এটা গল্প হলেও পারতো পর্ব ১২

0
327

#এটা গল্প হলেও পারতো
#পর্ব ১২
এতো তাড়াতাড়ি ফিরে এলে? শান্তিতে খেতেও পারো নি নাকি,

দরজা খুলে অর্ক কে দেখেই হেসে বললো অদিতি, অর্ক কোনো কথা না বলেই গম্ভীর মুখে অদিতির পাশ দিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলো। বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখলো দিতি একটু অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে, ওকে দেখেই চিন্তিত গলায় বললো,

কি হয়েছে তোমার?

অর্ক সোফায় বসে দিতি র দিকে তাকিয়ে বলল,

ফ্রিজে ঠান্ডা জল আছে? দাও তো একটু, মাথাটা প্রচণ্ড গরম হয়ে আছে!

অদিতি তাড়াতাড়ি জলের গ্লাস এনে অর্কর দিকে এগিয়ে দিয়ে, উল্টোদিকের সোফায় বসে উদগ্রীব চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলো। জলটা একচুমুকে শেষ করে গ্লাসটা আওয়াজ করে টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে দাঁতে দাঁত পিষে অদিতির দিকে তাকালো অর্ক,

অরিন্দম যে এতো খারাপ, সেটা একটুও ভানি নি কখনো। বিপদে পড়ে একটু হেল্প চেয়েছিলাম তখন, যদি জানতাম এই তার পরিণতি হবে তাহলে কখনো ওর কাছে কিছু শেয়ার করতাম না।

কি হয়েছে! অরিন্দম দা কি করেছে?

কি করে নি সেটা বলো! আমার কলেজে আর কোনো সম্মান রইলো না! গোটা কলেজে ও বলে বেরিয়েছে যে তুমি নাকি সন্দেহবাতিক!

কে বললো তোমাকে?

কান্নায় গলা প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে অদিতির, লক্ষ করলো অর্ক। নিজেকে শক্ত করে অদিতির হাতটা চেপে ধরে বললো,

তুমি কিছু ভেবো না, ওকে আমি এতো সহজে ছাড়বো না! যা খুশি রটিয়ে ও কিছুতেই পার পেতে পারবে না, আমি ওর সম্মানও ধুলোয় মিশিয়ে দেবো, দেখো তুমি!!

কি হবে ওসব করে আর! যা ছড়ানোর তাতো ছড়িয়েই গেছে! ইস! আমি কি করে মুখ দেখাবো সবার সামনে এবার!

জলভরা চোখে বললো অদিতি, অর্কর মাথা আরও বেশি করে গরম হয়ে যাচ্ছিলো। কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে ফোন তুলে সাথীকে ডায়াল করলো ও, সাথী হ্যাল্লো বলতেই ও ফোনের ভেতরে হৈ হুল্লোড় এর আওয়াজ পেলো। সাথী তারমানে সম্ভবত বিয়ে বাড়িতেই রয়েছে এখন!

ভালোই হলো আপনি অরিন্দমের ওখানে আছেন, আসলে ওকেই এই কথাগুলো বলতে চেয়েছিলাম।

কি হয়েছে? আপনি এতো উত্তেজিত কেনো?

বিপদে পড়েই হেল্প চেয়েছিলাম অরিন্দমের কিন্তু ও যে সেটাকে ওর মুখোরোচক গল্পের প্লট হিসেবে ইউজ করবে, সেটা একবারও ভাবিনি। সে যে আপনার প্রফেসনল এথিক্সও নষ্ট করেছে অদিতির খবর রটিয়ে দিয়ে, সেটা তাকে বুঝিয়ে বলবেন, ওর নিজেরই একটা কাউন্সিলিং দরকার এবার!!

দাঁড়ান, দাঁড়ান, কি বলছেন আপনি? অরিন্দম অদিতির কথা রটিয়ে দিয়েছে? সেতো খুব খারাপ কাজ, আমি ওর সঙ্গে কথা বলে আপনাকে অবশ্যই জানাবো!

