এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব ৮

0
1046

#এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-৮

ঘড়িতে বাজে সাতটা পয়তাল্লিশ।মাথার উপর ঘড়ঘড় শব্দ তুলে সিলিং ফ্যান ঘুরছে।কাল রাতের ঠান্ডা আবহাওয়ার লেঁশমাত্র নেই।কলেজের সম্পূর্ণ সাদা ইউনিফর্ম পরে চুলের দু’পাশে বেণি করতে করতে তোহা ভাবলো,তূর্যকে বলতে হবে তার ঘরের ফ্যানটা যেন মিস্ত্রি ডেকে ঠি ক করে দেয়।এই ঘড়ঘড় শব্দে শান্তিমত ঘুমানো যায়না।

ছোটখালারা চলে গিয়েছে গতকালকেই।নিশাও নেই।পুরো বাড়ি ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।বেণি গাঁথা শেষ হতেই কলেজের ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বের হলো তোহা।ডাইনিং টেবিলে বসে বসে রুটি ভাজি চিবোচ্ছে তূর্য।তার দৃষ্টি পাশে রাখা বইয়ের দিকে।পরীক্ষা শুরু কয়দিন পর।অনার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র সে।কিছুদিন বাদে পাশ করে বেরিয়েও যাবে।
পাশের চেয়ারটা মেলে রাখা।হয়তো তোহার জন্যই।কিন্তু তোহা বসলোনা।আতিয়া প্লেটে করে দু তিনটে গরম রুটি নিয়ে এসে বললো,
—“কি হলো?বস।নাস্তা খেতে একঘন্টা লাগবেনা।দুটো রুটি খেয়ে তারপর যা।”

তোহা আরেকবার ঘড়ির দিকে তাকালো।আটটা বাজতে পাঁচমিনিট বাকি।ঠিক ঠি ক আটটা বাজে না গেলে তিহানের রাম বকা খেতে হবে নিশ্চিত।ইততস্ত কন্ঠে সে বললো,
—“আসলে মা,তিহান ভাই…”

—“সবসময় শুধু খালামনির কাছে আমার বদনাম করা।তাইনা?আমি তোকে নাস্তা খেতে নিষেধ করেছি?চুপচাপ নাস্তা খা।তারপর বের হবো।”

আতিয়া মৃদু হেসে আবারো রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়।
হঠাৎ তিহানের কন্ঠে তোহা দ্রুত বেগে এদিক ওদিক তাকাতেই দেখে তাদের ড্রইংরুমের সোফায় আরাম করে বসে আছে তিহান।গায়ে সাদা কালো চেক চেক শার্টের সাথে হাতের বাদামী বেল্টের ঘড়িটা যেন একটু বেশিই মানিয়েছে তাকে।কয়েকসেকেন্ড কাঙালের ন্যায় সেদিকে চেয়ে থাকতেই তিহান একবার ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে তোহার চোখে চোখ রেখে ঠান্ডা গলায় বলে,

—“জাস্ট দশ মিনিট।”

চোখাচোখি হতেই চুপচাপ কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে রেখে চেয়ারে বসে পরে তোহা।ঠিক দশ মিনিটের মাথায় দুটো রুটি খেয়ে হাত ধুয়ে ফিরে এসে ব্যাগটা তোলার আগেই তিহান সেটা হাতে নিয়ে সামনে হাঁটতে হাঁটতে বলে,”জলদি আয়।”

