#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
লেখিকাঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৬
হিয়ার বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে তিতির চোখের জল ছেড়ে দিল। চেহারা পেয়েছে বাবার মতো। ভাগ্যটা বাবার মতো না হলেই হয়! তিতির নাজমা বেগমকে বলেন,
“কোর্টে মা*ম*লা করেই আমি মেডিকেল কলেজ মাইগ্রেশন করব। এই শহর আমাদের জন্য না। জানি কষ্ট হবে। ছোটো থেকে এখানে কিন্তু বাঁচতে হলে ছাড়তে হবে।”
নাজমা বেগমও আঁচলে চোখ মুছে বলেন,
“হ্যাঁ রে মা। আজকের ঘটনার পর আমার আর সাহস হয় না। কে দিবে সিকিউরিটি? সবাই দেখেও না দেখার মতো করে থাকে। হিয়াটা সুস্থ হোক। সব বিক্রি করে চলে যামু।”
তিতিরের মনে পড়ল বাড়ি রেখে কিভাবে যাবে? তাই মাকে সুধায়,
“আমাদের তো নিজেদের বাড়ি। বাড়ি রেখে কিভাবে যাব?”
“বিক্রি করে। ওইদিন যে এক ছেলে এসেছিল, সে বলেছে যদি বিক্রি করতে চায় তাহলে তাকে ফোন করলে সাহায্য করবে।”
তিতির ভ্রুঁদ্বয় কুঁচকে গেলো। সন্দিহান কণ্ঠে বলে,
“কোন ছেলে?”
“ওইযে বৃষ্টির দিনের ছেলেটা। মাশরিফ না কি যেনো নাম।”
তিতিরের মনে সন্দেহের দানা বাঁধে। চিরকুটের সাথে কি কোনো ভাবে মাশরিফ ছেলেটার যোগাযোগ আছে? মাকে জিজ্ঞেসা করে,
“সে তোমাকে হঠাৎ বাড়ি বিক্রির কথা বলল কেনো? কে সে?”
নাজমা বেগম বলেন,
“আমি তাকে সুজন, পলাশদের সম্পর্কে বলেছি। তুই কিসে পড়িস জিজ্ঞেসা করাতে তাও সব বলেছি।”
“তুমি পারোও মা! চেনা নাই জানা নাই এক অচেনা লোককে সব বলে বসে আছ। এখন সে যদি আমাদের ক্ষ*তি করতে চায়?”
নাজমা বেগম তিতিরকে বোঝাতে বলেন,
“ছেলেটা খুব ভালো। কথা বলে খুব ভালো মনে হলো।”
“আচ্ছা বাদ দাও। চাচারে কি জানাবা?”
নাজমা বেগম বললেন,
“বলে দেখ। ওরা মাসে তিন হাজার টাকা করে পাঠায়। আমি কয়েকবার মানা করেছি কিন্তু ওদের এক কথা, ‘বড়ো ভাই আমাদের লেখাপড়ার খরচ তুলছে। পুরো সংসার একা সামলাইছে তার জন্য এটুকু তো কিছুই না।’ আমাদের তো নিতেও চাইছিল কিন্তু নিজের বাড়ি ছেড়ে ঢাকা যাওয়ার ইচ্ছা হয় নাই তাছাড়া ওদের বাড়িতেও জায়গা কম। ওর বড়ো ছেলে কলেজে ওঠেছে। খরচও বাড়ছে।”
“আচ্ছা আমি আগে কলেজে কথা বলি।”
তখন নার্স এসে তিতিরকে বলে বাচ্চা নিয়ে তার সাথে যেতে তাই সর বাচ্চাটাকে নিয়ে নার্সের সাথে গেলো। তিতির গেলে নাজমা বেগম মাশরিফের নাম্বারে কল লাগায়। প্রথম দুইবার রিং হয়ে বন্ধ হয়ে যায়। নাজমা বেগম হতাশ হয়ে বসে থাকেন।
_______
“স্যার মেজর রাহান আহমেদের কোনো খোঁজ তো পেলাম না। তার বাবাও কিছু দিন আগে মা**রা গিয়েছেন।”
আর্মি হেড অফিসার বলেন,
“মেজর রাহান আহমেদ নিঃখোঁজ হওয়ার পর এইতো ছয় মাস আগে রেডিও বার্তা এসেছিল, ওদের দুই সদস্যকে মুক্ত করতে তাহলে রাহানকে ছাড়বে। আমরা রাহানের সাথে সুস্থ ভাবে ভিডিওতে কথা বলতে চাওয়ার পর আর যোগাযোগ করেনি। তাই আমরাও আর ছাড়িনি। রাহান জীবিত না মৃত তা জানা নাই। তাছাড়া এত সময় পরেই বা কেনো খবর পাঠাল? ওদের লোকেশনও ট্র্যাক করা যায়নি।”
“তার বাবাকে তো এটা জানানো হয়েছিল।”
“হ্যাঁ। রাহানের বাবা জানতেন। আমাদের চট্টগ্রামে মিশন আছে। প্রস্তুত হও। রাহানের পর তুমিই আমার ভরসা যোগ্য মেজর।”
“ইয়েস স্যার।”
_________
সকালে হিয়া প্রায় সুস্থ। আর র*ক্ত লাগেনি। ডাক্তার বলেছেন, আজকের দিনটা হসপিটালে থাকতে। যদি কোনো সমস্যা হয় তবে দেখবেন। তিতিররাও রাজি হয়। হিয়া জ্ঞান ফেরার পর থেকে নিজের মেয়েকে কোলে নিয়ে কিছুক্ষণ পরপর কাঁদছে। তিতির এবার বিরক্ত হয়ে বলে,
“থাম না। বাচ্চাটাও তোর দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। ভাবছে হয়তো তার মা খুশি না।”
হিয়া জড়ানো কণ্ঠে বলল,
“ও জন্ম থেকেই এতিম রে। আমার মেয়েটার কপাল এমন না হলেও পারত।”
“যা ভাগ্যে ছিল হয়েছে। এখন সামনের দিকে ভাব। আমরা এখান থেকে চলে যাব। কোনো কালো ছাঁয়া আমাদের ছুঁতে পারবে না।”
তিতিরের মুখে আচমকা চলে যাওয়ার কথা শুনে হিয়া সুধায়,
“কই যাব আমরা?”