অর্ক কে থামিয়ে দিয়ে বললো সাথী, অর্ক ফোন রেখে দিল। বেশ কিছুক্ষন দুজনেই নির্বাক হয়ে সোফায় বসে থাকার পরে অর্কর ফোন বেজে উঠলো। ফোনে অরিন্দমের নাম দেখেই বুঝলো অর্ক, সাথী ওকে সব বলেছে ইতিমধ্যেই! ফোন ধরার সঙ্গে সঙ্গেই অরিন্দমের উদ্বিগ্ন গলা ভেসে এলো,

ভাই কি হয়েছে? সাথী বলছে তুই নাকি ওকে ফোন করেছিস? বলেছিস আমি অদিতির কথা কলেজে সবাই কে বলে দিয়েছি?

বলিস নি বুঝি? সমর দা তাহলে মিথ্যে বললেন তাই তো?! তবে তোর কাছ থেকে সত্যিই এক্সপেক্ট করিনি এটা! কাজটা খুব খারাপ করলি কিন্তু!

ঠান্ডা গলায় কেটে কেটে বললো অর্ক, অরিন্দম একদম আকাশ থেকে পড়লো,

তুই কি পাগল হলি? সমর দার কথাও বিশ্বাস করছিস আজকাল! ঠিক আছে, আমি নেক্সট উইকে জয়েন করবো, মুখোমুখি বসবো সমর দার সঙ্গে। দেখি কেমন আমার সামনে এতো বড় মিথ্যে বলার ক্ষমতা রাখে ও, বলুক আমার নাম সামনে বসে!!

অর্ক আর কোনো কথা বললো না, অরিন্দম ফোন নামিয়ে রাখার পরে অর্কর মনে পড়লো, সমর দা তো অরিন্দমের নাম বলেন নি একবারও! মুখোমুখি বসে প্রমাণ করতে পারবে তো ও!

কিন্তু নেক্সট উইক নয়, পরের দিন সকাল হতেই অর্কর বাড়িতে উপস্থিত হলো অরিন্দম, ঘরে ঢুকেই অদিতির কাছে ক্ষমা চাইলো। অর্কর দিকে তাকিয়ে বললো,

বিশ্বাস কর, সত্যি আমার নিজেরই খুব খারাপ লাগছে! কিন্তু আমি যেটা করিনি, সেটার দায় স্বীকার, সত্যিই করতে পারবো না। কাল সারারাত আমি ভেবেছি, সমর দার এই যে অহেতুক, বিভিন্ন বানিয়ে বানিয়ে বলা কথাগুলো কে আর বাড়তে দেওয়া চলবে না। এর আগে আমার সম্বন্ধেও তোকে একবার মেট্রোতে কতো কথা বলেছিলো, সেবার আমি কিছু বলিনি! কিন্তু আর নয়! এবার একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে!

বলতে বলতেই সোফায় বসে অর্ক কে কোনরকম কথা বলার সুযোগ না দিয়েই সমর দা কে ডায়াল করে ফেললো অরিন্দম, সমর দা ফোন ধরার সঙ্গে সঙ্গেই ফোনটা স্পিকারে দিয়ে টেবিলের ওপরে রাখল ও। ওদিক থেকে সমরের গলা ভেসে এলো,

কি ভাই, ফুলশয্যার পরের দিনই দাদা কে তলব কেনো? সব খবর ভালো তো?

ভালো আর থাকতে দিচ্ছেন কই! বয়স তো কম হয়নি আপনার! এই বয়সে এইসব কথা আপনার মুখে মানায়?

অরিন্দমের কড়া গলার উত্তরে থতমত খেলেন ভদ্রলোক, খানিকটা অবাক হয়ে বললেন,

কি কথা? আমি তো কিছুই বুঝলাম না!

