এক সমুদ্র প্রেম পর্ব ৩৪

0
1038

#এক_সমুদ্র _প্রেম!
লেখনীতে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(৩৪)

সিকদার বাড়িটি মূলত দুইতলা ভবনের তৈরী। বিশাল প্রস্থের ডুপ্লেক্স এটি। ক্রিম আর সাদা রঙের মিশেলে প্রতিটি দেয়াল তকতকে,ঝকঝকে। শুরুতে এমন ছিলনা অবশ্য। বাড়ির মূল কর্তা, প্রতিষ্ঠাতা, চার সন্তানের পিতা জমির সিকদার। সাধ্যমতো স্তম্ভ তুলেছিলেন। তবে সম্পূর্ন করতে পারেন নি। পাঁকা মেঝে হলেও মাথার ওপর ছিল টিনের ছাদ। অর্থ যা কামিয়েছেন ব্যয় হতো পরিবার সামলাতে। বাকিসবের ফুরসত কই?
হৃদয়ের ব্যামোর তোপে দুনিয়া ছেড়েছিলেন তিনি। তখন পুত্রবধূদের মধ্যে সবে মাত্র রুবায়দা বেগম ছিলেন। গণনা অনুসারে তিনি মেজো বউ হলেও এই বাড়িতে সবার প্রথমে আগমন হয়েছিল তারই।
আফতাব তখন বেকার। পড়াশুনাও শেষ হয়নি। রুবায়দার বাড়িতে বিয়ের তোরজোড় শুরু হলো হঠাৎ । ওই আমোলে, মুখ ফুটে অন্য কাউকে পছন্দের কথা জানানো চাট্টিখানি ব্যাপার ছিল না। তাও আবার মেয়ে মানুষের! যাদের থাকার নীতিই ছিল পর্দার আড়ালে।

লজ্জ্বা,শরমের বালাই ভুলে সাহস করে রুবায়দা তবুও পিতাকে জানিয়েছিলেন। আফতাবের মতো চাকরিহীন ছেলেকে তিনি নাকচ করলেন এক কথায়। এদিকে তার অবস্থা হলো দূর্বিষহ। খাওয়া দাওয়া ভুলে বসলেন। হতে থাকলেন অগোছালো। মস্তিষ্কে চাপের পরিমান তরতর করে বাড়ছিল। রুবায়দার সাথে অন্য কারো বিয়ে,এ ভাবনাও অসম্ভব।
দুজনেই দুজনের জন্যে ম*রিয়া যখন, সম্মুখে খোলা রইল একটি পথ। উপায় না পেয়ে আফতাবের হাত ধরে ঘর ছাড়লেন বাবার। একেবারে বিয়ে সেড়ে হাজির হলেন শ্বশুর বাড়ি। আফতাবের মত ভদ্র,শান্ত, মার্জিত গোছের ছেলের কান্ডে তখন বাড়ি শুদ্ধ লোক হতচেতন, হতবাক। জমির সিকদার কথাই বলতে পারেননি অনেকক্ষণ। আজমল তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রেখেছেন মাত্র। আনিস পড়তেন দশম শ্রেনীতে। তার থেকেও বড় কথা, বড় ভাই আমজাদ অবিবাহিত। কেবল একটা চাকরিতে ঢুকেছেন তিনি। বেতনও আহামরি ছিল না। বড় ভাইয়ের আগেই মেজো ভাই বউ নিয়ে বাড়িতে হাজির? তৎকালে বিষয়টা এতটাই জটিল,আর অসহ থাকায় প্রত্যেকেই কিংকর্তব্যবিমূঢ়, ভাষাহীন।

জমির সিকদার একজন সৎ সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন। বড় পরিবার,পুরো সংসারের জোয়াল টানা সব মিলিয়ে একটু আধটু হিমশিমিয়ে যেতেন। আমজাদ চাকরি নেয়ার পর বাবার কাঁধে কাঁধ মেলানোয় একটু কমেছিল মাত্রাটা। অবশ্য আগেও কখনও সন্তানদের কোনও ইচ্ছে তিনি অপূর্ন রাখেননি। স্বচেষ্ট থাকতেন,তাদের আবদার মেটাতে।

কোনও টায় অপারগ হলে,বাকী তিন ভাই ভিড়তেন আমজাদের কাছে। প্রতিটি সহোদর তার চোখের মণি। কিন্তু আফতাব যেন একটু বেশিই সমীহ পেতেন। পিঠাপিঠি,সাথে আফতাবের ভদ্রতা,সভ্যতা আবার বাকী দুজনের চেয়ে তার চোখে অঢেল শ্রদ্ধার বর্ষন দেখে টান, মায়াও ছিল বাকীদের চেয়ে বাড়তি।
সেই ভাইয়ের কাজে তিনি নিজেও চমকেছেন,আশ্চর্য হয়েছেন। জমির রা*গে কাঁ*পছিলেন প্রায়। চি*ৎকার,চেঁচামেচিতে ভরে গিয়েছিল বাড়ির বসার ঘর। তাদের মা তখন দিশেহারা। কী রেখে কী সামলাবেন!
রুবায়দা গুনগুন করে কাঁ*দছিলেন। আফতাবের মস্তক নীচু। বাবার চোখের দিকে একটি বার সে তাকায়নি অবধি। রাগা*রাগির এক পর্যায়ে জমির বললেন,
‘ ও বেকার,বিয়ে করে বউ আনল,খাওয়াবে কী? ওকে কে খাওয়াবে?’

আফতাবের বলার কিছু নেই তখন। উত্তে*জনায় ওইসময় অত কিছু মাথায় আসেনি। সেই ক্ষনে আমজাদ এক কথায় ঘোষণা করলেন
‘ আমি খাওয়াব আব্বা।’
সকলে অবাক হয়ে তাকালে তিনি বললেন ‘ ‘আফতাব আগেও যা খেত এখনও তাই খাবে। রুবায়দার জন্যে এক প্লেট বাড়তি ভাত লাগবে তাইতো? সমস্যা নেই,সেই ভাতের হিসেব না হয় আমার সাথে করলেন!’

শুধু আফতাব নয়,বাকী দুই ভাইয়ের মাথা শ্রদ্ধায় নতজানু হয়ে গেল তার প্রতি। জমির কিছু বলতে পারলেন না আর। রা*গে গজগজ করে প্রস্থান নিলেন সভা থেকে।

আফতাবের পড়াশুনা শেষ করে চাকরি নেয়া অবধি আমজাদ সামলেছেন সব। রুবায়দার মত লক্ষীমন্ত রমনীর, শ্বশুর কে কাবু করতে বেশিদিন লাগেনি। শ্রদ্ধা,যত্ন,ভালোবাসা দিয়ে গলিয়ে দিলেন জমিরের শ*ক্ত ভীত। একটা সময় এই মেয়েকেই চোখে হারাতেন তিনি। পরিবারের স্বাভাবিকত্ব আর সুখ দুয়ারে দাঁড়িয়ে তখন।
তার মধ্যে ওনার মৃ*ত্যু আবার হাজির করল শো*কের ঘনঘটা।
আমজাদের ঘাড়ে বর্তাল পরিবারের সকলের দ্বায়ভার। আফতাব পরীক্ষা শেষের আগেই চাকরীর জন্যে বিভিন্ন স্থানে আবেদন শুরু করলেন। অন্তত ভাইয়ের থেকে কিছুটা বোঝা নিজের কাঁধে নেবেন বলে। লাভ হয়নি। তাদের মা পরামর্শ দিলেন বাসার দুটো রুমে ভাঁড়াটে তোলার। কিছু হলেও টাকা আসবে। দুই ভাইই নারাজ তাতে। নিজেদের বাড়িতে অন্য লোক তুলবেন কেন?।

