আঘাতের পরেও মানসিকতার কোনো বদল হয় না। অর্ক এই দ্বিতীয় শ্রেণীর, নিজের স্টুডেন্ডদের বন্ধু হয়ে ওঠার যে অভ্যাস তাকে বিপদে ফেলেছিলো একবার, সে অভ্যাস ত্যাগ করা তার অন্তত এ জীবনে আর হয়ে উঠবে না সেটুকু বুঝে গেছে অদিতি। তাই প্রায় প্রতি রবিবারই যখন স্টুডেন্ডদের দল বিভিন্ন রকমের আবদার নিয়ে স্যারের বাড়ি উপস্থিত হয়, তখন অর্কর অনুরোধে চা করতে করতে অদিতি মজা করে,
দেখো! আবার কেউ তাকে তোমার স্পেশাল স্টুডেন্ট না ভেবে বসে!
অর্ক মুচকি হাসে,
উঁহু! এখন ওরা সবাই স্পেশাল, আজ যার কথায় নোটস দি, কাল আর সে বললে দিই না!
সেই যে সমরেশ একদিন একটা কথা বলেছিলেন, যার নয়ে হয়নি তার নব্বইয়েও হবে না, সেই কথাটা অন্তত অর্কর ক্ষেত্রে একশো শতাংশ সত্যি। যে মোবাইল বন্ধ রাখা, সাইলেন্ট রাখা নিয়ে অদিতির সঙ্গে তার অশান্তি এতো বড়ো বিপদ ডেকে এনেছিলো তাদের জীবনে, সেই মোবাইল তার এখনও বন্ধ বা সাইলেন্টই থাকে প্রায়!
চরিত্রে বদল অবশ্য অদিতিরও হয় নি একটুও! অর্কর ফোন বন্ধ থাকলেই সে চিন্তিত হয় এখনও, বাড়ি ফিরলেই তার চিন্তা রাগের আকার নেয়, এবং যথারীতি প্রবল চিৎকারে পরিবর্তিত হয়। সে রাগ দুই বা তিন দিন থাকে খুব বেশি হলে তার মধ্যেই অর্ক তাকে ভবিষ্যতে আর কখনো না হওয়ার যে কথা দিয়ে এসেছে এতদিন, সেই কথাই আবার একবার নতুন করে দিয়ে মিটমাট করে নেয়।
তাই অর্কর ফোন বন্ধ থাকলে রুমা যতটা না বিরক্ত হন, তার থেকেও বেশি বিরক্ত হন অদিতির চিন্তিত মুখ দেখলে,
টেনশন করাটা বন্ধ করতো এবার! সব জানিস, সব বুঝিস, তাও একই জিনিস বারবার! আমাদের সময়ে ফোন ছিলো না, সেই ভালো ছিলো বুঝি এখন।
এই সব টানাপোড়েন নিয়েই এগিয়ে চলছিলো অর্ক, অদিতির সংসার, আর পাঁচটা স্বামী, স্ত্রীর সংসারের মতোই! কখনো রাগ, ঝগড়া, কখনো বা আনন্দে ভালোবাসায়। ইতিমধ্যে সময়ের চাকা গড়িয়েছে, কেটে গিয়েছে পাঁচ পাঁচটা বছর, ওদের কারোর সঙ্গেই আর দেখা হয়নি অর্ক বা অদিতির। রিয়ার চিকিৎসা শুরুর খবর অরিন্দমের মুখে শুনেছে বার কয়েক, তার পরে আস্তে আস্তে সে খবরও আর পাওয়া যায় নি। রিয়ার মা অরিন্দমের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলেন শেষের দিকে।
সময় এগিয়ে চলছিলো, ইতিমধ্যে সমরেশের স্ট্রোক হয় বছর তিনেক আগে। প্যারালাইসিস হয়ে বিছানায় পড়ে গিয়েছেন সমরেশ, ওখানে থেকে একা দেখাশোনা করা রুমার পক্ষে সম্ভব না হওয়ায় বাড়ি ভাড়া দিয়ে বাবা, মা কে কলকাতায় নিজের কাছে রেখেছে অর্ক। অদিতির বাবা আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁকেও নিয়ে আসা হয়েছিলো এখানেই। তাই দু কামরার ফ্ল্যাটে আর এতজন না ধরায়, অরিন্দমের দেওয়া খোঁজেই ওর পাড়াতেই একটা থ্রি বেডরুম ফ্ল্যাট কিনে বছর দুয়েক হলো ওরা উঠে এসেছিলো। যদিও অদিতির বাবা বছর খানেক আগে মারা গিয়েছেন, সমরেশ এখনও বিছানায় শয্যাশায়ী। একমাত্র রুমা এখনও বেশ শক্ত সমর্থ আছেন, সমরেশ কে দেখাশুনা নিজেই করেন, সাহায্যের জন্যে একজন মাঝবয়সী মহিলা আছেন।
ছেলেকে দক্ষিণ কলকাতার এক নামকরা স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে বছর দুয়েক আগে, এতদিন ছোটো থাকায় ও সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে বসে থাকতো ওখানে। সেখানে ঘর ভাড়া নিয়ে অনেকেই বসে থাকে, তাদের সঙ্গে বেশ একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে এই দু বছরে। ঘরে বসে শাড়ি, কুর্তি কেনা থেকে শুরু করে, পিকনিক, সিনেমা দেখা, রেস্টুরেন্টে খাওয়া, কোনোটাই বাদ যায় না।
এ বছরই প্রথম ছেলে কে একাই পুল কারে করে স্কুলে পাঠাচ্ছে অদিতি, প্রথম প্রথম খুব ভয় লাগতো, গাড়ি ফিরতে একটু দেরি হলেই ফোন করতো ড্রাইভার কে, ইদানিং মাস পাঁচেক হয়ে যাওয়ার পরে ভয় একটু হলেও কমেছে। ঘরের আড্ডাটা কে মিস করে ভীষণ, তাই মাঝে মাঝেই ফোনে কথা হয় সবার সঙ্গে। বন্ধুরা মাঝে মাঝেই ফোন করে ডাকে,
এই অদিতি চলে আয়! কিন্তু ওরই আর যেতে ইচ্ছে করে না, সকালে উঠে ছেলে কে রেডী করতে করতেই সব এনার্জি চলে যায়! নিজের যাওয়াটা আর হয়ে ওঠে না। রুমাও মাঝে মাঝেই বলেন,
তুই বড্ড কুঁড়ে! একটু মাঝে মাঝে বেরতেও পারিস তো! দু বছর তো দিব্যি যাচ্ছিলি! আর বছর দুয়েক যেতে পারতিস, অতো টুকু ছেলে কে একা ছেড়ে দিলি!