ওই অর্কর স্ত্রীর সম্বন্ধে ওকে যা বলেছেন কাল! তার কথাই বলছি! তা আপনাকে এতো মুখরোচক খবরটা দিলো কে? আমরা কেউ জানলাম না আপনি জেনে গেলেন?

এবার একটু চুপ করে থেকে নিচু গলায় উত্তর দিলেন সমর,

তুমি কিছু জানো না নাকি? সবাই জানে তো! আমি তো ভাবতাম তুমিই আগে জানবে সবটা, ওর সবচেয়ে ক্লোজ তো তুমিই! বলে নি তোমাকে কিছু?

সবাই জানে! কি জানে? এই সবাই কারা?

অরিন্দম অবাক গলায় বললো, গোপন খবর বলতে পেরে একটু খুশিই হলেন ভদ্রলোক, উত্তেজিত গলায় বললেন,

আরে! সবাই, মানে সবাই! টিচার থেকে স্টুডেন্ট কেউ বাদ নেই আর! এতো বেশ পুরনো কথা, প্রায় মাস তিনেক হতে চললো! অর্ক খুব চাপে আছে, তুমি জানো না দেখেই তো আমার অবাক লাগছে!

এসব সম্পূর্ন মিথ্যে কথা! কিচ্ছু হয়নি ওদের! কারা রটাচ্ছে এসব?

সমর কে থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলো অরিন্দম, সমর তাড়াতাড়ি উৎসাহের গলায় উত্তর দিলেন,

তুমি কিছুই খবর রাখোনা দেখছি! এসব কি আজকের কথা নাকি! আমি তো কবেই স্টুডেন্ড দের কাছ থেকেই শুনেছি! থার্ড ইয়ারের একটা গ্রুপ এর সঙ্গে নাকি বেশ কয়েকমাস আগে শান্তিনিকেতন বেড়াতে গিয়ে দেখা হয়েছিলো অর্ক আর ওর বউয়ের! সেখানে মেয়েদের দেখে নাকি ওর বউ জেরায় জেরায় ওকে জেরবার করে দিয়েছে, মেয়েদের নামও জিজ্ঞেস করেছে ডেকে ডেকে! আর এক্সকারসনের ঘটনা জানো না? সেখানে তো পাশে বসে অন্য মেয়েকে ফোনে কথা বলতে দেখে নাকি ওর বউয়ের কি রাগ! শেষে তো ওকে উঠেই যেতে হয়েছে ওখান থেকে! আরো অনেক কিছু আছে, অতো কি আর ফোনে বলা যায়!!এসো একদিন বাড়িতে, বলবো সব!

ফোন কেটে দিয়ে সোফায় মুখোমুখি বসে তিনজনেই তিনজনের দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছুক্ষন পরে অর্ক অরিন্দমের হাত চেপে ধরলো,

সরি ভাই! বিরাট বড়ো ভুল করে ফেলেছি!

অরিন্দম ম্লান হাসলো,

আমি বোধহয় সত্যিই তোর বন্ধু হয়ে উঠতে পারিনি, তাহলে তুই অন্তত অন্যের মুখের কথায় বিশ্বাস করতিস না! যাকগে! বাদ দে! আসল কথা ভাব! এক্সকারশনে সত্যি কোনো মেয়ে তোর পাশে বসে কথা বলছিল? অদিতি রিয়েক্ট করেছিলো তাতে?

রিয়েক্ট করিনি, মেয়েটা আসলে খুব জোরে জোরে কারোর সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলো, তাই বিরক্ত হয়েছিলাম! আমি ওর কোনো কথা শুনতে পাচ্ছিলাম না তাই,

অর্ক কিছু বলার আগেই অদিতি পাশ থেকে বলে উঠলো,

তোকে উঠে চলে আসতে দেখেছে কে কে?