শেষে দুজন মিলেমিশে পরিকল্পনা করলেন ব্যবসা করার। বাবার রেখে যাওয়া সঞ্চয় যোগ করলেন। তখন রুবায়দার পেটে বেড়ে উঠছে ধূসর। তার ও তো বাড়তি যত্নের প্র‍য়োজন! আমজাদের সঙ্গে মিনা বেগমের বিয়ে হয়েছে নতুন। কিন্তু ওইটুকু সঞ্চয় তাদের পরিকল্পনা মাফিক ব্যবসার জন্যে যথেষ্ট হয়নি। তাদের মা সাহারা হলেন সে সময়। নিজের সব গয়না বের করে তুলে দিলেন ছেলেদের হাতে। দেখাদেখি রুবায়দা আর মিনাও অনুসরন করলেন একই পথ। নাকফুল আর চুড়ি দুটো বাদে সমস্ত কিছু দিয়ে দিলেন। ওই অর্থ মিলিয়ে নতুন ব্যবসা শুরু হলো। দুই ভাই রাতদিন গাধার মত খাটলেন। ব্যবসা দাঁড় করাতে ত্যাগ করলেন আরামের ঘুম। বিনীদ্র রজনী বশ করল তাদের সহধর্মিণীদেরও। আস্তেধীরে ব্যবসা গড়ে ওঠে। শ*ক্ত পোক্ত ভীত,মজবুত হতে শুরু করে। গোডাউন একটার জায়গায় দশটা তৈরী হলো।
বাসে- ট্রামে যাতায়াতের পথে ব্যবহার হলো নিজস্ব গাড়ি। আফতাব কোথাও গরমিল করলে,আমজাদ বুদ্ধি দিয়ে সব মিটিয়ে ফেলতেন। বড় বড় ক্লায়েন্ট সামলাতে হয় তাকেই। আফতাব লম্বাচওড়া ছিলেন,তবে বুদ্ধীন্দ্রিয়ে পাকা-পোক্ত নয়। সেদিক থেকে আমজাদ করেছেন সব। ভাইকে বিশ্রামে পাঠিয়ে নিজে ঘাম ফেলেছেন। ভাইদের জন্যে বউ হিসেবে বেছে বেছে রত্ন খুঁজে এনেছেন। প্রত্যেককে শিখিয়েছেন,কীভাবে নিজেদের ভালোবাসতে হয়। এই বিরাট পরিবারে তিনি এক দরদী বাজপাখি। আর ভাইদের নিকট ফেরেস্তাতূল্য!

এই পরিজন সে আগলে রাখলেও, ভাইদের ছেলেমেয়ের মধ্যকার বৈবাহিক সম্পর্কের কথা কোনও দিন মাথায়ও আনেননি। আজমলের আবদার সবথেকে বেশি ভড়কে দিয়েছে তাকেই। সাথে বসার ঘরেও পিনপতন নীরবতা নেমেছে, ওই এক ঘোষনায়।

নিস্তব্ধ হয়ে পরেছে সকলে। হতবাক চেহারায় একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো কিছুক্ষণ। আমজাদ বিস্ময়ের তোপে খানিক সময় ভাইয়ের দিক হা করে চেয়ে রইলেন। ধাতস্থ হতে বিলম্ব হলো। তারপর ত্রস্ত ভঙিতে চায়ের কাপ টেবিলে রাখলেন। আজমল একটু লজ্জা পেলেন। এমনিতেই প্রস্তাবখানা রাখতে অস্বস্তি হচ্ছিল তার। যা সবার প্রতিক্রিয়া দেখে দ্বিগুন হলো এখন।

বিভ্রান্ত নজর একবার স্ত্রীর চেহারায় বোলালেন। তাকেও চিন্তিত দেখাচ্ছে। আজমল দৃষ্টি ফিরিয়ে আবার ভাইয়ের পানে তাকালেন। ইতস্তত করে বললেন,
‘ ইয়ে,আমি কি কোনও ভুল কিছু চেয়ে বসলাম ভাইজান?’
আমজাদ নড়ে উঠলেন। ওষ্ঠযূগল মিলিত হলো। গলা খাকাড়ি দিয়ে সামলালেন নিজেকে। সকলের বিস্ময়াবহ ভাবমূর্তি কে*টে গেল ওমনি। তিনি
সংশয় সমেত শুধালেন
‘ তুমি কি কথাটা নিশ্চিত হয়ে বললে আজমল?’

আজমল একটু চুপ থেকে বললেন,
‘ জি। আসলে, আমারও পুষ্পকে পছন্দ,সাথে জবারও। দুজনেই পরামর্শ করে ঠিক করলাম ওকে সারাজীবনের জন্যে আমাদের কাছেই রেখে দিই। মেয়েকে আজ না হোক কাল পরের ঘরে তো দেবেনই। আমাদের কাছেই থাকল না হয়!’
বলতে বলতে তার হাতটা পুষ্পর মাথায় বুলিয়ে গেল। মেয়েটার বিস্ময়াহত চাউনী তখনও অনড়। অগ্রমস্তিষ্ক ছি*ন্নভিন্ন। স্নায়ুতন্ত্র বিবশ,বিদীর্ণ।

আমজাদ মাথা নামিয়ে তাকিয়ে রইলেন মারবেল মেঝেতে। স্থূল মুখস্রী দেখে সকলে একটু ঘাবড়ে যায়। আমজাদ চুপ রইলেন। যেন গহীন প্রণিধানে ভাবছেন। একে অন্যকে ভ্রুঁ উঁচায় তখন। ঘটনাচক্র ঠাওর করতে ব্যর্থ তারা। শেষে চোখ তুললেন তিনি। আগের থেকেও গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
‘ তুমি এরকম একটা প্রস্তাব কী করে রাখলে আজমল? আমিত সেটা ভেবেই অবাক হচ্ছি।’

পিউ এতক্ষণে কিঞ্চিৎ নড়েচড়ে উঠল। আশায় বুক বাঁধল বাবার কথায়। তবে কী বাবা মানা করে দেবেন?
আজমল ভীত হলেন। ভাইজান হয়ত নাখোশ হয়েছেন। তার কি আর একটু ভাবা উচিত ছিল? জবার কথায় স্বায় দিয়ে ভুল করে বসলেন না তো? এই জন্যে ভাইজান আবার ভুল না বোঝেন।
তৎপর, তটস্থ চাউনী সকলের। চোখমুখ কৌতুহলী। মিনা বেগম শ*ঙ্কিত নেত্রে চেয়ে। স্বামীকে সামলানোর জন্যে মুখ খুলবেন কেবল,আচমকা হো হো করে হেসে উঠলেন আমজাদ। উপস্থিত প্রত্যেকে চকিত,চমকিত। ভ্যাবাচেকা খেল এক কথায়। আজমল হাসবেন, না কি হাসবেন না, দ্বিধাদ্বন্দে ভুগলেন। কয়েক পল বোকা বোকা চাউনীতে চেয়ে থাকলেন।
আমজাদ হাসতে হাসতে বললেন,
‘ এই দারুণ বিষয়টা আমার মাথায় আগে কেন আসেনি আজমল? ভাই থেকে বেয়াই হওয়ার বুদ্ধিটা কিন্তু মন্দ নয়।’
ছ্যাত করে উঠল পুষ্পর বক্ষস্থল। থমকে তাকাল বাবার দিকে। অথচ
স্বস্তির শ্বাস টানল সকলে। আজমলের ঠোঁটে তৎক্ষনাৎ হাসি ফোটে। উন্মুক্ত হয় শুভ্র দাঁত। কপালের ভাঁজ চটজলদি মিলিয়ে গেল। বাকীদের ঠোঁট দুলে উঠল খুশিতে। তিনি আগ্রহ ভরে শুধালেন,
‘ তাহলে আপনার রাজী ভাইজান?’