অদিতি হাসে,
ধুর! আমার আর যেতে ইচ্ছে করে না! আর ওকেও এবার একটু বড়ো হতে দাও মা, কতো বাচ্চা ওর থেকেও ছোটো, তারাও একাই যায়!
অর্কও ইদানিং ওর সঙ্গে মজা করে, রুমা কে বলে,
দিতির শাড়ির স্টকটা এবছর বড্ড কম হয়ে গেছে, তাই না মা? দু একদিন ঘুরে এলেই আবার ঠিক হয়ে যেতো!
তবু দিতি বেরোয় না! অর্ক, ছেলে সবাই বেরিয়ে যাওয়ার পরে এই সময়টুকু ওর নিজের, বেশ আরাম করে গুছিয়ে গল্পের বই নিয়ে বসে কখনো, কখনো বা এক কাপ চা নিয়ে টিভির সামনে জনপ্রিয় কোনো ওয়েব সিরিজ খুলে। গত মাস পাঁচেক ধরে এই যে যা খুশি করার নিজের সময়টুকু ও পেয়েছে, সেটা কে লুটেপুটে নিতে চায় ও!
সামনের শনিবার ছেলের ফার্স্ট টার্মের রেজাল্ট বেরোবে, টিচারের সঙ্গে মিটিং আছে স্কুলে, স্কুল থেকে নোটিশ এসেছে পি টি এম এর, সেটাকেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিলো ও।
এই বারের আণ্টি কেমন রে? খুব রাগী?
ছেলে কে প্রশ্ন করলো অদিতি, ছেলে তখুনি স্কুল থেকে ফিরেছে, ট্রাই সাইকেলে ঘরের মধ্যে পাক খেতে খেতে উত্তর দিলো,
না তো! একটুও বকে না! শুধু ঋজু কে বকে, ও কোনো কথা শোনে না তাই!
রুমা হেসে ফেললেন,
তাই! তুই খুব শান্ত, তাই না! খুব ভালো ছেলে!
ঠাম্মার ইয়ার্কি বোঝার মতো ক্ষমতা নাতির ছিলো না, গর্বের সঙ্গে বললো,
হ্যাঁ, আণ্টি বলে তো! খাতায় গুড দিয়েছে দেখো!
অদিতি হেসে ফেললো,
রাখ এবার সাইকেল, স্নান করে নে! বেলা হয়েছে অনেক!
মনের মধ্যে অনেক প্ল্যান ভেবে ফেললো, রেজাল্ট নিতে যেতে খুব কুঁড়েমি লাগছে! অর্ক কে যে করেই হোক ম্যানেজ করতে হবে! সন্ধ্যে বেলায় অর্ক বাড়িতে ফিরতেই অদিতি ধরে বসলো,
যাও না প্লিজ! বেশিক্ষন লাগবে না, রেজাল্ট টা নিয়েই কলেজে চলে যাবে!!
অর্ক মাথা নাড়লো,
অসম্ভব! কতক্ষন বসে থাকতে হয়! আমার পরশু প্রথমেই ক্লাস আছে! তুমি যাও না, বন্ধুদের সঙ্গে একটু আড্ডাও হবে আর টিচার কে তো দেখোই নি এবার, একবার দেখেও এসো কেমন তিনি।
সত্যিই অন্যবার ছেলের ছুটির সময় টিচারের সঙ্গে দেখা হতো, এখন ও আর যায়না বলে ছেলের ক্লাস টিচার কে দেখেই নি অদিতি। তাছাড়া বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হওয়ার লোভটাও ও ছাড়তে পারলো না, তাই শনিবার শেষ পর্যন্ত ছেলে কে রুমার কাছে রেখে অর্কর সঙ্গে স্কুলে রওনা হলো ও। ওর ছেলের স্কুলে বাচ্চা কে পি টি এমে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি নেই। অর্ক ওকে স্কুলের গেটে নামিয়ে দিয়ে চলে যাওয়ার পর ও নিচে দাঁড়িয়ে থাকা গার্ড কে জিজ্ঞেস করে ছেলের ক্লাসে উঠে এলো তিন তলায়। টিচারের সঙ্গে কথোপকথন হলো, রেজাল্ট দিয়ে বললেন,
একটু অঙ্কের টিচারের সঙ্গে কথা বলে যাবেন যাবার আগে, প্লিজ!
অদিতি মাথা নাড়লো, গার্ড কে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলো, তিনি দোতলায় বসেন, অন্য একটি ক্লাসের ক্লাস টিচার।
মে আই কাম ইন ম্যাম?
বিনীত গলায় উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকা অন্য একজন গার্জিয়ানের সঙ্গে কথা বলতে থাকা ছেলের অঙ্কের টিচার কে জিজ্ঞেস করলো অদিতি, ভদ্রমহিলা ঘুরে তাকাতেই বসে থাকা গার্ডিয়ান কে দেখেই একদম চমকে গেলো ও, এ তো সেই মহিলা! যিনি পাঁচ বছর আগে ওদের বাড়িতে এসেছিলেন, রিয়ার বাবার বান্ধবী হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন!
ইয়েস্! প্লিজ কাম ইন!
ভদ্রমহিলার দিকে আর না তাকিয়েই মাথা নিচু করে ঘরে ঢুকে এলো অদিতি, সামনে পর পর বেঞ্চে অভিভাবকরা বসে আছেন, সেদিকে তাকাতেই ওর দিকে হাত উঠলো,
এই! এদিকে আয় অদিতি!
নিচু গলায় ডাক শুনে অদিতি দুজন কে এক্সকিউজ মি বলে টপকে এসে বসে পড়লো সীমার পাশে, সীমা ওর রুমে বসে, মেয়ে ওর ছেলের থেকে এক ক্লাস নিচে পড়ে। বসেই একটু নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলো,
এই মহিলা কে চিনিস? নাম কি?
সীমা মাথা নাড়লো,
হ্যাঁ, চিনি তো, শর্মিলা কুন্ডু। আমার মেয়ের সঙ্গেই পড়ে ওর মেয়ে।
অদিতি একটু অন্য মনস্ক হলো, মেয়ে আছে বলেছিলো বটে! কিন্তু সেতো পাঁচ বছর আগের কথা! এতদিনে তো এতো ছোট থাকার কথা নয়! ওকে চুপ করে থাকতে দেখে সীমা প্রশ্ন করলো,
কেনো রে? তুই চিনিস নাকি!
