#এক_প্রহরের_খেলা ১০
মোর্শেদা হোসেন রুবি
||
রাত দশটা বাজতে না বাজতেই হুড়মুড় করে বাসস্ট্যান্ড ফাঁকা হয়ে যায়। মাঝেমধ্যে পুলিশের তাড়া খেয়ে ওরা বাসস্ট্যান্ড থেকে খানিকটা সরে চলে যায় সোজা বড় রাস্তার মোড়ে। তারপর রাত বাড়লে গলির মুখটাতে আড্ডা চলে ওদের। মাঝরাত পর্যন্ত চলে এই আড্ডা। তারপর দলটা তিনভাগ হয়ে যায়। দুজন ডানে দুজন বামে, একজন পেছনের রাস্তা ধরে আরেকজন সোজা কাঞ্চননগরের দিকে। সেই একজন হলো এই দলের লিডার। সে থাকলেই আড্ডা তুমুল জমে। নালিশ আর তোষামোদী চলে একচেটিয়া। গুরুজী সেসব শোনেন আর দাপুটে ভঙ্গিতে সমাধান দেন। আজকের বাসস্ট্যান্ডের আড্ডায় সে নেই। এমনকি আজ কোন পুলিশও নেই। কোন কোনদিন তো এমন হয় যে পুলিশ এদিকটায় আসেই না। দুর থেকে টর্চ মেরে চলে যায়। কেননা লিডার সাহেব সাথে থাকলে কনস্টেবলের টর্চ তো দুর, পুলিশ জিপের হেডলাইটও উপেক্ষা করে তারা। আজ লিডার সাথে না থাকায় উসখুস বাড়ছে। কেউ কেউ অপেক্ষায় থেকে ক্লান্ত। মৃদু ফিসফাস চলছে ওদের মধ্যে। দু’ একজন চকিতে ঘড়িও দেখছে।
এমন সময় বাস থামতে দেখে সচকিত হল তারা। দলটা বিচ্ছিন্ন হয়ে দুপাশে সরে গেল। উঁকি ঝুঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করছে চারপাশটা। বাসটা চলে যেতেই যে দুচারজন যাত্রী নেমেছিল তারা নিজেদের মত হাঁটা ধরল তাদের গন্তব্যে। কেবল একজন যাত্রীকেই তারা দেখল কোথাও না গিয়ে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে দাঁড়িয়ে মোবাইল বের করতে। বারকয়েক টেপাটিপি করে সে ক্ষান্ত দিয়ে চারপাশে তাকাতে লাগল সে। দলটা দুর থেকে তাকে দেখলেও কোন মন্তব্য করল না। তবে লোকটার পিঠে একটা ছোট্ট ব্যাগ ছাড়া আর কিছু নেই দেখে সামান্য অবাকই হল। খুব বেশী হলে দু একটা শার্ট আছে ওতে। খুব একটা মালপানি হয়ত নেই। তবে হাতের ঘড়ি আর মোবাইলটা দামী। ধমক দিয়ে কেড়ে নেয়া যেতে পারে ওগুলো। কাজটা করবে কিনা ভাবছে দলটা। একে অন্যের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে অবশেষে প্ল্যানটা বাদ দিল। এমনিতেই আজ দিনটা ঝামেলার।
প্ল্যান মোতাবেক কাজ এগোয়নি। সব এলোমেলো হয়ে গেছে। অথচ ঘটনা রটে গেছে। কিভাবে কী হল কিছুই বুঝতে পারছে না তারা। এখন চুপচাপ লিডারের সংকেতের অপেক্ষা।
