#এক_সমুদ্র_প্রেম!
লেখনীতে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(৪০)
টিকটিক করতে করতে ঘড়ির কাঁটা বারোটায় থেমেছে। সিকদার পরিবারে খানিকক্ষণ আগেই বয়ে গিয়েছে এক বিরাট, সুপ্ত ভয়া*নক কালবৈশাখি। ঝড়ের তা*ন্ডব একটুর জন্য রেহাই দিলো পুষ্প আর ইকবালকে। তাদের সাবলীল,সুন্দর জীবন অল্পের জন্য মুক্তি পেলো এলো মেলো হওয়ার হাত থেকে। সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমত অবশেষে বর্তেছে।
আমজাদ সিকদার হার মেনেছেন। মেনে নিয়েছেন ওদের ভালোবাসাকে। অবশ্য,মেনে নিতে বাধ্য হলেন এক প্রকার। মেয়ের অশ্রুসিক্ত চোখ-মুখ হৃদয়ে অগাধে দাগ কে*টেছে। আনাচে-কানাচে মানবিকতা আর পিতৃত্ব ছুটেছে। মিনা বেগমর ‘ মেয়ের সুখই আমাদের সুখ’ কথাটা তীক্ষ্ণ ভাবে আঘা*ত করেছে বিবেকের দ্বারে।
মন আর মর্জির বিরুদ্ধে গিয়ে বড় ক*ষ্টে,নারাজ ভঙিতে হ্যাঁ বলেছেন তিনি। অথচ ইকবাল,তার অপছন্দের তালিকায় সারাজীবন থাকবে। সেখান থেকে এই ছেলের নাম মোছার সাধ্য নেই কারো। তবুও চাইছেন,ছেলেটা সুখে রাখুক তার মেয়েকে।
আমজাদ সোফায় থম ধরে বসে আছেন। বাকীরা সবাই ঘিরে দাঁড়িয়ে ওনাকে। চেহারার জলদগম্ভীর দশা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিচ্ছে,লোকটা এখনও মন থেকে মেনে নিতে অক্ষম। টু শব্দ করছে না কেউ। ইকবাল আমোলেই নিচ্ছে না এসব। তার আনন্দ নিরন্তর। শত কাঠখড় পু*ড়িয়ে হলেও পুষ্পকে পাবে এই ঢেড়। বাকী সব গোল্লায় যাক। হিটলার শ্বশুর খুশিমনে মেয়ে দিক,বা জোর করে,দিলেই হবে।
মিনা বেগম রয়ে সয়ে স্বামীর মুখের সামনে শরবতের গ্লাস বাড়িয়ে ধরলেন। তিনি এক পল স্ত্রীর দিক চেয়ে হাতে নিলেন সেটা। আস্তেধীরে চুমুক দিলেন। চোখের কোনা দিয়ে একবার তাকালেন হাতের বাম দিকে।
ইকবাল বিজয়ী হেসে বারংবার ধূসরকে জড়িয়ে ধরছে। যতবার গায়ে গা মিলছে ওদের, পিত্তি সহ জ্ব*লে যাচ্ছে ওনার। এত ঢংয়ের কী আছে? এই আদিখ্যেতা কীসের? মেয়েটাকে দিতে রাজী হয়েছে বলে তার ভাইপোর গলা সাপের মত জাপ্টে ধরবে? আশ্চর্য ছেলে তো!
এই বিরক্তিকর ছেলের ভেতর কী দেখল তার মেয়ে?
তিনি পুষ্পর দিকে ফিরলেন এবার। মেয়েটার, রিক্ত, সিক্ত চেহারা এখন নক্ষত্রের ন্যায় জ্ব*লছে। ঠোঁটে হাসির অভাব নেই। মুখমন্ডলে পরিষ্কার, সে কতটা খুশি! আমজাদের রা*গটুকু পরে গেল। যাক! মেয়ের আনন্দেই সে আনন্দিত। মেয়েটা ভালো থাকলে আর কী চাই?
রুবায়দা বললেন, ‘ আপা সবাইকে খেতে দেই?’
‘ হ্যাঁ হ্যাঁ। চল ব্যবস্থা করি।’
যেতে যেতে ধূসরকে বললেন, ‘ ইকবালকে নিয়ে বোস ধূসর। খাবার আনছি।’
ইকবাল আপত্তি জানিয়ে বলল,’ আন্টি আমাকে বেরোতে হবে। আজ খেতে পারব না।’
‘ ওমা কেন বাবা? খাবেনা কেন?’
আমজাদ সিকদার বিড়বিড় করে বললেন,
‘ দিনরাত এ বাড়ির ছেলে-মেয়ের মাথা খেলে পেটে জায়গা থাকে না কী?’
সে কথা কর্নকুহর হলো না কারো। ইকবাল হেসে বলল,
‘ আসলে অনেক রাত হয়েছে তো,আম্মু কল দিচ্ছেন বারবার। রাতে ঘরে গিয়ে না খেলে দেখব ঠিকই বসে আছে আমার জন্য।’
রুবায়দা বললেন, ‘ অল্প কিছু…. ‘
‘ না আন্টি,অন্য দিন। এরপর তো আসা যাওয়া থাকবেই।’
আমজাদ কপালে ভাঁজ ফেলে তাকালেন। ভাবলেন,
‘ কী বেহায়া ছেলে! ‘
ধূসর বলল,’ একা যেতে পারবি?’
‘ আরে হ্যাঁ। তুই বিশ্রাম কর। আমি আসি এখন।’
ইকবাল আড়চোখে পুষ্পর দিকে একবার তাকাল। এতেই ভীষণ লজ্জা পেল মেয়েটা। চিবুক গিয়ে ঠেকল গলদেশে।
ইকবাল আমতা-আমতা করে আমজাদকে শুধাল,
‘ কাল তাহলে আব্বু -আম্মুকে পাঠাচ্ছি আঙ্কেল?’
তিনি আরেকদিকে মুখ ঘুরিয়ে উত্তর দিলেন,’পাঠিও।’
ইকবাল কপাল কোঁচকায়। মনে মনে বলে,
‘ এই হিটলার ব্যাটা আস্ত একটা বদ, ভা*ঙবে তবু মচকাবে না।
পরমুহূর্ত ভাবল,
‘তাতে আমার কী,শ্বশুর হোক যেমন তেমন,বউ আমার মনের মতন।’
ইকবাল হাসল। কী একটা ভেবে চিন্তিত ভঙিতে ধূসরের দিক তাকিয়ে বলল,
‘ কাল বাবা -মা আসবে কী করে ধূসর? তুইত সকালে সিলেট যাবি বললি!’
এ পর্যায়ে সবার নজর তার দিকে পড়ল। ধূসর বলল, ‘ আমি না থাকলেও বা,সবাইতো থাকবে।’
‘ তুই থাকা আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ‘
ধূসর ফিচেল হাসে, ‘ তাই?’
ইকবালের সুদৃঢ় জবাব ‘ অবশ্যই।
তারপর আমজাদের দিক চেয়ে বলল,
‘ আঙ্কেল, ওনাদের পরের শুক্রবার আনি? ধূসর ফিরুক?’
আমজাদ কিছু বলার আগেই ধূসর বলল,
‘ থাক,দরকার নেই। আমি সিলেট যাচ্ছি না।’
ইকবাল অবাক হয়ে বলল ‘ তবে যে বললি?’
‘ মিথ্যে বলেছিলাম।’
আফতাব নড়েচড়ে শুধালেন ‘ কেন?’