অদিতি মাথা হেলাল,
হুঁ, চিনি মানে একবার দেখেছি এইটুকুই! এর বেশি কিছু না!
ভদ্রমহিলা বেরিয়ে গেলেন, সীমা উঠে দাঁড়ালো, এবার ওর টার্ন।
রাতে বাড়িতে এসে অর্ক কে বললো দিতি,
ওই মহিলা যিনি আমাদের বাড়িতে এসে ছিলেন না রিয়ার ব্যাপারে ইনফরমেশন দিতে, তাকে দেখলাম আজ। পি টি এমে এসেছিলো, মেয়ে নাকি সীমার মেয়ের সঙ্গে পড়ে! আচ্ছা! এতো ছোট মেয়ে কি করে হলো বলতো?
অর্ক খাতা দেখছিলো, গলায় বিরক্তি এনে বললো,
তোমার যত ভুল ভাল কথা! আমি ওর মেয়ের বয়স হিসাব করে রেখেছি নাকি! খেয়ে দেয়ে কাজ নেই তোমার! মেয়ে ছোটো না বড়ো তাতে আমাদের কি!
অর্কর বিরক্তি দেখে ওকে আর বিরক্ত না করে রুমার কাছে চলে এলো ও,
কি করে হলো বলতো মা! আমার তো হিসাব মিলছে না!
রুমা একটু ভাবলেন,
হতেও পারে, মেয়ে কতো বড়ো ছিলো, সেতো আর জিজ্ঞেস করিস নি তখন! আবার বিয়ে করে থাকতেও পারে হয়তো!
অদিতির মন মেয়েলি উৎসাহে খচ খচ করতে লাগলো,রুমার কথাই ঠিক! ঠিক আবার বিয়ে করেছেন মহিলা! রিয়ার বাবা কেই নাকি? এই মেয়েটা কি এ পক্ষের! প্রবল উৎসাহে সীমার ফেসবুক ফ্রেন্ডলিস্ট থেকে শর্মিলা কে খুঁজে বার করলো, কিন্তু প্রোফাইল পিকচার ছাড়া আর কিছু দেখা গেলো না। অগত্যা দ্বারস্থ হলো আবার সীমার
সীমা তোর ফ্রেন্ড লিস্ট থেকে ওই শর্মিলা কুণ্ডুর প্রোফাইল টা একবার দেখতে চাই, প্লিজ কাউকে বলিস না!
কেনো রে? কেস টা কি,? আচ্ছা, সোমবার স্কুলে চলে আয় তাহলে!
আবার অহেতুক ঝামেলায় জড়াতে চাইছো দিতি! কি দরকার এতদিন পরে আর এসব করে!
সোমবার স্কুলে যাওয়ার কথা শুনেই বললো অর্ক, অদিতি ঘাড় নাড়লো,
আরে! ঝামেলায় কেনো জড়াবো! ও কি জানতে পারবে নাকি যে আমি ওর প্রোফাইল দেখছি!
এবার রুমা এগিয়ে এলেন,
যাক না! তোর কি অসুবিধা! সব ব্যাপারেই কি তোকে মতামত দিতে হবে? এতে তো কারো ক্ষতি হচ্ছে না! ওতো বাড়ি থেকে বেরোনো ছেড়েই দিয়েছে, এই সুযোগে তাও একটু বেরোনো তো হবে!
যা খুশি করো! পরে কোনো গন্ডগোল হলে আমাকে বলতে এসো না!
ধৈর্য্য ধরছিলো না আর, সোমবার ছেলের সঙ্গেই পুল কারে ম্যানেজ করে উঠে বসলো দিতি। সীমার ফ্রেন্ডলিস্ট থেকে প্রোফাইলটা খুলে দেখতে লাগলো, পর পর ফটো একসঙ্গে চার জনের,দুই মেয়ে আর হাসব্যান্ড। সঙ্গের বয়স্ক ভদ্রলোক কে হাসব্যান্ড এবং একজন কে তারই মেয়ের বন্ধু বলে আইডেন্টিফাই করলো সীমা। এবার মেয়ে ছোটো হবার রহস্য টা পরিষ্কার হলো দিতি র কাছে। বড়ো মেয়েটি তারমানে আগের পক্ষের! তবে কি শেষ পর্যন্ত বিয়েই করেছেন মহিলা রিয়ার বাবা কে! ইনি কি রিয়ার বাবাই!
আচ্ছা, মহিলা ম্যারেড তুই জানিস শিওর?
সীমা ঘাড় নাড়লো,
শিওর কি করে হবো! আমি কি দেখেছি নাকি ওর বর কে কখনো! ছবি দেখে তো তাই মনে হয়। আসলে আমার সঙ্গে খুব বেশি কথা নেই, ওই মিউচুয়াল ফ্রেন্ড অনেক, তাই রিকোয়েস্ট দেখে অ্যাড করেছিলাম।
কার কথা বলছিস?
পাশ থেকে জিজ্ঞেস করলো প্রিয়াঙ্কা, ওর ছেলেও সীমার মেয়ের সঙ্গে পড়ে। সীমার মুখে শর্মিলার নাম শুনেই মুচকি হাসলো ও,
আরে, হ্যাঁ! ওটা ওর বরই! বেশ বয়সের ডিফারেন্স আছে দুজনের, মাঝে মাঝে মেয়ে কে ড্রপ করতে আসে স্কুলে।
দুজনের কথা শুনতে শুনতেই প্রোফাইলটা স্ক্রল করতে করতে প্রায় এক বছর পুরোনো একটা অ্যালবামের নিচে এসে থমকে গেলো অদিতি, এটা সঙ্গে কে! তিয়াসা না! যদিও বিয়ের সাজে তিয়াসা কে একদম অন্য রকম লাগছে, তবু আইডেন্টিফাই করতে কোনো অসুবিধা নেই! যদিও কিছুটা অদ্ভুত ব্যাপার, তিয়াসা কে ট্যাগ করা নেই! ওর কি প্রোফাইল নেই তাহলে! অ্যালবামের ক্যাপশন, ” বোন ঝির বিয়ে”।
ক্রমশ
#এটা গল্প হলেও পারতো
#পর্ব ২১(শেষ অংশ)
প্রোফাইলে দেখা ছবিটা যেনো এক মুহূর্তে চোখের সামনে থেকে একটা পর্দা সরিয়ে দিলো অদিতির, পাঁচ বছর আগের স্মৃতিগুলো জীবন্ত হয়ে উঠলো নতুন করে। নিজেকে এই মুহূর্তে একদম বোকা লাগছে! একটা ছবি! শুধু মাত্র একটা ছবি ওর জানা গল্পটা সম্পূর্ন পাল্টে দিলো!
