#এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-১২
পড়ন্ত বিকেলের আরক্তিম গোধুলীবেলা।লাল কমলা সূর্য একটু একটু করে হেলে পড়ছে পশ্চিম আকাশে।বারান্দার রেলিংয়ে দুহাত রেখে অদ্ভুত দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে তোহা।চোখের পাতা নিভু নিভু হয়ে আসছে বারংবার।বেশ খানিকক্ষণ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের পর তার মনে পরলো একটা কথা,”সূর্যের দিকে বেশিক্ষণ অর্থ্যাৎ চোখ না সরিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা যায়না।এ কথাটা সে আগে থেকে জানলেও কখনো প্রমান স্বরূপ দেখা হয়নি।আজ দেখলো।আসলেই সূর্যের দিকে বেশিক্ষন তাকানো যায়না।চোখ জ্বালা করে।আপনাআপনিই চোখের পাতা বন্ধ হয়ে যায়।এবার চোখজোড়া সত্যি সত্যিই বন্ধ করে ফেললো তোহা।আনমনে ভাবলো,”তিহান ভাইয়ের চোখের দিকেও তো তাকিয়ে থাকা যায়না।বেশিক্ষন তো দূর,একপলকও তাকানো যায়না।আচ্ছা,তার চোখ জোড়াও কি সূর্যের মতো?জলন্ত?নাকি সে মানুষটাই জলন্ত,ভস্মকারী?যার সংষ্পর্শে এলে ভয় হয়?ভরসাপূর্ণ ভয়?যে কিনা কেবল মুখের কথা দিয়েই তার ছোট্ট শরীরের অভ্যন্তরে থাকা রন্ধ্রে রন্ধ্রে,শিরায়-উপশিরায় পর্যন্ত কাঁপুনি ধরিয়ে দিতে পারে?”
এতটুকু ভাবতেই চোখ মেলে ফেললো তোহা।এলোমেলো,অগোছালো,ফাঁকা ফাঁকা লাগছে মস্তিষ্ক।মাথা নুইয়ে রেলিংটা আরো শক্ত করে চেঁপে ধরে সে।কানে বাঁজছে তিহানের “তুমি” সম্মোধন করা সম্মোহনী কথাগুলো।ভাবে,এই কথাগুলো শুনলে কি আদৌ কোন কিশোরীর আবেগি মন শান্ত হয়ে থাকতে পারে।উনি কি বুঝেননা এই বাক্য গুলো আমাকে প্রচন্ডভাবে প্রভাবিত করে?ইচ্ছে হয় সকল বাঁধা নিষেধ উপেক্ষা করে আমি তুমুলগতিতে তার বুকে আঁছরে পড়ি?”
____________
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।পড়ার টেবিলে মনোযোগ সহকারে পড়তে বসেছে তোহা।এখন চলছে গরমকাল।মোটামুটি একবছর পর আগামী গরমকালে তার উচ্চ মাধ্যমিক।পড়াশোনায় তেমন সিরিয়াসনেস না থাকলেও হেলাফেলাও নেই তার।মোটামোটি মাঁঝারি সারির শিক্ষার্থী সে।ভালো ও নয়,আবার ফেল করার মতো খারাপ ও নয়।
বাড়ি প্রায় ফাঁকা।তূর্য গেছে ঢাকার বাইরে,তার কোন এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বাড়িতে।তাও আবার এক দিনের জন্য নয়।গুনে গুনে তিনদিনের জন্য।বন্ধুর বড় ভাইয়ের বিয়ে।তাকে যেতেই হবে,বন্ধুর মা বাবা পর্যন্ত তাকে ফোন করে বলেছে।অগত্যা দাওয়াত রক্ষার জন্য এই পড়াশোনার মাঝেও ছুটেছে সে।
তোহার বাবা গেছে অফিসের কাজে।ফিরবে আগামী পরশু।মাঝেমধ্যেই অফিসের কাজে এহেন ছোটাছুটি করতে হয় তাকে।প্রাইভেট কম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সে।দায়িত্বের বোঁঝাটাও তাই বেশি।