অর্ক মাথা নাড়লো,

জানি না! হোটেলের সব রুম থেকেই নদীর ধার দেখা যায়। অসীম বাবু, ধীমান বাবু ছিলেন টিচারদের মধ্যে, আর স্টুডেন্টদের কথা কি করে বলবো! অনেকেই ছিলো, যে কেউ হতে পারে!

অন্য মনস্ক গলায় বললো অর্ক,

আর শান্তিনিকেতনে?

সেখানেও তো জনা ছয়েক ছিলো প্রায়, কার কথা বলি বলতো! তবে দিতি যে তিয়াসার নাম জানতে চেয়েছিল, এটা কিন্তু ঠিক!

অরিন্দম অদিতির দিকে তাকালো, অদিতি মাথা নাড়লো,

এটা ঠিক যে আমি একজনের নাম জিজ্ঞেস করেছিলাম, কারণ সে আমাকে বলেছিলো অর্কর হাট থেকে কেনা গয়নাগুলো সে পছন্দ করে দিয়েছিলো। কিন্তু আমি মোটেও সবার নাম জানতে চাইনি! কেউ কথা বললে তার নাম জিজ্ঞেস করা কি অশোভন? তুমিই বলো অরিন্দম দা?

একদমই নয়! খুব সাধারণ ব্যাপার! কিন্তু সেটা এরকম অসাধারণ বানিয়ে তুললো কে? এটা কিন্তু জানা খুব দরকার!

একটু চিন্তার গলায় বললো অরিন্দম, অর্ক বাধা দিলো,

আমি শিওর, সমর দাই! কেউ হয়ত বলেছে কথাগুলো এমনই, সেটা কে উনিই তিল থেকে তাল করে তুলেছেন।

অরিন্দমও সহমত হলো, একটু রাগের গলায় বললো,

একবার সুযোগ পাই! দ্যাখ ওকে কি করি! বুড়ো হয়ে মরতে চললো এখনও কুট কাচালি গেলো না! ওই বাড়িতে প্রাইভেট টিউশন করে না! ওখানেই গল্প শুনে নতুন নতুন গল্প বানায়! এক কাপ কড়া করে চা করো তো অদিতি, মাথাটা ধরে গেছে একদম!

অদিতির আনা চা খেয়ে, সমর কে গালাগালি দিতে দিতে অরিন্দম বিদায় নিলো। আগামী মাসে হনিমুন সেরে ফিরেই দুজনে মিলে সমরের কিছু ব্যবস্থা করবে, যাবার আগে অদিতি কে কথা দিয়ে গেলো। সপ্তাহখানেক পরে আস্তে আস্তে ঘটনাটা সবারই মন থেকে মুছে গেলো।

দেখতে দেখতে আরো মাস তিনেক কেটে গেলো, সমরেশ এবং রুমা বিভিন্ন ঝামেলায় আটকে পড়ে আর কলকাতায় আসতে পারলেন না। অদিতির বাবার শরীর বরাবরই খারাপ, তাই তাঁর পক্ষে আসাও সম্ভব ছিলো না। শেষ পর্যন্ত রুমার ইচ্ছেই ছেলে নিয়ে অদিতি আর অর্ক দুজনে বাড়ি থেকে ঘুরে এলো। ফিরে এসে অর্ক কলেজে যেদিন জয়েন করলো তার কিছুদিন পরেই থার্ড ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষা। ওকে দেখেই অনির্বাণ এগিয়ে এলো,

স্যার, আপনার বাড়িতে আসতাম একদিন, কিছু জিনিস বোঝার ছিলো!

অর্ক রাজি হলো, সত্যিই ওর ছুটি নেওয়ার জন্যে কিছু কিছু জিনিস তাড়াহুড়ো করেই শেষ করেছে ও। ওগুলো আর একবার ডিসকাস করলে ভালোই হবে, বললো,

ঠিক আছে এই সপ্তাহে তো দিন তিনেক ছুটি আছে, ওইসময় এসো তাহলে। যারা যারা আসতে চায়, তাদের সবাই কে বলে দিও একটু। দু তিন দিন বসলেই সব টা কমপ্লিট হয়ে যাবে। কলেজ থেকে ফিরে অদিতি কে বললো সবটা,

তোমার অসুবিধা হবে না তো! যদি হয় তাহলে অন্য কোনো ব্যবস্থা করবো না হয়!

