#এক_সমুদ্র_প্রেম!
লেখনীতে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(১৭)
‘ উনি? উনি কে?’
শান্তা নাজুক স্বরে জানাল ‘ ধূসর ভাই।’
হাবভাব দেখে পিউয়ের মাথা গরম হয়। নামটা বলার সময় এত লজ্জ্বা পাওয়ার কী আছে? কোমড়ে হাত দিয়ে বলল,
‘ উনি কী? ভাইয়া বলতে পারিস না?’
শান্তা বিরক্ত হলো। ভ্রুঁয়ে ভাঁজ পরলেও উত্তর করল না। পিউ যেতে নিলে নিরবে আবার বাঁ*ধা দিলো। পিউ রে*গে তাকায়। পরপর চোখ বন্ধ করে শ্বাস টেনে বলে,
‘ উনি কি তোকে পাহাড়াদার রেখেছেন?’
‘ না,কিন্তু এখন কাউকে যেতে মানা করলেন।’
পিউ দৃষ্টি সরু করে বলল,
” তোকে বলতে বলেছে?”
শান্তা মাথা দোলাল। পিউ ঠোঁট গোল করে শ্বাস ফেলে বলল,
” বলেছিস,শুনেছি। এখন সর,যেতে দে।’
শান্তা শুনলনা। উলটে ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
‘ গেলে উনি রা*গ করবেন।’
‘ আশ্চর্য! করলে আমার ওপর করবেন। তোর তাতে কী? ‘
‘ ভালোর জন্যে বলছি,শুনছোনা।’
‘ শুনবওনা। ধূসর ভাই যদি পুরো দুনিয়াটাকেও পাহাড়া বসান,ওনার কাছে যাওয়া থেকে আমাকে আটকাতে সফল হবেনা। ”
শান্তার রা*গ হলো। পিউ বয়সে বড় দেখে মুখের ওপর কিছু বলতে পারল না। বললেও কী সে তোয়াক্কা করবে? পিউ ওকে ঠেলেঠুলে ওপরে উঠতে নেয় । এর আগেই ওপাশ থেকে নেমে এলো ধূসর। থেমে গেল পিউ। ধূসর দুজনকে দেখেও এড়িয়ে গেল। পাশ কা*টিয়ে নেমে যেতেই পিউ পেছন পেছন ছুটল। শান্তা দাঁড়িয়ে থাকল সেখানে।
” আপনি কি আমার সাথে রা*গ করেছেন ধূসর ভাই?”
নামতে নামতে উদ্বিগ্ন স্বরে প্রশ্ন ছুড়*ল পিউ। ধূসর থামল না। চলতে চলতে জবাব দিল,
” না।”
পিউ বুক ভরে শ্বাস নেয়। খুশি হয়ে আওড়ায়,
” তাহলে ঠিক আছে।
ধূসর থেমে দাঁড়ায় হঠাৎ। ঘাঁড় বাঁকা করে চেয়ে বলে,
‘ কিচ্ছু ঠিক নেই।সময় এলে তোকে বোঝাব।’
‘ কী বোঝাবেন?’
ধূসর অর্থটা আর ভে*ঙে বলেনা। শব্দ যুক্ত পায়ে নেমে যায়৷ পিউ বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়ে থাকে। মাথায় ঘুরছে ‘সময় এলে তোকে বোঝাব ‘ কথাটা। কবে আসবে সময়?
******
লীলাবালি লীলাবালি,
বড় যুবতি সইগো,
বড় যুবতি সইগো,
কী দিয়া সাজাইমু তরে…!