‘ রাজী মানে? আলবত রাজী। তুমি মুখ ফুটে চাইলে আমি দেব না,এমন হয়েছে?’
পিউ চোখ বুজে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এমন যে হবে সে আগেই জানত।
আজমলের জবাব,
‘ জি না।’
‘ তাহলে আবার জিজ্ঞেস করলে কেন? আমার মেয়ে আজ থেকেই তোমাদে সম্পদ ধরে নাও আজমল। মেয়ে পেলেপুষে দূরে পাঠানোর যা*তনা থেকে বাঁচিয়ে দিলে। ‘
জবা বেগম হুড়মুড়িয়ে ছুটে গিয়ে মিনা বেগমকে জড়িয়ে ধরলেন। ভদ্রমহিলা পরতে পরতেও সামলালেন নিজেকে। জবা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন ‘ ‘ আপা আমরা বেয়াইন হয়ে যাব।’

মিনা হাসলেন। পালটা জড়িয়ে ধরলেন তাকে। সকলে যখন হাসছে, পুষ্পর চেহারায় পরতে পরতে ছুটছে আমাবস্যা। হত*বুদ্ধি সে,নির্বাক। কী বলবে, কী করবে জানেনা। কম্পিত নেত্রে সামনে বসা সাদিফের দিক তাকায়। সে সুস্থির ভঙিতে কাপে চুমুক দিচ্ছে। মুখস্রীতে উত্তেজনা,উদ্বেজনা কিচ্ছু নেই। মানুষটি তুলনামূলক নির্বিকার,নিষ্প্রভ। যেন কিছু শোনেনি,কিছু ঘটেনি।

রুবায়দা ছুটে গেলেন ফ্রিজ থেকে মিষ্টি আনতে। সুমনা বললেন,
‘ তাহলে সবাই মিলে বিয়ের একটা দিন পাঁকা করি?’

‘ কার বিয়ের কথা হচ্ছে?’
ধূসরকে দেখে,এই এতক্ষণে পিউয়ের প্রানে পানি এলো। তীব্র আশা ফুটে উঠল চেহারায়। আনিস বললেন,
‘ এসেছিস,আয় বোস এখানে।’
ধূসর গিয়ে বসল। আজমল বললেন,
‘ এটাই বলতে চাইছিলাম তখন,আমাদের ইচ্ছে পুষ্পর আর সাদিফের দু জোড়া হাত এক করার। ‘

পিউ আগ্রহভরে, ফের নড়েচড়ে বসল। উদগ্রীব,উতলা সে। ধূসর ভাই সাহসী মানব। কাউকে পরোয়া করেন না। নিশ্চয়ই এক্ষুনি বলে দেবেন আপুর মনের কথা। সবাইকে গুরুভার কণ্ঠে ঘোষণা দেবেন,
‘ এই বিয়ে হবেনা। কারণ পুষ্প, ইকবাল কে পছন্দ করে। ‘
হ্যাঁ এক্ষুনি বলবেন।
অথচ তাকে বিমূর্ত করে দিয়ে ধূসর বলল,
‘ ভালো সিদ্ধান্ত।’
পিউ আশ্চর্য বনে যায়। ওষ্ঠ ফাঁকা হয় নিজেদের শক্তিতে।

সে পরমুহূর্তে আবার বলল,
‘ তা যাদের বিয়ে দেবে তাদের মতামত নিয়েছেন চাচ্চু?’
আজমলের টনক নড়ল যেন। কিঞ্চিৎ কুণ্ঠিত হলেন। বাকীদের অবস্থাও তাই হয়। যাদের বিয়ে দেবে তাদের মতামত নেবেনা?
তিনি শশব্যস্ত হয়ে বললেন,
‘ হ্যাঁ হ্যাঁ, সাদিফ বাবা!’
সাদিফ এতক্ষণে তাকায়। চশমার সাদা গ্লাস ভেদ করে তার নিষ্প্রাণ দৃষ্টি অবধি পৌঁছাতে পারেনা কেউ।
তিনি রয়ে সয়ে শুধালেন ‘ বিয়েতে তোমার আপত্তি নেইত?’

পিউ নীচের দিক চেয়ে দুদিকে মাথা নাড়ল। সাদিফ ভাইয়ের উওর ওর জানা। উনিতো আপুকে পছন্দ করেন। তার ওপর ইকবাল ভাইয়ের বিষয়েও কিছু জানেন না। ‘না’ বলার প্রশ্নই আসেনা এখানে। ‘ হ্যাঁ’ ই বলবেন। সে হান্ড্রেড পার্সেন্ট কনফার্ম।
পুষ্পর ব্যকুল নেত্রযূগল সাদিফের দিকে নিবদ্ধ। তার কন্ঠনালী কা*পঁছে। ভেতর ভেতর ছট*ফটে ভঙিতে অনুরোধ করছে,
‘ না বলো ভাইয়া,প্লিজ না বলো।’

প্রত্যেকের জিজ্ঞাসু চাউনী যখন সাদিফের ওপর,সে তখন গাঢ় দৃষ্টিতে মেঝের দিক চেয়ে রয়। চোখ না তুলেই, ঠোঁট নেড়ে জানায়,
‘ না। তোমাদের ইচ্ছেই আমার ইচ্ছে।’

পুষ্পর বুক ভে*ঙে এলো। হৃদয় ভ*গ্ন হলো হতাশায়৷ পিউ আবার সন্তর্পনে চ বর্গীয় শব্দ করে। জানতো এমনটাই হবে। সাদিফ ভাই ইজ আ বেস্ট বয় ইন দ্য ফ্যামিলি কী না!

সে গুটিকতক ভরসা জড়োসড়ো করে ধূসরের পানে পুনরায় তাকাল। সবার মধ্যে পারলনা চিল্লিয়ে নিবেদন করতে। কিন্তু তার ভেতরটা অধৈর্য ভীষণ। সে চেঁচায়,
‘কিছু করুন ধূসর ভাই,কিছু করুন। ‘

ছেলের উত্তরে জবা বেগমের বক্ষ থেকে পাথর নেমে গেল। গাল ভরল হাসিতে। উদ্বীগ্ন চোখেমুখে দেখা গেল সূর্যকিরণ। যাক! তাহলে তিনি ভুল ভাবেননি,সাদিফের তবে পুষ্পকেই পছন্দ।
সবার উজ্জ্বল চেহারা ধূসর একবার একবার দেখল। বেশ মনোযোগ সেই পরিদর্শনে।
নিশ্চিন্ত মানুষগুলোর উদ্দেশ্যে চট করেই বলল,
‘ সবে তো একজনের মতামত নেয়া হলো,পুষ্পর মতামত? ‘

পিউয়ের নেতিয়ে যাওয়া মুখস্রী, মুহুর্তমধ্যে সতেজ হলো।
উত্তরাশার কুটি কুটি চারা বক্ষে রোপন করল সবেগে। অতিদ্রুত বোনের দিক তাকাল ফের। বিড়বিড় করে বলল ‘ আপু বল তুই রাজি না।’

পুষ্পর পুরো শরীর কাঁ*পছে। জ্বিভ বিবশ। কথা ফুটছে না। ধূসর তখনি পুরূ স্বরে ডাকে,

‘ পূষ্প?’
সে ত্রস্ত, ক্লান্ত,চোখ তোলে। অবরুদ্ধ কণ্ঠে জবাব দেয় ‘ জজি!’
ধূসর পূর্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল ‘ বিয়েতে তুই রাজি?’