ইতোমধ্যেই একটা জিপ এসে থামল ওদের সামনে। দুদিক থেকে দলটা জিপের কাছে এসে ভিড়ল। জিপের মধ্যে বসে থাকা ছেলেটা দেখতে ভীষণ সুদর্শন। তবে রুক্ষতা তার চেহারায় স্থায়ী ছাপ গেড়ে দিয়েছে। দেখলে ভাললাগার বদলে ভয় জাগে প্রথমে। ছেলেটাকে দেখে মনে হলো এই মুহূর্তে সে ভীষণ রেগে আছে । দাঁত মুখ খিঁচিয়ে খিস্তি আউড়ে বলল, ” সব *** পো এইখানে খাড়ায়া কী ** ফালাইতাছোস ? ঐখানে তো ছেমড়ি হাওয়া ? ”
-” কী কন আজাদ ভাই ? ছেমড়ি কই হাওয়া হইব। সে গেলে এদিক দিয়াই যাইব। কাঞ্চননগর যাওনের রাস্তা তো এইটাই। গেলে তো দেখতাম।”
-” এই খুশিতেই নাচ। ডাক্তারখানার সামনে পুরো ফাঁকা। ছেমড়িরে পাই নাই আমি।”
-” ওমা, তাইলে মাইয়াটা গেল কই ? ”
-” সবজায়গায় সার্চ কর। পোলাপান যে কয়টা আছে সব কয়টাকে ডাক। আমার কথা বলবি। এক বাঘের গ্রাস অন্য বাঘে খায়না। কোন ***পুত কামটা করছে তারে খুঁজে বের কর। আমি এখন সোজা মামার সাথে দেখা করব। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেব। বুঝেছিস কিছু না আরো বুঝিয়ে বলতে হবে ? ”
-” না, বস। আর কিছু বুঝাইতে হইব না। সব এক্কেরে কিলিয়ার। আপনে ঐ দিকে যান। আমরা এদিকে সব খবর বাইর করতাসি।”
-” ওকে…!” ভুঁস করে টান মেরে বেরিয়ে গেল জিপটা। লিডারের নির্দেশ মেনে বাকিরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। আজ রাতের মধ্যেই বের করতে হবে মেয়েটার খোঁজ। এ তো বড় অদ্ভুত কথা। মেয়ে কিডন্যাপ হয়েছে অথচ তারা মেয়েটাককে কিডন্যাপ করার সুযোগই পায় নাই। এখানে তৃতীয় পক্ষটা কে খুজে বের করতে হবে। নইলে একটারও ছাল পিঠে থাকবে না। আজাদ মুনতাসীর যার নাম।
~`~`~`~`~`~`
বাস থেকে নামার পর চারপাশটা বড় নিরব ঠেকল আমার কাছে। সাধারণত বাস স্ট্যান্ডের মত পাবলিক প্লেসগুলো এতটা শান্ত হয়না। আজ কী এই অঞ্চলে কোন হরতাল নাকি কে জানে। নাকি রাত হয়েছে বলে ? হাঁটতে হাঁটতেই পকেট থেকে মোবাইল বের করে লাইট জ্বেলে সময় দেখলাম। সোয়া দশটা। এমন কিছু রাত না। তারপরেও এতটা নিরবতা একটু অস্বস্তিকরই ঠেকছে। এরকম সময় ঢাকায় এর উল্টোটাই ঘটে। শহরশুদ্ধ লোক জমা হয় বাস টার্মিনালগুলোতে। ট্রেন আর লঞ্চঘাট গুলোতেও একই দশা । কাকডাকা ভোর কী মাঝরাত। সারাক্ষণ হাটবাজারের দৃশ্য। এখানে তেমনটা নেই। নাকি মফস্বল বলে কে জানে। কিন্তু কই, আগেও তো এসেছি। তখন তো এরকম দেখিনি।