বাসায় শুধু তোহা আর তোহার মা আতিয়া।ঘরের দরজা খুলে রেখেছে তোহা।ড্রইংরুমের সোফায় বসে অল্প আওয়াজে টিভি দেখছে আতিয়।তোহা এখান থেকে তাকে স্পষ্ট দেখতে পারছে।মনটা খারাপ হচ্ছে একটু।আগে নিশার সাথে সারাক্ষণ খুঁনসুটিতে মেতে থাকতো।এখন কেমন একা একা লাগে।তূর্য বরাবরই কম কথা বলে আর পড়াশোনায় ডুবে থাকে।তার সাথে হাসি মজা করার উপায় নেই।
॥
॥
ঘড়িতে বাজে সাড়ে সাতটা…
ড্রইংরুমের কোঁণায় রাখা ল্যান্ডফোন বেঁজে উঠলো।আতিয়া তখন স্হির দৃষ্টিতে মনোযোগের সহিত নাটক দেখছে।ল্যান্ডটফোনের অবিরাম শব্দে তিক্ত কন্ঠে সে বললো,
—“তোহা,এসে ফোনটা তোল।”
ঘর থেকে তোহার উওর এলোনা।আতিয়া আবারো গলা বাড়িয়ে ডাকলো,
—“তোহা?”
কোনো সাড়াশব্দ নেই।এবার বিরক্তি নিয়ে পিছে তাকাতেই খেয়াল করলো টেবিলে মাথা রেখে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে তোহা।উপায় না পেয়ে নিজেই উঠে গেলো সে।ফোনটা কানে নিতেই এমন একটা খবর পেলো যা শুনে তার অন্তরাত্মা পর্যন্ত কেঁপে উঠলো।কথা শেষে খট করে ফোনটা কেটে গেলো।
চোখে পানি নিয়ে তোহাকে ডাকার জন্য হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিতেই তুমুল অস্থিরতায় ছটফট করে উঠলো তার মন।গা কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে তোহার।ঘুমের মাঝেই মেয়েটা কাঁপছে।ঠোঁট শুঁকিয়ে কাঠ।
গ্রাম থেকে আতিয়ার মা ফোন করেছিলো।তার বাবার অবস্থা ভালোনা।অনেকদিন যাবতই অসুস্থতায় ভুগছিলেন সে।আজ সকাল থেকে নাকি কেমন নির্জীব হয়ে আছেন।শুধু নিজের মেয়েদেরকে দেখতে চাচ্ছেন।
কোনো অঘটন ঘটার আগে এখনই তাকে আর আফিয়া কে রওনা হতে বলেছেন তার মা।ছোট মেয়ে অর্থ্যাৎ তোহার ছোটখালা আনিয়া ও নাকি একটু আগে খবর শুনেই রওনা দিয়েছে গ্রামের উদ্দেশ্য।
॥
আফিয়া আর আতিয়া মিলে ধরাধরি করে খাটে শুইয়ে দিয়েছে তোহাকে।প্যারাসিটামল খাইয়ে দেয়া হয়েছে।
আতিয়ার কপালে চিন্তার ভাঁজ স্পষ্ট।একদিকে নিজের বাবা আর আরেক দিকে অসুস্থ মেয়ে।কই যাবে সে?বাসায় কেউ নেই যে তোহাকে রেখে যাবে।
খালি বাসায় একা একা অসুস্থ মেয়েটা কিভাবে থাকবে?তাছাড়া রান্নাবান্নাও করা নেই।এই জ্বর নিয়ে তোহা রান্না করতে পারবে না।সবদিকেই বিপদ।
চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে আতিয়া সিক্ত কন্ঠে বললো,
—“আপা,তুমিই যাও।আমি থাকি।আব্বাকে বইলো তোহার জ্বর।তাই আসতে পারিনাই”
ধমকে উঠলো আফিয়া।বললো,
—“তুইতো জানিস তিয়া,আব্বা সবচেয়ে বেশি তোকেই আদর করে।আর এখনো তোর নামই বলছে বেশিবার।তোর দুলাভাইকে ব্যবস্থা করতে বলে এসেছি।একটু পরই রওনা দিবো আমরা তিনজন ”
—“কিন্তু আপা,তোহা?”