মেয়েটা ভীতু,অচঞ্চল। বাবা-চাচাদের সামনে মাপঝোঁক করে কথা বলেছে সব সময়। চোখ তুলে অবধি দেখেনি। প্রত্যুত্তর করেনি।
সেখানে আজ না বলবে? পারবে বলতে?
এক ঘর মানুষের মধ্যে যদিও বা না বলে বসে, তারপর কী হবে? কতগুলো প্রশ্ন বাণ ছো*ড়া হবে আন্দাজ করলেই ঘামছে। হচ্ছে আতঙ্কে আঁটশাট। গলবিলটা তখন মরুভূমি প্রায়। যেন তৃষ্ণায় শহীদ হবে। একটু পানি পেলে ভালো হতো!

ধূসর ধৈর্যহীন হয়ে বলল ‘ কী হলো?তুই রাজি?’
পুষ্প শুকনো ঢোক গে*লে। অতিক*ষ্টে,বেগ সমেত সাহস জমায় বক্ষে। না বলার জন্যে, হা করতে যায়,অথচ কথা ফোটার আগেই আমজাদের রাশভারি কণ্ঠে শোনা গেল,
‘ অবশ্যই রাজি। আমার মেয়েকে আমি চিনি। সে আমাদের মতের বাইরে কখনওই যাবেনা। মুখের ওপর আপত্তি করার শিক্ষা তারা পায়নি। আমাদের পছন্দ যে তাদের জন্যে খা*রাপ হবেনা তারা অবগত। এইটুকু বিশ্বাস আমাদের আছে। তাইত পুষ্প মা?’

বাবার আত্মবিশ্বাস,অহং*কার আর গর্ব দেখে পুষ্পর কথা মুখেই আটকে গেল। ঠোঁটগহ্বর থেকে জ্বিভটা আর বের হওয়ার জোর পেলো না আর। ঘোলা চোখে চেয়ে রইল কিয়ৎক্ষণ। জবা উৎকণ্ঠিত হয়ে বললেন,
‘ কী রে, তাই কী? বল কিছু ।’

পুষ্প অবসাদগ্রস্ত ভারী চোখ নামিয়ে নিলো। ভারা*ক্রান্ত মন চে*পে রেখে, মন্থর বেগে ওপর নীচে মাথা দোলাল। নিরবে বোঝাল ‘ হ্যাঁ ‘।
পিউ বিহ্ববল হয়ে দেখে গেল তা।
ধূসর হেসে বলল ‘ গুড।’

বিস্ময়ে পিউয়ের মাথা চক্রের ন্যায় ঘোরে। একবার পুষ্পকে দ্যাখে, একবার ধূসরকে। এরা দুজন এরকম করছে কেন? ধূসর ভাই সব জেনেশুনেও বা….

আমজাদ সূক্ষ্ণ হাসছিলেন। ধূসরের মুখে ‘ গুড’ শুনতেই হাসিটা উবে গেল। ভীষণ অবাক হলেন। মেয়েকে বলা কথাখানা তিনি যে ইনিয়ে-বিনিয়ে ওকে খোঁচা মা*রতে বলেছেন,ছেলেটা কি বোঝেনি? এত নির্বোধ তো সে নয়। বুঝলেও হাসল কেন তাহলে ?
তিনি নিজেই ভ্রান্তিতে তলিয়ে গেলেন। কূল পেলেন না ধূসরের রহস্যের।

মিনা বেগম ঘুরে এসে স্বামীর পাশে বসলেন। হাত নাড়িয়ে স্ফূর্ত কণ্ঠে বললেন,
‘ তবে না হয় ভালো দিনক্ষণ দেখে, আংটি বদলের দিনটাও পাঁকা করব? কী বলিস ধূসর?’
ধূসর বলল ‘ করো।’

রুবায়দা পিরিচে মিষ্টি নিয়ে হাজির। আমুদে গলায় বললেন, ‘ তার আগে সবাই মিষ্টিমুখ করো দেখি। নে জবা তুই আগে খা।’
বলতে বলতেই একটা আস্ত রসগোল্লা ঠুসে দিলেন তার মুখে। সবাই হেসে ফেলল।

হৈহৈ পরিবেশ থেকে অকষাৎ পুষ্প উঠে দাঁড়াল। কাউকে কিছু না বলে ঘরের দিকে রওনা হলো। জবা বেগম হেসে বললেন,
‘ লজ্জা পেয়েছে!’
সাদিফের কাপের চা শেষ হচ্ছেনা আজ। হাতল ধরা আঙুল গুলোও হালকা, পাতলা কম্পমান। তবুও বাইরে থেকে তার সাদাটে চিবুক পাথরের ন্যায় শক্ত,উদ্বেগহীন।

পিউ বোনের যাওয়ার দিকে বেদ*নাদায়ক, সহায়হীন চোখে চেয়ে থাকে। ধূসরের দিক ফিরতেই দেখল সে শান্ত নজরে তার দিকেই তাকিয়ে। ঠোঁটের ভাঁজে মিটিমিটি, পুরুষালি হাসিটা পিউয়ের মেজাজ খা*রাপ করল। নাকমুখ কোঁচকাল সে। এতদিন পেছনে,মনে মনে ধূসরকে হাজার হাজার ভেঙচি কে*টেছে । কিন্তু আজ,মাথাটা গরমে দাউ*দাউ করে জ্ব*লছে। প্রবল সাহসে বুকটা ফুলে ওঠে তার। ধূসরের মুখের ওপর ভেঙচি কে*টে চেহারা ঘুরিয়ে নেয়। হনহন করে নিজেও প্রস্থান নেয় বোনের পিছুপিছু।

চলবে,

#এক_সমুদ্র_প্রেম!
লেখনীতে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
( ৩৪ এর বর্ধিতাংশ)

বসার ঘরে হল্লাহল্লি চলছে। বড়দের প্রফুল্ল আওয়াজ বাড়ির প্রতিটি কোনায় ভেসে বেড়ায়। এখনই বসেছেন বিয়ের আলাপে। সামনে কী করবেন, কীভাবে সবটা গোছাবেন,এই আলোচনায় পরিবেশ মুখরিত।
পুষ্প বহু ক*ষ্টে ঘর অবধি এলো। তার পা চলছে না। এতটা ভারি হয়ত পাথরখন্ড ও হয়না। গলবিলে দলা পাঁকানো কা*ন্নার পরিমান হুহু করে বাড়ছে। কত ক*ষ্টে এতটা সময় চে*পে রেখেছে কেউ জানেনা।
চৌকাঠ পেরিয়ে কক্ষে ঢুকতেই চোখ ছাপিয়ে বেরিয়ে এলো তা। বর্ষার ন্যায় মুষলধারে ঝরে পরলো গালে। ঝরঝর করে, গা ভে*ঙে কেঁ*দে ফেলল সে।
ইকবাল ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে? এ দুঃস্বপ্নেও ভাবা যায়না। একজন কে ভালোবেসে,তার প্রতি হৃদয় সপে, আরেকজন কে জীবনে বরন করা যায়? এতটা দুর্বোধ্য অনলে পু*ড়ে নিজের অন্ত ডাকার সাহস তার নেই।
ইকবালের চিত্তচাঞ্চল্যকর মুখমণ্ডল মানস্পটে হানা দেয় তখন। তার ওষ্ঠে বুলির মত আওড়ানো ‘ মাই লাভ ‘ শব্দটা উর্মির মত কানে বাজে। পুষ্পর কা*ন্না বাড়ে। শব্দ বের হয় মুখ দিয়ে। হাত দিয়ে চে*পে রাখার প্রয়াস চালায় কিছুক্ষণ। ব্যর্থ সে,অপারগ। এত কা*ন্না কেন পাচ্ছে? কেন ঝরছে এত অশ্রু? মনের বিরুদ্ধে গিয়ে মত দিয়েছে বলে? ইকবাল টাকে ঠকালো বলে?
পুষ্পর বুক ধ্বক করে ওঠে , আজ দুপুরের কথাগুলো মনে করতেই।
ইকবালের হাতে হাত রেখে সে যে কথা দিয়েছিল,কোনও দিন ছেড়ে যাবেনা? তাহলে কী করে রাজী হয়ে গেল তখন? কেন প্রতিবাদ করল না? পুষ্প নিজেকেই ধিক্কার জানায়। সাহস নিয়ে তাচ্ছ্যিল্য করে। ইকবাল তো যেচে ভালোবাসেনি। সে বেসেছে,অনুরক্তির ধুমজাল বিছিয়ে ওকেও বাধ্য করেছে প্রেমে পরতে। ইশ! সে মানুষটা যখন জানবে এসব,কীভাবে সহ্য করবে? কীভাবে?
পুষ্প বালিশের ওপর আছড়ে পরে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উগলে দেয় অশ্রু। সাদা কভারটা ভিজে যায়,হয় চুপচুপে।