সাউন্ডসিস্টেমে পুরো দস্তুর চলছে গান। আওয়াজে একজন আরেকজনের গলাও শুনছেনা। কাল অবধি খোলামেলা বাড়িটাতে আজ পা রাখার জায়গা নেই। বিয়েতে দাওয়াত প্রাপ্ত সকল মেহমানে ঠে*সে গিয়েছে একদম। আত্মীয় স্বজনের উপচে পরা জমকাল ভীড়। ময়মুনা খাতুনের হাত জিরোচ্ছেনা। মেয়ের বিয়ের কাজে ছুটতে হচ্ছে এদিক সেদিক। কতরকম মেহমানদের আপ্যায়নের দায়িত্ব কাঁধে ! রাশিদ মজুমদার সামলাচ্ছেন বাইরেটা। তার সঙ্গে অবশ্য লোকের অভাব নেই। এখন তো সাদিফ ও আগ্রহভরে কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছে । দুপুর থেকেই হৈচৈ বেঁধেছে। গিজগিজে কথাবার্তায় কান ঝালা পালা। বর্ষা গ্রামে বড় হলেও বেশ মর্ডান। বিয়ে উপলক্ষে তার হাজারখানেক আবদার। এই যেমন, বাড়ির গৃহীনিরা চেয়েছিলেন, বাড়ির পেছনের উঠোনে গোসল করাবেন ওকে। সেখানেই হলুদ সাড়বেন। মাটিতে পাটি বিছিয়ে বসাবেন। প্রস্তাবখানা শুনেই বর্ষা নাকচ করে দিলো। তার একটাই কথা, স্টেজ করে বসাতে হবে। নাহলে সে ঘর আটকে বসে থাকবে৷ দুদিন বাদেই পরের ঘরে চলে যাবে যে মেয়ে, তার আবদার ফেলার সাহস নেই মজুমদারের৷ বিনাশর্তে মেনে নিলেন তিনি। ছোট খাটো একটা স্টেজ সেখানেও গড়লেন। মুত্তালিব আবার নাঁচ -গানের জন্যে বাইরে থেকে লোক আনাবেন রাতে। ভদ্রলোক বুঝলেন না,বাড়ি ভর্তি ছেলেমেয়ে নাঁচলেই স্টেজে জায়গা হবেনা,সেখানে বাইরের লোক পা রাখবে কোথায়?
বর্ষাকে পড়ানো হয়েছে হলুদ রঙের কড়কড়ে তাঁতের শাড়ি আর ফুলের গয়না। সাথে টুকটাক মেক-আপের আস্তরন। সব মিলিয়ে শ্যামলা মেয়েটা পরীর মতো হয়ে উঠল। কচি-কাঁচা মেয়েরা সব পাল্লা দিয়ে সাজছে। হাঁটলে দু তিনটে আ*ছাড় খেয়ে পরা বাচ্চাটাও শাড়ির আঁচল ছড়িয়েছে পিঠে।
এদিকে পুষ্প পরেছে মহা ঝা*মেলায়। ইকবাল তাকে বারবার নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে কিছুতেই বেশি সাজগোজ করা যাবেনা। বিয়ে বাড়িতে কত ছেলে আছে,আসবেও পরে,ওর ভেতর যত কম সুন্দর লাগবে ততই ভালো। পুষ্পর শাড়ির’ শ’ ও উচ্চারন করা বারন । মেয়েটা চো*টপাট দেখিয়েও লাভ হলোনা। ইকবাল গললনা একটুও। শেষ মেষ মুখ ভাঁড় করে হলুদ থ্রি পিস পরেই বের হলো পুষ্প। একটু পরপরই ভিডিও কল দিচ্ছে ইকবাল। পরীক্ষা করছে আদৌতেই সে পরেছে কী! পুষ্প মাঝেমধ্যে বেজায় ক্ষু*ব্ধ হয় তার এসব স্বভাব দেখে। যার সাথে গোটা জীবন কাটাবে, তাকে বিশ্বাস নেই? আশ্চর্য পুরুষ মানুষ!