ধূসরের ভণিতাহীন জবাব,
‘ ইকবালের মুখ থেকে কথা বের করতে।’
আমজাদ সিকদার দ্বিতীয় বার বিরক্ত হলেন। আরেকদিকে ফিরে থাকলেন। প্রত্যেকে অবাক হলেও, ইকবাল বিস্ময়ে স্তব্ধ। বাকরুদ্ধ হয়ে কথা বলতে পারল না। ধূসর ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ হা করে না থেকে বের হ।’
সম্বিৎ ফিরল তার। বন্ধুর প্রতি মনে প্রাণে কৃতজ্ঞতায় লুটোপুটি খেল। ঠোঁট কামড়ে হেসে তাকিয়ে রইল কিছু ক্ষন। বলল,
‘ আসছি,কাল দেখা হবে।’
ধূসর বিনিময়ে ঈষৎ বেগে হাসে। চেয়ে চেয়ে দ্যাখে প্রিয় বন্ধুর প্রস্থান।
ইকবাল ঢুকেছিল যতটা উদ্বীগ্ন,অশান্ত মনে, বেরিয়েছে ততটাই ফুরফুরে মেজাজে। সে লাফিয়ে লাফিয়ে সিড়ি বেয়ে নামে। পুষ্পর ফোনে মেসেজ পাঠায়,
‘ আর কিছু দিন মাই লাভ,তারপর ইকবালের লোমশ বুকে তোমার জন্য পার্মানেন্ট একটা ঘর বানাব। ‘
পুষ্প উশখুশ করতে করতে সবাইকে একবার করে দেখল। সন্তর্পনে, খুব আস্তে, পা টিপে টিপে সিড়ি বেয়ে উঠল। কক্ষের সামনে এসেই, এক ছুটে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়াল। উঁকি দিলো সোজা মেইন গেটের ওপর। ইকবাল হেলেদুলে যাচ্ছে। পেছনের চুল দুলছে বায়ুতে। পুষ্প তৃষ্ণার্ত চোখ মেলে চেয়ে রয়। ইকবাল গাড়ির দরজা খুলতে গিয়ে কী মনে করে থামল। ঘুরে,একদম সোজাসুজি দোতলার বারান্দার দিকে তাকাল। ঠিক যা ভেবেছিল তাই,পুষ্প দাঁড়িয়ে আছে দেখে হেসে ফেলল সে। অতদূর থেকেই ভ্রু উঁচাল। পুষ্প মুচকি হেসে হাত নেড়ে বিদায় জানায়। ইকবাল হাত উঁচাল না। উলটে ফ্লাইং কিস ছু*ড়ে মা*রল তার দিকে। পুষ্প নড়ে উঠল। কুন্ঠায়,গাল দুটো লাল হয়ে আসে। হেসে মাথা নামিয়ে নেয়। ইকবাল মুক্ত,প্রশান্ত শ্বাস নিয়ে,উঠে বসল গাড়ির ভেতর।
‘ বাবাহ, কত প্রেম!’
হঠাৎ কথায় পুষ্প চমকে তাকায়। পিউ মিটিমিটি হেসে বলে,
‘ এক কাজ কর,তুইও ভাইয়ার সঙ্গে চলে যা। ‘
পুষ্প ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ বড় বোনের প্রেম করা দেখছিস? লজ্জা লাগছেনা?’
পিউ দুদিকে মাথা নাড়ল,
‘ একটুও না। প্রেম করতে পারলে দেখতে পারব না?’
পুষ্প হাসল। তারপর নিশ্চিন্ত কণ্ঠে বলল,
‘ সব যে ভালোয় ভালোয় মিটছে এই অনেক তাইনা? আমিইত ভাবিইনি আব্বু রাজী হবেন।’
‘ আমিও না। ‘
পুষ্প স্নেহার্দ্র চোখে বোনের দিক চাইল।
‘ তুই খুব ক*ষ্ট পেয়েছিস? আব্বু মে*রেছেন যে!
পিউ লম্বা হাসল। মাছি তাড়ানোর মত হাত নেড়ে বলল,
‘ আরে ধুর! ক*ষ্ট পাব কেন? আব্বুইত মে*রেছে। ব্য*থা যা পেয়েছিলাম,তোর বিয়েটা হচ্ছে বলে সব শেষ! ‘
পুষ্প আপ্লুত হয়। বোনের ভালোবাসার গভীরতা হৃদয় দিয়ে মেপে নেয়। বিলম্বহীন জড়িয়ে ধরে দুহাতে। পিউ পালটা আকড়ে ধরল।
পুষ্প ওমনভাবেই আবদার করল,
‘ আজ থেকে আমার সাথে ঘুমাবি? ‘
‘ আচ্ছা।’
**
পিউ, পুষ্পর ঘর থেকে বের হতেই সামনে পরল সাদিফ।
ওকে দেখতেই ছেলেটা দীর্ঘ হাসল। ঝকঝকে, তকতকে শুভ্র দাঁত উঁকি দিল ঠোঁটগহবরের মাঝ থেকে। পিউ দাঁড়িয়ে গেল। সাদিফের হাসি দেখে বুকটা মুচ*ড়ে উঠল তার। এতক্ষনের ভালো মনটা ঝুপ করে খারা*প হলো। মায়াময়,পূর্ন দুই অক্ষি দিয়ে চেয়ে রইল। বক্ষপিঞ্জরের চারপাশটা হুহু করে উঠল দুঃ*খে। আপু, ইকবাল ভাইকে ভালোবাসে ঠিকই,কিন্তু সাদিফ ভাইতো আপুকেই ভালোবাসতেন। আহারে! মনটাই ভে*ঙে গেল ওনার।
পিউয়ের মুখ কালো দেখে সাদিফ ভুরু নাঁচাল,
‘ কী রে?’
তার ঘোর কা*টে,
‘ হু? না কিছু না।’
‘ ওভাবে তাকিয়ে আছিস কেন তাহলে? ‘
পিউ চোখ নামিয়ে ফেলল।
ইনিয়ে-বিনিয়ে শুধাল,
‘ ইয়ে,আপনার খুব খা*রাপ লাগছে, তাইনা ভাইয়া?’
‘ কেন? বিয়েটা হচ্ছেনা বলে?’
পিউ মাথা ঝাঁকাল। সাদিফের পুষ্ট অধর কানায় কানায় ভরে গেল তখন। কিছু না বলে পাশ কে*টে যেতে নিয়ে থামল আবার। পরপর পিউয়ের মাথার গোছানো চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল,
‘ বোকা! ‘
পিউ নির্বোধ বনে চেয়ে রইল। এই মুহুর্তে তার মনে হচ্ছে, সাদিফ ভাই শোকে,দুঃ*খে পাগল হয়ে গিয়েছেন। কাঁ*ন্নার বদলে দাঁত মেলে হাসছেন কেন নাহলে? ওনার তো মন খারা*প হওয়ার কথা। কেঁদেকে*টে টিস্যু বক্স শেষ করার জায়গায় আনন্দে লাফাচ্ছেন। বোকা মেয়েটার হৃদয়পট আক্ষেপে শেষ । দু তিনবার আহারে! আহারে! বিড়বিড় করল ওর যাওয়ার দিক তাকিয়ে। অগোছালো কেশরাশি গোছাতে গোছাতে সামনে ফিরতেই চমকে উঠল। একদম সম্মুখে দাঁড়িয়ে ধূসর। পিউ যত্রতত্র নুইয়ে গেল। অশান্ত মন, স্থির,অবিচল হলো। লাজুক ভঙিতে পল্লব ঝাপটে চুল গুজল কানে। চোরা চোখে একবার তাকাতে গিয়ে নাগাল পেল ধূসরের শ*ক্ত চিবুকের। ওই ধা*রাল নেত্রদ্বয় অবধি পৌঁছাতে, তার দৃষ্টিযূগল বিফল হয়।
তখনি ধূসর এগিয়ে আসে। যত কদম দুরুত্ব ছিল তার থেকে অর্ধহস্ত দুরুত্ব ঘুঁচিয়ে দাঁড়াল। পিউয়ের বক্ষস্পন্দন আকাশ ছুঁলো ওমনি। অনুভূতিরা মেঘ ছিদ্র করে ফাঁক গলে পালাল তখন,ধূসরের ঠান্ডা, নিরেট হস্ত খানা গাল ছুঁয়েছে যখনই।
শিউরে উঠল মেয়েটার সমস্ত শীর্ণ দেহ।
পিউ নিভু চোখে তাকায়। ধূসরের হাত থেমে নেই,বৃদ্ধাঙ্গুলি স্লাইড হচ্ছে সমগ্র গাল জুড়ে।
পিউয়ের পল্লব বুজে আসতে চায়। চোখ খুলে রাখতে পারেনা। সুরসুর করছে শরীর। তার গাল বেঁকে পৌঁছায় কানের কাছে।
ধূসর এক ভাবে তাকিয়ে আছে,তার ফর্সা গালের দিকে। তার অক্ষিপটের মায়া, পরপর মুখ ফস্কে বেরিয়ে এলো,
‘ ব্য*থা পেয়েছিলি?’