পিউয়ের ছোট্ট মুখটা আরো কয়েকধাপ সংকুচিত এখন। কোটর চিকচিক করছে জলে। দরজার এপাশে সে স্তম্ভের মতন দাঁড়িয়ে। নিরব চাউনীতে দেখে যায় বোনের হুতাশন ভরা কা*ন্না৷ খুব ইচ্ছে হয় একবার কাছে যেতে। যাবে কী? পিউ এক পা বাড়াল,পরমুহূর্তে কী ভেবে ফিরিয়ে আনল কদম। তার মস্তিষ্ক চিন্তায় ফাঁটছে। মাথাব্য*থা উঠেছে অনুচিন্তনের দাপা-দাপিতে। কপালের শিরা দপদপ করছে।
আজ যদি ওর অন্য কোথাও বিয়ে ঠিক হতো? ধূসর ভাইকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করার কথা ভেবেই তার ক্ষুদ্র চিত্ত আঁ*তকে ওঠে। দম আটকে যায়। সেখানে আপুর অবস্থা না জানি কী!

পিউয়ের সবটুকু রা*গ ওই মানুষটার ওপর বর্তাল। যে সব জেনেও চুপচাপ মেনে নিলেন। কেন? এমনি সময় তো মুরুব্বিদের মধ্যেও বুক ফুলিয়ে কথা বলে। সেবার গ্রামে? মা*রপিট করেও গর্ব করে বলে বসল ‘ দরকার পরলে আবার মা*রব।’
আজও কি ওরকম একটু সাহসিকতা দেখানো যেত না? তার আপু যে কোনঠাসা হয়ে সবার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে সে ছোট মানুষ হয়েও বুঝতে পারছে। তাহলে ধূসর ভাইয়ের মত একটা দা*মড়া ছেলে, সে কী বোঝেনা এসব?

পিউয়ের বড় বড় চোখ দুটো ভীষণ ক্ষো*ভে জ্ব*লে ওঠে। দুঃসাহসের তোপে শুকনো শরীর ওঠানামা করে। আজ একটা হেস্তনেস্ত করবে সে। ভ*য় পেলে হবেনা, জানতেই হবে ধূসর ভাই এমন কেন করলেন? ইকবাল ভাইয়ের ভালোবাসা পাইয়ে দেয়া কি ওনার দায়িত্ব নয় না কী? ওনার না বেস্টফ্রেন্ড? এই তার নমুনা?

পিউ দোতলার করিডোর থেকে একবার বসার ঘরে উঁকি দিলো। ধূসরের বসা, একেকবার একেক জনের দিক বিক্ষি*প্ত চাউনী,মাঝেমধ্যে পাতলা অধর নড়ে নিঃসৃত হওয়া বাক্যবাণ, পাকোড়া চিবানোর ধরন হারিয়ে দিলো খেই। ক্ষো*ভ যেন তুষারের ন্যায় গলে গেল। রা*গঢাক বদলে গেল মুগ্ধতায়। এই মানুষটাকে এত অসাধারণ হতে কে বলেছে? এমন প্রলুব্ধ মানবের ওপর রা*গ করার সাধ্যি তার নেই।

পিউ ঠান্ডা হলো খানিক। তবে সিদ্ধান্ত অপরিবর্তিত। ঘটনা সে জেনেই ছাড়বে। হয়ত রা*গের বদলে, শান্ত মাথায়। এখন তো ধূসর ভাই সবার মাঝে বসে, তাকে অপেক্ষা করতে হবে। পিউ আরেকবার বোনের ঘরের দিকে চায়। পুষ্প এখনও কাঁ*দছে, সে জানে। তবে শব্দশূন্য, আওয়াজহীন।
সে নিঃসহায় শ্বাস ফ্যালে। বাড়ি জুড়ে এত কাহিনী ঘটছে, আর এই সময়েই পরীক্ষা! কোনটা রেখে কোনটায় মনোযোগ দেবে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে। মাঝেমধ্যে নিজের জন্যেই মায়া হয়, একটা বাচ্চা মানুষের পক্ষে মাথায় এত প্রেশার নেয়া সম্ভব?

বসার ঘরের রমরমে আড্ডার শেষ নেই। একেকজনের মুখে হাসি যেন ধরছে না। অন্যদিনে এই হাসিখুশি, উৎফুল্ল পরিবার পিউয়ের মন প্রশান্ত করে। অথচ আজ কেমন অস*হ্য লাগছে। দুটো মানুষকে কাঁ*দিয়ে খুশি থাকার মানে হয়না। এসব আনন্দ নিরর্থক।
পিউ প্রতীক্ষা করছে এই সভা ভঙ্গের। ধূসর কখন ওপরে আসবে, কখন জিজ্ঞেস করবে, উতলা সে।
সাদিফ পুরো কাপের চা খালি করেছে। পরপর মাকে বলেছে আরো এক কাপ রং চা আনতে। একেবারে গাঢ় লিকারের। কোনও রকম চিনি দেয়ার নিষেধাজ্ঞা সেখানে। জবা একটু অবাক হলেন। সাদিফ তুলনামূলক মিষ্টিপ্রিয় ছেলে। তার হঠাৎ এমন আবদার বিভ্রান্ত করল ওনাকে। কিন্তু কথা বাড়ালেন না।

চা বানিয়ে এনে হাতে দিলেন। সাদিফ নিষ্পৃহ ভঙিতে চুমুক দিলো। তিঁতকুটে চা শেষ করল চোখের পলকে। বিস্বাদে একটুও নাকমুখ কোঁচকাতে দেখা গেল না।
সমস্তটা খেয়ে,তবেই উঠে দাঁড়াল। ‘ঘরে যাচ্ছি’ বলে সিড়িতে পা রাখল। কেউ কিছু বলে না। সে আলগোছে এগিয়ে যায়।

রুমের কাছাকাছি এসে পিউকে দেখে দাঁড়াল সাদিফ। পিউ ও তাকিয়েছে তখন। সাদিফ কিছু একটা ভাবল। চোখের চশমাটা খুলে এগিয়ে দিল হঠাৎ। খুব ধীর-স্থির কণ্ঠে বলল
‘ একটু মুছে দে তো। ঝাপ্সা হয়ে গিয়েছে।’
পিউ দ্বিরুক্তি করে না। বাধ্যমেয়ের মত চশমা এনে ওড়না দিয়ে মুছতে থাকে। তার গভীর মনোনিবেশ যখন সেখানে ব্যস্ত,সাদিফের বরফ দৃষ্টি লুটোপুটি খায় ওর মুখেতে। নিখাঁদ, পূর্ন চোখদুটো এক ধ্যানে দেখে যায় তাকে। পিউয়ের নাক,ঠোঁট, ভ্রুঁ, গাল, সব কিছু এঁকে নেয়,মুখস্থ করে। বক্ষ অশান্ত,দুরন্ত। মন্তঃস্তাপ প্রতিটি পলকে। পিউ তাকানো মাত্র হিঁচ*ড়ে সরায় নেত্র। চেহারা ঘোরায় অন্য কোথাও। মুখমণ্ডলে ফুটিয়ে তোলে বিরসতা।
পিউ অতশত খেয়াল করেনি। সে চশমা এগিয়ে বলল,
‘ নিন।’
সাদিফ না তাকিয়েই ধরল। আর একটি কথাও বলল না। নিঝুম প্রস্থান নিলো। তবে যেতে যেতে মনে মনে আওড়াল,
‘ এই চশমা মোছার দায়িত্বটা আজীবনের জন্যে তোকে দিতে চেয়েছিলাম পিউ। হলোনা বোধ হয়! ‘