প্রোফাইল কি আদৌ নেই তিয়াসার! নাকি ওর সঙ্গে নিজের সম্পর্ক যাতে কেউ না বুঝতে পারে তার জন্যেই ইচ্ছা করেই ওকে ট্যাগ করেন নি মহিলা! রিয়া নিশ্চয়ই তিয়াসার ফ্রেন্ডলিস্টে নেই! কিন্তু এমন কেউ কেউ তো নিশ্চয়ই আছে, যারা দুজনেরই বন্ধু, অনির্বাণ, কৌশিক, শ্রেয়া বা দীপ! তাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখার জন্যেই কি এই ব্যবস্থা! কিন্তু কেনো! এতো গোপনীয়তার কারণ কি! তাহলে কি রিয়া তিয়াসার সঙ্গে ওই মহিলার সম্পর্কের কথা জানতোই না কখনো! কেউই কি আদৌ জানতো! অনির্বাণ তো অর্ক কে বলেছিলো তিয়াসা চেনে না ওনাকে, তিয়াসা নিজেও তো তাই বলেছিলো অর্ক কে!
ক্রমশ একটা অস্পষ্ট ছবি যেনো স্পষ্ট হয়ে উঠছিলো অদিতির কাছে! কেনো এতো উৎসাহী হয়ে সাহায্য করতে এসেছিলেন মহিলা ওদের!! তিয়াসার উৎসাহই বা কেনো এতো বেশি ছিলো! যদি ওই মহিলা কে ও চিনতো, তাহলে সেটা স্বীকার করতে বাধা কোথায় ছিলো!! তাহলে কি সবটাই কোনো গভীর চক্রান্ত! সেখানে ওকে জড়িয়ে দেওয়ার কারণ কি! ও কি শুধুমাত্রই সেই চক্রান্তের অংশ, ওর ঘাড়ে বন্দুক রেখেই কি কেউ নিজের উদ্দ্যেশ্য চরিতার্থ করতে চেষ্টা করেছিলো!
ঘটনাগুলো পরপর ভাবতে ভাবতেই ছবিটা অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে উঠলো কিছুক্ষনের মধ্যেই, কয়েক মিনিট থম মেরে বসে থেকে প্ল্যান ছকে ফেললো অদিতি, মহিলা কে ও ছাড়বে না, ওকে ধরতেই হবে!
চট করে ছবিগুলোর স্ক্রীন শট নিয়ে সীমার মোবাইল থেকে নিজের মোবাইলে সেন্ড করে নিলো অদিতি,
স্ক্রিন শট নিচ্ছিস! করবি টা কি বলতো!
সীমা আর প্রিয়াঙ্কা একসঙ্গে প্রশ্ন করলো অদিতি কে, অদিতি মাথা নাড়লো,
বলবো, বলবো! আগে কথা বলি ওর সাথে দাঁড়া! মেয়ে কিসে যায় রে?
ছুটির সময় আসে তো নিতে, ওখানেই কথা বলে নে না!
ওর ছেলের যেহেতু সীমার মেয়ের অনেকটা আগে স্কুল শুরু হয় তাই শেষও হয় ওদের আগেই। ছেলে কে স্কুল থেকে নিয়ে পুল কারে তুলে দিয়ে রুমা কে ফোন করে দিলো অদিতি, ওর যেতে কিছুটা দেরি হবে জানিয়ে দিলো। ক্রমশ ওদের ক্লাসের ছুটির সময় এগিয়ে আসছিলো, অভিভাবকরা গেটে ভিড় জমাতে শুরু করেছিলেন এক এক করে, ছুটির কিছুটা আগেই উঠে পড়লো অদিতি, সীমা আর প্রিয়াঙ্কা নিজেদের সেকশনের গার্ডিয়ান দের দিকে এগিয়ে যেতে স্কুলের গেট থেকে একটু দুরত্ব রেখে দাঁড়ালো ও।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই মহিলা একটা গাড়ি থেকে নেমে গেটের দিকে এগিয়ে এলেন, ড্রাইভার ওনাকে নামিয়ে দিয়ে সম্ভবত পার্কিং খুঁজতে গেলো। অদিতি ধীরে ধীরে গিয়ে মহিলার সামনে দাঁড়ালো,
চিনতে পারছেন? আমি অদিতি, প্রফেসর অর্ক মিত্র র ওয়াইফ, বছর পাঁচেক আগে আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন আপনি! রিয়ার ফোনের কল রেকর্ডিং দিতে! রিয়ার বাবার বান্ধবী তো আপনি?
ভদ্রমহিলা সানগ্লাসের ভেতর দিয়ে তাকালেন,
সরি! আপনি কিছু ভুল করছেন! আমি রিয়া নামে কাউকে চিনি না!
অদিতি হাসলো, মোবাইলটা বার করে স্ক্রিন শট গুলো দেখিয়ে বললো,
আচ্ছা! আমারই ভুল হচ্ছে তাহলে! একে চেনেন তো? তিয়াসা, আপনার বোন ঝি, তাই তো?
অদিতি লক্ষ্য করলো মহিলার হাত কাঁপছে এবার!
কি জন্যে দেখাচ্ছেন এসব আমাকে! আমার বাচ্চার ছুটি হয়ে যাবে, দেরি হয়ে যাচ্ছে,
মহিলা কে এগোতে দেখেই দিতি সামনে এগিয়ে গেলো,
ঠিক আছে! বাচ্চা কে নিয়ে আসুন তাহলে, আমি এখানেই ওয়েট করছি। তবে বাচ্চার সামনে এসব কথা হোক আপনি চাইবেন না নিশ্চয়ই!! পাঁচ বছর আগের ভিডিও টা ড্রাইভে রাখা আছে! রিয়ার ক্ষতি করতে চাইছিলেন আমাদের ফ্ল্যাটের লোভ দেখিয়ে, সেটা জানলে আপনার হাজব্যান্ডের সঙ্গেও তো প্রবলেম হবে আপনার! সেটা যদি বাদও দি তাহলেও পুলিশ আপনাকে ছাড়বে তো!!
কি চান এতদিন পরে?
তিয়াসার সঙ্গে কথা বলিয়ে দিন, আপনার পরামর্শেই সব কিছু করেছিলো নিশ্চয়ই, সেগুলো ওর মুখ থেকে শুনতে চাই!
