এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব ২৫

0
725

#এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-২৫

বিকেলের তেজহীন রোদ উঁকি দিচ্ছে সাদা মেঘের ফাঁকফোকর দিয়ে।একটু পর পর যানবাহনের হর্ণের শব্দ শোনা যাচ্ছে।বিকেলটাও আজকাল বড্ড ব্যস্ত থাকে।কেমন যেন কোলাহলময়।তোহার মতে বিকেলবেলাটা হবে শান্ত,নির্মল।অর্ধেক দিনের ব্যস্ততা শেষে মানুষ এককাপ চা নিয়ে বারান্দায় বসবে।দু একটা চুমুক দিয়ে প্রিয় মানুষের সাথে একটু আধটু আলাপে মেতে উঠবে।কিন্তু না,সময়টাও আজকাল ভারি হয়ে উঠেছে।মানুষজনের শ্বাস ফেলার অবকাশ নেই।মন মস্তিষ্ক জুড়ে শুধু কাজ কাজ আর কাজ।

টিভির রঙচঙে স্ক্রীনের দিকে অবসন্ন চোখদুটোকে কোনরকমে নিবদ্ধ করে রেখেছে তোহা।মুখজুড়ে তেঁতোভাব।ফ্যানের উষ্ণ বাতাসটাতেও বিষন্নতার ছোঁয়া।পাশে আতিয়া বসে আছে।তার দৃষ্টি উৎসুক।
গভীর মনোযোগ আর প্রাণবন্ত মন নিয়ে বাংলা নাটক দেখছে সে।ড্রইং রুমে তারা ব্যতিত তৃতীয় কোনো ব্যক্তির অস্তিত্ব নেই।তোহার বাবা ঘরে ঘুমোচ্ছে।আর তূর্য ঘন্টাখানেক আগেই কি কাজে যেনো বেরিয়েছে।সোফায় পা উঠিয়ে বসে হাতের বাটিটা থেকে পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে চানাচুর মাখা খেতে খেতে মায়ের সাথে টিভি দেখছে তোহা।

—“আর খাবা আম্মু?”হাতের বাটিটা মায়ের দিকে এগিয়ে ধরলো তোহা।

আতিয়া তাকালো।বিরস মুখে আবারো মুখ ফিরিয়ে বললো,
—“নাহ,তুই লবণ কম দিয়েছিস।মেটমেটা স্বাদ।তুই ই খা।”

মায়ের কথায় কপাল কুঁচকালো তোহা।আরেক চামচ মুখে পুড়ে নিয়ে চিবাতে চিবাতে বললো,”তাহলে লবণ দিয়ে আনি আরেকটু।”

হাসলো আতিয়া।বললো,
—“আচ্ছা আন।”

গা মুচরিয়ে আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাড়ালো তোহা।অনেকক্ষণ একধ্যানে বসে থাকার কারণে মনে হচ্ছে হাড্ডিতে জং ধরে গেছে।হাটাহাটি করা দায়।টলমলে পায়ে রান্নাঘরে গেলো সে।তিন চিমটি লবণ দিয়ে হাত দিয়ে মেখে নিলো।মায়ের হাতে বাটিটা দিয়ে হাত ধুয়ে আবারো ড্রইংরুমে যেতে নিতেই মেজাজ খারাপ করা কলিংবেল বেজে উঠলো।
গাল ফুলিয়ে শ্বাস ছাড়লো তোহা।গেটটা খুলে তিহানকে দেখে বিশেষ একটা অবাক হলোনা সে।ভেবেছিলোই তিহান অথবা আফিয়া এসেছে।তিহানকে ভেতরে ঢোকার জায়গা দেয়ার জন্য একটু পাশে চেপে যেতেই তার বামহাতটা নিজের হাতের মাঝে টেনে নিলো তিহান।অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো তোহা।মিনমিনে কন্ঠে বললো,
—“হাত ছাড়ুন,আম্মু ড্রইংরুমে।”

তিহান হাত ছাড়লোনা।উল্টো জুতো পায়েই একটু ভেতরে ঢুকে গলা উঁচিয়ে ডাকলো,
—“খালামনি?”

চমকে উঠলো তোহা।তড়িঘড়ি করে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে চাপা স্বরে বললো,
—“তিহান ভাই..”

এর মাঝেই ফিরে তাকালো আতিয়া।তিহানকে দেখে মুখে হাসি টেনে বললো,
—“বল বাবা।কিছু দরকার?”

—“তিহু কে একটু আমার সঙ্গে নিয়ে যাই খালামনি?এই সামনের মার্কেটে যাবো।মা কিছু জিনিস আনতে বলেছে।ভাবলাম তিহু তো বাসায়ই আছে।ওকে সাথে নিয়ে যাই।যাবো খালামনি?”বলে চমৎকার করে হাসলো তিহান।এই অসহ্য সুন্দর হাসির বিনিময়ে কোনোকিছুতে মানা করা সম্ভব নয়।আতিয়ার ক্ষেত্রেও ব্যাতিক্রম হলোনা।মাথা নাড়িয়ে সাঁয় দিয়ে সে বললো,
—“আচ্ছা যা বাবা,সমস্যা নেই।”

অনুমতি পেতেই মুচকি হাসলো তিহান।তোহার হাত ধরে টেনে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই তোহা হকচকানো কন্ঠে বললো,
—“এভাবেই যাবো নাকি?জামাটাতো বদলে আসি?”

