এক মুঠো প্রেম রঙ্গনা পর্ব ৪

0
1189

#এক_মুঠো_প্রেম_রঙ্গনা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব চার |

————————–
–“তুই পিক তুলে পাঠাইছিস কেন? মাথা খারাপ?”
–“আরে আমি জানতাম নাকি যে ওটা রাফিয়ার-ই বোন। কিন্তু কথা সেটা নয়। তুই রাফিয়াকে ছেড়ে কেন ওর বোনকে প্রস্তাব পাঠালি? মাথা গেছে তোর?”
–“যায়নি। মা পছন্দ করেছে নওরিকে। এছাড়া রাফিয়াকে আমি কোনো কালেই বিয়ে করতাম না। মেয়েটার অহংকার বেশি। সুন্দরী বলে খুব ভাব দেখায়ে চলতো মহল্লায়। এজন্যই প্রেম করে বুঝাইছি, এত ভাব ভালো না। তবে আমার কিন্তু নওরিকে মোটামুটি পছন্দ হয়ে গিয়েছে।”

কথাগুলো বলে প্রিতম আলতো হাসলো।
–“হাতে একটা সেলফোন থাকলে সত্যি আপনার কথাগুলো রেকর্ড করে আপাকে শুনাতাম। তখন সে টের পেত আপনার এই আসল রূপ।”

মেয়েলি কন্ঠস্বর শুনে প্রিতম চমকে পিছে ফিরে তাকালো। পিছনে নওরিকে দেখে সে হতবাক হয়ে গেলো। নওরির হাতে বাজারভর্তি ব্যাগ। দৃষ্টি বড়োই শীতল তার। প্রিতম শুকনো ঢোঁক গিললো। এর মানে কী নওরি সব শুনে নিয়েছে? প্রিতম আমতা আমতা করে নওরিকে ডাকলো। তাঁর কথার মানে ব্যাখ্যা দিতে চাইলো।
–“নওরি, আমার কথাটা শুনো। আমি…”

নওরি গম্ভীর নজরে একপলক প্রিতম এবং প্রিতমের বন্ধুকে যাচাই করে নিলো। অতঃপর প্রিতমের কোনো কথা না শুনেই ধপাধপ পায়ে দ্রুত চলে গেলো প্রিতমের দৃষ্টির সীমানার বাইরে৷ প্রিতম অজস্র বার নওরিকে পিছুডাক দিয়েছে। শক্ত নওরিকে একবারের জন্যেও দমাতে পারেনি সে। হতাশ হয়ে পরলো প্রিতম। প্রিতমের বন্ধু প্রিতমের কাঁধে হাত দিতেই প্রিতম ঝাড়ি দিয়ে হাত সরিয়ে ফেললো। অতঃপর চোখে মুখে ক্রোধ ফুটিয়ে কাঠ কাঠ গলায় বলে,
–“শালা! সব দোষ তোর! তোরে তো…”

প্রিতম হাত জোড়া মুঠিবদ্ধ করে ফুঁসতে ফুঁসতে কোথাও চলে গেলো।

রাতে চুপি চুপি নওরি তাঁর বাবার ঘরে প্রবেশ করলো। সৎ মা এবং বাবা দুজনেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সৎ মা তো রীতিমতো নাক ডাকছে ঘুমে। কী শান্তির ঘুম তাঁর। অথচ কেউ যে না ঘুমিয়ে রাত পার করছে, ব্যথার তাড়নায় দু’চোখের পাতা এক করতে পারে না তাঁরা। নওরি নিঃশব্দে নিঃশ্বাস ফেলে বাবার দিকে গেলো। বাবা বাম কাত হয়ে ঘুমোচ্ছে। নওরি সপ্তপর্ণে বাবার মুখের কাছে হাঁটু গেড়ে বসলো। আবছা আলোয় বাবাকে প্রাণভরে দেখে নিলো সে। মানুষটা তাঁর কদর না করলেও এই মানূষটা তাঁর বাবা। প্রতিটা মেয়ের কাছেই বাবা নামক শব্দটি আস্ত দুর্বলতা। নওরিও ব্যতিক্রম নয়। নির্নিমেষ বাবার দিকে চেয়ে মিনমিন স্বরে আওড়ায়,
–“তুমি আমায় ভালো না বাসলেও আমি তোমায় খুব ভালোবাসি বাবা।”

বলতে বলতে নওরির চোখ জোড়ায় অশ্রু’রা ভীড় জমালো। ঝাপসা চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে সপ্তপর্ণে চোখ মুছে ফেললো। অতঃপর নিঃশব্দে উঠে দাঁড়িয়ে বাবার বালিশের কাছে থাকা বাটন ফোনটা নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো৷

———————–
প্রিয় আপা,
এই চিঠিটা তোমার জন্যে-ই। আমি চলে যাচ্ছি, তোমাদের থেকে অনেক দূরে। জানি না যেখানে যাচ্ছি সেখানে আমার আশ্রয় হবে কি না, তাও আল্লাহ্’র উপর সব ছেড়ে দিয়েছি। আসে প্রিতম ভাইয়ের কথা, তুমি তাকে নিয়ে সুখী থেকো। তোমার সুখের জন্যে এইটুকুনি তো আমি করতেই পারি। এছাড়া কেউ তো আমার মনের অবস্থার খেয়াল রাখে না, চলে যাওয়ার কথা ছিলো অনেক আগে! তুমি তোমার মায়া কাটাতে পারবো না বলে কোথাও যাইনি। মুখ বুজে সহ্য করেছি সৎ মায়ের অ!ত্যাচার।