হাঁটতে হাঁটতেই চারপাশে তাকালাম। লাইটপোস্টের নিচে একজন ফল বিক্রেতা বসে আছে। তার একটু পেছনে এক পিঠা বিক্রেতা তার ছাপড়া গোটাচ্ছে। হয়ত ক্রেতা নেই বলেই তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছে। আশেপাশে ইতিউতি লোকজন হাঁটাহাঁটি করছে উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে। খানিক এগিয়ে গিয়ে রিক্সা খুঁজলাম। এদিকটায় তেমন রিক্সা নেই। দু চারটা যাও বা আছে সেগুলিও প্যাসেঞ্জার ভরা। হতাশ চোখে খানিক অপেক্ষা করে অনুমানেই হাঁটা ধরলাম সামনের দিকে। যতদুর মনে পড়ছে এর আগের বার এদিক দিয়েই রুমকিদের বাড়ি গিয়েছিলাম। আসলে বেশ অনেকদিন ধরেই এদিকে আসা হয় না। আপানের অসুস্থতার কারণে যেটুকু আসা হয়েছিল সেটাও ছিল রাতের বেলা ফলে চারপাশ ঠিকমত নোটিশ করা হয়ে ওঠেনি। তাছাড়া সেদিন মনটাও ছিল বিক্ষিপ্ত। অত কিছু খেয়ালও করা হয়নি। তার উপর সেদিন এসেছিলামও মাইক্রোতে করে । যাওয়াও ঐ গাড়ীতেই। যার ফলে বাসের রাস্তাটা অচেনা।
মুহূর্তেই নস্টালজিক হয়ে গেলাম। সেদিনের কথাগুলো মনে পড়ল। কবুল বলানোর আগে আম্মু রুমকিকে একবার আমার সামনে নিয়ে এসেছিলেন। মেয়েটা থরথর করে কাঁপছিল রীতিমত। ঘরে ঢুকে আমার পর্যন্ত আসতেই দু’বার হোঁচট খেয়েছিল বেচারী। আর আমার দশা হয়েছিল তখন ফ্রাইপ্যান থেকে উনুনে পড়ার মত অবস্থা। জ্বলন্ত আগুনে পোড়া কাঠকয়লার মত লালচে মুখ নিয়ে রাগে গনগন করছিলাম। রুমকিকে তখন মনে হচ্ছিল বিশ্বখ্যাত। যে কিনা শাড়ি পড়তে জানে না। চৌদ্দবার উষ্টা খায়। আপানের ভাষাতে আপন মনেই বলেছিলাম কথাগুলো। আরো যে কী কী বলেছিলাম তা যদি রুমকি কোনদিন শোনে তো ও’ই আমাকে উষ্টা দিয়ে চলে যাবে।
ভাবনটা মনে আসতেই দুপাশে মাথা নাড়লাম। নাহ্, আমার রুমকি অমন মেয়েই না। সে কী নায়লা যে আমাকে উষ্টা মারবে। সে তো মায়াবন বিহারিনী হরিনী। মুঘলে আজমের মধুবালা। বনহুরের মনিরা। হ্যাঁ, সে মনিরা। নুরী নয়। সে আমার মনিরা। আর আমি দস্যু বনহুর। আচ্ছা, আজ কয় তারিখ। আজ আমি রিয়েল দস্যু হতে পারব তো !!!
====
-” কই যাইবেন সার ? ” ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম রিক্সাটা আমার পাশেই এসে দাঁড়িয়েছে। বেতাল ভাবনায় এতটাই মশগুল ছিলাম যে চারপাশের সবকিছু গুলে খেয়েছি। থতমত খেয়ে বললাম,
-” ইয়ে, কাঞ্চননগর যাবে ?