সবাই সেজেগুজে শেষ করে ফেললেও পিউ তৈরি হচ্ছেনা। সে অগোছালো রুপেই হাঁটাহাঁটি করছে। এর অবশ্য কারনও আছে। সে এখনও দেখেনি ধূসর কী রঙের জামা পরেছে। আগে ওকে দেখবে,সে মোতাবেক মিলিয়ে নিজেও পরবে। কারন অনুষ্ঠানে কাপলরা একে অন্যের সাথে ম্যাচিং করে জামাকাপড় পরে। সে আর ধূসর তো মনে মনে কাপল। ধূসর তার ইয়ে না….! ভেবেই পিউ লজ্জ্বায় গুঁটিয়ে যায় একহাত।
পিউ সদর দরজায় এসে দাঁড়িয়ে রইল। ধূসর বাড়ির কোথাও নেই। মুত্তালিব ওকে কাছ ছাড়াই করছেন না। অল্পতে দারুন জমেছে দুজনের। পিউ অপেক্ষা করছে ধূসরকে দেখার। প্যান্ডেলে এত ছেলেরা ঘুরছে ,মিনা বেগম কড়া করে বলে দিয়েছেন ওখানে না যেতে। গ্রামের ছেলেপেলে, কী বলতে কী বলবে! শেয়ানা- ডাঙর মেয়ে হলে চিন্তার শেষ নেই।
পিউয়ের প্রতীক্ষার মাঝেই ধূসর দৃশ্যমান হলো। পাশে সবুজ রঙের শার্ট পরিহিত সাদিফ,দুজন কথা বলতে বলতে এদিকেই আসছে। ওর গায়ে নীল রঙের পাঞ্জাবিটা দেখতেই পিউ উজ্জ্বল পায়ে ঢুকে গেল বাড়িতে।
***
গ্রামের রীতি অনুসারে গোসলের আগে-পরে মেয়েকে হাঁটিয়ে নেয়া বারন। দুলাভাইয়েরা কোলে করে নিয়ে যান। কিন্তু জ্ঞাতীগোষ্ঠিতে বর্ষাই সবথেকে বড়। দুলাভাই আসবে কোত্থেকে?কোলে নেয়ার কথা উঠতেই মিনা বেগম হৈহৈ করে ধূসরের নাম জানালেন। সেই মোতাবেক রুবায়দা বেগমও ছুটে এলেন ছেলের কাছে। জ্বলজ্বলে চোখমুখে প্রস্তাব খানা রাখতেই ধূসর এককথায় বলে দেয় ,
” আমি পারব না।”
রুবায়দা বেগমের হাসি নিভে গেল। অবাক হয়ে বললেন,
” ওমা,কেন?”
ধূসর রুমাল দিয়ে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে জানাল,
” এমনি।’
” এটা কোনও কথা হলো?’
‘ হলো। মেয়েদের সাথে কথা বলিনা যেখানে,সেখানে কোলে নেয়া তো অনেককিছু। আনকম্ফোর্টেবল ফিল হয়,অন্য কাউকে বলো।’
‘ বর্ষা তো তোর বোনের মতো। কোলে নিলে কী হয়? পিউ যখন পায়ে ব্যা*থা পেল ওকে তো নিয়েছিলি।’
ধূসর মায়ের দিক অসহায় চোখে তাকায়। মনে মনে আওড়ায়,
” পিউ আর বাকী মেয়ে এক ?’
মুখে বলল,
” তখন ইচ্ছে করেছে,এখন করছেনা। সাদিফ কে বললে সমস্যা কী? ‘
রুবায়দা বেগম হার মেনে বললেন,
” আচ্ছা,ওকেই বলি বরং। ”
সাদিফ বাধ্য ছেলে। একবার বলাতেই রাজি। বর্ষার কামড়া ছিল দোতলায়। একদম সেখান থেকে কোলে তুলে পেছনের উঠোন অবধি নিয়ে এলো সে। তার সুঠাম গাত্র, সৌন্দর্য দেখে গলে গেল বিয়ে বাড়ির অনেক তরুনী । সব থেকে বেশি প্রভাব পরল মিনা বেগমের ছোট বোনের মেয়ে মৈত্রির ওপর। অনার্সে উঠেছে কেবল। সাদিফ কে দেখেই তার গা ছুঁলো খোলা বসন্তের হাওয়া।
***
পিউ নীল রঙের শাড়ি পরেছে। কোমড় অবধি খোলা চুল। সাথে অল্প স্বল্প সেজেছে। কিন্তু বিপত্তি বাঁধল লিপস্টিক দিতে গিয়ে। নীলের সাথে কোন রঙ মানাবে কিছুতেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছেনা। লাল পরবে না গোলাপি? নাকি মেরুন? তার দ্বিধাদ্বন্দের মধ্যেই ঘরে ঢুকল পুষ্প। বোনকে দেখে প্রথম দফায় মুগ্ধ হলো। পিউ জীবনে প্রথম শাড়ি পরল আজ। দেখতে হুরের মত লাগছে। পরপর ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,
‘ গায়ে হলুদের দিন তুই এই কালার পরেছিস কেন? হলুদ পরতে হয় জানিস না?’
