#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২৭
দুইদিন পর বিকেলে মেডিকেল কলেজ থেকে বাসায় এসে দেখল দরজা খোলা! বিদ্যুৎ নেই বলেই হয়তো সদর দরজাটা খোলা! দরজার বরাবর সোফায় এক অচেনা মধ্যবয়সী মহিলাকে বসে থাকতে দেখে কপাল কুঁচকাল তিতির। আচার-ব্যাবহারে তার মায়ের সাথে বেশ সখ্যতাপূর্ণ সম্পর্কই পরিলক্ষিত হচ্ছে তার কাছে। ব্যাপারটা তিতিরের বোধগম্য হচ্ছে না। দুইদিন যাবত পড়ার চাপে মা ও হিয়া কারও সাথেই ঠিকঠাক কথা হয়ে উঠছে না। তিতিরের নজর যায় তার দিকে পোছোন করা সিঙ্গেল সোফাটাতে একজন পুরুষ বসে আছে। পুরুষটির মুখাবয়ব দৃশ্যমান না।
তিতির দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই দেখল হিয়া একটা ট্রেতে করে কিছু আনছে। তিতিরের ধারণামতে দই-মিষ্টি। হিয়া উনাদের উদ্দেশ্য করে বলে,
“একটু পরেই বিদ্যুৎ চলে আসবে। বাড়িওয়ালা বলেছে সন্ধ্যার দিকে লোডশেডিং হলেও বেশি সময় হয় না।”
মধ্যবয়সী মহিলাটি বললেন,
“সমস্যা নাই। তুমি বসো। তোমার মেয়েটা কিন্তু খুব শান্ত। কী সুন্দর চুপচাপ কোলে বসে আছে।”
“মানুষ দেখলে ভদ্র হয়ে যায়। এই আরকি! আমাকেই বুঝায় সে কেমন!”
হিয়ার দুঃখ ভরা কণ্ঠস্বরে সবাই হেসে ওঠল। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তিতিরও হেসে ফেলে। হিয়া তিতিরের হাসির শব্দ শুনে দরজার দিকে তাকিয়ে বলে,
“আরে তিতির, তুই এসে পড়েছিস? ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আয় ঘরে আয়।”
তিতির দৃঢ় পায়ে সোফার কাছে এগিয়ে গেলো। সামনাসামনি মধ্যবয়সী মহিলার মুখশ্রী এবার পুরোপুরি দৃশ্যমান হয়। কিছুটা চেনাচেনা লাগলে খানিক মাথা খাটিয়ে ধরতে পারলো ইনি ছবির মহিলাটি। তিতির মৃদু হেসে সালাম দিল। সালাম বিনিময়ের পরক্ষণেই তিতির পাশ ফিরে সিঙ্গেল সোফায় দেখে তার চক্ষু চড়কগাছ! মাশরিফ! তিতির হকচকিয়ে ওঠে। তিতিরের অভিব্যক্তি দেখে মাশরিফ সৌজন্য হেসে আবার সামনের দিকে নজর ঘুরিয়ে নেয়। তার সৌজন্য হাসিতেও গম্ভীর্যতা পরিলক্ষিত!
নাজমা বেগম হাস্যজ্জল মুখে মহিমা বেগমকে দেখিয়ে বললেন,
“দেখ তিতির, ইনি হচ্ছে তোর মহিমা খালামনি। আর মহিমা আপার ছেলেই মাশরিফ! আমি তো চিনতেই পারিনি। অবশ্য চিনব কী করে? কখনো দেখিনি তো।”
মাশরিফের পরিচয় শুনে তিতিরের মা*থা যেনো ঘুরে উঠল! সে খানিক ভারসাম্য হারিয়েও নিজেকে সামলে নিয়েছে! বিড়বিড় করে বলল,
“এই ধা*ন্ধাবাজ লোক আমার খালাতো ভাই! কী সাংঘা*তিক লোক! এক লহমায় পিছনে পরা লোক থেকে কাজিন হয়ে গেল!”
নাজমা বেগম তিতিরকে অন্যমনস্ক দেখে বাহুতে হাত দিয়ে ডেকে বলে,
“কীরে? কই হারালি? কী বিড়বিড় করছিস?”