রাস্তা ভর্তি কাঁদাপানি।বাসার সামনের জায়গাটা থেকে গেট পর্যন্ত হাঁটার রাস্তাটাও পানিতে পরিপূর্ণ।পা রাখলে নিশ্চিত সাদা পায়জামায় ছিঁটে বিচ্ছিরি অবস্থা হবে।যদিও একটু পর পর ছোট ছোট ইট বিছানো আছে যেনো পানিতে পা না পরে।কিন্তু এভাবে যেতে হলে নির্ঘাত উষ্ঠা খেয়ে পড়বে তোহা।তিহান দাড়িয়ে আছে তোহার পাশেই।গাড়ির ড্রাইভার চাচাকে ফোন দিচ্ছে বারবার।উনি গাড়ি বের করে গেটের কাছে দাড়াতেই কাঁদাপানিতে নেমে গেলো তিহান।তার চকচক করা জুতোজোড়ায় কাঁদার ছিঁটা লেগে গেলেও সেদিকে কোন হেলদোল নেই তার।অথচ তোহার স্পষ্ট মনে আছে কদিন আগে এই জুতোজোড়া তিহান বেশ শখ করে কিনেছিলো।কেনার সময় তাকেই সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলো সে।

সে তোহার দিকে একহাত বাড়িয়ে দিতেই তোহা আলতো করে তার হাতের উপর হাত রাখলো।তিহান দৃঢ়ভাবে তা আঁকড়ে ধরে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে,

—“ইটের ওপর পা ফেলে আয়,তিহু।অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে।পরবি না,আমি ধরেছি।”

তোহা আশস্তমনে পা বাড়ালো।সে যে কোনোক্রমেই পড়বেনা এই ব্যাপারে একেবারে নিশ্চিত।
___________
গাড়ি থামে কলেজের গেটে।বের হওয়ার আগমূহুর্তে তিহান মানিব্যাগ থেকে একশো টাকার দুটো নোট বের করে তোহার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,
—“ক্যান্টিনে থেকে কিছু খেয়ে নিস।কিন্তু বাইরের উল্টাপাল্টা খাবার খাবিনা,খবরদার!”

তোহা একপলক তাকায়।”খবরদার” শব্দটার মানে সে জানে।তিহান “খবরদার” বলেছে মানে কথার অমান্য হলে যে আসলেই খবর করে ছাড়বে,সে ব্যাপারে পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে তার।
সে টাকাটা তিহানের দিকে এগিয়ে নিচু গলায় বলে,
—“আম্মু টাকা দিয়েছেতো।এটা লাগবেনা।”

হাত বাড়ায়না তিহান।পূর্বের ন্যায় সাবলিল ভঙ্গিতে বলে,
—“টাকা দিয়েছে তাইনা?ব্যাগ চেক করতো।টাকাটা কি আদৌ সঙ্গে এনেছিস তুই?”

তোহা একবুক আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলে,
—“এনেছি।আমার মনে আছে।”

তিহান চোখ ছোট ছোট করে তাকায়।দুইহাত বুকের মাঝে ভাঁজ করে বলে,
—“দেখাতো,আমাকে বের করে দেখা।”

উওরে প্রথমেই জামার বামপকেট হাতরায় তোহা।টাকাটা না পেয়ে আরেক পকেট হাতরায়।বুকটা দুরুদুরু কাঁপছে।তারমানে সে টাকা আনেনি?ডাইনিং টেবিলেই রেখে এসেছে?আমতাআমতা করে তিহানের দিকে তাকায় সে।
মিচমিচে কন্ঠে বলে,
—“আপনি তো দেখেছেন,তো তখন বলতেন টাকাটা আমি নিতে ভুলে গিয়েছি?তাহলেই তো নিয়ে আসতাম।”

—“তোর সাহস তো দিন দিন বেড়েই চলেছে রে।খালি মুখের উপর পাল্টা জবাব দেস।দেবো এক চড়।যা ভেতরে ঢুক।”

ধমক শুনে রাগে মুখ ফোলায় তোহা।বেরিয়ে গিয়ে দরজা লাগিয়ে তিহানের ডাকে আবারো জানলা দিয়ে তাকিয়ে বলে,
—“কি সমস্যা?বলেন।”

—“ছুটির সময় গাড়ি পাঠিয়ে দিবো।আঙ্কেলের সাথে সোজা বাড়ি চলে যাবি।”

তোহা বুঝতে পারে তিহানের কাজ আছে সেজন্যই সে আসতে পারবেনা।তবুও নরম কোমল আকুতিভরা স্বরে মিষ্টি করে বলে,
—“আপনি আসবেন না?”