পিউ ঘুরে তাকাল না। আয়নার দিক চেয়ে থেকে বলল,
” ইচ্ছে হয়েছে তাই।’
পুষ্প মৃদূ হাসল। দু পা ফেলে এগিয়ে গেল। পেছন থেকে বোনের গলা জড়িয়ে বলল, ‘ রা*গ করেছিস?’
পিউ ভেঙচি কে*টে বলল
‘ রা*গ করব কেন? আমি কে? মানুষ ইচ্ছে করলেই আমাকে ব*কবে,মা*রবে,ধম*কাবে তাতে কী,আমিতো সরকারি। ‘
পুষ্প গাল টেনে বলল,
‘ ওলে আমাল বাবুতা! তুই তো আমার সবথেকে আদরের। তখন একটু ধ*মকেছি বলে এতদিনের ভালোবাসা ভুলে যাবি?’
পিউ এতক্ষনে ঘুরে তাকায়, আহ্লাদী স্বরে বলে,
‘ আর ব*কবি আমায়?’
‘ না না মাথা খা*রাপ। ‘
পিউ হাসল। ঝকঝকে দাঁত উন্মুক্ত হলো। পুষ্প অভিভূতের ন্যায় আওড়াল,
” তোকে যে কী সুন্দর লাগছে রে পিউ!”
‘ থ্যাংক ইউ। আচ্ছা আপু,কোন লিপস্টিক টা পরব?
‘ মেরুন পর, ভালো লাগবে।’
” আচ্ছা।”
পিউ ঘুরে আবার আয়নার পানে তাকায়। পুষ্প ঘর থেকে বের হতে হতে বলল
” তাড়াতাড়ি আসিস। ”
‘ আসছি, আসছি।’
পিউ একা একা শাড়ি পরেছে। অত গোছালো না হলেও হয়েছে কোনও রকম। কিন্তু কুঁচি উলটে যাচ্ছে বারবার। এই নিয়ে মুসিবতে পরেছে ভীষণ । সব ঠিকঠাক করতে করতে বাড়ি শূন্য। সে একবার জানলায় গিয়ে উঁকি দিলো। উঠোন ভর্তি মানুষ। গায়ে হলুদ শুরু হয়েছে। অত মানুষের মধ্যে ধূসরকে ঠিকই দেখতে পায়। ওইত উঠোনের এক কোনায় গোল টেবিল পাতানো। চার পাঁচজন ঘিরে বসে সেখানে। ধূসরও আছে। সে দ্রুত ঘর থেকে বের হলো।এমনিতেই কত কিছু মিস করে ফেলেছে। তবে হাতদুটো খালি খালি লাগছে। একটা ব্রেসলেট ও আনেনি পরবে বলে। কাঁধে মেলে রাখা আঁচল ঠিকঠাক করে উঠোন অবধি এলো।
ওমনি কানে গেল একটি পুরুষালি আওয়াজ।
কেউ চিন্তিত স্বরে বলছে, ‘ এই যা! ধূসর ভাই, আপনার ফোনের গ্লাস তো ভে*ঙে গেল।’
পিউ চট করে তাকায়। চোখাচোখি হয় ধূসরের সাথে। নিষ্পলক তার দৃষ্টি। গোটা চার পাঁচজন ছেলে নিয়ে দাঁড়িয়ে সে। ফোনটা পরে আছে মাটিতে। কানে গুঁজে কথা বলছিল। পিউকে দেখতেই হাত শিথিল হয়ে খসে পরল সেটা। ছেলেটা ফোনের ধূলো ঝেড়ে ধূসরের দিক বাড়িয়ে দিলো। সাথে পরামর্শ দিল,
” এই মোড়ে একটা সার্ভিসিংয়ের দোকান আছে,বিকেলে নিয়ে যাব আপনাকে। ”
ধূসরের জবাব নেই। থমকে আছে সে। কথা কানে ঢুকেছে কী না সন্দেহ! সে ব্যস্ত সামনের নীল জামদানি পরিহিতা মেয়েটিকে নিপুণ চোখে দেখতে।
পিউ ঘটনার আগামাথা জানেনা,বুঝলোওনা। সে ধূসরের চাউনী দেখেই গুঁটিয়ে গেছে। লজ্জ্বায় মাথা নামিয়েছে। মিনা বেগম কুলো নিয়ে পাশ থেকে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ মেয়েকে দেখেই দাঁড়িয়ে গেলেন। পা থেকে মাথা অবধি দেখে আওড়ালেন,
” মাশ আল্লাহ! কে সাজালো তোকে?’