তিতির হাসার চেষ্টা করে বলে,
“না কিছু না। এমনিতে ভাবছিলাম।”
“কী ভাবছিস আবার?”
“এই কী, কেমন কাকতালীয় সব! অচেনা থেকে এখন আত্মীয় হয়ে গেল! কতো বছর পর হারানো বোনকে এভাবে ফিরে পেলে।”
তিতিরের কথায় নাজমা বেগম ও মহিমা বেগম হাসেন। মহিমা বেগম বলেন,
“আমি তো কল্পনাও করিনি কখোনো নাজমাকে দেখতে পাব! রেহমানের হাত ধরে বাড়ি ছাড়ার পর থেকে কারও সাথে যোগাযোগ নেই। অবশ্য যোগাযোগের মুখ তো আমি রাখিনি! তবে আমার দুই সন্তানকে আমার বাবা বাড়ির সবার ছবি দেখিয়ে চিনিয়েছিলাম। সেখান থেকেই মাশরিফ নাজমাকে দেখেছে। ও যখন তোমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিতে এসে চেনা চেনা লাগলে গ্রাম, ঠিকানা জিজ্ঞেসা করে চিনতে পারে। আমাকে তো গতকাল রাতে বলেছে সব। নাজমা যখন মাশরিফকে ফোন করেছে, তখন। আজ সকালেই টাঙাইল থেকে মির্জাপুর এসেছি। তারপর ক্লাস নিয়ে দুপুরে এখানে রওনা করেছি।
নাজমা বেগম বলেন,
“কীভাবে কীভাবে যে মিলে গেল। আলহামদুলিল্লাহ সবকিছুর জন্য। এই তিতির, দাঁড়িয়ে না থেকে যা এবার হাত-মুখ ধুঁয়ে আয়।”
তিতির হাসি বিনিময় করে চলে যায়। ভেতরের ঘরে গিয়ে ব্যাগটা রেখে হিজাব খুলতে খুলতে বিছানায় বসল। তারপর নিজে নিজেই বলতে থাকে,
“এজন্যই সে ‘খুব জলদি দেখা হবে’ বলেছিল। সে তো সব জানতোই। আমিই বো*কা। যাই করুক। কাজিন বলে বেশি বাড় বাড়লে অবস্থা খারাপ করে দিব। উনার জন্য সিনিয়ররাও আমার সাথে মুখ কালো করে রাখে! ”
কথা গুলো বলার মাঝেই হিয়া হায়াতকে কোলে নিয়ে ঘরে ঢুকল। তিতিরের শেষোক্ত কথা শুনে শুধাল,
“কার জন্য তোর সিনিয়ররা তোর সাথে মুখ কালো করে রাখে?”
তিতির হতচকিত হয়ে হুঁশে ফিরে। তারপর আমতা আমতা করে বলে,
“কারও জন্য না!”
“তুই মাত্রই তো বললি!”
“হায়াতের কান্নায় তুই এখন কানে বেশি শুনিস!”
তিতিরের বিরক্তিকর কণ্ঠের জবাবে হিয়া প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না। লম্বা শ্বাস ফেলে হায়াতকে ফিডিং করাচ্ছে। এদিকে তিতির অন্যমনা হয়ে ছটফট করছে। হিয়া বিষয়টা লক্ষ্য করে পরোক্ষভাবে জিজ্ঞেসা করে,
“কেউ হয়তো ভুলে যাচ্ছে আমি তার বেস্ট ফ্রেন্ড!”
তিতির কথাটা শুনল। বান্ধবী প্লাস ভাবীর বুলিতে যেনো অভিমান ঝড়ে পরছে। মুচকি হেসে বলল,
“তুইও তো আমাকে কাল রাতে বলিস নাই যে মা উনাদের ফোন করেছে। তবে আমি কোনো বলব?”
হিয়া এবার অক্ষিগোলক ছোটো ছোটো করে বলল,
“তুইও তো আমায় কিছু বলিস না। তাছাড়া ইদানীং যা ব্যাস্ত তুই!”
তিতির হেসে ফেলে। হিয়ার কাঁধ জড়িয়ে আহ্লাদীপনা করে বলে,
“কী করব বল? মেডিকেলের প্রেশার তো জানিসই। আর টিউশনিও খুঁজতেছি।”
হিয়া তিতিরের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আবদারের সুরে বলল,
“বল না। কী হয়েছে?”
হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে তিতির বলতে শুরু করে,
“ওই যে একজন অচেনা লোক আমাকে কয়েকটা চিঠি দিয়েছিল না?”
“হ্যাঁ”
“তিনিই মাশরিফ ইকবাল মানে মায়ের বোনের ছেলে। সে আমাকে ভালোবাসে। আর বাবা মানে রাহানের বাবাও উনাকে শেষ চিঠিতে আমার সাথে থাকার কথা ও আমাকে নিয়ে নতুন জীবন শুরু করা এসব বলেছে। তাছাড়া মাশরিফ ইকবাল আমার মেডিকেলের সিনিয়রদের ফ্রেন্ড। তার লাস্ট আরেকটা চিঠিটা কিছুদিন আগে পেয়ে আমি কয়েকটা ইকুয়েশন মিলিয়ে বুঝতে পেরেছি চিঠির মালিকই উনি। তারপর সেদিন সে পূর্ণাঙ্গ স্বীকারোক্তিও দিয়েছে।”
“এইজন্য তুই ফোন করতে চাসনি?”
তিতির এবার বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় জানালার কাছে গিয়ে উদাস মনে বাহিরে বিকেলের ডুবুডুবু অরুণের র*ক্তিম আভা দেখতে দেখতে বলে,
“কী করব আমি? আমার হতাশ লাগে। জীবনে কম কিছু তো দেখিনি।”
হিয়া তার ঘুমন্ত মেয়েকে এবার শুইয়ে দিয়ে তিতিরের কাছে আসে। আলতো ভাবে তিতিরের কাঁধে হাত রেখে বলে,
“তোকে অতীত ভুলতে হবে। তোর ভাগ্যে রাহান ভাইয়া ছিল না বলেই শুরুতেই বিচ্ছেদ হয়েছে। আমি বলব না যে তোকে এখনি নতুন জীবন শুরু করতে। সময় নে। মাশরিফ ভাইয়া যদি তোর পাশে থাকতে চায় তবে ক্ষতি কী?”
“লাভ-ক্ষতির হিসেব করতে ভালো লাগে না। তাছাড়া কাউকে মিথ্যে আশ্বাস দিতে ও নিতে আমার ভালো লাগে না। তোর কি মনে হয়? একজন বিধবাকে পুত্রবধূ কে করতে চায়? সমাজের চোখের আমি অশুভ! বিয়ের দুইদিনের মাথায় স্বামীকে খে*য়ে ফেলেছি! এমন মেয়েকে কোন মা তার পুত্রবধূ করতে চায়? মাশরিফ ইকবাল আবেগের বশবর্তী হয়ে এমন করছে। যখন সমাজের রূঢ়তা বুঝবে তখন ঠিক নিজের ভুলটা বুঝতে পারবে। তাই এসবে পাত্তা না দেওয়াই ভালো।”
তিতিরের কথাতে হিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মেয়েটা মিথ্যাও বলেনি। সমাজের রূঢ় বাস্তব তার বুলিতে। কিন্তু হাতের পাঁচ আঙুল যেমন সমান না তেমনি সবাই এক না। হিয়া প্রত্যুত্তরে বলে,
“মহিমা আন্টি মেনেও নিতে পারেন। তাই না? তাছাড়া তিনি এখন আমাদের আত্মীয় হয়।”
“আত্মীয় বলেই আরও ভয়। জোড়া লাগা সম্পর্ক আমার কারণে ভাঙার ভয়। প্লিজ এসব বাদ দে। সময় বলে দিবে সব। কোথাকার জল কোথায় গড়ায় তা আগে থেকে কে জানে!”