কয়েক মিনিট চুপ করে থাকার পরে মহিলা কথা বললেন,
আপনি আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছেন! পাঁচ বছর আগের ভিডিও নিয়ে গেলে পুলিশ আপনাকেও ছাড়বে না! আপনি এতদিন কেনো চুপ করে ছিলেন সেটাও জানতে চাইবে!
অদিতি হাসলো,
আপনি বেশ গুছিয়ে কথা বলেন, এটা আগেও আমি লক্ষ্য করেছিলাম। কিন্তু এর উত্তরে আমারও কিছু বক্তব্য থাকবে, আমি পুলিশ কে বলবো যে আমরা তখন জানতাম না যে তিয়াসা আপনার বোন ঝি, তাই এটা শুধু মাত্র রিয়ার ওপরে তাৎক্ষণিক রাগে আপনি আমাদের কাছে চলে এসেছেন ভেবে অতোটা গুরুত্ব না দিয়েই ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন সত্যি টা জানতে পেরেছি, এটাও বুঝতে পেরেছি যে পুরোটাই প্রি প্ল্যান্ড! ঘটনার সূত্রপাত আরো আগে, আপনার পরামর্শেই আপনার বোন ঝি রিয়া কে ফাঁসানোর জন্যে অনির্বাণের বাড়ি থেকে আমাকে ফোন করেছিলো!
এটা আপনি প্রমাণ করতে পারবেন?
অদিতি মুচকি হাসলো,
আপনি সত্যি খুব শক্ত মনের, তবে এটা ঠিক বলেছেন এই কথাটা আমি কিছুতেই প্রমাণ করতে পারবো না! তবে এর জন্যে আমিও একটা খুব ভালো প্ল্যান করে রেখেছি। আমি পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাবো, যে তিয়াসা আপনার বোন ঝি এটা জানার পরে এখন আমরা বুঝতে পেরেছি যে তখন আপনাদের দুজনের জন্যেই রিয়া সুইসাইড করার চেষ্টা করেছিলো। এটা সুইসাইড করা নয়, সুইসাইড করতে প্রভোক করা! ডাক্তার, কৌশিক, প্রেসক্রিপশন, প্রেসক্রিপশনে লেখা হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজের বক্তব্য সব জোগাড় করে দেবো। এই সুযোগ রিয়াও নিশ্চয়ই ছাড়বে না! তারপরে অনির্বাণ কেও খুঁজে আনবো যে সাক্ষী দেবে আপনার বোন ঝি কালীঘাট মেট্রোর সামনে আপনার পাশে দাঁড়িয়েও আপনাকে চেনে না বলেছিলো। তিয়াসা আপনাকে কেনো চেনে না বলেছিলো সেটা অন্তত পুলিশ তদন্ত করে দেখুক, এটুকুই আমরা চাই। এবার দেখুন, পুলিশে এই কথা জানানো মানেই তো আপনার বোন ঝি কে ডেকে পাঠাবে পুলিশ, ওর তো নতুন বিয়ে হয়েছে দেখলাম, শ্বশুরবাড়িতে কোনো সমস্যা হলে আমাকে কিন্তু দোষ দেবেন না তখন! ও আর আপনার হাজব্যান্ডও যদি জেনে যান, তখন বলবেন না, আমি আপনাকে সাবধান হওয়ার সুযোগ দিই নি! এবার আবার আপনি নিশ্চয়ই জানতে চাইবেন না যে আমি ওদের কি করে খুঁজে বার করবো! যেভাবে আপনাকে বার করলাম সেভাবেই, আর তাও না হলে আপনার হাসব্যান্ড তো আছেনই, রিয়ার খবর রাখেন নিশ্চয়ই তিনি, শুনলাম মাঝে মাঝেই বাচ্চা কে ড্রপ করতে আসেন স্কুলে!
অবশেষে মোবাইল বার করলেন মহিলা, দিতি নিজের ফোন টা এগিয়ে ধরলো,
এটা থেকে করুন,
নিজের মোবাইলের কন্টাক্ট লিস্ট দেখে দিতি র ফোন থেকে ডায়াল করলেন মহিলা, রিং বাজার সঙ্গে সঙ্গে ফোন মহিলার হাত থেকে নিয়ে পাশে সরে এলো দিতি, তিয়াসার গলা শোনা গেলো,
হ্যালো, কে বলছেন?
সঙ্গে সঙ্গেই রেকর্ড বাটনে হাত রাখলো দিতি,
আমি অদিতি তিয়াসা, অর্ক স্যারের ওয়াইফ, তোমার মাসীর কাছ থেকে নম্বরটা নিলাম।
কয়েক সেকেন্ডের নীরবতার পরে তিয়াসার গলা শোনা গেলো,
কোন মাসি?
অদিতি হাসলো,
কেনো? তোমার বান্ধবী রিয়ার বাবার গার্লফ্রেন্ড! ও সরি! এখন তো বোধ হয় মেসোমশাই, তাই না! যার জন্যে তুমি এতো কিছু করলে! এমনকি রিয়া কে ফাঁসাবার জন্যে অনির্বাণের বাড়ি থেকে আমাকে ফোনও করে ফেললে!
আমার কোনো মাসি নেই! কিসব বলছেন এগুলো ম্যাম?
বিরক্তির গলায় বললো তিয়াসা, অদিতি চোয়াল শক্ত করলো,
তাই! কতোগুলো ফটো দেখিয়েছি তোমার মাসি কে, তোমারই বিয়ের সময়ের তোলা! মাসী কে বলো, সময় মতো তোমাকে হোয়াটসঅ্যাপে সেন্ড করে দেবে! আর শোন মিথ্যে বলে আর কিছু লাভ নেই, তোমার মাসীর একটা ভিডিও রেকর্ডিং আছে আমার কাছে, সেটা তোমাকেও বিপদে ফেলতে পারে! ওটার ভয়েই তোমার মাসি আমাকে তোমার নম্বর দিলো, দরকার হলে তুমিই যে মাসীর পরামর্শে আমাকে ফোন করেছিলে, সেটাও বলবে এবার। আর তারপরেও সাক্ষীর দরকার হলে অনির্বাণ তো আছেই! দরকার হলে যে করেই হোক খুঁজে নেব ওকে! যার সামনেই ফোনে তুমি তোমার মাসি কে চেনো না বলেছিলে সেদিন স্যার কে রিয়ার হসপিটাল থেকে! আর তোমার বিয়ের ছবিতে দেখলাম অনির্বাণের সঙ্গে তোমার বিয়ে হয় নি, তাই এখন আর ও তোমার কথায় ওঠাবসা করবে না নিশ্চয়ই!