‘ আমি একাই সেজেছি।’
মিনা বেগম আপ্লুত হয়ে মেয়ের মাথায় চুমু খেলেন। সাথে কূলোর ওপর রাখা কূপের কালি নিয়ে লাগিয়ে দিলেন গলায়।
মায়ের যাওয়া থেকে দৃষ্টি এনে পিউ আবার ধূসরের দিক তাকায়। সে তখনও চেয়ে আছে৷ তার দিক তাকাতে তাকাতেই চেয়ারে বসল। কেমন হাঁ*সফাঁস করে উঠল,যেন শ্বাস নিতে পারছেনা। পরপর টেবিল থেকে বোতল নিয়ে ছিপি খুলে ঢকঢক করে পানি খেলো। পিউ দাঁড়িয়ে থাকে। খুব করে চায়,ধূসর একবার কাছে আসুক। এসে জানাক কেমন লাগছে! কিন্তু এলোনা সে। ভা*ঙা ফোনটা হাতে নিয়েই ব্যাস্ততা দেখাল। পিউয়ের আনন্দ মিইয়ে আসে। মুখ ভাঁড় হলো। সেই ফাঁকে ছুটে এল সাদিফ। গলায় ঝুলছে তার পার্সোনাল ক্যামেরা। পিউকে দেখেই বলল,
‘ মাই গুডনেস! তোকে তো পরীর মত লাগছে।”
পিউ আলগোছে ওপর ওপর হাসল । এত সুন্দর প্রসংসাও তার মন ভালো করতে পারেনি। মেয়েরা প্রিয় মানুষের মুখের একটু তারিফ শুনলে যে খুশি হয়,পুরো পৃথিবী সেখানে বিফল।
সাদিফ বলল ‘ চল ছবি তুলে দেই। না, আয় আগে সেলফি তুলি।’
পিউ মানা করল না। সাদিফ ফোনের ক্যামেরা উচু করে ধরল। পরপর ক্যাপচার হলো তাদের যূগল ছবি। ধূসর উঠে যাচ্ছিল, কোত্থেকে শান্তা এসে দাঁড়িয়ে গেল সামনে। অত গুলো ছেলেকে এড়িয়ে সরাসরি তাকে বলল,
‘ আপনি কি ভালো ছবি তুলতে পারেন ভাইয়া? আমাকে তুলে দেবেন?”
ধূসর সাদিফের দিক ইশারা করে বলল,
” ক্যামেরা ম্যান ওদিকে। যাও, তুলে দেবে।’
এরপর চলে গেল সে। শান্তা মনস্তাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। পাশ থেকে এলাকার ছেলে রাকিব দাঁত কেলিয়ে প্রস্তাব করে,
” আমি তুলে দেই শান্তা?”