একমূহুর্ত ভাবে তিহান।অত:পর দৃষ্টি সামনের দিকে দিয়ে ছোট্ট করে বলে,

—“আচ্ছা,আসবো।”

কথাটা শোনামাত্র মুখে বিস্তর হাসি ফুটে উঠে তোহার।কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে নিয়ে সে গেটের ভিতর ঢুকতেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ড্রাইভার আঙ্কেলকে গাড়ি স্টার্ট দিতে বলে তিহান।
___________

রাত প্রায় আটটা…
ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরেছে তিহান।গায়ের শার্ট ঘামে লেপ্টে আছে শরীরের সাথে।চুলগুলো এলোমেলো।দুপুরে তোহাকে বাসায় দিয়ে আবারো একটা জরুরি মিটিংয়ে ছুটেছিলো সে।অফিসের কাজে আর নিজের হেলাফেলায় দুপুরের লান্চ করা হয়নি।ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে।ঘরে ঢুকতে ঢুকতে সে বললো,
—“মা,টেবিলে খাবার দাও।ক্ষুধা লেগেছে।”

আফিয়া রান্নাঘর থেকেই চেঁচালেন,
—“ফ্রেশ হয়ে আয়।দিচ্ছি।”

তিহান আর কোন কথা না বলে ঘরে ঢুকলো।জুতোজোড়া কোনরকম খুলে সোফায় হাত পা ছড়িয়ে গা এলিয়ে দিলো।শার্টের বোতাম খুলে চোখ বন্ধ করে কিছুসময় সেভাবেই পরে রইলো।
একটু ঘুমাচ্ছন্ন ভাব আসতেই ধুম করে কিছু পরার শব্দে সচকিত দৃষ্টিতে চোখ মেললো সে।বিছানায় চোখ পড়তেই হাত পায়ের আড়ষ্ট-অবশ ভাবটা কেঁটে গেলো মূহুর্তেই।

তার বিছানার ডান দিকের কোঁণ ঘেঁষে ঘুমিয়ে আছে তোহা।ঘুমের ঘোরে তোহার হাতে লেগেই পাশের টেবিল ক্লকটা নিচে পরে গেছে।উঠে যায় তিহান।ঠোঁটের কোঁণে মৃদু প্রশান্তির হাসি।
তোহাকে টেনে বিছানার মাঝখানে শুইয়ে দেয় সে।গায়ে জড়ানো অগোছালো ওড়নাটা পাশে সরিয়ে রেখে গলা অবধি কাঁথা টেনে দেয়।

অত:পর ধীরপায়ে দরজা ভিজিয়ে বেরিয়ে আসে।রান্নাঘরে যেয়ে আফিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে,
—“তিহু আমার রুমে কেনো মা?”

আফিয়া চুলের গ্যাসটা নিভিয়ে দেয়।বাটিতে তরকারি বাড়তে বাড়তে বলে,
—“বিকেলে এসেছিলো।তোর শেলফ থেকে কোন বই নিবে বলে রুমে ঢুকলো।তারপর আমি যখন গেলাম তখন দেখি ঘুমিয়ে পরেছে।তাই আর ডাকিনি।তুই ডেকে তুলে দে।”

তিহান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
—“না,থাক।ঘুমাক।….আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।তুমি খাবার দাও।”

আফিয়া হাসলো।কিন্তু কিছু বললোনা।

রুমে ফিরে আসে তিহান।তোহার কাছে যেয়ে কপালের মাঝখানটায় আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে,

—“আর কতভাবে মুগ্ধ করবে আমায়?এ মুগ্ধতার কি কোন শেষ নেই?আমার চোখগুলোতে ক্লান্ত হয়ে পরবে তোমার মুগ্ধতা দেখতে দেখতে।”

~চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here