ম্যাম, প্লিজ! এসব করবেন না! আমার নতুন বিয়ে হয়েছে, হাসব্যান্ড জানলে সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে যাবে ম্যাম!! আমার ভুল হয়ে গিয়েছে ম্যাম, আমি ক্ষমা চাইছি!
আমার সম্পর্কটা যে নষ্ট হয়ে যেতে পারে, ভেবেছিলে একবারও? একটা মেয়ের ওপর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে আমার সংসার নষ্ট করতে চেয়েছিলে যখন, তখন তো ভাবো নি এসব! আমি কোনো কথা তোমাকে দিতে পারছি না তিয়াসা, আর হ্যাঁ, এই কল টা আমি রেকর্ড করেছি, যেখানে নিজে মুখে তুমি অপরাধ স্বীকার করেছ। এটা আমার কাছে থাকলো, ঠিক তোমার মাসীর ওই ভিডিওটার মতন, কখন যে কি করতে ইচ্ছে হবে আমি নিজেই জানি না! হয়ত কোনোদিন তোমার মাসি র মত আমি তোমার হাজব্যান্ড কেও খুঁজে বার করে ফেললাম!
ম্যাম, প্লিজ এবারের মতো মাফ করে দিন! আমি কথা দিচ্ছি আর কোনোদিনও হবে না!
হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলো তিয়াসা,
ভালো কথা, মনে রেখো সেটা! তবে আমি তোমাকে কোনো কথা কিন্তু দিতে পারলাম না, তিয়াসার কান্নার মধ্যেই ফোনটা কেটে দিলো দিতি।
এবার মহিলার দিকে তাকালো অদিতি,
কি সুন্দর প্ল্যান ছিলো তাই না! একবার ফোন করে সন্দেহ ঢুকিয়ে দিতে পারলেই যে আমি ফোনের পেছনের ব্যক্তিটি কে খুঁজে বেড়াবো, সেটা তো জানতেনই! তার সঙ্গে রিয়ার আমার হাজবেন্ডের প্রতি মনোভাবও অজানা ছিল না নিশ্চয়ই আপনার বোন ঝির কল্যাণে। রিয়াও তো বলেছিলো ওকে ওর বন্ধুরা স্যারের স্পেশাল স্টুডেন্ট ভাবে, ও চাইলেই স্যার নোটস দেন! সুতরাং ওর ছোটো ছোট মিথ্যে গুলো কে কিভাবে এই ফোনের সঙ্গে রিলেট করা যায় তার জন্যে যথেষ্টই চেষ্টা চালিয়েছেন! কফির কথা, গয়নার কথা, সবই তো এক এক করে বোন ঝি কে দিয়ে আমার হাজবেন্ডের কানে তুলে দিয়েছেন। কিন্তু তাও আমরা কোনো কিছু প্রুভ করতে পারলাম না! উল্টে রিয়া সুইসাইড করার চেষ্টা করায় আমরা এটা নিয়ে আর এগোতে চাইবো না সেটা বুঝতে পেরে অবশেষে নিজের কলের রেকর্ড নিয়ে আমাদের হেল্প করতে চলে এলেন। অ্যাড্রেস টা নিশ্চয়ই বোন ঝিই দিয়েছিলো আপনাকে!
কৌশিক, ওই ছেলেটি কিছুটা সিম্পথেটিক রিয়ার প্রতি সেটা বুঝে ওকেও আমাদের বাড়ি ডেকে নিয়ে এলো আপনার বোন ঝি, ওদের বাড়ি কেমন, ও কতটা মিথ্যে কথা বলে সেটা কৌশিকের মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্যে। এমনকি রিয়ার বাড়ির ঠিকানাও অনির্বাণ কে দিয়ে কৌশিকের কাছে বলিয়ে দেওয়া হয়েছিলো যাতে ও নিজে গিয়ে দেখে আসে রিয়া কেমন জায়গায় থাকে, এবং কতো টা মিথ্যে বলে! যাতে ওর সঙ্গেও রিয়ার সম্পর্কটা খারাপ হয়ে যায়। রিয়া ফোন করেছে আমাকে এটা প্রুভ করার জন্যে তো অনির্বাণ কে দিয়ে ওর বোন ফোন করতে দেখেছে বলে তো মিথ্যে বলিয়েও নিয়েছে আপনার বোন ঝি! কৌশিক সেদিন হসপিটালে আমার হাসব্যান্ড কে বলেছিলো আমি যে সন্দেহ বাতিক, সেই কথাটা রিয়া শুধু মাত্র ওকেই বলেছিলো, আর কাউকে নয়, এখন বুঝতে পারছি এক্সকার্শন থেকে ফেরার সময় ট্রেনে বা কলেজে কোনো সময় এই কথোপকথন কোনো ভাবে তিয়াসা শুনে ফেলেছিলো। ও জানতোই এই রটনা টা ছড়িয়ে গেলে আমাদের সন্দেহ রিয়ার ওপরেই যাবে, কারণ নদীর ধারে বেঞ্চে বসে আমার হাসব্যান্ড আমার সঙ্গে কি কথা বলেছে সেটা শুধুমাত্রই পাশে বসে থাকা ব্যক্তি অর্থাৎ রিয়াই শুনতে পারে! মেয়েটা কে বাঁচতে দিতে চান নি, তাই না? চেয়েছিলেন মেয়েটা সত্যিই মরে যাক! আমার হাসব্যান্ড তখন আপনাদের একসাথে রাসবিহারী তে দেখেও কিচ্ছু বোঝে নি সেদিন! ভেবেছিলো আমাদের মতই ওকে কোনো টোপ দেবার জন্যে ডেকেছেন আপনি!! কি মানসিকতা আপনাদের! নিজেদের শিক্ষিত বলে জাহির করেন! কি শিক্ষা দেবেন সন্তান কে? রিয়া কে মেয়ের মতো ভাবেন বলেছিলেন না তখন? কোনো মা এই কাজটা করতে পারে! আর হ্যাঁ, আপনার বোন ঝি কে যা বলেছি, তা আপনাকেও বললাম, কোনোদিন আপনার হাসব্যান্ড এর নম্বর খুঁজে নিয়ে ভিডিওটা সেন্ড করে দিলে কিছু মনে করবেন না যেনো!