শান্তা জ্ব*লে উঠে বলল ‘ আপনাকে বলেছি? নিজের কাজ করুন”
_____
সাদিফ ছবি তুলতে ভালোবাসে। আর সেই ভালোবাসার চক্করে ফেঁসেছে পিউ। এদিক সেদিক টেনে নিচ্ছে ওকে। এখানে বোস,এভাবে তাকা, ওদিক ঘোর,এরকম হাজার খানেক ইন্সট্রাকশন দিচ্ছে। পিউ মনোযোগ দিয়ে পোজ দিতে পারছে না। তার মাথায় একটা নতুন চিন্তা বাসা বেঁধেছে। চিন্তার নাম শান্তা। কাল থেকে লক্ষ্য করছে মেয়েটা একটু বেশিই ধূসরের ধারেকাছে ঘিঁষছে। মতলব কী ওর? কোনও ভাবে যদি উল্টোপাল্টা ভাবনাচিন্তা করেই থাকে,এক চ*ড়ে সিধে করে দেবে পিউ। টেনে সব চুল ছি*ড়ে ফেলবে। ধূসর ভাইকে নিয়ে নো কম্প্রোমাইজ!
” কী রে! দ্যাখ এদিকে…”
পিউ নড়েচড়ে লেন্সের দিক তাকায়। সাদিফ ক্লিক করে। এর মধ্যে পেছনে এসে দাঁড়াল মৈত্রি। আস্তে করে ডাকল,
” শুনছেন?”
সাদিফ ঘুরে তাকায়। বাঙালী মেয়েদের মত শাড়ি পরা,খোপা করা মেয়েটিকে চিনতে পেরে বলে,
” জি বলুন?”
” আমার ক’টা ছবি তুলে দেবেন?”
সাদিফ কিছু বলার আগেই সামনে থেকে পিউ চটপটে কণ্ঠে বলে দেয়,
” হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই। কেন দেবেনা? আমার সাদিফ ভাইয়া দারুন ছবি তোলে।”
সাদিফের বলার কিছু রইল না। মৈত্রি হেসে বলল,
‘ থ্যাংক ইউ। আসলে বিয়ে বাড়িতে সবাই ব্যস্ত। ফটোগ্রাফার বর্ষার ছবি তুলছে তো,তাই আমি আপনাকে বলছিলাম।’
এবারেও পিউ জবাব দেয়,
‘ আরে কোনও সমস্যা নেই। তাইনা ভাইয়া?’
সাদিফ চোখা চোখে চেয়ে ভ্রুঁ কুঁচকায়। পিউয়ের লাফালাফি টা অহেতুক ঠেকল। মেয়েটাকে দেখেছে আজ সকালে। পরিচিত ও হয়নি। এখন কী না ছবি তুলতে হবে? সে মুখের ওপর মানা করতে পারেনা। পিউ যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেদিকটা দেখিয়ে বলল,
‘ ওখানে গিয়ে দাঁড়ান,ছবি ওদিকটায় ভালো আসে।’
মৈত্রি উচ্ছ্বল পায়ে এগিয়ে যায়। পিউ সুযোগ পেয়ে সরে আসে। স্টেজের দিক না গিয়ে ধূসরকে খুঁজতে থাকে। চিরুনি তল্লাশি করেও পায়না। শেষে সুপ্তিকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
‘ ধূসর ভাইকে দেখেছিস?’
‘ হ্যাঁ, বাড়ির ভেতর গেল তো ‘
পিউ চিন্তায় পরে যায়৷ অনুষ্ঠান রেখে সে ভেতরে গেল কেন? শরীর টরির খারাপ না কী? উদ্ভট ভাবনা মনে নিয়ে শাড়ির কুঁচি আগলে ছুটল সে।
ধূসর আর সাদিফ কে একটা ঘরে থাকতে দেয়া হয়েছে। যেহেতু বিয়ে বাড়ি,সংখ্যাতীত মানুষজন,একেক জন কে একটা রুম দেয়া তো সম্ভব নয়। ওদের কামড়া পরেছে তিন তলায়। পিউ ত্রস্ত সিড়ি বেয়ে উঠল। বাড়িতে আপাতত কেউ নেই। সবাই ওখানে। পিউ একদম গিয়ে কামড়ার সামনে দাঁড়াল। দরজা ভেজানো। পিউ টোকা দিয়ে ডাকল,
” ধূসর ভাই, শুনছেন? ‘
সাড়া এলোনা। সে আবার ডাকল,
‘ শুনছেন? আপনি কি আছেন ভেতরে?’