***
অপেক্ষার অবসান হচ্ছেনা। উলটে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পা ঝিম ধরে যাচ্ছে। মেরুদন্ডের হাড়ে অনুভব হচ্ছে চিনচিনে ব্য*থা। পিউ বির*ক্ত হলো। অধৈর্য সে। যদি পারতো, ধূসরকে ডেকে ওপরে আনতে? ওখান থেকে টেনে তুলতে? ইশ!
সেই ক্ষনেই চট করে মাথায় উদয় ঘটল নতুন বুদ্ধির। পিউ তৎক্ষনাৎ সোজা হয়ে দাঁড়াল। ছুটে গেল নিজের ঘরে। ফোন এনে ফিরে এলো আগের জায়গায়। ধূসরের নম্বরে কল দিলো ঝটপট ।
ফোন বেজে উঠল তার কামড়ায়। পিউ হতাশ হয়। নিরাশায় কান থেকে নামিয়ে ঠোঁট ওল্টায়। পরপর আবার এক বুদ্ধি পেতেই মুখবিবর চকচকে হলো। তক্ষুনি গলা উঁচিয়ে ডাক ছুড়ল,
‘ ধূসর ভাই!’
সে তাকানোর সাথে সাথে বাকীদের দৃষ্টিও ক্ষেপণ হলো। এত জোরা চাউনী ক্ষানিক গুঁটিয়ে দেয় তাকে। তবুও সে দমে না। ধূসরকে উদ্দেশ্য করেই বলল,
‘ আপনার ফোন বাজছে। ‘
ধূসরের চোখেমুখে আগ্রহ দেখা গেল না। নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলল
‘ বাজুক।’
পিউ ভ্রু কোঁচকায়। বাজুক মানে? এটা কোনও কথা হলো?
সে দ্বিগুন ছট*ফট করে ওঠে। ফটাফট মিথ্যে বলে,
‘ ইকবাল ভাই ফোন করেছেন। অনেকক্ষণ ধরে করছেন দেখছি।’

এই বুদ্ধিটা কাজে লাগে। ধূসর শোনামাত্র উঠে এলো সেখান থেকে। পিউয়ের অধর ভরল জয়ের হাসিতে। আমজাদ সিকদার নাকচোখ গুঁটিয়ে বসে রইলেন। এই ইকবাল হতচ্ছাড়াটাই সব ন*ষ্টের মূল। একটা পারিবারিক আলোচনার মধ্যেও এর ফোন করতে হবে?

ধূসর সোজা নিজের ঘরে যায়। পিউ ত্রস্ত এগোলো তার পেছনে। ধূসর টেবিলের ওপর থেকে ফোন তুলে হাতে নেয়। ভাবল,কল কে*টে গিয়েছে,ব্যাক করবে। স্ক্রিন জ্ব*লতেই ‘মিসডকল ফ্রম পিউ ‘লেখা ভেসে উঠল। ধূসরের ভ্রুতে ভাঁজ পরল। কললিস্ট চেক করে ইকবালের সম্প্রতি কোন কল পেলোনা। এর মানে পিউ মিথ্যে বলেছে? তার মেজাজ খারা*প হলো ওমনি। চিবুক শ*ক্ত করল। পুঁচকিটাকে কয়েকটা কড়া কথা শোনাতে ঘুরতে গেল, তখনি ওপাশ থেকে চঞ্চল পায়ে এসে দাঁড়াল পিউ। নাকটা মুহুর্তে ঠু*কে গেল তার বুকের সাথে। পিউ পিছিয়ে এলো খানিক। চোখ ঝাপ্টে ধাতস্থ হলো। ধূসরের শৈলপ্রান্ত বেঁকে আছে। ভ্রুঁ একসাথে গোছানো।

‘ কী মানে এসবের?’
তার নিম্নভার,রুদ্রপ্রতাপ কণ্ঠে পিউ জড়োসড়ো হল। সদাজাগ্রত নজরে তাকাল।

‘ মিথ্যে বলেছিস কেন?’

পিউয়ের নিষ্পাপ জবাব,
‘ কী করব? অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি,আপনার কথাই শেষ হয়না। উঠছিলেনই না ওখান থেকে। তাই জন্যেইত…..’

ধূসরের কপালের ভাঁজ শিথিল হলো। বিদ্বিষ্ট চাউনী গভীরতা পেল। কয়েক সেকেন্ডে যা ছুটে গেল পিউয়ের স্নিগ্ধ,ললিত চেহারা জুড়ে।

পিউ বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল,
‘ আপু খুব কাঁ*দছে ধূসর ভাই। ‘
সে ছোট করে বলল ‘ ও।’

নিরুৎসাহিত উত্তরে, পিউ আশ্চর্য হয়ে বলল ‘ ও মানে? আপনি কিছু বলবেন না?’
‘ কী বলব? ও কাঁ*দছে,এখানে বলার কী আছে?’
পিউ হা করে বলল,
‘ কিছু নেই?’
‘ না।’

পিউ রুক্ষ ধাতে বলল,
‘ এটা কোনও কথা হলো ধূসর ভাই?’
ধূসর চোখ ছোট করতেই তার চিবুক গিয়ে গলদেশে ঠেকল। ভদ্র,মৃদূ কণ্ঠে বলল,
‘ না মানে,আপনি আমি দুজনেই জানি,আপু আর ইকবাল ভাইয়া একে অন্যকে পছন্দ করেন। বিয়েতে আপু রাজী না। তাও…. ‘

ধূসর পথিমধ্যেই কথা কে*ড়ে নিয়ে বলল,
‘ কীভাবে জানলি? পুষ্প তোকে বলেছে?’
পিউ তাকায়।
উত্তর দেয়,
‘ বলেনি। আমিত জানি। আপনিও তো জানেন।’
‘ ওরা জানিয়েছে আমাদের?’
জলদগম্ভীর স্বরে, পিউ দুদিকে মাথা নেড়ে বলল ‘না।’

‘ ওরা আমাদের জানায়নি,আমরা নিজেদের মত করে জেনেছি। জানি যে পুষ্প রাজী নয়। কিন্তু একে অন্যকে ভালোবেসেছে ওরা,তাই সবাইকে সত্যি জানানোর দায়বদ্ধতা ওদের পিউ। তোর বা আমার নয়।’

‘ কিন্তু…. ‘
ধূসর হাত উঁচু করল। পিউ থেমে যায় ওখানেই। সে বলল,
‘ পুষ্পকে আমি সময় দিয়েছি,সুযোগ দিয়েছি। সবার সামনে ওকে জিজ্ঞেস করেছি সে রাজী কীনা। ও যদি একবার না বলতো,বাকীটা আমি সামলাতাম। কিন্তু সে বাবার বাধ্য মেয়ে। বলে বসল ‘হ্যাঁ’। বোকা মেয়ে বুঝলোইনা,তোর বাবা ওসব কথা আমাকে শোনাতে বলেছেন।’

পিউ অবাক চোখে তাকাতেই বলল,
‘ কাকে কী বলছি, তুইত আরেক নির্বোধ।”
পিউ ঠোঁট ফুলিয়ে বলল ‘ আমি কী করলাম?’