অনেক চেষ্টার পর ওই মা, মেয়েকে আমার স্বামীর জীবন থেকে সরিয়ে অবশেষে শান্তিতে জীবনটা শুরু করেছি, আপনি এরকম কিছু করলে আমার সব কিছু নষ্ট হয়ে যাবে!
কথা বলতে বলতে কান্নায় বুজে এলো মহিলার গলা, দিতি হাত তুলে থামিয়ে দিলো,
যে অন্যের জীবন নষ্ট করে নিজের জীবন সাজাতে চায়, তার ওপরে আমার বিন্দুমাত্র সহানুভূতি নেই! আর ওনার স্ত্রীর সঙ্গে হয়ত ওনার সম্পর্ক ভালো ছিলো না, কিন্তু কোনো সন্তান কে তার বাবার কাছ থেকে সরিয়ে নেওয়া কে আমি একটুও সমর্থন করিনা!
কথাগুলো বলেই অটো স্ট্যান্ডের দিকে হাঁটতে লাগলো অদিতি, ছুটি হতে শুরু করেছিলো ততক্ষনে, পেছন থেকে প্রিয়াঙ্কা ডাকলো,
আরে, শর্মিলার সঙ্গে কি এতো কথা বললি! ঝেড়ে কাস না একটু!
অদিতি হাসলো,
ছড়ানো গল্প ভাই, সময় নিয়ে বলতে হবে! রাতে কল করছি,
ওকে! কনফারেন্সে নিস! সীমাও জানতে চাইছিলো!
ও যখন মেট্রো থেকে নামলো, তখন অর্ক ও নামছে, স্টেশনেই দেখা হয়ে গেলো দুজনের, অর্ক জানতে চাইলো,
হলো কিছু?
অনেক কিছু! কিন্তু সবাই কে আলাদা আলাদা করে বারবার বলতে পারবো না, বাড়ি চলো, একসাথে বলছি!
সমরেশের ঘরে গিয়ে বসলো সবাই, তিনি উঠে আসতে পারেন না তাই এই ব্যবস্থা!
সমস্ত ঘটনা বিস্তারিত বর্ণনা করে বলার পরে রুমা মাথায় হাত দিলেন,
ইস! কি বাজে মহিলা! এরকমও করে কেউ কেউ! ভাবতেই পারছিনা।
হ্যাঁ, মা, কতো ধরনের মানুষ হয় বলতো! তিয়াসা আসলে জানতো রিয়া যেহেতু নিজেই নিজেকে অর্কর স্পেশাল স্টুডেন্ট প্রুভ করার চেষ্টা করে সব সময়, আর সেটা করতে গিয়েই বেশ কিছু কাজ সত্যিই করেছে, তাই সব দোষ যে ওর ওপরেই পড়বে সেটা সবাই জানে। এখন আমি সবটা পরিষ্কার বুঝতে পারছি! অনির্বাণের বাড়ি থেকে আমাকে ফোন করে এসেই ও ফোনটা কে সাইলেন্ট করে গ্যাসের ওভেনের তলায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলো, যাতে আমি আর ওর সঙ্গে কন্টাক্ট করতে না পারি, এবং আরো বেশি টেনশন করি। তবে একটা কথা এখন আমি বুঝতে পারছি যদি তিয়াসা সেদিন ফোনে আমার মনের মধ্যে সন্দেহ টা ঢুকিয়ে না দিতো, তাহলে হয়তো রিয়ার এই ছোটখাটো মিথ্যেগুলো কে আমি ইগনোরই করতাম! সামান্য পাশে বসে জোরে কথা বলা বা গয়না ও পছন্দ করেছে, ও কফি করেছে অনেকবার, এই রকম মিথ্যে গুলো এতটা বড় হয়ে দাঁড়াতো না! ওর ছোটো ছোটো মিথ্যেগুলো তে ইন্ধনের কাজ কিন্তু ওই ফোনটাই করেছিলো আসলে!
যখন আমি ওকে রাসবিহারী তে ভদ্রমহিলার সঙ্গে দেখেছিলাম তখন এটা একটুও বুঝতে পারিনি। আমি বরং ভেবেছিলাম রিয়া কে ফাঁসাতে ওর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে তিয়াসা! একবারের জন্যেও বুঝতে দেয়নি ওর মাসি! কি সাংঘাতিক মেয়ে! এতদিনে রিয়ার ওপরে ওর রাগের কারণটা স্পষ্ট হলো, রিয়া বোধহয় জানতোও না যে এই মহিলা তিয়াসার মাসি! কিন্তু আর এখন এসব ভেবে লাভ কি! মেয়েটা কে যতই ভয় দেখাও ক্ষতি তো করতে পারবে না তুমি, সেটা তুমি নিজেই জানো। ওর বিয়ে ভেঙে দিতে যে আমরা পারবো না সেটা কি আমরা জানি না!
অদিতি হাসলো,
মেয়েটা কে সত্যি কিছু করতে পারবো না! ওর ক্ষতি করা যে সত্যিই সম্ভব নয় আমার পক্ষে সেটা আমি জানি। কিন্তু কিছু করতে পারি যে কোনো সময়, হয়ত ওর হাজব্যান্ড কেও জানিয়ে দিতে পারি, এই যে ভয় টা দেখিয়ে এসেছি না, এটাই ওকে তাড়িয়ে বেড়াবে সব সময়, আর জীবনে শান্তি তে থাকতে পারবে না ও। তবে ওই মহিলা কে আমি ছাড়বো না! এমনিতেও ওর বরের কাছে ভিডিও পাঠিয়ে দেবো বলে ওকে হুমকি দিয়েই এসেছি! তাছাড়াও ওর জন্যে আমার অন্য দাওয়াই আছে। এই দাওয়াই এর জ্বালা যে কি সেটা আমি নিজে জানি!!
কি করবি তুই?
রুমা অবাক গলায় প্রশ্ন করলেন,
সব কীর্তি গুলো ছড়িয়ে দেবো! সব মায়েরা জেনে যাবে এবার! স্কুলের সামনে গিয়ে লজ্জায় দাঁড়াতে পারবে না আর! যখন আমার সন্দেহবাতিক হওয়ার কথা ছড়িয়ে গিয়েছিলো কলেজে, তখন কি হয়েছিলো আমার, সে আমিই জানি শুধু! ঠিক ওই রকমই করবো ওর সঙ্গে, একসঙ্গে এতগুলো সম্পর্ক নষ্ট করা, একটা বাচ্চা মেয়েকে মৃত্যু মুখে ঠেলে দেওয়ার পরিণতি কি হতে পারে সেটা এবার বুঝবে ও!