জবাব এবারেও আসেনা। পিউ দরজা ঠেলে দেয়। ঘরটা দিনের বেলাতেও অন্ধকার। জানলা বন্ধ,পর্দা ঝুলছে। পিউ দরজা আরেকটু ঠেলতেই একটা হাত শক্ত করে তার হাত ধরল। পিলে চমকে উঠল তার। রীতিমতো হাতটা জোর খাটিয়ে টে*নে তাকে ঢুকিয়ে নিলো ভেতরে। পরপর ঠে*সে ধরল দেয়ালে। দরজা লাগালো শব্দ করে। পিউয়ের গলা শুকিয়ে যায়। সে নিশ্চিত এটা অন্য কেউ। ধূসর জীবনেও এরকম আচরন করেনি,করবেওনা। সমস্ত শরীর ভ*য়ে থরথর করে কেঁ*পে ওঠে। কম্পিত কণ্ঠে শুধায়,
‘ ককে? ককে আপপনি?’
আগন্তুক নিরুত্তর। উলটে ঘেঁষে এলো কাছে। গা থেকে ছুটে এলো কড়া পারফিউমের গন্ধ। উষ্ণ শ্বাস তে*ড়ে এসে পরল মুখমন্ডলে। পিউ বিভ্রান্ত হয়ে পরল। অবয়ব ছাড়া কিচ্ছু বুঝতে না পেরে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগলো। চেনা সুবাসে অপরিচিত আচরন ভ্রান্ত করল মস্তক। সে চটজলদি ফোনের সাইড বাটন চেপে আলো ধরতে গেলেই ওই হাতটাও আটকে দিল আগন্তুক। পিউ এবার নেতিয়ে গেল শ*ঙ্কায় । এ কিছুতেই ধূসর হবেনা। কোনও বখাটের পাল্লায় পরেছে নির্ঘাত। গলা ফাঁ*টিয়ে চিৎকার করবে ভাবল,এর আগেই সুইচ টেপার আওয়াজ হয়। কক্ষে জ্বলে ওঠে চকচকে আলো। সেই আলোয় স্পষ্ট হয় ধূসর। পিউ কিংকর্তব্যবিমুঢ়, হতবিহ্বল। ঠোঁট ফাঁকা করে বলে,
” আপনি?”
ধূসর নিশ্চুপ। সে চেয়ে আছে। ক্লান্তিহীন, অমত্ত চোখে।
হাত দুটো ছেড়ে দেয় পিউয়ের। পকেটে গোঁজে। সেকেন্ডের মাথায় কিছু একটা বেরিয়ে আসে। প্যাকেট ছি*ড়ে পিউয়ের চোখের সামনে উন্মুক্ত হয় দু মুঠো নীল কাচের চুড়ি। পিউ স্তব্ধ,বিস্মিত। ধূসর তার বিস্ময়ের তোয়াক্কা করল না। মুখ ফুঁটে একটা কথাও বলল না। চুপচাপ ওর হাত তুলে উঁচুতে ধরল। মুঠো ভর্তি চুড়ি পাঁচ আঙুলে ভরে কব্জিতে রাখল। তারপর একটা একটা করে কব্জি বেয়ে নামাল। পুরোটা সময় পিউ হতবাক চেয়ে। অথচ ধূসর ভ্রুঁক্ষেপহীন,নিরুপদ্রব৷
পিউয়ের ফর্সা খালি দুটো হাত, নিমিষেই চুড়িগুলো দখল করে। ধূসর তার হস্তদ্বয় মুঠোয় তুলে উল্টেপাল্টে বলল,
‘ এবার ঠিক আছে।’
‘ আপনি এগুলো আমার জন্যে কিনেছেন ধূসর ভাই?’