কিসের সমস্যা! কোনো অসুবিধা নেই, আমি ছেলে কে নিয়ে বেডরুমে থাকবো। ওকে নিয়ে বেরোলেই ও জ্বালাতন করবে,

হেসে বললো অদিতি, অর্কও হাসলো,

হ্যাঁ ওটাই ভয় আমারও, যা দুরন্ত হয়েছে, দু দুবার খাট থেকে পড়তে পড়তে বাঁচলো!

ওরাও কি আমার কথা জানে? সমর দা কি ওদেরও বলেছে! আমার একটু অস্বস্তি হচ্ছে,

ছাড়ো না! জানলেও বা কি এসে যায়! ভালোই তো, যদি জেনেও থাকে, তাহলে এখানে এসে তোমাকে দেখে ওদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হবে। সেটাই তো আমরাও চাই, তাই না?

অদিতি কে থামিয়ে দিয়ে বললো অর্ক, অদিতি একটু হাসলো,

আচ্ছা! সত্যিই কি আমি সন্দেহবাতিক? তুমি নিজেও কি তাই ভাবো?

অর্ক মাথা নাড়লো,

মোটেও না! তুমি একবারই এরকম কাজ করেছিলে বাড়িতে একা থাকার সময়ে, তবে আমি পরে ভেবেছি জানো, তোমাকে ওই সময় একা রাখা আমার উচিত হয়নি! যাইহোক ওসব আলোচনা থাক, ওদের দু একবার চা করে দিও একটু, তাহলেই হবে।

স্টুডেন্টরা আসতে শুরু করলো নির্ধারিত দিনে, আজ নিয়ে তৃতীয় দিন হলো স্টুডেন্টদের বাড়িতে ডেকে ওদের সমস্যা গুলো বুঝিয়ে দিচ্ছে অর্ক। অদিতি কে খুব বেশি বিরক্ত করে না ও, শুধু বার দুয়েক সবাই কে চা করে দিতে বলা ছাড়া। সেটুকু দিতি হাসি মুখেই করে, যে মেয়েগুলো এসেছে এখনও পর্যন্ত, প্রত্যেকটা মেয়েকেই বেশ ভালো লেগেছে দিতির।

চা করার সময় ওরাই ওর ছেলেটা কে নিয়ে রেখেছে, ওর খুব একটা অসুবিধা হয়নি। ওদের সঙ্গে একটু আধটু গল্পও করেছে ও, ভালোই লাগছিলো ওর। অনেকদিন তো সেভাবে ওর কোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়নি, এরা কলেজের ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট, বেশ বড়ই সবাই, কথা বলে বেশ সময় কেটে যাচ্ছিলো ওর।

সংখ্যায় বেশি হয়ে যাচ্ছিলো বলে স্টাডি তে জায়গা হচ্ছিলো না, ড্রইং রুমের সোফায় ওদের নিয়ে বসছিলো অর্ক। ওখান থেকে কথা বললে বেড রুম থেকে শোনা যায়, ছেলে ঘুমাতে চায় না, এখন প্রায় ছয় মাসের হয়ে খুব দুষ্টু হয়েছে সে। তাই কদিন ধরেই পেছন দিকের ঘরে এসে দুপুরে ছেলেকে ঘুম পাড়াচ্ছিলো দিতি। ওই ঘর থেকে বেরোলে সামনে রান্নাঘরটা পড়ে, ডাইনিং থেকে ড্রইং এর অনেকটা দূরত্ব, তাই অতোটা আওয়াজ আসেনা এখানে।