এটা বলেই তিতির হায়াতের পাশে বসে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখল। সারাদিনর ক্লান্তিতে ঘুমও আসছে বেশ। আজান পড়বে একটু পর।
_______
মাগরিবের নামাজের পর মহিমা বেগম ও মাশরিফ বিদায় নিয়ে মির্জাপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। বিদায় বেলায় নাজমা বেগম ও মহিমা বেগমের মাঝে আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। মাশরিফ ড্রাইভ করতে করতে মাকে একবার দেখল। মহিমা বেগম কেমন উদাস দৃষ্টিতে বাহিরে দেখছে। মাশরিফ জিজ্ঞেসা করে,
“কী হয়েছে মা? তোমার কী আরও থাকতে ইচ্ছে হচ্ছিল? কিন্তু কাল তোমার ক্লাস আছে তাই চলে আসলাম। তাছাড়া আমি আগামীকালই আর্মি কোয়াটারে চলে যাব। কতোদিন ছুটি কাটালাম।”
মহিমা বেগম মাশরিফের কথার কোনো প্রত্যুত্তর করলেন না। তিনি এখনও অন্যমনা হয়ে আছেন। মায়ের থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে এবার মায়ের বাহুতে হাত দিয়ে আলতো ডেকে বলে,
“মা, কোথায় হারালে?”
মহিমা বেগম ঘন নিঃশ্বাস ফেলে বলেন,
“আমার দোষেই এসব হয়েছে। শুরুটা তো আমাকে দিয়েই। অবশ্য যার নিয়তিতে যা আছে তা হবেই। তাও কেনো জানি মনে হচ্ছে, আমি ভালো থাকার জন্য বাড়ি ছেড়েছিলাম বলেই আজ আমার বোনের জীবনের এই দশা! আমাদের বংশ মর্যাদা অনুযায়ী নাজমার বিয়ে আরও বড়ো ঘরে হতে পারতো। কিন্তু বাড়ির এক মেয়ে পালিয়ে গেলে সেই সময়ে ও এখনও সমাজে সেই পরিবারের বংশ মর্যাদাটা আর অক্ষুণ্ণ থাকে না। আমার বোনটার জীবনে যা ঘটলো, স্বামী-ছেলে ও মেয়ের জামাই, কেউই জীবিত নেই। জন্ম-মৃত্যু এসব নিয়তি কিন্তু তাও আমার খারাপ লাগছে।”
মাশরিফ মায়ের হাত ধরে। অতঃপর আশ্বাস দিয়ে বলে,
“বিগড়ানো সবটা না পারলেও কিঞ্চিত তো আমি ঠিক করতে পারি। আমি করব ইনশাআল্লাহ। তুমি শুধু আমার পাশে থাকবে তাহলেই হলো।”
“কী করবি?”
মায়ের প্রশ্নাত্মক বুলিতে নজর লুকালো মাশরিফ। কিন্তু মহিমা বেগমের দৃষ্টি অনড়! তার অবিচল দৃষ্টিতে মাশরিফ ফাঁকা ঢোক গিলে বলল,
“তোমায় কিছু বলার আছে।”
“হ্যাঁ বল।”
“আসলে আমি…”
“কী?”
মহিমা বেগমের কন্ঠে আগ্রহের আভাস। মাশরিফ কিছুটা সময় নিয়ে গাড়ি জায়গায় থামালো। সেখানে আগে থেকে দুয়েকটা বাস ও ট্রাক থামিয়ে রাখা আছে। হঠাৎ গাড়ি থামানোতে মহিমা বেগম ভ্রুঁকুটি করে প্রশ্ন করেন,
“গাড়ি থামালি কেনো?”
মাশরিফ লম্বা শ্বাস নিয়ে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে মায়ের হাত ধরে বলে,
“তোমাকে বলেছিলাম মনে আছে? আমি একটা মেয়েকে ভালোবাসি!”
“হ্যাঁ আছে। কেনো কী হয়েছে এখন?”
মাশরিফ এবার মায়ের চোখের দিকে তাকায়। মায়ের দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা তাকে নজর ফেরাতে বাধ্য করল। মাশরিফ দৃষ্টি নামিয়ে বলল,
“সেই মেয়েটা তিতির! তুমি কিছু বলার আগেই আমি বলে রাখি, আমি সব জেনেশুনেই ওকে ভালোবেসেছি। ও যতো সময় নিক তাতে আমার কোনো প্রবলেম নাই। আমি ওর জন্য অপেক্ষা করতে প্রস্তুত।”
এক শ্বাসে পুরোটা বলে তবেই থামল সে। মহিমা বেগম স্তম্ভিত দৃষ্টিতে ছেলের দিকে চেয়ে আছেন। তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না এসব! তিনি বললেন,
…..
চলবে ইনশাআল্লাহ,