পিউয়ের অবিশ্বাস্য কণ্ঠ৷ ধূসর বলল,
” না। রাস্তায় পরে ছিল। ভাবলাম ফেলে দেব? তাই নিয়ে এসছি।’
পিউ চোখ নামিয়ে মুচকি হাসল। জানাল,
” আমার খুব পছন্দ হয়েছে!”
বলতে বলতে তাকাতেই দেখল ধূসর তার আপাদমস্তক দেখছে। দৃষ্টিতে মুগ্ধতা। শাড়ি পরা পিউকে প্রথম দেখল কী না! এক পর্যায়ে ভ্রুঁ কোঁচকায় সে। জিজ্ঞেস করে,
‘ কুঁচির এই হাল কেন?’
ধূসরের চোখ অনুসরন করে তাকাল পিউ। আগের মতোই কুঁচি সরে গেছে দুদিকে। ঠোঁট উলটে ভীষণ দুঃ*খ নিয়ে বলল,
‘ একা একা পরেছি না,তাই।’
ধূসর তাকায়। শ্বাস ঝাড়ে। হুট করে হাটুমুড়ে বসে যায়। আশ্চর্য হয় পিউ। পাথর বনে দাঁড়িয়ে রয়। ধূসর একটা একটা করে কুঁচি ধরে ঠিকঠাক করে দিচ্ছে। পিউ বাকরুদ্ধ। জ্বিভে শব্দ নেই,মুখে কথা নেই। কাজ শেষে ধূসর সোজা হয়ে দাঁড়ায়। পিউ প্রবল বিস্ময়ে চেয়ে থাকে তার তামাটে চেহারায়। ধূসর তার মাথার একপাশের দেয়ালে হাত রাখে। কিছু বলতে চায়,এর আগেই বাইরে থেকে পুষ্পর গলার স্বর ভেসে এলো। উঁচু কণ্ঠে নাম ধরে ডাকছে সে। পিউ ভ*য় পেল। চোখ বড় করে বলল,
‘ আপু আসছে।’
‘ সমস্যা নেই।’
‘ আছে। এভাবে দেখলে কী না কী ভাববে!’
‘ কী ভাববে?’
পিউ চুপ করে যায়। কী ভাববে তা কি মুখ ফুটে বলা যায়? লজ্জ্বা লাগবে না?
পুষ্প ডেকে ডেকে হয়রান। পিউয়ের সাড়া নেই।
আচমকা ধূসরই চিল্লিয়ে জানাল,
” এদিকে পুষ্প।”
পিউয়ের মুখ আ*তঙ্কে ছোট হয়ে এলো। চকিতে চেয়ে বলল, ‘ ডাকলেন কেন?’
ধূসর জবাব দেয়না। ডাক শুনে পুষ্প ঘরে ঢুকে পরে। দেয়ালে লেপ্টে থাকা পিউ আর কাছাকাছি ধূসরকে দেখে থতমত খেয়ে চোখ ফেরাল। পিউ মুচড়ে উঠলেও ধূসর সরলোনা। একটু দূরত্ব অবধি বাড়াল না। সে নিরুদ্বেগ। পুষ্প ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
” তোকে আম্মু ডাকছেন, আয়। ”
বলে দিয়েই বেরিয়ে গেল। ভাবভঙ্গি স্বাভাবিক। পিউয়ের কপালে ভাঁজ পরে। ধূসর এতক্ষনে সরে দাঁড়ায়৷ চোখ ইশারা করে বলে,
‘যা।’
পিউ হাঁটা ধরল। এক পা বাড়াতে গেলেই ধূসর পেছন থেকে শাড়ির আঁচল টেনে ধরল। চমকে, থমকে গেল সে। দুরুদুরু বুকে ঘাঁড় ঘুরে তাকাল। ধূসর উদ্বেগহীন,শান্ত কণ্ঠে বলল,
” শাড়ি পরেছিস ভালো কথা, সামলে রাখার দায়িত্বটাও তোর। আমি যেন না দেখি, শরীরের অযাচিত কোনও অংশ বেরিয়েছে। ”
চলবে,