ছেলে কে ঘুম পাড়াতে গিয়ে নিজেরই কখন চোখ বুজে এসেছিলো টের পায় নি দিতি। আজকাল ছেলের পেছনে ওকে এতো ছোটাছুটি করতে হয়, ও পেরে ওঠেনা আর। আগে যতদিন অর্ক ছুটিতে ছিলো ততদিন ও ও কিছুটা সাহায্য করতো ওকে, এখন সবটাই ওর ওপরেই এসে পড়েছে। ড্রইং রুম থেকে ভেসে আসা অর্কর গলার স্বরে ঘুম ভাঙ্গলো দিতি র। কিছু বোঝাচ্ছে ও স্টুডেন্টদের বুঝতে পারছে দিতি, তার মানে ওর ছাত্র ছাত্রীরা এসে গিয়েছে।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো প্রায় চারটে বাজে, এইসময় একবার চা দিতে বলে অর্ক, চা করবে বলে ঘরের বাইরে এসেই থমকে গেলো দিতি। সেন্টার টেবিলের চারিদিকে ছড়ানো সোফায় গোল হয়ে বসে আছে স্টুডেন্টরা, ওর দিকে পেছন ফিরে সোফায় বসে মাথা নিচু করে টেবিলের ওপর রাখা নোটস এর দিকে তাকিয়ে কিছু বোঝাচ্ছে অর্ক। ওর বাম পাশে একটা ছেলে, উল্টোদিকের সোফায় বেশ কয়েকটা ছেলে, মেয়ে আর ঠিক ডান পাশে বসে একটা মেয়ে খুব বিশ্রী ভাবে অর্কর গায়ের সঙ্গে প্রায় লেপ্টে বসে আছে।

অর্ক মাঝে মাঝেই নিজেই অস্বস্তিতে একটু করে সরে যাচ্ছে বাম দিকে বসা ছেলেটার দিকে, আর ঠিক ততটাই সরে আসছে মেয়েটা। উল্টোদিকের সোফায় বসা ছেলে, মেয়েগুলোর ঠোঁটে লেগে থাকা মুচকি হাসিটা চোখে পড়ছিলো দিতির। অনেকদিন পরে আবার সেই সন্দেহ টা ফিরে আসছে বুঝতে পারছে দিতি, নিজেকেই নিজে শান্ত করার চেষ্টা চালাতে লাগলো ও।

ঘরের মধ্যে আবার ফিরে চলে এলো অদিতি, এখন বেরোলেই সব গন্ডগোল হয়ে যাবে আবার। আজ আর চা করতে বেরোবে না ও, হে ভগবান! কিছু যেনো ভুল করে না ফেলে ও। বিছানায় শুয়ে ঘুমন্ত ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে শক্ত করতে লাগলো, এই সময় টুকু তাড়াতাড়ি পার করে দাও, মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগলো ও।

ইস , আর তো দু একদিনের ব্যাপার ছিলো আজকের দিনে এটা চোখে না পড়লেই হতো না! কি করে ও এখন! একটুও ভুল পদক্ষেপ ওর আর অর্কর সম্পর্কটা কে সারাজীবনের মতো শেষ করে দিতে পারে জানে ও! আজ যদি ও স্টুডেন্ট দের সামনে কোনো বোকামি করে ফেলে, অর্ক ওকে কোনো দিনও ক্ষমা করবে না, ওর সংসারটাই ভেঙে যাবে একদম।

চা করবে না?

