এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব ২০

0
714

#এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-২০

ছোট্ট নরম কোমল মেয়েলি একটা হাতের অবাধ বিচরণ তিহানের চোখের উপর।আধো আধো জাগরণে চোখ মেললে চোখের উপর হাতের তালুর আবরণটিই সর্বপ্রথম নজরে আসলো তিহানের।ঠোঁটের কোঁণ আপনাআপনিই প্রসারিত হয়ে এলো তার।বুকের উপর ভাঁজ করে রাখা হাতটা মোটা কয়েকটা কাঁথার তলদেশ থেকে উদ্ধার করে চোখের উপর থেকে হাতটা সরালো সে।কিছুক্ষন একদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে ঘাড় বাঁকিয়ে হাতের মালিকের দিকে তাকালো।নিবিড় পর্যবেক্ষণে হাতের মালিক যে ঘুমে বিভোর ব্যাপারটা নিশ্চিত হতেই হাতের নরম তালুতে শুভ্র স্পর্শে ঠোঁট ছোয়াঁলো সে।

—“কাল তো ভয়ই পাইয়ে দিয়েছিলি বাবা।”

হঠাৎ মায়ের কন্ঠে বেশ খানিকটা লজ্জা পেলো তিহান।ভেবেছে মা ঘুমিয়ে আছে।কিন্তু না,আফিয়ার দৃষ্টি যে তার দিকেই তা স্পষ্ট হতেই লজ্জার মাত্রাটা বাড়লেও কোনরকম তাড়াহুড়ো করলোনা সে।ধীরগতিতে তোহার হাতটা নামিয়ে রেখে একটু কাত হয়ে মায়ের দিকে চেয়ে বললো,

—“কালরাতে তোমার খুব কষ্ট হয়েছে।তাইনা মা?”

—“আরে না রে পাগল।আমারতো তোর কষ্টটা সহ্য হচ্ছিলো না।”

তিহান হাসলো।গায়ের কাঁথাগুলো সরিয়ে মাথার চুলে হাত চালাতে নিলেই আবারো বাঁধ সাধলো তোহার হাত।তার চুলের ভাঁজেও মেয়েটা হাত ডুবিয়ে রেখেছে।একটু অপ্রস্তুত হয়ে পরলেও এবারো আলতো ভাবেই হাতটা সরালো তিহান।তোহার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটুক তা সে চাচ্ছেনা।
আফিয়া একটু হেসে বললো,
—“একটু আগে দেখলাম ঘুমাচ্ছে অথচ গভীর ঘুমের মাঝেও তোর মাথা টিপে যাচ্ছে তো টিপে যাচ্ছেই।”

—“তোমার বেপরোয়া ছেলের বউ বলে কথা।ছেলের একটু পরোয়া তো করতেই হবে।”দুষ্টু হেসে বললো তিহান।

—“ছেলের বউ আর হলো কই?আচ্ছা তুই কি বুড়ো হয়ে বিয়ে করবি তিহান?মেয়েটাকে এভাবে ঘুরানো কি তোর ঠি ক হচ্ছে?”

—“তুমিতো সব জানোই মা।তিহু এখনো কলেজও পেরোয়নি।এ বয়সে মেয়েরা আবেগপ্রবণ হয় বেশি।বিয়ের কথা আসলে পড়াশোনা মাথায় উঠবে।ক্যারিয়ারটা নষ্ট হয়ে যাবে ওর।তাছাড়া আমাদের পরিবারে এতো ছোট বয়সে মেয়েদের বিয়ে হয়না।নিশাকেও তো পড়াশোনা কম্প্লিট করে তবেই বিয়ে দিয়েছে খালু।তিহুও আর একটু বড় হোক।পড়াশোনাটা অন্তত শেষ করুক।তারপর নাহয়…”

—“তোহা তো বুঝে তোর মনের কথা।তোর কি ওকে এতোটাই বাচ্চা মনে হয়?”

—“আমি জানি ও বুঝে।”নির্লিপ্ত কন্ঠে বললো তিহান।তারপর আবার বললো,”আমি যতটুকু বুঝতে দেই ও ততটুকুই বুঝে মা।এর বেশি নয়।আর আমি ঠি ক ততোটাই প্রকাশ করি যতটা ওর ছোট্ট মস্তিষ্ক নিতে পারবে।”

আফিয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।তার ছেলেটা বোধহয় শ্বাস নেয়ার আগেও একশবার চিন্তা করে।সবকিছু একদম সুক্ষ্ণ ভাবে চিন্তা করে তবেই কোন সিদ্ধান্ত নেয়।

গায়ের কাঁথা সরিয়ে উঠে বসে তিহান।আফিয়া উঠে দাঁড়ায়।ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
—“ফ্রেশ হয়ে আয়।আমি নাস্তা করে আনি।ওর হাতেই খাবি?”

মায়ের কথায় দাঁত বের করে হেসে ফেললো তিহান।একআঙ্গুল দিয়ে কপাল ঘষে বললো,
—“ওর হাতের অভ্যাস হয়ে গেলে ঝামেলা হয়ে যাবে মা।আমি নিজেই খেতে পারবো।আচ্ছা,খালু কি চলে গেছে রাতে?”

—“খালু তোর বাবার সাথে ঘুমোচ্ছে।কোনো ডাক্তারকে ফোন করা আর বাদ দেয়নি কাল।শেষমেষ অতোরাতে কাউকেই পায়নি।”

বলে আফিয়া চলে যেতেই উঠে দাড়ায় তিহান।খাটের হাল্কা শব্দে একটু নড়েচড়ে যায় তোহা।একটু একটু করে তাকাতেই চোখের সামনে তিহানকে না পেয়ে ভ্রুতে ভাঁজ পরে তার।মুখ বাকিয়ে আলমারির সামনে তিহানকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে আড়মোড়া ভেঙে সোজা হয়ে বসে তোহা।দুহাতে চোখ কঁচলে বলে,
—“আপনি উঠলেন কখন?জ্বর কমেছে?”