পিউয়ের চটক কা*টল। তখনি খেয়াল হলো, এই গালেই চ*ড়টা পরেছিল।
ওনার কি মায়া হচ্ছে তার জন্য? ক*ষ্টও পাচ্ছেন? পাবেননা কেন? উনিও যে ভালোবাসেন। বসার ঘরে যতক্ষন দাঁড়িয়ে ছিল সে,কতবার যে তাকিয়েছে মানুষটা! আর বাবা থা*প্পড় দেয়ার সময়, কী রকম করে চমকে উঠেছিল। চোখ খিঁচে বুজেছিল,যেন ওনার গায়েই লেগেছে।
সেতো সব দেখেছে,খেয়াল করেছে।
পিউ মিহি কণ্ঠে বলল ‘ পেয়েছিলাম,এখন শেষ।’
ধূসর বলল,
‘ কেন বলতে গেছিলি ওসব? জানিস তো তোর বাবা ইকবালকে পছন্দ করেন না।’
তার নিষ্পাপ উত্তর,
‘ ভুল করে বলে ফেলেছি ধূসর ভাই।’
ধূসর অন্য হাত উঠে এলো পাশের গালে। অনমনীয় অঞ্জলিপুট ভর্তি হলো পিউয়ের ক্ষুদ্রাকার মুখবিবরে।
দুটো টানা টানা চোখের দিক চেয়ে বিনম্র আদেশ করল,
‘ আর কখনও এরকম পরিস্থিতিতে কথা বলবিনা পিউ। পৃথিবী উলটে গেলেও চুপ করে থাকবি। আমিতো আছি,সব সময় থাকব। সমস্ত প্রতিকূলতার মোকাবেলা করতেও প্রস্তুত আমি। কিন্তু চাইনা,তোর ওপর একটা নখের আঁ*চড় ও লাগুক।’
পিউয়ের অন্তঃস্থল অবধি স্পর্শ করল কথাগুলো। ভালোবাসার দুঃসাহসিকতায় হঠাৎই ভীষণ সাহসী হলো সে। তার কোমল হস্তযূগল ধরে ফেলল ধূসরের অমসৃন কব্জি। ক্ষুর-ক্ষার চাউনীতে চেয়েই শুধাল,
‘কেন ধূসর ভাই,আপনার পাশে দাঁড়িয়ে আপনার সঙ্গ দেয়ার একটুও অধিকার কি আমার নেই?’
ধূসরের অভিব্যক্তি তৎক্ষনাৎ মসৃন হয়। সদর্পে শিথিল হয় নিরেট, শ্যামরঙা চিবুক। পরতে পরতে বিছিয়ে যায় নিরুপদ্রব হাওয়া। অন্তঃপটে এক শীতল স্রোতের কলকল শব্দ স্পষ্ট কানে লাগে। সেই আওয়াজ নিস্তব্ধ তরঙ্গের ন্যায় ঢেউ তোলে হৃদয়ে। পিউয়ের পাপশূন্য, রিনঝিনে কণ্ঠস্বর জলতলে ডুবি*য়ে ছাড়ে গম্ভীরতার জাহাজ।
চমৎকার করে হেসে ফেলল সে। দুদিকে ছড়িয়ে গেল পুরুষালি, পাতলা ঠোঁট।
অন্যরকম গলায় বলল,
‘ অধিকার ও বুঝিস! ‘
পিউয়ের কাছে সব তুচ্ছ। তার গভীর দুটো চোখ ধূসরের হাসি দেখতে ব্যস্ত। বক্ষ কাঁ*পছে,তোলপাড় হচ্ছে খুব। এই হাসি দেখেছে যতবার, খু*ন হয়েছে ততবার। এখানে একটুও কার্পণ্য করেনা মানুষটা। লেশ মাত্র মায়া দেখায়না। বারংবার নি*ষ্ঠুর ভাবে মার*তে উঠেপড়ে লাগে।
পিউয়ের সম্মোহনী দৃষ্টির দিকে খেয়াল পরতেই
ধূসরের হাসিটা কমে এলো। আজোলে বন্দী মেয়েটার স্নিগ্ধ আঁদল থেকে আলগা হলো বাঁধন। তার লম্বা শরীরটা স্বল্প নেমে আসে। কণ্ঠ নামল খাঁদে। অধড় নড়েচড়ে বেরিয়ে এলো কিছু হৃদয়কাড়া শব্দ,
‘ পৃথিবীর সব ভালোটুকু শুধু তোর থাকুক পিউ। তোকে স্পর্শ করতে আসা সমস্ত খা*রাপ,সমস্ত অ*নিষ্ট, আমায় তাদের নিশানায় রাখুক। ‘
পিউ তুষারের ন্যায় জমে গেল। রোমাঞ্চিত অনুভূতির ডিঙি নৌকা বিরাট পাল খুলে, ছেড়ে, উড়িয়ে দিলো। সেই পাল যতবার দুলল বাতাসে,ততবার তার কানে বাজল ধূসরের নাম। কল্পনায় ভাসমান হলো কিছু উচ্চাকাঙ্খা,কিন্তু কাঙ্ক্ষিত, প্রত্যাশিত স্বপ্ন।
বেহায়া মনের ইচ্ছে জাগল ওই চওড়া বুকে মাথা রাখবে একবার। সেই সুযোগ কি আর আসবেনা? কবে হুশ হারিয়ে ধরেছিল, ওটা কি গোনার মধ্যে পরে? একবার ভালোবেসে ধরলেই না হোতো!
পুষ্প ঘর থেকে বেরিয়েছে কেবল। দোরগোড়ায় ধূসর পিউকে এমন কাছাকাছি দেখে থতমত খেল। দুরন্ত পায়ে ঢুকে গেল আবার। পরক্ষনে মাথাটা বের করে উঁকি দিলো। মুখের কাছে হাত নিয়ে খুক খুক করে কাশি দিয়ে বলল,
‘ কেউ কি আছে এখানে?’
চমকে উঠল ওরা। পাশ ফিরে পুষ্পকে দেখেই দুজন দুজনের থেকে ছিটকে সরে গেল। পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে রইল দুদিকে। পুষ্প ঠোঁট টিপে হেসে বলল,
‘ আমি কি যেতে পারি?’