একনজর তাকালো তিহান।তোহাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে নিলো।অত:পর শক্তপোক্ত কন্ঠে বললো,
—“এভাবেই যাবি।জুতোটা পরে নে শুধু।”

মুখ লটকালো তোহা।তিহান তার হাত ছাড়েনি।একহাত দিয়ে পাশের জুতো রাখার র্যাক থেকে জুতো বের করলো সে।পরে নিয়ে বললো,
—“আপনাকে নিয়ে আর পারিনা।চলুন।”
_________________
রাস্তায় আজ তেমন একটা জ্যাম নেই।অবশ্য বিকেল গড়িয়ে গেছে বলেই হয়তো যানবাহনের আনাগোনা কম।ধীরগতিতে ড্রাইভ করছে তিহান।পরণে ব্লু জিন্সের সাথে ধূসর রংয়ের হাফহাতা টি-শার্ট।চুলগুলো একটু এলোমেলো।গালের চাঁপদাড়ি গুলো নিখুঁতভাবে শেভ করা হয়েছে।বামগালের কাঁটা জায়গাটা এখনো লাল হয়ে আছে।
তোহা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে একদৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে সেদিকে।চেহারায় কোনো আবেগ নেই অনুভুতি নেই শুধুই কৌতুহলী প্রেমিকার মতো সুঁচালো দৃষ্টি।আড়চোখে একবার তাকালো তিহান।তিহান তাকিয়ে আছে বুঝতে পেরেও চোখ সরালোনা তোহা।
—“এভাবে কি দেখছিস?কি হয়েছে?”

তোহা উওর দিলোনা।জীবন্ত পুতুলের মতো তিহানের দিকে চেয়ে দুবার পলক ঝাপটালো।ভ্রু কুঁচকালো তিহান।ড্রাইভিংয়ে মনোযোগ স্হাপনের চেষ্টা করে অস্বস্তি ভরা কন্ঠে বললো,
—“অন্যদিকে তাকা তিহু।এভাবে দেখার কি আছে?”

শুকনো গলায় ছোট্ট করে একটা ঢোঁক গিললো তোহা।দৃষ্টি না সরিয়ে হুট করে তিহানের দিকে ঝুঁকে তার ঘাড় হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরতেই তিহান মৃদু ধমক দেয়ার চেষ্টা করে বললো,
—“তিহু সর।সামনে দেখতে পাচ্ছিনা আমি।এক্সিডেন্ট হয়ে যাবে কিন্তু..”

তিহানের বাঁধা নিষেধ শুনেনা তোহা।কিছু না ভেবে আচমকাই এক অদ্ভুত কাজ করে ফেলে সে।মুখ নামিয়ে চোখ বন্ধ করে আলতো স্পর্শে তিহানের বামগালের বাদামী তিলটায় ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়।প্রচন্ডভাবে চমকে উঠে তিহান।তোহা যে এমন কিছু করবে ভাবতেও পারেনি সে।আচমকা ধাক্কাটা নিতে না পারায় হঠাৎই তার পুরুষ মনেও অদ্ভুত লজ্জা খেলে যায়।লজ্জায় অস্থির হয়ে উঠে চোখের ধূসর চাহনী।

কি করে ফেলেছে তা বুঝে আসতেই চট করে সরে যায় তোহা।লজ্জিত ভঙ্গিতে নিজেকে একটু গুটিয়ে নিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়।

চুলে হাত চালিয়ে নি:শব্দে ঠোঁট চেপে হেসে ফেলে তিহান।পরমূহুর্তেই নিজেকে সামলে নিলেও ঠোঁটের কোণের মিটমিটিয়ে হাসিটা আজ আর সরার নয়।তোহার দিকে একবার তাকিয়েই বুঝতে পারে তার সাথে এখন আর কথা বলতে পারবেনা মেয়েটা।তুমুল লজ্জা ঘিরে ধরেছে তাকে।
বেশ কিছুক্ষণ সব চুপচাপ।তোহা একবারও তাকায়নি।
অনেকক্ষণ বাদে দমবন্ধকর পরিবেশ একটু শিথিল হতেই তিহান তোহার মাথার পড়ে যাওয়া ঘোমটাটা একহাত দিয়ে টেনে উঠিয়ে দিতে দিতে আস্তে করে বলল,
—“তুমি আমার ক্ষণিকের মোহ নও চারুপ্রিয়া,তুমি আমার আমরণ প্রেমতৃষ্ণা।তোমার এই একটু আধটু প্রেমের ছোঁয়ায় এই পিপাসা মিটবেনা।বরং তোমাকে কাছে পাওয়ার আকাঙ্খাটা বেড়ে যাবে আরো বহুগুন।তবুও তুমি কোনো এমন করছো বলোতো?এতো অবিচার তোমার এই প্রেমিক পুরুষের সইবেনা কিন্তু।”

~চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here