ফোন হাতে তুলে নিয়ে ডায়াল করে ফেললো দিতি,
প্রিয়াঙ্কা, আছিস তো? হোল্ড কর, সীমাকেও নিয়ে নিই একটু!! আরে, ওই যে তোদের ওই শর্মিলা, আর ওর ঐ বোন ঝি টা, যার স্ক্রিন শট নিলাম সকালে, আমার বরের এক কলিগের বউ কে ওই মহিলার বরের আগের পক্ষের মেয়ে কে ফাঁসানোর জন্যে……
কথা শেষ হওয়ার পরে ফোন রেখে ঘুরে তাকিয়ে দেখলো অর্ক অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে,
কি বললে? কলিগের বউ! মানে!
তো? আমার বর বলবো? তারপর আমিই নিজেই তো আর দাঁড়াতে পারবো না কোনোদিনও স্কুলের গেটে! যা কথা ছড়ায় এখানে, কালকের মধ্যেই সব ছড়িয়ে যাবে দেখো!
কোনো কোনো গল্প শেষ হয়েও হয়না বোধ হয়! এরও বছর তিনেক পরের কথা, গরমের ছুটিতে সিকিম থেকে বেড়িয়ে এসে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে দার্জিলিং মেলে ফেরার রিজার্ভেশন ছিলো অর্ক, অদিতির এবং রুমার। সমরেশ তার আগের বছর মারা গেছেন, তাই অনেকটা রুমার মন ভালো করার জন্যেই আসা। তখনও প্ল্যাটফর্মে ট্রেন দেয়নি, লাগেজ নিয়ে সামনের একটা বেঞ্চে বসেছিল ওরা।
এমন সময় বেশ অনেক মালপত্র নিয়ে একটা ফ্যামিলি ওদের দিকে পেছন করে এসে দাঁড়ালো, দুজন বয়স্কা মহিলা, সম্ভবত বিধবা আর দুজন অল্পবয়সী স্বামী, স্ত্রী, সঙ্গে একটি ছোটো মাস সাতেকের বাচ্চা। শিশু টি ঘ্যান ঘ্যাণ করছিলো, বোধহয় খিদে পেয়েছে, তার মা এবং বাবা তাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কোলে নিয়ে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে শান্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে, কিন্তু কিছুই হচ্ছে না।
প্ল্যাটফর্মে বসার আর খুব বেশি জায়গা নেই, ততোক্ষনে বাচ্চা টির ঠাকুমা বা দিদিমা যেই হন না কেনো, কৌটো খুলে দুধ বানিয়ে বোতলে ভরে ফেলেছেন, কোথায় বসে খাওয়াবেন তার জায়গা পাচ্ছেন না। ওনাকে এদিক ওদিক তাকাতে দেখে অর্ক উঠে দাঁড়ালো, ভদ্রমহিলার দিকে ইশারা করে বললো,
এখানে বসুন!
জায়গা পেয়ে বোতল নিয়ে বসে ওদের কে ডাক দিলেন ভদ্রমহিলা, যুবক টি শিশু কোলে এগিয়ে এলো, অর্ক আর অদিতি এক সঙ্গে চমকে উঠলো, কৌশিক! ততোক্ষনে কৌশিকও অর্ক কে দেখে ফেলেছে,
স্যার! আপনি! বেড়াতে গিয়েছিলেন নিশ্চয়ই!
এরপরেই অন্য বয়স্ক মহিলা এগিয়ে এলেন,
ইস! আমি তো চিনতেই পারিনি! অনেকটা বদলে গেছেন স্যার! চেনাই যাচ্ছে না আপনাকে!
রিয়ার মা! অর্ক অবাক হলো! তার মানে মেয়েটি নিশ্চয়ই রিয়া! অদিতি একটু অবাক চোখে তাকিয়ে আছে, ও আগে মহিলা কে দেখেনি কখনো।
ভদ্রমহিলা প্রচুর কথা বলেন, কয়েক মিনিটের মধ্যেই রিয়ার বিয়ে থেকে নিজের ডিভোর্স, পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়ের শাশুড়ি, শ্বশুর মশাইয়ের মারা যাওয়া, নিজের মেয়ের কাছে থাকা সব গল্পই করে ফেললেন! কৌশিক অর্কর সঙ্গে দাঁড়িয়ে গল্প করতে থাকলো, একমাত্র রিয়া কোনো কথা না বলে পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো। ইতিমধ্যে ট্রেন দিয়ে দিয়েছিলো, ওদের কোচ আরও দুটো পরে, কৌশিক শাশুড়ি আর মা কে ডেকে নিয়ে কিছু লাগেজ হাতে এগিয়ে গেলো, বাকি লাগেজের সামনে রিয়া ছেলে কোলে দাঁড়িয়ে রইলো।
অর্কও ততোক্ষনে রুমা, আর ছেলে কে নিয়ে অদিতি কে বাকি লাগেজ দেখে রাখার কথা বলে ট্রেনে উঠে গেছে। এমন সময় রিয়া একদম অদিতির পাশে সরে এলো, খুব নিচু গলায় বললো,
ম্যাম! আমি ক্ষমা চাইছি! জানি অনেক ভুল করেছি, কিন্তু সব জেনেও আপনারা কৌশিক কে কিছু জানান নি, তার জন্যে থ্যাংকস ম্যাম! তবে একটা কথা এখনও বলছি, আমি আপনাকে কখনো কোনো ফোন করিনি ম্যাম! প্লিজ আমাকে ভুল বুঝবেন না! আর স্যার কে বলবেন উনি সত্যিই খুব ভালো মানুষ, সব জানার পরেও আমাকে ছেড়ে দিয়েছেন, আমি ওনার কাছে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো!
অদিতি হাসলো, রিয়ার হাতে চাপ দিয়ে বললো,
আমি জানি সেটা এখন! যা হয়েছে সেসব আমি বা তোমার স্যার কেউই মনে রাখি নি, তুমিও ভুলে যাও! কৌশিক খুব ভালো ছেলে, তোমরা দুজনে খুব ভালো থাকবে নিশ্চয়ই! আসি, আবার কখনো দেখা হবে নিশ্চয়ই, ভালো থেকো!
সমাপ্ত
(অনেকটা অপেক্ষা করতে হয়েছে আপনাদের শেষ পর্বের জন্যে, আমি তার জন্যে লজ্জিত, কেমন লাগলো সম্পূর্ন গল্পটা সবাই মতামত দেবেন কিন্তু?)