—“তিহান অফিস থেকে আসুক।রান্না নিয়ে সমস্যা নেই,তোহার খাবার তিহান দোকান থেকে কিনে দিবেনে একয়দিন।আর অপেক্ষা কর।জ্বর নেমে যাবে।চিন্তা করিস না।”
আতিয়া কোনরকমে চোখের পানি আটকালো।তিহানই তার একমাত্র ভরসার স্হল।ছেলেটাকে সে খুব বেশি বিশ্বাস করে।খুব বেশি।তোহাকে তিহানের দায়িত্বে রেখে যেতে কোনরকম ভয় নেই তার।
॥
তিহান ফিরেছে।বাসায় নিচে ঢুকতে না ঢুকতেই তার ফোন বেঁজে উঠলো।পকেট থেকে ফোনটা বের করে “মা”
লেখা দেখতেই মুখে হাসির রেখা টেনে ফোনটা তুলে কানে লাগালো সে।বললো,
—“হ্যাঁ মা,আমি এসে পরেছি।এখন সিঁড়িতে।”
—“বাবা,তুই একটু তাড়াতাড়ি তোর খালামনির ফ্ল্যাটে আয় তো।একটু সমস্যা হয়েছে।”
—“কি হয়েছে?তি..নামটা বলতে গিয়েও থেমে গেলো সে।বললো,সবাই ঠি ক আছেতো?”
—“হ্যাঁ,তুই একটু আয় তাড়াতাড়ি।”বলে ফোনটা কাটলো আফিয়া।
তিহান দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠলো।তোহাদের ফ্ল্যাটের দরজা ধাক্কা দিতেই তা খুলে গেলো।দরজা লক করা না।তোহার রুম থেকে কথাবার্তার শব্দ আসছে।কাঁপা কাঁপা মন নিয়ে সেদিকে যেতেই দেখলো বিছানায় সোয়া অবস্থায় আছে তোহা।গায়ে কম্বল দেয়া।চেহারা কেমন শুকিয়ে গেছে।ঠোঁটগুলো শুষ্ক।
তাকে দেখেই আফিয়া বললো,
—“যাক,এসেছিস।শোন…”
—“কি হয়েছে ওর?”আফিয়ার কথার মাঝেই বলে উঠে তিহান।শান্ত তবে কাঁপা কন্ঠ তার।
—“জ্বর এসেছে।এখন ১০১ ডিগ্রি।একটু আগে ১০৩ ছিলো।শোন..তোকে যে জন্য ডাকছি,তোর নানা খুব অসুস্থ।তোর খালামনি আর আমাকে যেতে হবে।নিয়ে যাবে তোর বাবা।কারণ আর কেউ বাসায় নেই।তোহার জ্বর ওকে অসুস্থ শরীর নিয়ে টানাটানি করা যাবেনা।আমাদের পৌঁছাতেই সকাল হয়ে যাবেএতোক্ষণ মেয়েটা জার্নি করতে পারবেনা।তাই বলছি,ওকে তো রেখে যেতে হচ্ছে।তুই একটু ওকে দেখে রাখিস।আর একয়দিন ওর খাবার দোকান থেকে কিনে এনে দিস।আমরা একটু পরেই রওনা দিব।বুঝলি?”