ধূসর গম্ভীর কণ্ঠে বলল ‘ মার খাবি বেয়াদব।’
তারপর গটগট করে হেঁটে ঢুকে গেল নিজের রুমে। পিউ লজ্জ্বায় হাঁসফাঁস করছে। জ্বিভ কা*টছে বারবার। আপু দেখে নিয়েছে। নিশ্চয়ই আন্দাজ করবে কিছু । আল্লাহ,তারপর আম্মুকে বলে দিলেই ওর পিঠ শেষ। হাতা-খুন্তি সব ভা*ঙবে এখানে।
সে ছুটে পালাতে চাইল, এর আগেই পুষ্প হাত টেনে ধরে বলল,
‘ এই এই কই পালাচ্ছিস?
পিউ কাচুমাচু করে বলল,’
‘ পালাচ্ছি নাতো,এমনি। ‘
‘ এমনি? আমি তখন প্রেম করছিলাম বলে খুব তো কথা শুনিয়ে এলি,এখন এটা কী হচ্ছিল?’
পিউ ঘাবড়ে গেল। কাঁ*পা গলায় বলল,
‘ কী হচ্ছিল? ককথা বলছিলাম।’
পুষ্প ভ্রুঁ উঁচায়। অভিনয় করে দেখায়,
‘ এভাবে?গালে হাত রেখে,হাতে -হাত দিয়ে, একে অন্যের দিকে তাকিয়ে কেউ কথা বলে জানতাম না তো।’
পিউয়ের মাথা ঘুরছে। কপালে ঘাম জমেছে ভ*য়ে।
পুষ্প সন্দেহী চোখে তাকাল। এই দৃষ্টিতে অবস্থা আরও খারাপ হলো তার । ঠিক সেই সময় পুষ্প ভ্রু নাঁচায়,
‘ ভাইয়াকে ভালোবাসিস?’
পিউ চকিতে তাকায়। দুপাশে মাথা নেড়ে বলতে যাওয়ার আগেই পুষ্প সাবধান করল,
‘একদম মিথ্যে বলবি না। তুই যে ক্লাসে পড়িস,সেটা পার করে এসেছি।’
পিউ মিইয়ে গেল।
সে বলল, ‘ আমি কিন্তু সব জানি।’
পিউ অবাক হয়ে বলল ‘ কী জানিস?’
‘ তেমন কিছু না,তুই যে তিন বছর ধরে ভাইয়ার পেছনে ঘুরঘুর করছিস, এটুকুই।’
পিউয়ের চোয়াল ঝুলে পরে। চোখ বেরিয়ে এলো প্রায়। ভীত কণ্ঠে বলল,
‘ ইকবাল ভাই বলে দিয়েছেন?’
‘ ও কেন বলবে?’
‘ তাহলে কীভাবে জেনেছিস?’
পুষ্প রহস্য হেসে বলল ‘ সিক্রেট।’
আতঙ্কে পিউয়ের চোখমুখ শুকিয়ে আসছে। পুষ্প খেয়াল করে দমে গেল৷ মেয়েটাকে বেশি ঘাটানো ঠিক হবে না।
নিশ্চিন্ত করতে বলল,
‘ এত ভ*য় পাওয়ার কিছু নেই। আব্বু- আম্মুকে জানানোর হলে আগেই জানাতাম। ‘
পিউ কী বলবে জানে না। তার চিন্তা কমেনি। আমতা-আমতা করে বলল,
‘ আসলে আমার ধূসর ভাইকে খুব ভালো লাগে।’
‘ ভালো লাগে? না ভালোবাসিস?’
সে চোখ নামিয়ে স্বীকার করল, ‘ ভালোবাসি।’
পুষ্প ফিক করে হেসে ফেলল। পিউ ত্রস্ত মাথা উঠিয়ে বলল, ‘ তুই রাজী?’
‘ রাজী না হলে এতদিন ধরে কথাটা চে*পে রাখতাম?’
পিউয়ের নেতিয়ে যাওয়া চোখমুখ সচল হলো ওমনি।
মুখমন্ডল সোনালী রোদের ন্যায় ঝলমলায়। উত্তেজিত হয়ে দ্বিতীয় বার জাপটে ধরে বোনকে। পুষ্প হাসল। পিঠে হাত বুলিয়ে বলল,
‘ ধূসর ভাইয়ার মতন মানুষ হয়না। তুই সুখী হবি।’
***
খাওয়ার টেবিলে শোরগোল হলো না আজ। একদম তটস্থ,শান্ত পরিবেশ। এত রাত করে খেতে বসায় রিক্ত, রাদিফ ঘুমিয়ে গিয়েছে। সুমনা দুটোকে জোর করে তুলেও খাওয়াতে পারেননি। পরাজিত হয়ে ক্ষান্তি দিলেন।
পিউ বসতে গেলে আমজাদ নরম গলায় বললেন,
‘ এখানে বোসো।’
সে অবাক হলো, তবে ধরা দিল না। সুস্থির বেশে বসল। পুরোনো অভিমানে ফুঁসে উঠল মন।
অথচ নির্বিকার আমজাদ গায়ে মাখলেন না। এটা -ওটা এগিয়ে দিতে থাকলেন । দুই মেয়ের থালায় নিজেই তুলে দিলেন ভাত।
বাড়ির সবাই দেখল এসব। প্রকাশ না করলেও মনে মনে বিমুগ্ধ হাসল সকলে। একজন পিতার কাছে কন্যা শ্রেষ্ঠ সম্পদ। তার ছোট্ট রাজ্যের আদুরে রাজকন্যা। এই সম্পর্ক তো সবকিছুর উর্ধ্বে। সামান্য একটা থা*প্পড় , অল্পখানিক ধ*মকে এগুলো ফিঁকে হয়?