ধূসর সে কথার জবাব দিলোনা। সুদৃঢ় গলায় বলল,
‘ পুষ্প,ইকবাল কেউই আমাকে বলেনি তাদের সম্পর্কের কথা। তাদের মতে আমি কিছুই জানিনা। তাই যতক্ষণ না ওরা নিজেরা এসে আমাকে জানাবে,আমি এরকমই থাকব। নির্লিপ্ত, চুপচাপ। ওরা যদি আমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ না করে,তাহলে যা ভালো বোঝে করুক। আমি এসবে নেই,আর তুইও থাকবি না। ‘

পিউ আগ্রহভরে শুধাল,
‘ আর যদি জানায়, তখন?’
ধূসর কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,
‘ আমাকে ভরসা করিস?’
পিউ বিলম্বহীন মাথা দোলাল।
করে না মানে? বাবা মায়ের পর এই মানুষটাকে সবথেকে বেশি ভরসা আর বিশ্বাস তার। অন্ধ যেমন একজন অচেনা মানুষের হাত ধরে রাস্তা পার হতে শেখে? একটা তুলতুলে শিশু যেমন মায়ের মুখ থেকে শুনে দুনিয়া চিনতে শেখে? এই ভরসা হয়ত তারও উর্ধ্বে।
ধূসর বলল,
‘ তাহলে নিশ্চিন্ত থাক। যা হবে,খা*রাপ হবে না৷ ‘

এই এক বাক্য অচিরেই দূর করল পিউয়ের সকল অস্থিরতা,উদ্বীগ্নতা।
তার ওষ্ঠপুটের মৃদূমন্দ হাসি,আর মুখস্রীতে অকংপিত চিহ্নটা ধূসর সূচালো,একাগ্র চিত্তে দেখল। পরোখ করল এক কথায়। ততোধিক শান্ত গলায় বলল,
‘ কাল পরীক্ষা রেখে ঘুরে বেড়াচ্ছিস কেন? পড়াশুনা নেই তোর? দিনে একবারও বইয়ের আশেপাশে দেখিনা তোকে। ফেল করার ইচ্ছে আছে?”

অলঘু কণ্ঠ পিউয়ের ধ্যান ভা*ঙায়। হাসি মিলিয়ে তটস্থ হয়। জবাব দেয়,
‘যাচ্ছি।’
সে মোটামুটি নিরুপদ্রব এখন। ধূসর ভাই যখন বলেছেন,তিনি নিশ্চয়ই কিছু করবেন। শান্তিপূর্ণ মন নিয়ে উল্টোপথে হাঁটা ধরল পিউ। দরজা অবধি গিয়ে আবার ফিরে তাকাল।
ডাকল ‘ ধূসর ভাই?’
‘হু।’
‘ একটা কথা বলতাম।’
‘ কী?’
‘ ইয়ে,ইকবাল ভাইকে জানাব,আপুর বিয়ে ঠিক হয়েছে যে?’
তার ক্ষুদ্র জবাব ‘ ইচ্ছে।’
পিউ মাথা দোলাল। হাঁটতে গিয়ে কী একটা ভেবে আবার থামল। ঘুরে চেয়ে দেখল ধূসর সেখানেই দাঁড়িয়ে, এদিকেই তাকিয়ে।
সে মনঃদ্বিধা নিয়ে বলল,
‘ না থাক। আপনিই জানিয়ে দিন। আমার দ্বারা হবে না।’

ধূসরের হাসি পেলো পিউয়ের মুখ দেখে। অথচ ভারী গলায় বলল ‘ ঠিক আছে, যা।’
পিউ আবার মাথা দুলিয়ে চলে গেল। বরাবরের মত ওই পথে গেঁথে রইল ধূসরের অবিচল,অনিমেষ, তৃষ্ণাতুরা চক্ষুদ্বয়।

***
পিউ পড়ার টেবিলে বসলেও তার মনোযোগ নেই। ইংলিশ ফার্স্ট পেপার বলে আগ্রহ ও কম। সে ইংরেজিতে ভালো,বলা বাহুল্য যথেষ্ট ভালো। আগে যা পড়েছে ওতেই হবে।
পিউ কলমের গোড়া দিয়ে মাথা চুল্কাল কিছুক্ষন। উশখুশ লাগছে। খচখচ করছে মনের মধ্যে। ইকবাল কে ফোন করবে ভেবেও করেনি। এরকম দুঃসংবাদ কী করে দেবে সে? ভাইয়া কতটা ক*ষ্ট পাবে তার কী জানা নেই ? এতটা নি*ষ্ঠুর সে নয়। ওসব ধূসর ভাই করুক গে। তার বন্ধুকে তিনিই সামলাক।

পুষ্প-সাদিফের ব্যাপারটা যতবার ভাবছে ততবার মন খারা*প হচ্ছে তার। বইয়ের পৃষ্ঠায় জাগছে বিতৃ*ষ্ণা। একবার চাইছে,সাদিফকে গিয়ে জানাবে সব। পরক্ষনেই ধূসরের কথা মনে করে থেমে যাচ্ছে।
নিজের প্রতি অস*ন্তোষ ভঙিতে মাথা নাড়ছে। বিমুখ হয়ে খাতায় আঁকিবুঁকি করছে। তবুও লাভের লাভ হচ্ছেনা। ঘুরেফিরে প্রশ্ন করছে মনটা ‘ কীভাবে কী হবে?’
শেষে শ্রান্ত ভঙিতে মাথাটাকে টেবিলের ওপর এলিয়ে দিলো পিউ। যা হওয়ার হোক। পৃথিবী উলটে যাক,ভঃ*স্ব হোক। যতক্ষণ না ধূসর ভাই কিছু করবেন,সে নিজেও থাকবে নীরব দর্শক।

**
ইকবাল ফোন করে করে ক্লান্ত,অবিশ্রান্ত। বিপ*ন্ন হস্তে শেষ বার চেষ্টা করল,রিসিভ হলো না। তার অস্থিরতা বাড়ল ক্রমশ। পুষ্প ফোন ধরতে দেরি করলেও একদম ধরেনা এরকম ঘটেনি আগে। তাদের তো ঝগ*ড়াও হয়নি। তবে রিসিভ হচ্ছেনা কেন? ঠিক আছে তো মেয়েটা?
ইকবাল দ্রুত হাতে আবার চেষ্টা করল। এবারেও একই ফল। শেষে রে*গেমেগে ফোনটাকে বিছানায় ছু*ড়ে ফেলল সে। সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে চলল বারান্দায়।

পুষ্প সাদিফের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে। তার মুখটা এইটুকুন। বুকটা জড়োসড়ো ভ*য়ে। তবুও চমৎকার এক আশা পুষে এখানে হাজির হয়েছে। ভাইদের মধ্যে সাদিফের সঙ্গে তার নৈকট্য বেশি। বয়সের গ্যাপ কম হওয়ায় একে অন্যকে বোঝেও ভালো। সাদিফ ভাইয়াকে সব জানালে তিনি নিশ্চয়ই একটা কিছু করবেন। সেজো মাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজী করাবেন বিয়ে আটকাতে। এটুকু ভরসা ওর আছে।
এই আশ্বাসেই পুষ্প কা*ন্নাকা*টি থামিয়ে এখানে উপস্থিত হলো। ভেতরটা তবুও কাঁ*পছে অজানা আশ*ঙ্কায়। বুক ধড়ফড় করছে খুব। সবটা ভালোয় ভালোয় হবে তো?