-” না, ঐ দিকে যামু না। ” বলেই সে রিক্সা টান দিতে চাইল। দ্রুত হাত তুলে থামালাম। কারণ এতক্ষণে লক্ষ্য করেছি রাস্তায় রিক্সা একটাও নেই। এটাকে হায়ার না করলে আমাকে সারারাত রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হতে পারে। রুমকিকেও ফোন দিতে পারছি না কারণ তাতে সারপ্রাইজ নষ্ট হয়ে যাবে। আমি চাই ও যেমন করে আমাকে চমক দিয়ে রেখে এসেছে তেমনি আমিও ওকে আজ চমকে দেব। ডাবল চমক। দেরী করে পস্তাতে চাই না। ত্রস্তে বলে উঠলাম,
-” কেন, ঐ দিকে তোমার কী সমস্যা ? চলো চলো…ডাবল ভাড়া পাবে।”
-” না স্যার। ঐ দিকে আজকা বহুত ক্যাচাল বাজছে। ঐ দিকে যাওন যাইব না।
-” আজ আবার কিসের ক্যাচাল ? আজ না কোন হরতাল না ধর্মঘট।”
-” না, সার। ঐসব কিছু না। আইজ একটা মাইয়া কিপনাপ হইসে। এহন ঐ দিকে যাওন যাইব না। পুলিশ লোক দেখলেই জিগাস করতাছে। রিক্সাএলাগো তো আরো বেশী।”
-” ওহ, তাই নাকি । দেখ, এরকম কিডন্যাপ এখন বাংলাদেশের প্রায় সব এলাকাতেই হচ্ছে। তাই বলে লোকে পথ চলবে না নাকি ? তুমিইবা রিক্সা চালানো ছেড়ে দেবে নাকি, বলো ? পথ চলতে গেলে এসব পরিস্থিতি ফেস করতে হবেই। চলো তো ভাই, আমাকে একটু নামিয়ে দিয়ে এসো। ভাড়া নিয়ে ভেব না।” বলেই লাফ দিয়ে রিক্সায় উঠে পড়লাম। কারণ যা বুঝতে পারছি এই রিক্সাওয়ালাকে চাপ না দিলে কেবল লোভ দেখিয়ে রাজি করানো যাবেনা। আমার উঠে পড়া দেখে সেও আর দ্বিরুক্তি না করে প্যাডেল চাপল।
রাতের নিরবতা আর মৌসুমী হাওয়া বারবার আমাকে অন্যমনস্ক করে দিচ্ছে। বাতাসটাও যেন মন উদাস করা। একবার মনে হল এই বাতাস আজ আমার রুমকিকেও ছুঁয়ে এসেছে। বুকের ভেতরের চোরা মনটা বাতাসের অনুরণনের সুরে বলতে লাগল, ‘ভালবাসি, রুমু ভালবাসি।’ ভাবনটা মনে আসতেই এক অন্যরকম ভাললাগা অনুভব করলাম সমস্ত মন জুড়ে। অবচেতন মন বলে উঠল, তুই বড় লোভী রে ঋভূ। এক প্রহরের খেলা সাঙ্গ হবার আশাতেই বুঝি মন আজ এত উচাটন। আপন মনে হাসলাম। এটা ঠিক, আজ রুমকিও দারুণ সারপ্রাইজড হবে। প্রথমত আমার আচমকা আগমন দ্বিতীয়ত আমার এখানে দু’দিন অবস্থান। কারণ রুমকি জানে যে সে কাল ঢাকা ফিরে যাবে। সেখানে আমার স্বয়ং উপস্থিতি ওকে চরম বিস্মিত করবে এটাই স্বাভাবিক। ভাবছি আমাকে দেখার পর ওর এক্সপ্রেশনটা কেমন হবে । ও কী লজ্জায় লাল হবে না আকাঙ্খায় বেগুনী ? ও তো জানেনা আমি কোন মাত্রার অসভ্য। ইচ্ছে করেই আজ একটা জিনিস কিনেছি। ভাবছি এটা ওর হাতে দিয়ে জানতে চাইব এর ফাংশান কী। জানি লজ্জায় স্রেফ পাথর বনে যাবে ও। অধিক শোকে পাথর যাকে বলে। ও