—“আচ্ছা,ঠিকাছে।”সংক্ষিপ্ত উওর তিহানের।
________________
“দায়িত্ব” খুব বড় একটা জিনিস।যার কাঁধে “দায়িত্ব” নামক ভারি জিনিসটা আছে শুধু সেই বুঝে এর গুরুত্ব।
আতিয়া যাওয়ার আগে তিহানকে বলে গিয়েছে,”তোর দায়িত্বে রেখে যাচ্ছি তোহাকে।ওর খেয়াল রাখিস।”।
ব্যাস!এতটুকু কথাই যথেষ্ট।যে এই বিশ্বাসটার মর্মার্থ বুঝে সে অবশ্যই কথাটার মান রাখবে।
শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে এসেছে তিহান।ভেজা গায়েই কোনরকম শার্ট চেপে সে বেরিয়ে গেলো।উদ্দেশ্য মোড়ের দোকান থেকে খাবার কিনে আনা।তোহার জ্বর কমেছে হয়তো।সে অবশ্য যায়নি ওই ফ্ল্যাটে।পকেটে ফ্ল্যাটের চাবিটা ভরে দ্রুতপায়ে হাঁটা ধরলো সে।খাবার কিনে এনে আস্তে করে দরজার নব খুললো তিহান।ভেতরে ঢুকে ড্রইংরুমের লাইট জ্বালিয়ে খাবারের প্যাকেটটা টেবিলে রেখে তোহার দরজায় যেয়ে নক করলো।যদিও সে জানে তোহা দরজা লক করেনা কখনো তবুও সেই মেহেদির দিনের কান্ডের পর সে আর নক না করে ভুলেও রুমে ঢুকেনি।সেদিনের ঘটনাটা একেবারেই একটা একসিডেন্ট।ওই ঘটনার আগেও সে নক করে ঢুকলেও ওইদিন তাড়াহুড়োয় হুট করেই ঢুকে গিয়েছিলো।যদি ভুলটা না হতো তাহলে হয়তো আর তোহাকে সেই বাজে পরিস্থিতিটায় পরতে হতোনা।হতাশ শ্বাস ছাড়ে তিহান।অত:পর আবার নক করে বলে,
—“তিহু,আসবো?”
তিহানের কন্ঠে হুঁস ফিরে তোহার।চোখ বন্ধ করে ছিল সে।দরজার আওয়াজ শুনতে পায়নি।ওষুধ কাজে দিয়েছে।জ্বর এখন অনেকটাই কম।নেই বললেই চলে।হুঠাৎ এত জ্বর কেনো এসেছিলো নিজেও বুঝতে পারলোনা।
দুহাতে ভর দিয়ে আস্তে করে উঠে বসলো সে।পাশ থেকে ওড়না নিয়ে সুন্দরমতো গায়ে জড়িয়ে নিয়ে মৃদু কন্ঠে উওর দিলো,
—“জি আসেন।”
আস্তে করে দরজা খুলে রুমে ঢুকলো তিহান।দরজার সামনে দাড়িয়েই বললো,
—“জ্বর কমেছে?”
—“এখন নেই।”
তিহান আর এগোলোনা।তোহার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে দৃষ্টি নামিয়ে বললো,
—“তোর খাবার প্লেটে বেড়ে ঘরে দিয়ে যাচ্ছি।হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিস।”
তোহা সম্মতিসূচক মাথা নাড়ায়।তিহান ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বলে,
—“তোর নাম্বারে রিচার্জ করে দিয়েছি।রাতে কোন সমস্যা হলে ফোন দিস।আমি চলে আসবোনে।আর কাল কলেজ যাওয়া লাগবেনা।বাসায়ই থাকিস।সকালের নাস্তা কিনে দিয়ে যাব।ওকে?”
—“আচ্ছা।”মাথা কাঁত করে বলে তোহা।
তিহান বেরিয়ে যেয়ে খাবার বেড়ে তোহার ঘরে নিয়ে গেলো।তোহা তখন রুমে ছিলোনা।ওয়াশরুমে গিয়েছিলো ফ্রেশ হতে।বেরিয়ে এসে তিহানকে খাবার রাখতে দেখে সে বললো,
—“আপনি খেয়েছেন?”
—“নাহ্,খাবো।”
বলে খাবারটা পড়ার টেবিলে রেখে গ্লাসে পানি ঢেলে দিলো তিহান।বেরিয়ে যাওয়ার আগে তোহার মাথায় একহাত রেখে স্নেহময় কন্ঠে বললো,
—“একদম ভয় পাবে না।আমার দায়িত্ব তুমি।দায়িত্বের অবহেলা হবেনা।আমি আছি।”
~চলবে~