**
পরেরদিন সপ্তাহ ঘুরে আবার হাজির হলো শুক্রবার। এই শহরে চাকরিরত নব্বই ভাগ মানুষের অবসরের দিন এটি। সেই মোতাবেক সিকদার বাড়ি প্রতিটা ছুটির দিনে আরাম-আয়েশে জিইয়ে রইলেও আজকের সবটা ব্যতিক্রম। সকাল থেকে রান্নাবান্না, ঘর গোছানো, মোছা সব মিলিয়ে হুলস্থূল কান্ড বেঁধেছে। পুষ্পকে ঘর থেকে বাইরেও উঁকি মারার নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন মিনা বেগম। সকাল সকাল গোসল সেড়ে,লক্ষীটি হয়ে বসে থাকতে বলেছেন। পিউয়ের দায়িত্ব ওকে সাজানোর। তিনি,জবা,আর রুবায়দা মিলে হাত চালাচ্ছেন রান্নায়। ঘরের একজন নির্দিষ্ট আয়া,আরেকজন ছুটা আয়াতেও আজ আর কূলোচ্ছেনা । বিরাট দৈর্ঘ্যের খাবার টেবিল ভরিয়ে ফেলার পণ করেছেন সকলে।
সুমনার দায়িত্ব বাচ্চা সামলানো। রিক্ত আর রাদিফ ঘর অগোছালো করতে ওস্তাদ। ওদের দিকে নজর রাখাই আজকে তার একমাত্র কাজ
সবার মধ্যে ধূসর বাড়িতে নেই। কাকভোরে উঠে বেরিয়েছে সে। সাথে নিয়েছে অফিস রুমের চাবি। গতকাল পার্লামেন্টের উৎসবের জন্য কিছু ফাইল ঘাটার কাজ অসম্পূর্ন রেখে এসেছিল। যেগুলো দুদিনের মধ্যেই জমা করতে হবে। আরাম করে সময়টাকে নষ্ট করল না তাই। ছুটল বাকী কাজ সাড়তে।
সে বেরিয়েছিল একা। অথচ ফিরল সাথে আরো চারজনকে নিয়ে। এগারটার দিকে ইকবালের পরিবারের পা পরল চৌকাঠে। প্রফেসর খোরশেদুল আলম আর স্ত্রী মুমহতাহিনা বেগম। তিন ছেলে মেয়ে,ইকবাল, ইফাত আর নুড়ি। পঞ্চ সদস্যের ক্ষুদ্র পরিবার ওদের। নুড়ি সবে ক্লাশ ফাইভে উঠেছে। একেবারে পুতুলের মতোন দেখতে। ইফতি আর পিউ সমবয়সী। তবে পিউয়ের মত হ্যাংলা পাতলা নয়, বেশ স্বাস্থ্যবান।
আমজাদ সিকদারের চেহারা একদম স্বাভাবিক। তিনি নিজেই এগিয়ে গেলেন তাদের নিয়ে আসতে। আসুন, বসুন বলে সাদরে আমন্ত্রন ও জানালেন। ঘরের মেয়ে- বউরা ভালো জামাকাপড় পরে একদম পরিপাটি।
আওয়াজ শুনে পিউ, পুষ্পর ঘর থেকে দৌড়ে বের হয়। ওপর থেকেই উঁকি দেয়। সবাইকে সোফায় বসতে দেখে আবার ছুট্টে চলে যায়।
‘ আপু ওনারা এসে গিয়েছেন।’
পুষ্প আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে। বহুদিন পর মন ভরে সাজল সে। লাল কাতান শাড়ি, চোখ ভরা কাজল, মুখে অল্পস্বল্প মেক আপের আস্তরন,চিকন ঠোঁটে লাল টুকটুকে লিপস্টিক। পিউয়ের কথায় বিদ্যুৎ বেগে ঘুরে চাইল সে। ইকবাল এসেছে শুনেই কয়েক হাত গুঁটিয়ে গেল। লাজুক ভঙিতে ছটফ*ট করল। পিউ কপাল কুঁচকে বলল,
‘ এহ,লজ্জায় একেবারে লাউ ডগা সাপের মত লতিয়ে যাচ্ছে। প্রেম করার বেলায় লজ্জা লাগেনি?’
পুষ্প চোখ সরু করে বলল,
‘ তুই বুঝি খুব ভালো? ভাইয়াকে দেখলেই যে কেমন করিস আমি দেখিনি?’
পিউ থতমত খেল। মিনমিন করে বলল,
‘শুরু হয়ে গেল আমাকে খোঁচানো।’
পুষ্প আই- ঢাই করে বলল,
‘ আমার না সত্যি খুব লজ্জা লাগছে পিউ।’
‘ কেন?’
‘ জানিনা,ভ*য় ও করছে।’
পরমুহূর্তে চিন্তিত কণ্ঠে বলল ‘ আচ্ছা,আমাকে সুন্দর লাগছে তো?’
পিউ মিটিমিটি হেসে বলল,
‘ লাগছে। ইকবাল ভাই আজ তোকে দেখেই হা করে তাকিয়ে থাকবেন।’
পুষ্প কুণ্ঠা পেয়ে বলল ‘ যাহ!’
পিউ পাশে এসে দাঁড়াল , মেকি অভিমান নিয়ে বলল,
‘ তুই কিন্তু আমাকে এখনও বললিনা আপু।’
সে ভ্রু গোছায় ‘ কী বলিনি?’
‘ ওমা! কাল না কথা ছিল,যে ইকবাল ভাইয়ের সাথে প্রেমের শুরু থেকে সবটা বলবি আমাকে?’
‘ ও হ্যাঁ। আজকে রাতে শোনাব।’
‘ আচ্ছা।
সুমনা বেগম ঘরে ঢুকেই ব্যস্ত কণ্ঠে বললেন,
‘ তোরা গল্প করছিস? ও পুষ্প চল এবার। ওনারা দেখতে চাইছেন তোকে।’
পুষ্পর হার্টবিট ওমনি বন্ধ হবার উপক্রম হলো। ফ্যাসফ্যাসে অবস্থা ঘুরপাক গেল গলবিলে। আলগোছে শাড়ির কুঁচি ধরে পা বাড়াল। সুমনা বলেন ‘ দেখে,সাবধানে,পরে যাস না আবার। ‘
পুষ্প করূন নেত্রে তাকায়। শাড়ি পরে হাঁটতে হিমশিম খায় সে। সচরাচর পরেনা তাই। আজ মেজো মা জোর করে পরিয়ে দিলেন।
সুমনার হাতটা আকড়ে ধরে বলল,
‘ ও ছোট মা,ভ*য় লাগছে তো।’
‘ আরে ভ*য় কীসের? কিছু হবে না চল।’
তারপর হাঁটতে হাঁটতে বললেন,
‘ তুইত তাও ইকবালকে চিনিস,জানিস,শুধু ওর বাবা মায়ের সামনে যাবি এখন। আর আমার বিয়ের সময়ে আমি কাউকেই চিনতাম না। কোনটা যে বর তাই জেনেছি বিয়ে ঠিক হওয়ার একটু আগে।’
পিউ পেছন থেকে চোখ বড় করে বলল ‘ তাই?’
‘ হ্যাঁ। ‘
‘ কী সাং*ঘাতিক! এভাবে না জেনে বিয়ে করা যায় না কি?’
‘ যখন তোর বিয়ে হবে তখন বুঝবি!’
পুষ্পকে নিয়ে সুমনা এগিয়ে গেলেন সামনে। পিউয়ের কদম শিথিল হলো। দুপাশে দুলে দুলে হাসল। তার বিয়ে ওভাবে কেন হবে? ছোট মা তো আর জানেন না, ওর বর এই বাড়িতেই থাকে। বলতে গেলে জন্মের পর চোখ ফে*টে দেখেছে মানুষটাকে। ওইজন্য এরকম হওয়ার কোনও চান্সই নেই।
‘ তোর চাচা একটা ব্রিটিশ। কাল আমার সাথে কেমন করছিল,আর দ্যাখ আজ আমার বাপ মায়ের সঙ্গে কথা বলতে গেলে যেন মধু ঝড়ছে মুখে।’
ধূসর চোখ-মুখ অপরিবর্তিত রেখে বলল,
‘ যে যেরকম ব্যবহারের যোগ্য!’
‘ ঠিকই ব…. খেয়াল করতেই ইকবাল থেমে গেল। নাক ফুলিয়ে বলল,
‘ এভাবে বলতে পারলি?’
‘ পারলাম।’
‘ তুই আমার বন্ধু?’
‘ না,শত্রু।’
ইকবাল কথাটা হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘ এহ,এটা স্বয়ং ফেরেস্তা এসে বললেও বিশ্বাস করব না ভায়া।’
‘থাম এখন।’
‘ কথা বলাও নিষেধ?’
‘ তোর বউ আসছে।’
ইকবাল চোখ বড় করে এদিক- ওদিক চেয়ে বলল,
‘ কই কই।’
‘ গর্দভ! ওপরে দ্যাখ।’
ইকবাল ফটাফট সিড়ির দিকে তাকাল। পুষ্পকে এক পলক দেখেই বক্ষ কম্পিত হয়ে থমকে গেল। ভীষণ বিভ্রান্ত,ভয়ার্ত রুপসী এক কন্যা এগিয়ে আসছে তার দিকে। ইকবালের পিটপিটে আঁখিদ্বয় বাকী সবাইকে ছাড়িয়ে পরে রইল সেখানে। শাড়ি পরিহিতা মেয়েটি তার ঘুম কাড়তে যথেষ্ট। মুখ থেকে বেরিয়ে এলো,
‘ মাশ আল্লাহ! মেয়ে তো নয়, যেন হুরপরি!’