ধারণাই করতে পারবে না যে আমি এমন রসিকতাও করতে পারি। সত্যি বলতে কাল ওর লজ্জাবনত মুখ দেখার পর ভীষণ ইচ্ছে জেগেছিল ওকে অনেক কিছু বলি। বলে বলে ওর চেহারা লজ্জায় লাল করে ফেলি। আজকাল তো মেয়েদের লাজুক চেহারা বিরলই হয়ে গেছে। নায়লাকে তো ঠাট্টা করে লজ্জা দিতে গিয়ে উল্টো নিজেই লজ্জায় পড়ে গেছি কতদিন। তারপর থেকে ওর সাথে সাবধানে ঠাট্টা করি।
একবার দুজনে বেড়াতে বেরিয়ে কোল্ড ড্রিঙ্কসের খোঁজ করছিলাম। হঠাৎ দুষ্টামী চাপে আমার মাথায়। ঠাট্টা করে নায়লাকে বলেছিলাম, ইস্, তোমার সাথে থাকলেই কেন যেন আমার গলা শুকিয়ে আসে।” কথাটার মধ্যে প্রচ্ছন্ন একটা ইঙ্গিত ছিল। নায়লাও ধরতে না পারার মত বোকা নয়। কিন্তু ওকে লজ্জা দেয়াই ছিল আমার উদ্দেশ্য। মেয়েরা জানে না, তাদের লজ্জিত মুখ পুরুষদের কতটা শিহরিত করে। আমিও ব্যতিক্রম নই। ভেবেছিলাম নায়লা এটা শুনে লজ্জা পাবে। ববিতা স্টাইলে কিল মারবে কিন্তু নায়লা লজ্জা পাবার বদলে হিহি করে হেসে ফেলেছিল। তারপর চোখ মটকে ঝটপট জবাব দিয়েছিল, ” গলা ভেজানোর সাহস না থাকলে আমি কী করতে পারি ? এজন্যই তো তোমাকে বলি, গ্রো আপ ঋভূ, গ্রো আপ ! ”
ঠাট্টার মুখে ঝাঁটার বারি। নিজের গালেই নিজে চপেটাঘাত করেছিলাম সেদিন। এ এক অদ্ভুত অনুভূতি। যে মন অাকুল থাকে নারীর লজ্জাবনত মুখ দেখার আশায় সেই মন নারীর নির্লজ্জতায় কতইনা কষ্ট পায়। থমকে গিয়ে আশাভঙ্গের বেদনা চেপে বলেছিলাম, ” চুরি করে তৃষ্ণা মেটানোকে যদি বড় মানুষের কাজ ধরা হয় তাহলে আমার নাবালক থাকাই সই। বড় হবার সংজ্ঞা একেক জনের কাছে একেক রকম। মদ খেলে কিছু সমাজে অনেক উঠে যাওয়া হয় আবার কিছু সমাজে অধঃপতনের চুড়ান্তে। আজকাল কাপড় খুলে অভিনয় করাকে বলা হয় সাহসী দৃশ্যে অভিনয়। সাহস আর বড়ত্বের সংজ্ঞা স্থান কাল পাত্র ভেদে একেক রকম। আমি মনে করি, সাহস আর সবরকম সুযোগ থাকার পরেও অনৈতিক ইচ্ছেকে লাগাম পড়িয়ে সত্যের উপর অটল থাকাটাই সত্যিকারের বড়ত্ব।”
নায়লা আমার কথাটাকে হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, ” তুমি আসলেই একটা নিরামিষ। সব কথাকে সিরিয়াসলি নেয়া আর একটা না একটা লেকচার ঝাড়া চাই তোমার।”
-” বাহ্, লেকচার কই ঝাড়লাম ! বরং আমার ঠাট্টাকে তো প্রথমে তুমিই সিরিয়াসলি নিয়েছ। আমি খুঁজলাম কোল্ড ড্রিঙ্কস আর তুমি বড় হতে বলছ। দোষটা কার ? ”
-” তুমি বলো নি আমাকে দেখলে গলা শুকায় ? ”
-” আলবৎ বলেছি কারন জানি তুমি সফট ড্রিঙ্কসের পাগল। কথাটার ভিন্ন অর্থ না খুঁজে এটারই উত্তর দিতে।”