সে দোরের পৃষ্ঠে টোকা দিতে গেল,ওপাশ থেকে আগেই খুলে যায় সেটা। সাদিফও তখন বের হচ্ছিল। দুজন আকষ্মিক দুজনের সামনে পরায় মৃদূ চমকাল,হতভম্ব হলো।
একে অপরের মুখ দেখেই যত্র গাঢ় অস্বস্তিতে ডুবে গেল। নিজেদের বিয়ের আলাপ,নিজেদেরই সামনে হওয়ায় এই স্বস্তিহীনতার সীমা নেই। ছোট বেলা থেকে যারা নিজেদের ভাই-বোন জেনে এসেছে তাদেরই বিয়ে?
পুষ্প চোখ নামিয়ে নিলো। সাদিফ সামলালো তার অপ্রতিভ অভিব্যক্তি। স্বাভাবিক হয়ে শুধাল,
‘ তুই হঠাৎ? ‘
পুষ্প ওমন নীচে চেয়েই বলল ‘ একটু কথা ছিল।’

‘ ভেতরে আয়।’
সাদিফের পিছু নিয়ে সে ঘরে ঢুকল। খোলা দরজাটা হাত দিয়ে আস্তে করে চাপিয়ে দিল।
‘ বোস।’
‘ না,ঠিক আছি।’
‘ কী বলবি?’
পুষ্প ঘামছে। কপাল গড়িয়ে দু এক ফোটা পরছেও গলায়। ঢোক গি*লছে বারবার। কোত্থেকে শুরু করবে বুঝে উঠছেনা। সাদিফ তা*ড়া দিল,
‘ কী? বল!’
পুষ্প শ*ক্ত হলো খানিক। মস্তিকে সাজিয়ে,গুছিয়ে আনা বাক্যসংলাপ আরেকবার আওড়াল।
প্রচন্ড মিহি কণ্ঠে বলল,
‘ আমি বিয়েটা করতে চাইনা ভাইয়া।’
সাদিফের কর্নকুহর হলোনা। বলল,
‘ আরেকটু জোরে বল।’
পুষ্প তাকাল। জ্বিভে ঠোঁট চেটে বলল,
‘ এই বিয়ে করা আমার পক্ষে অসম্ভব।’

‘ কেন?’
সাদিফের উদ্বেগশূন্যতা, পুষ্পর সব গুলিয়ে দেয়। ভী*ত হয় সে।
সাদিফ নিজে থেকেই জানতে চাইল,
‘ কাউকে পছন্দ করিস?’
পুষ্প মাথা নামিয়ে নেয়,তবে ওপর নীচে দুলিয়ে বোঝায় ‘ হ্যাঁ। ‘
সাদিফের শান্ত স্বর ‘ কাকে?’
পুষ্পর গলা কাঁ*পছে খুব। ইকবালের নাম নিতে আতঙ্কে থরথর করছে ভেতরটা। এরপর কী হবে ভেবে শ*ঙ্কিত সে।
কিন্তু না জানিয়ে উপায়ও যে নেই। এই পরিস্থিতি থেকে নিস্তার পাওয়ার এটাই পথ।
প্রগাঢ় ভ*য়ডর বুকে চে*পে,
রুদ্ধশ্বা*সে সে জানাল ‘ ইকবাল কে।’

সাদিফ অবাক হলো। চেহারায় পরিষ্কার ফুটে উঠল চিহ্নটা। তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল ‘ ধূসর ভাইয়ার বন্ধু ইকবাল?’

পুষ্পর গ্রাস তরতরিয়ে বাড়ে। বক্ষস্পন্দন জোড়াল। তার মৌণতা সাদিফকে উত্তর বুঝিয়ে দেয়। সে রাশভা*রি গলায় প্রশ্ন করে,
‘ কবে থেকে? ‘
‘ দু… দু বছর।’
সাদিফ একটু ভেবে শুধাল ‘ ভাইয়া জানেন?’
তার ত্রাসিত জবাব,
‘ না।’
‘ এখন আমাকে কী করতে বলছিস?’
পুষ্প চট করে তাকায়। চেহারায় উঁকি দেয় অল্পস্বল্প আশার আলো। সাদিফের প্রতি তার অমায়িক আস্থা,বিফলে যাবেনা নিশ্চয়ই?
সে আকুল স্বরে অনুরোধ করল,
‘ সেজো মাকে একটু বুঝিয়ে বলোনা ভাইয়া। তুমি বললে আব্বুও শুনবেন। আমি ইকবালকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করতে পারব না। ‘

সাদিফের চেহারায় পরিবর্তন হলো না। সে চুপ করে তাকিয়ে আছে। বাইরে থেকে ভেতরটা বুঝে ওঠা মুশকিল।
পুষ্পর ব্যগ্র চাউনী। বক্ষঃপিঞ্জর আন্দোলিত। সাদিফের অভিপ্রায় বুঝতে অক্ষম মস্তক।
সেই মুহুর্তে শোনা গেল তার তপ্ত শ্বাস আ*ছড়ে আসার শব্দ। সাদিফ দীর্ঘকায় নিঃশ্বাস নিলো।
পরপর বলল,
‘ সমস্যাটা তোর পুষ্প,আমার নয়। তাই যা করার,যা বলার তুই বল। আমার থেকে কিছু আশা করিস না।’

পুষ্প মাথায় বাঁ*জ পরল। বিস্ময়াকুল সে। হৃদয় ভে*ঙে খান*খান হয়। আলোকশ্যূন্যতায় ছেঁয়ে যায় অন্তঃস্থল। লোঁচন থেকে ঠিকড়ে গড়ায় দুফোঁটা জল। নৈরাশ্যে পিছিয়ে গেল এক পা। মর্মাহ*ত কণ্ঠে বলল,
‘ এর মানে তুমি কিছু করবে না?’
সাদিফ অকপটে বলল,
‘ না। বড়দের ওপর কথা বলা, আমার ধাঁচে নেই। তুই বিয়েটা ভা*ঙতে পারলে আমার আপত্তি নেই,তবে নিজে কিছু করতে পারব না। সরি!

পুষ্পর চোখেমুখে অবিশ্বাস। ছোট বেলা থেকে চিরপরিচিত সাদিফ ভাইকে আজ অজ্ঞাত,অচেনা মনে হচ্ছে। এ কেমন মানুষ তার সম্মুখে? পুষ্পর ঝাপ্সা নেত্র অচিরাৎ ক্রো*ধিত হলো। অক্ষিপট দপ করে জ্ব*লে উঠল রু*ষ্টতায়। শান্ত,সংযত মুখমণ্ডল শ*ক্ত হলো ভীষণ।
একেবারে মুখের ওপর,সরাসরি বলে বসল,
‘ তুমি খুব স্বার্থ*পর সাদিফ ভাই। তোমার মত স্বার্থ*পর মানুষ, আমাদের এই সুন্দর পরিবারের জন্যে বিষা*ক্ত। আমারই ভুল,মিথ্যে আশা নিয়ে তোমার কাছে আসা। নিজের সময় ন*ষ্ট করে আমি অনুতপ্ত। ‘

সাদিফ নিরুত্তর। টু শব্দ করল না। তর্কে গেল না। পুষ্প ক্রো*ধে গজগজ করে বেরিয়ে গেল। দেয়ালে দরজা ফেলার শব্দটা বিক*ট হলেও পা থামেনি তার। সাদিফ পুনরায় দম ফেলল। ভ্রুঁ কুঁচকে এগিয়ে গেল বিছানায়। তার নির্জীব ভাবভঙ্গি, যেন পুষ্পর কথায় যায় এলোনা। চশমা খুলে,আলো নিভিয়ে,গায়ে কম্বল পেঁচিয়ে চুপচাপ শুয়ে পরল সে। প্রস্তুতি নিলো একটি চমৎকার নিদ্রার।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here