অর্কর গলার স্বরে চমকে তাকালো দিতি, ও অর্কর দিকে তাকাতেই পারছে না,

আমার শরীরটা ভালো লাগছে না, আজ তুমি একটু নিজেই করে নাও প্লিজ,

কথাগুলো বলেই পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো অদিতি, হটাৎ করেই খুব কান্না পাচ্ছে ওর।

অর্ক একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলো, কিছু একটা হয়েছে অদিতির বুঝতে পারছে, এই কিছু হওয়া টাকেই ভয় পায় ও। এক্ষুনি স্টুডেন্টদের সামনে কিছু করে ফেলবে না তো! রীতিমত ভয় লাগছে এবার, সঙ্গে সঙ্গে মনস্থির করলো ও, ঘর থেকে বেরিয়ে এসে স্টুডেন্ট দের দিকে তাকালো ও,

আমার ছেলের শরীরটা একটু খারাপ হয়েছে, আজ আর হবে না, কাল কে একটু আরেকবার সবাই এসো এই সময় প্লিজ।

স্টুডেন্টরা বেরিয়ে যেতেই অদিতির সামনে দাঁড়ালো ও,

কি হয়েছে তোমার?

ওই মেয়েটা কে? তোমার গায়ে লেপ্টে বসেছিলো তোমার পাশে,

অর্কর দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ স্বরে বললো অদিতি, অর্ক প্রমাদ গুনলো, উফফ আবার!

প্লিজ দিতি, এগুলো নতুন করে আবার শুরু কোরনা, ওখানে সবাই আমার স্টুডেন্ট। এই ধরনের কথা যদি একটুও ওদের কানে যায়, তাহলে কিন্তু আরও ছড়িয়ে যাবে তোমার সন্দেহবাতিক হওয়ার কথা!

অদিতি কে শান্ত করার চেষ্টা চালাতে লাগলো অর্ক।

বিশ্বাস করো আমি একদম সত্যি বলছি। তুমি দেখেছিলে, ওই মেয়েটার কাণ্ড দেখে অন্যরা কেমন মুচকি হাসছিলো,

কেউ হাসেনি দিতি, আবার এগুলো কল্পনা করছো তুমি, সবাই আমার পড়ানো শুনছিল, এখানে কেউ হাসতে আসেনি। ওদের পরীক্ষা সামনে, ওরা পড়া বুঝতে এসেছে আমার কাছে!

অদিতির পাশে বসে বললো অর্ক, হটাৎ করেই লজ্জা লাগলো অদিতির, ইস একটু আগেই ও ভেবেছিলো এগুলো নিয়ে কিছু বলবে না অর্ক কে, তাও আবার বলে ফেললো! কি যে করে ও!

সরি অর্ক, আমার ভুল হয়ে গেছে, আর হবে না দেখো তুমি,

অর্কর হাত টা ধরে ফেললো দিতি, খুব লজ্জা লাগছে এখন,

ওদের আবার কালকে আসতে বলেছি, আজ কিছুই বুঝিয়ে উঠতে পারিনি, সবে শুরু করেছিলাম, তুমি কাল কিন্তু ওদের দেখে এরকম আর কিছু করবে না, প্রমিস করো আমাকে,

প্রমিস,

ঘাড় নেড়ে বললো দিতি, ওকে শুয়ে পড়তে বলে সোফায় এসে বসলো অর্ক। এই প্রথম বার অদিতির সামনে স্বীকার না করলেও নিজের মনের মধ্যেই একটা অস্বস্তি হচ্ছে। অন্যরা হাসছিলো কিনা ও লক্ষ্য করেনি সেটা, কারণ মাথা নিচু করে পড়াচ্ছিলো ও, কিন্তু রিয়া মেয়েটা যে সত্যিই বার বার ওর গায়ের সাথে লেপ্টে আসছিলো, নিজেও সেটা ফিল করেছে ও। তাই বারবারই পাশে বসা ছেলেটার দিকে নিজেকে সরানোর চেষ্টা যে ও করছিলো সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু এটা দিতি কে বুঝতে দেওয়া চলবে না একটুও, তাহলেই বিরাট অশান্তি বাধাবে ও। কাল দূরে গিয়ে আলাদা একা বসতে হবে, মনে মনে ঠিক করলো ও।
ক্রমশ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here