ধূসরের দিক তাকাতেই দেখল তার চোখ-মুখ কোঁচকানো। সে বুঝতে না পেরে বলল ‘ কী?’
ধূসর ক্লান্ত শ্বাস ফেলে বলল,
‘ আমি ওর বড় ভাই ইকবাল,একটু লজ্জা রাখ।’
‘ তাতে কী হয়েছে? ওর ভাই পরে, আগে আমার বন্ধু তুই।’
পরপর দুষ্টু হেসে বলল ‘ সেতো তুই পিউয়েরও বড় ভা….’
কথা শেষ করার আগেই ধূসর সবেগে কনুই দিয়ে গুঁ*তো দিলে পেটে। অতর্কিত হাম*লায় ইকবাল ভাঁজ হয়ে নুইয়ে যায়। আ*হত স্থান চে*পে ধরে দুহাতে। ধূসর বুকের সাথে বাহু গুঁজে দাঁড়িয়ে থাকে। তার চোখ বাকীদের দিকে। মুখভঙ্গি স্বাভাবিক। ইকবাল ধাতস্থ হলো,সোজা হয়ে পেট ডলতে ডলতে বলল,
‘ তুই ঠান্ডা মাথায় খু*ন ও করতে পারবি।’
‘ তোকেই করব ভাবছি। ‘
‘ এই না না, তোর বোন বিধ*বা হবে।’
ধূসর হেসে ফেলল। ইকবাল হেসে কাঁধ আকড়ে ধরল ওর। বলল,
‘ আমার বিয়ের সব কেনাকা*টা কিন্তু তুই করবি ধূসর। ‘
ধূসর মুখের ওপর বলল,
‘ পারব না। আমি মেয়ে পক্ষ।’
ইকবাল ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
‘ না,তুই ছেলেপক্ষ। তুই শপিং না করে দিলে আমি বিয়ে করব না।’
ধূসর ভ্রুঁ উঁচাল,’ তাই? বিয়ে করবিনা?’
ইকবাল দুঃখী মুখ করে বলল,
‘ তুই চাইলে করব না।’
‘ এসব অন্যদিক ফিরে বল ইকবাল৷ তোর মিথ্যুক চেহারা দেখার ইচ্ছে নেই।’
ইকবালের কিচ্ছু যায় এলো না এমন ভঙিতে বলল,
‘ ইচ্ছে না থাকলেও আমাকেই দেখতে হবে বন্ধু। তোমায় যে ইহজন্মে ছাড়ব না আমি।’
ধূসর সন্দিহান চোখে তাকাতেই সে চা*পা কণ্ঠে গান ধরল,
‘ বন্ধু তুমি,শত্রু তুমি,তুমি আমার জান।
খোদার পরে তোমায় আমি,দিয়েছি স্থান।’
ধূসর কপাল কুঁচকেই চেয়ে রইল। ইকবাল দাঁত কপাটি বের করে বলল,
‘ একটু হাস শালা,সরি সমন্ধি!’
পুষ্পকে নামতে দেখেই মুমতাহিনা উঠে গেলেন। কথা বার্তা ছাড়াই জড়িয়ে ধরলেন। পুষ্প কবুতর ছানার ন্যায় থরথর করছে। হাত পা সব কাঁ*পছে। নাক ঘামছে নার্ভাসনেসে। তিনি থুত্নী ধরে বললেন,
‘ মাশ আল্লাহ! মাশআল্লাহ!আমার ছেলের পছন্দ আছে।’
ইকবাল লজ্জা পেয়ে মাথা চুল্কাল। পুষ্প এত মানুষের মধ্যে চোখ তুলতে ব্যর্থ। নুড়ি এক লাফ দিয়ে সরে গেল। নিজের পাশ দেখিয়ে উত্তেজিত হয়ে বলল,
‘ ভাবিকে আমার পাশে বসাও আম্মু। আমার পাশে বসাও।’
‘ভাবি’ ডাক শুনে পুষ্পর ভেতরটা ধড়াস করে ওঠে৷ ভালোবাসার মানুষকে স্বামী হিসেবে পাবে,সে হবে বউ। এর থেকে পূন্যের কিছু পৃথিবীতে নেই।
তার পায়ের তলা অবধি শিরশির করছে। সবাইকে ছাপিয়ে কোনও মতে একবার তাকাতে চায় প্রিয় মানুষের দিকে। পেরে ওঠেনা। কুন্ঠার বেড়ি আটকে দেয় চক্ষু। পরে না হয় মন আর চোখ ভরে দেখে নেবে!
সুমনা ওকে নিয়ে সোফার দিক এগোলেন। পুষ্পর দৃষ্টি পা থেকে ওপরে ওঠেনা। চকচকে ব্যুট আর তকতকে স্যুট দেখেই ঠাওর করে ইনি ইকবালের বাবা হবেন। সে কোনও মতে তাকাল। আস্তে করে খোরশেদ আলমকে সালাম দিল। ভদ্রলোক মুগ্ধ হেসে উত্তর করলেন। বসার জন্য আবেদন জানালেন। নুড়ির পাশেই ওকে বসিয়ে দিলেন সুমনা। ছোট্ট মেয়েটা রাজ্য জয়ের ন্যায় হাসল। পুষ্পর হাত ধরে বলল,
‘ ভাবি কত সুন্দর! তাইনা ভাইয়া? ‘
ইফতির মন আর যোগ সিড়ির দিকে। পিউ দ্রুতপায়ে নামছে। বোনের কথায় চটক কে*টে বলল, ‘ হু হ্যাঁ! কেমন আছেন ভাবি?’
পুষ্প মিহি করে বলল ‘ ভালো। আপনি? ‘
‘ আমি আপনার ছোট, আপনি বলছেন কেন আল্লাহ? তুমি করে বলবেন।’
পুষ্প নীচু চেয়েই মাথা ঝাঁকাল। ইকবাল মন খারাপ করে তাকিয়ে দেখছে সব। এই মুহুর্তে পুষ্পর পাশে বসার তীব্র ইচ্ছে তার। নুড়ি যে হাতটা ধরে আছে,ওতেও হিং*সে হচ্ছে এখন। সে ওষ্ঠ উলটে রাখে শিশুর ন্যায়। মনে মনে চায়,
‘ একটু আলাদা কথা বলতে পাঠাক ওদের, প্লিজ!’
মুমতাহিনা পুষ্পর অন্য পাশে বসতে বসতে বললেন,
‘ ইকবাল আগেই আমাকে পুষ্পর ব্যাপারে জানিয়েছিল। ছবিও দেখেছিলাম ওর। আমিত সেই থেকেই পুষ্পকে মনে মনে ছেলের বউ ভেবে বসেছিলাম। কতবার বলেছিলাম,বাড়িতে নিয়ে আয় একটু মন ভরে দেখি। আনেইনি। বলত, সময় হলে সব হবে। কিন্তু তখনও জানতাম না,ও ধূসরের বোন।
কাল হঠাৎ গিয়েই পাগলামি শুরু করল ছেলেটা। বিয়ে করবে,বিয়ে করবে বলে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলল। তাও আবার ধূসরের বোন? আমরা তো আকাশ থেকে পড়লাম। ধূসরকে তো আমরা ছোট থেকেই চিনি। আপনাদের ব্যাপারেও শুনেছি। দেখা হয়নি এই যা!