কেন বলতে পারব না, সেদিন বেশ বিরক্ত লাগছিল আমার। নায়লা ঠিকই বলে, আমি দারুণ মুডি। হুটহাট সিরিয়াস হয়ে যাই। এটাও নিঃসন্দেহে আমার নরম মাতা আর গরম পিতার দুই মিশেলী প্রভাব। আমি অন্তত তাই মনে করি।
রিক্সাটা গর্তে পড়ায় ঝাঁকুনি খেয়ে ভাবনাগুলো সব এলোমেলো হয়ে গেল। নড়েচড়ে বসতেই শুনতে পেলাম রিক্সা ওয়ালার প্রশ্ন করছে।
-” সার কী এলাকায় নতুন ? ”
-” হ্যাঁ, কেন বলতো ? ”
-” না, এমনেই। আপনারে দেইখা আমার মনে হইল।”
-” মনে হবার কারণ ? ”
-” কারণ কিছু না তয় আমি এই এলাকায় রিকসা চালাই আজ তিনবছর। সবাইরে কম বেশী চিনি। আপনারে কখনও এদিকে দেখিনাই। তাছাড়া মানুষ শহরের বাইরের থেকা আসলেই তো বাসইস্টানে আইসা নামে। তাই আন্দাজ করলাম আরকি ! ”
-” তোমার আন্দাজ ভাল। দশে নয়। আমি এলাকায় নতুন তবে একেবারে আনকোরা না। এখানে আগেও এসেছি। ”
-” তাইলে তো অনেক কিছুই জানেন।”
-” অনেক কিছু বলতে ? ”
-” এই যেমুন, কাঞ্চননগরের ন্যাতা সম্পর্কে। ”
-” কাঞ্চননগরের নেতা মানে ? এরকম কেউ আছে নাকি আবার ? ”
– ” আরে সার কী যে কন। ছ্যামড়া দুইন্যার বদ। সারাদিন মাস্তানী করে আর মানুষের লগে ঝামেলা করে। আইজকা হেই তো ঐ মাইয়াডারে কিপনাপ করসে। এই নিয়া বিরাট তোলপাড়। একটু আগে পুলিশ আসার পর ঠান্ডা হইসে।”
-” বলো কী ? এই মেইন রোডের উপর কিডন্যাপ ? ”
-” আরে সার। অহনকার দিনে মেইনরোড আর গল্লি লাগেনা। রাইত আর দিন এহন সব সমান।”
এ নিয়ে আর কথা বাড়ালাম না। চুপ করে গেলাম। আমার এখন এসব জাতীয় সমস্যা নিয়ে ভাবার সময় নেই। আমি আছি নিজের সমস্যা নিয়ে। রুমকির বাসায় না পৌঁছানো পর্যন্ত সে সমস্যার কিনারা মিলবে না।
দুর থেকেই রুমকিদের গলিটা চিনতে পারলাম। গলির মুখেই একটা পুলিশ জিপ দাঁড়িয়ে আছে। হয়ত ঐ কিডন্যাপিং এর ঝামেলার কারণেই পুলিশ এসেছে। কিন্তু চব্বিশ ঘন্টার আগে তো কাউকে মিসিং পারসন গন্য করবে না পুলিশ। এখানে দেখি আগেভাগেই এসে বসে আছে। কেস কী কে জানে। ধুর, আমার বাপের কী।
রিক্সা থেকে নেমে মানিপার্স বের করে ভাড়া মিটালাম। লোকটা সন্তুষ্টির হাসি হাসল। সালামও দিল একটা। মাথা ঝাঁকিয়ে মানিপার্স পকেটে পুরে রুমকিদের গেটের দিকে এগিয়ে যেতেই দেখলাম একটা লম্বা সুদর্শন তরুণ বেরিয়ে আসছে বাড়ীটার ভেতর থেকে। তার পাশেই ক্রন্দনরত যে লোকটি রীতিমত মুষড়ে পড়েছে। তাকে না চেনার কোন কারণ নেই। সুদর্শন যুবক এক হাতে আগলে রেখেছে বৃদ্ধটিকে যিনি আর কেউ নন। আমার শ্বশুড় সাহেব। আমি স্থির দাঁড়িয়ে পড়লাম নিজের জায়গায়।
চলবে….