আলমারি থেকে টি-শার্ট বের করলো তিহান।অত:পর আলমারি আটকে দিয়ে টি-শার্টটা এনে বিছানার উপর রেখে বললো,
—“কমেছে।তুই ঘুমোসনি সারারাত?শরীর খারাপ লাগছে?”

আবারো চোখ কঁচলালো তোহা।বড় একটা হাই তুলে অলস ভঙ্গিতে তিহানের বালিশটা মাথার নিচে টেনে নিয়ে বিছানায় ডানকাত হয়ে গা এলিয়ে দুহাত জোড়া করে গালের নিচে দিয়ে বললো,
—“আপনি ঘুমোতে দেননি রাতে।এখন ডাকবেননা।আধঘন্টা পর আমি নিজেই উঠে যাবো।”

তিহান হাসলো।উবু হয়ে বিছানা ছাড়িয়ে পরে যাওয়া তোহার ওড়নার আঁচলের অংশবিশেষ তুলে দিয়ে বললো,
—“ঘুমা।কেউ ডাকবেনা।”

তিহানের কন্ঠটা আবছাভাবে শুনতে পেলো তোহা।তবে ঘুমিয়ে তলিয়ে যাওয়ার পরপরই আবারো স্পষ্ট হয়ে এলো তিহানের মুখশ্রী।তার সপ্নরাজ্য যে কেবল তিহান এবং তিহানই।তিহান ছাড়া সেখানে দ্বিতীয় কোনো পুরুষের স্হান নেই।
________________

আজ আর কলেজ যাওয়া হয়নি।সবে গোসল করে বারান্দায় চুল ঝাড়ছে তোহা।মধ্যদুপুরের সরু চিকন রোদরশ্নি অদ্ভুত আল্পনায় বারান্দায় ছড়িয়ে পরেছে।রেলিং ঘেঁষে দাড়িয়ে মাথা কাঁত করে চুল মুছতে মুছতে উৎসুক দৃষ্টিতে রাস্তার মানুষ জনদের দেখে যাচ্ছে সে।চোখেমুখে সৌন্দর্যের বিস্তর ছেলেখেলা।চুলের নিচের অংশের পানিতে কোমড়ের জামা ভিজে একাকার।তার সেদিকে খেয়াল নেই।সে ব্যস্ত রঙিন শহরের ব্যস্ততা দেখতে।গায়ের মসৃণ মেরুন ওড়না কাঁধ গলিয়ে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে অথচ তরুনীর কোন মাথাব্যাথাই নেই।

এদিকে সদ্য স্নানকরা প্রেয়সীর হৃদয়হরণ করা জ্বালাময়ী রুপে চোখ রীতিমত ঝলসে যাচ্ছে তিহানের।বারান্দায় ল্যাপটপ নিয়ে বসেছিলো একটু খোলা বাতাসে কাজ করার উদ্দেশ্য কিন্তু এই মেয়েতো তা করার অবকাশ টুকুও দিচ্ছেনা।দিনকে দিন মন মস্তিষ্কে এমনভাবে জেঁকে বসছে যে অন্যকিছুকে সেখানে ঠাঁই দেয়াটাই মুশকিল হয়ে দাড়িয়েছে।
ল্যাপটপ টা অর্ধেক বন্ধ করলো তিহান।গলা উঁচুতে চড়িয়ে ডাকলো,
—“তিহু…”

তার হঠাৎ গাম্ভীর্য কন্ঠের ডাকে চমকে উঠলো তোহা।শরীরের মৃদু কম্পনে হাতের তোয়ালেটা পরতে যেয়েও পরলোনা।ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো সে।খানিকটা ভীত কন্ঠে বললো,
—“এভাবে ডাকছেন কেনো?কি হয়েছে?”

কোনরকম ভূমিকা উপসংহার করলোনা তিহান।আদেশসূচক গম্ভীর পুরুষালি কন্ঠে বললো,
—“ঘরে যা।”

—“কেনো?”কৌতুহলী অবাক কন্ঠ তোহার।

তিহান একপলক তাকালো।ভেজা চুল গড়িয়ে টুপটাপ পানিগুলোকে মুক্তকোণা মনে হচ্ছে তার চোখে।আবারো ঘোর লেগে যাচ্ছে।তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে বেহায়া প্রেমিকের মত।কিন্তু তা সম্ভব নয়।মনে মনেই একটা শ্বাস ফেললো তিহান।পুনরায় ল্যাপটপের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলল,
—“আমি একটা জরুরি কাজ করছি তিহু।তুই প্রচন্ড ডিস্টার্ব করছিস।”

—“আমি কিছু বলেছি আপনাকে?আমিতো শুধু…”

—“তুই যাবি নাকি না?”

—“আপনি একটা অসহ্যকর,তিহান ভাই।”ঝাঁঝালো কন্ঠে কথাটা বলে তোয়ালেটা শুকাতে দিলো তোহা।গটগট করে রুমে যাওয়ার আগেই তিহান দুষ্টুমিমাখা কন্ঠে বললো,

—“তুমিতো এই অসহ্যকর লোকটার চিন্তায়ই সারাক্ষন ধ্যানমগ্ন থাকো প্রাণপ্রেয়সী”।

~চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here