ছেলের অবস্থা দেখে কাল রাতেই ওর বাবার সাথে আলাপ করলাম। তিনিও মত দিলেন। ব্যস, চলে এলাম পরিবার নিয়ে, মেয়ের হাত চাইতে। ছবিতে তো মনে হচ্ছে কমই সুন্দর দেখেছিলাম। মেয়ে একেবারে চাঁদের টুকরো আপা। আমার কিন্তু মন জুড়িয়ে গিয়েছে দেখেই।’
মিনা বেগম প্রসস্থ হেসে বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ! ‘
পুষ্প নতজানু থেকেই মৃদূ হাসল। বাবা,চাচা, বড় ভাইদের সামনে রূপের প্রসংশায় তার কী যে অবস্থা!
পিউ ঘুরে এসে বোনের পেছনে দাঁড়ায়। আড়চোখে একবার তাকায় ধূসরের দিকে। সে মানুষটা গম্ভীর নেত্রে অন্যদিক তাকিয়ে। একবার ওর দিক তাকালে কী হয়?
পিউ অনেকক্ষণ, একভাবে ধূসরকেই দেখে গেল শুধু । ওই সময়ের একটুও ধূসর ফিরল না এদিকে। যেন কসম কে*টেছে তাকাবে না। সে ছোট্ট শ্বাস ফেলে ইকবালের পরিবারকে দেখতে থাকে। আজই প্রথম দেখছে সবাইকে। ওর দিক একবার চেয়ে মুমতাহিনা শুধালেন,
‘ ওকি আপনার মেয়ে?’
আমজাদ বললেন, ‘ জি, ছোট মেয়ে।’
‘ হ্যাঁ পুষ্পর সাথে মিল আছে চেহারায়।’
পিউ হেসে সালাম দিলো। ভদ্রমহিলা হাসি বিনিময় করে উত্তর দিলেন। শুধালেন,
‘ কোন ক্লাশে পড়ো।’
‘ এইচ এস সি দেব এবার।’
‘ ওমা তাই,আমাদের ইফতিও তো পরীক্ষার্থী এবারে।’
ইফতি কে? ব্যাপারটা জানতে পিউ চারপাশে তাকাল। খুঁজে পেল একটা অপরিচিত মুখ। ছেলেটাও তাকিয়েছে তখন। অল্প হেসে আবার ফিরিয়ে নিল চোখ। পিউ অবাক হলো এই ছেলে ইন্টারে পড়ে জেনে। এতো ওকে ধরে দশটা আ*ছাড় মারতে পারবে। কলেজ পড়ুয়া ছেলে এত লম্বাচওড়া বাবাহ! অবশ্য আঙ্কেলও উন্নত স্বাস্থ্যের। ইকবাল ভাইযে ওনার মতোন হয়েছেন বোঝাই যায়।
খোরশেদ গলা খাকাড়ি দিয়ে বললেন,
‘ এবার তাহলে কাজের কথা শুরু করি আমজাদ ভাই?’
‘ জি।’
তিনি অনুমতি পেয়ে কৃতার্থ হাসলেন। বললেন,
‘ ইকবাল আমার বড় ছেলে। ওদের জ্ঞাতিগোষ্ঠী ভাইবোনের মধ্যেও বড়। ওর বিয়েই বলতে গেলে বংশে প্রথম বিয়ে। তাই আমাদের প্রত্যেকের ছোট খাটো শখ রয়েছে। ছেলের বিয়ে ধুমধাম করে দেব। সাথে মনে রাখার মতন হবে এমন আয়োজন করতে চাই আমি। তাই একেবারে আংটিবদল থেকে অনুষ্ঠান শুরু করতে চাইলে আপনাদের অসুবিধে নেইতো? ‘
আমজাদ হেসে বললেন ‘ জি না। তবে আমার সেজো ভাই আজমল, পনের দিনের মত বাড়িতে আছে। এরপর আসতে আসতে অনেক দেরী। এবারই এলো প্রায় ছয় মাস পর। তাই ও থাকাকালীন বিয়ের কাজ সেড়ে ফেলতে চাইছিলাম,যদি আপনাদের আপত্তি না থাকে আর কী।’
খোরশেদ চায়ের কাপ রেখে বললেন,
‘ না না আপত্তি থাকবে কেন? যাতে আপনাদের সুবিধা তাই হবে।’
‘ তাহলে কবে করলে ভালো হয় বলুন তো!’
আমজাদ ভাইদের দিকেও দেখলেন উত্তরের আশায়। আজমল হাতের কড়ে হিসেব করলেন দিন তারিখ। তারপর জানালেন,
‘ ভাইজান,আজ তো শুক্রবার,এই সোমবার আংটিবদল করলে হয় না?’
‘ আমাদের তো সমস্যা নেই। কিন্তু ওনাদের….’
মুমতাহিনা বললেন ‘ আমাদেরও সমস্যা নেই।’
‘ তাহলে সোমবারই ফাইনাল হোক?’
‘ জি। আর বিয়ে?’
এ পর্যায়ে আমজাদের অভিব্যক্তি পাল্টাল। কপালে দেখা দিলো অনুচিন্তনের প্রগাঢ় ভাঁজ। থেমে থেমে বললেন,
‘ আসলে খোরশেদ ভাই,আমি একটা কথা তখন থেকেই বলতে চাইছিলাম। আপনারা কী ভাবে নেবেন বুঝতে পারছি না।’
ইকবালের গলা অচিরাৎ শুকিয়ে গেল। কী বলবে এই লোক? হিটলার শ্বশুর মেয়ে দিতে আবার বেঁকে বসবেন না তো?
সে উদ্বীগ্ন চোখে ধূসরের দিক তাকায়। ধূসরের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি অন্য কোথাও গাঁথা। ইকবাল ভাবল, হয়ত পিউকে দেখছে। কিন্তু তাকানোর ধরণ দেখে পরক্ষনে বিভ্রান্ত হলো। দৃষ্টি অনুসরন করে নিজেও তাকাল। উৎসের মাথায় নিজের ভাই ইফতিকে দেখে শৈলপ্রান্ত বেঁকে এলো।
ওকে এইভাবে দেখছে কেন ধূসর?
খোরশেদ বললেন,
‘ আপনি নিশ্চিন্তে বলুন ভাই। আত্মীয়র মধ্যে আবার এত ফরমালিটি কীসের?।’
আমজাদ চুপ রইলেন। সবার মধ্যে চাপা উত্তেজনা ফুটে ওঠে তখন। ভীত হয় তারা। এমনকি পুষ্পও ঘাবড়ে যায়। কী বলবে আব্বু?