তিতির দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“কথা বলব আজ। ময়মনসিংহতে মাইগ্রেশন করব। কতোদিন আর পলাশ, সুজনদের ভয়ে থাকব! আবার কোনদিন ঘরে এসে হা*ম*লা করে কে জানে!”
হিয়া মলিন কণ্ঠে বলে,
“উনার শেষ স্মৃতি তো ওই বাড়িতে ওই ঘরটাতে। আমি উনার গায়ের ঘ্রাণ পাই।”
“আবেগে থাকলে মেয়েকে রক্ষা করা কঠিন হবে। আমিও তো পারতাম, সারাজীবন ওই বাড়িতে সবার কুকথা শোনে থেকে যেতে। কিন্তু জীবন কারও জন্য থেমে থাকে না। একজন পৃথিবীতে নেই বলে কি আমি নিজের জীবনও বিসর্জন দিব? নিজেকে তো বাঁচতে হবে। এখন বলতে পারিস, আমার ও রাহানের তেমন সম্পর্ক ছিল না বলে পিছুটান নেই। ভাগ্যিস নেই। নয়তো আবেগের বশবর্তী হয়ে আমি সেই দুই বছর আগেই থেমে যেতাম। আমার লক্ষ্য এখন নিজের স্বপ্ন পূরণ করে তোদের নিয়ে ভালো ভাবে বাঁচা। শ্বশুরবাবার প্রতি আমি আজীবন কৃতঙ্গ থাকব।”
তিতিরের বোঝানোতেও হিয়া মলিন দৃষ্টিতে কোলের ঘুমন্ত বাচ্চাটার দিকে চেয়ে আছে। হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে তিতির আবার বলে,
“সবকিছু কনস্ট্যান্ট না। রিপ্লেসেবল সবকিছুরই রিপ্লেসমেন্ট সম্ভব।”
নাজমা বেগম ক্যান্টিন থেকে নাস্তা করে এসে বলেন,
“এবার তুই যা তিতির। হিয়ার পাশে আমি বসতেছি। তোর ক্লাস নেই আজকে?”
“আছে। সকালেরটা মিস গেছে। মৃদুলা ও ইতির থেকে নোট নিয়ে নিব। এখন নাস্তা করে আরেকটা ক্লাসে যাব। তুমি কিন্তু বাড়িতে যাবে না। আমি দুপুরের ব্রেকে হাসিব ও ইতিকে নিয়ে বাড়িতে গিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে আসব।”
তিতিরের কথায় নাজমা বেগম সম্মতি প্রদান করেন। তিতির ক্লাসে চলে যায়।
________
লাঞ্চ ব্রেকে হাসিব ও ইতিকে নিয়ে বাড়িতে যায়। রাস্তায় তিতিরের এক স্কুল বান্ধুবী ইরার সাথে দেখা হলে সে জিজ্ঞেসা করে,
“কেমন আছিস রে তিতির? শুনলাম কালকে সুজন, পলাশরা নাকি তোদের বাসায় আ*ক্রমণ করেছিল? হিয়ার কি অবস্থা এখন?”
তিতির হাসি মুখে বলে,
“আলহামদুলিল্লাহ মেয়ে হয়েছে। তুই কবে আসলি? চাচি কেমন আছেন?”
ইরা খুশি হয়ে বলে,
“আলহামদুলিল্লাহ্। আমিও ভালো আছি। বাবা সেই কতো দূরে বাড়ি করলেন তারপর আমি চান্সও পেলাম রাজশাহীতে। দেখাই হয় না। কালকে বাসায় এসেছি। রাতে মায়ের মুখ থেকে শোনলাম। বাবা নাকি বড়ো বাজার থেকে খবর পেয়েছেন।”
তিতির দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“দোয়া করিস রে। কতোদিন আছিস? হিয়াকে নিয়ে ফিরলে বাসায় আসিস। এখন তাড়াহুড়োতে আছি।”
“হ্যাঁ যা। আমি কয়েকদিন আছি এখানে। ভাতিজি দেখতে মাকে নিয়ে আয়োজন করে আসব।”
ইরাকে বিদায় দিয়ে তিতির হাসিব ও ইতিকে নিয়ে বাড়ির রাস্তায় যায়। বাড়িতে গিয়ে নিজের, মায়ের ও হিয়ার এক সেট কাপড়-চোপড় নেয় সাথে বাবুর জন্য বানিয়ে রাখা কাঁথাও জামা নেয়।
হসপিটালে ফিরার পথে কিছু ফল কিনে সেসব মায়ের হাতে বুঝিয়ে দিয়ে ক্লাসে যায়। টানা দুটো ক্লাস হবে। তারপর টিউশন করাতে যাবে। মায়ের মুখে শুনেছে কালকে দুপুরে নাকি চাচারাও বাড়িতে আসবেন। আবার এডমিশন অফিসেও কথা বলতে হবে।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।