সবাই যখন ওনার দিকে চেয়ে,
তিনি সময় নিয়ে বললেন,
‘ দেখুন, পুষ্প আমার বড় মেয়ে,ওর বয়সও কম। মা চাচীদের স্নেহে,আদরে,তাদের ছায়ার বড় হয়েছে। একটা সংসার সামলানোর মত বোধবুদ্ধি ওর হয়নি। বলা যায়,পরিপক্কতা আসেনি।’
মুমতাহিনা মাঝপথে বলে উঠলেন,
‘ আপনি এসব নিয়ে ভাববেন না ভাই,আমি আপনার মেয়েকে বউ করে নিচ্ছিনা। নুড়ির মতো সেও আমার আরেক মেয়ে। আমার সংসার ওর সামলানোর ও প্রয়োজন হবেনা। ওরা ভালো থাকলেই আমার চলবে।’
আমজাদ বললেন ‘ আমি জানি আপা,আপনারা ভালো মানসিকতার মানুষ সে আমি শুনেছি। কিন্তু আমি এসব নিয়ে ভাবছি না। আমার কথাটা একটু শুনুন, পুষ্পর পড়াশুনা এখনও চলছে। আমি চাইছি ও পুরো অনার্স শেষ করেই একটা সংসারে পা রাখুক। বাবা হিসেবে মেয়ের জন্য এটুকু আমি চাইতেই পারি। তাই আমার ইচ্ছে, আপাতত ইকবালের সঙ্গে ওর কাবিন হয়ে থাকুক। লেখাপড়া শেষ করতে তো আর দু বছর। তারপরই তুলে দেব আপনাদের হাতে। ওবাড়ি গিয়েই না হয় মাস্টার্স করবে।’
পুষ্পর গলায় আটকে থাকা নিঃশ্বাসটুকু স্বস্তি হিসেবে বেরিয়ে গেল। হাঁপ ছেড়ে বাঁচল যেন। অথচ ইকবালের মাথায় বাঁজ পরে। বিস্ফোরিত নেত্রে চেয়ে রয় সে।
‘ ভাই এটা কী হলো? তোর চাচা তো চালবাজি করলেন। আমার বউ আমাকে পুরোপুরি দেবেনা?’
ধূসরের নিরুদ্বেগ জবাব,
‘ মোটেও না পাওয়ার থেকে এটুকু ভালো। যা হচ্ছে চুপচাপ মেনে নে।’
ইকবাল আ*হত, নিহ*ত। বাধ্য হয়ে চুপ করে থাকল। পুষ্পর দিকে তাকাল অসহায় চোখে। এই অসাধারণ, মিষ্টি ফুলটা সে রেখে যাবে? হায় হায়!
তার তো শোকে গড়াগড়ি খেতে মন চাইছে৷ অথচ এই মেয়ের মুখে শোকের ছায়া অবধি নেই। কত স্বাভাবিক! তোমার কি খা*রাপ লাগছেনা মাই লাভ? জামাই রেখে দু বছর থাকবে শুনে ক*ষ্ট হচ্ছে না?
খোরশেদ, মুমতাহিনা মুখ দেখা-দেখি করলেন। শেষে বললেন ‘ বেশ,তাই হবে।’
আমজাদ নিশ্চিন্ত শ্বাস ফেলে বললেন ‘ ধন্যবাদ! তবে কাবিন হলেও বিয়ের মতই সব আয়োজন করব আমি। শুধু মেয়েটা নিয়ে যাওয়ার বদলে রেখে যাবেন আর কী।’
ওনার দুই ঠোঁটের হাসিটা ইকবালের অসহ্য লাগল। চোরের ওপর বাটপারি করে দিল এই লোক! চোখের সামনে দুটো বছর বউ রেখে দেয়ার শাস্তি দিয়ে দিলো। রাজনীতি তো এনার করার কথা! তা না করে ব্যবসায় নামলেন কেন? হুয়াই?
মুমতাহিনা ব্যাগ থেকে আংটি বের করে বললেন,
‘ এটা আমার তরফ থেকে তোমার জন্য উপহার।সম্পূর্ন আমার তরফ থেকে বুঝলে? এই আংটি দিয়ে আমার পূত্রবধূ হিসেবে তোমায় দলিল করে নিলাম কিন্তু ।’
বলতে বলতে আংটিটা ভরে দিলেন পুষ্পর অনামিকায়। সে সালাম করতে ঝুঁকলে আটকে দিলেন। কপালে চুঁমু খেয়ে বললেন,
‘ সুখী হও, আমার ছেলে যা উড়নিচণ্ডি! ওকে বেঁধে রেখো আঁচলে।’
মিনা বেগম অনেকক্ষন যাবত একটা কথা বলার জন্য উশখুশ করছেন। কীভাবে শুরু করবেন, কেউ যদি বলে দিতো!
শেষে অধৈর্য হয়ে মিনমিন করে বলে ফেললেন,
‘ ইয়ে,আপা,দেনাপাওনার বিষয়টা?’
মুমতাহিনা এমন ভাবে তাকালেন যেন ওনার জান চেয়েছে কেউ। খোরশেদ আর তার মূক দৃষ্টি দেখেই অপ্রস্তুত হয়ে পরলেন তিনি।
ভদ্রলোক অবাক কণ্ঠে বললেন,
‘ এসব কী বলছেন ভাবি? এ যুগে এসেও এমন কথা মানায়?’
‘ না আসলে আমি…..যৌতুক বোঝাইনি,উপহার বোঝালাম আর কী!
খোরশেদ তীব্র প্রতিবাদ করলেন,
‘ না না ভাবি,এটা আশা করিনি। উপহার আমার দরকার নেই। আপনার মেয়েইতো আমার জন্য আস্ত একটা দামী তওফা। তাছাড়া আল্লাহর রহমতে আমার যা আছে আমি তাতেই সন্তুষ্ট। আপনারা এরকম কথা মুখেও আনবেন না।’
ইকবাল বিদ্বিষ্ট ভঙিতে বিড়বিড় করে বলল,
‘ আপনাদের উপহার আপনারা রেখে, মেয়েটা দিয়ে দিন আমায়। ওটাই চাই আমার। ‘
আমজাদ মনে মনে মুগ্ধ হলেন ইকবালের পরিবারের প্রতি। খোরশেদ একটা পাব্লিক ভার্সিটির প্রফেসর। অনেক নাম-ডাক আছে তার। অনেকবার সামনা-সামনি দেখেওছেন ওনাকে। লোকটা আসলেই অমায়িক। তার আফসোস হলো,ইকবাল কে ওনার ছেলে ভাবতেই।
ছেলেটা বাবার মতো হলেই পারতো।
পিউ দাঁত বার করে হাসছিল। তার ভীষণ ভালো লাগছে। শেষমেষ ইকবাল, তার দুলাভাই হবে ভাবতেই ডগমগ করছে খুশিতে। আচমকা ইফতির দিকে চোখ পড়তেই হাসিহাসি ভাবটা কমে এলো। ছেলেটা তাকিয়ে ছিল না? চোখাচোখি হতেই তড়িৎ বেগে আরেকদিক ফিরল যেন।
পিউ ঠিকঠাক হয়ে দাঁড়াল। অপ্রস্তুত ভাবে ঘাড় চুল্কাল। কেন যেন মনে হলো,ইফতি ছেলেটা ওকেই দেখছিল এতক্ষণ।
পিউ ঘুরেফিরে আবার ধূসরের দিক তাকাল । মুহুর্তে মেরুদণ্ড সোজা করে ফেলল। মানুষটার ক্ষিপ্ত,কটমটে চাউনী জোড়া দেখেই ঘাবড়ে গেল। যেন এক্ষুনি তে*ড়ে এসে থা*পড়ে চোখ-মুখ অন্ধকার করে ফেলবে। পিউ বিভ্রান্ত হলো। এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন উনি? রাতেও তো ঠিকঠাক ছিলেন। কত কাব্যিক কথা শোনালেন! গাল ধরলেন। সে কি আবার কোনও অঘটন ঘটিয়েছে?
ওমন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই গতকাল রাতের পর থেকে এক এক করে সমস্ত ইতিহাস ঘাটতে শুরু করল পিউ। মাথা এলোমেলো করে ভাবতে থাকল,
‘ কী করেছি আমি?’
চলবে
এক্সাম নোটিশ দিয়েছেএএএএ। এরপরের বাকীটা যাকে বোঝাতে হবে,তাকে লাল সেলাম🫡