আমি তোমার করা অ!ত্যাচারের কোনো প্রতিবাদ করিনি। কেন জানো? তুমি আমার বড়ো বোন, তোমার অবস্থা আমি বুঝি। একটি মায়াজালে অন্ধ হয়ে বন্দী তুমি। আমি তোমায় ধো!কা দেইনি আপা। আমি সেদিন প্রিতম ভাইয়ের কাছে জানতে গিয়েছিলাম কেন আমার জন্যে বিয়ের প্রস্তাব এলো? কেন সে তোমার ভালোবাসার মর্যাদা দিলো না? সেসব জিজ্ঞেস করতে। কিন্তু তুমি আমায় ভুল বুঝলে। আচ্ছা আপা, তোমার ছোট বোনের চাইতে তোমার দুইদিনের ভালোবাসাই বড়ো হয়ে গেলো? একবার কী যাচাই করে দেখেছো, তোমার ওই ভালোবাসা কতটা খাঁটি?

আমি সত্যি আমি পারিনি, এত এত সমস্যায় নিজেকে জড়িয়ে রাখতে। তাই আজ সিদ্ধান্ত নিয়েছি মুক্ত পাখি হয়ে যাবো। অ!ত্যাচার এবং দয়ার জেলখানায় আমি সেকেন্ডের জন্যেও থাকতে পারব না। তাই চলে যাচ্ছি, তোমাদের থেকে বহুদূরে। ভেবো না তোমার এই ম!রে যাওয়া বোনটা ভেঙ্গে গুড়িয়ে গেছে। বরং সে ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে শক্ত হয়েছে। পাথরের মতো শক্ত। তোমার মতো সে কল্পনার জগতে নেই। সে আছে এক বাস্তব জগতে, যেই জগতে সে আর নিরব থাকবে না। একদম নিরব থাকবে না, অ’ন্যায় হলেই কন্ঠস্বর তাঁর প্রতিবাদে দগ্ধ হবে। কথা দিলাম তোমায়।
ভালো থেকো, তোমার প্রতি আমার অনেক অভিযোগ আছে। তবে সেগুলো হৃদয়েই থাক। আল্লাহ্ হাফেজ!”

এরকমই এক চিঠি লিখে এসেছে নওরি। স্টেশন। প্লাটফর্ম নাম্বার সাত। মানুষদের চলাচল কম। ধরণীতে ধীরে ধীরে আলো ফুটছে। আলো গ্রাস করছে অন্ধকার। হঠাৎ বিকট শব্দে ট্রেনের হর্ণ বেজে ওঠে। শব্দের সাথে ট্রেন ধীরে ধীরে চলতে শুরু করেছে। হ্যাঁ, নওরি পালিয়েছে। মাহি তাকে পালাতে সাহায্য করেছে। নওরির সিটটা পরেছে জানালার কাছে। যখন অন্যমনস্ক হয়ে ভাবছিলো তখনই মেয়েলি ভরাট কন্ঠস্বর শুনে নওরির ধ্যান ভাঙ্গলো।
–“তোমার বিড়ালটা সুন্দর।”

নওরি চমকে সামনের সিটে তাকায়। এক মধ্যবয়সী মহিলা বসে আছে। মুখে তাঁর প্রাণখোলা হাসি। নওরি জোরপূর্বক হেসে প্যাট ব্যাগটায় তাকালো। বর্তমানে ব্যাগটি তার কোলে। এই ব্যাগে ফ্রিশা রয়েছে। একবার রাফিয়া আপার সাথে মার্কেটে গিয়ে এই ব্যাগটা দেখতে পায় সে। সেখানে দর-দাম করে ছয় মাস লাগিয়ে টাকা জমিয়ে এই ব্যাগটা কিনেছিলো সে। মাহিও কিছু টাকা দিয়েছিলো।

ফ্রিশা এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ফ্রিশা যেন নিঃশ্বাস নিতে পারে, এজন্য ব্যাগের চেইন কিছুটা খুলে রেখেছে। ব্যাগটির পেছনে স্কুল ব্যাগের মতোন হাতল থাকলেও সামনে দিয়ে একদম ফাঁকা। যার ফলে অনায়াসেই দেখা যায় ভেতরের পোষা প্রাণীটি কী করছে। ভ্রমণেও এই ব্যাগটি বেশ কার্যকরী।

নওরি মহিলার বলা উক্তিতে মুচকি হেসে বলে,
–“ধন্যবাদ।”
–“কোথাও যাচ্ছো?”
নওরি ইতস্তত বোধ করলো। আমতা আমতা করে বললো,
–“জ্বী।”
–“কোথায়?”
–“ঢা..ঢাকা।”
–“একা?”
–“একা কোথায়? এইযে আমার সঙ্গী আমার সাথে।”

বলেই মুচকি হাসলো নওরি। মহিলা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রয় নওরির সেই হাসির দিকে। এই হাসিতে যেন মায়া এঁটে আছে। ব্যবহারও বেশ ম্লান। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকলো তারা। আধ ঘন্টা পেরোতেই নওরি মহিলার দিকে তাকিয়ে বলে,
–“ঢাকা পৌঁছাতে কতটুকু সময় লাগবে?”
হাসলো মহিলা। হাসি বজায় রেখেই বললো,
–“এইতো৷ আরও দেড় ঘন্টা।”

নওরি মহিলার দিকে তাকিয়ে রইলো। আসলেই কী পৃথিবীতে ভালো মানুষ বেঁচে আছে? হ্যাঁ আছে। তাঁর মাহি আপু এবং এই অচেনা, মিশুক স্বভাবের মহিলাটি। নওরি তাঁর ব্যাগটা জড়িয়ে বসে আছে সপ্তপর্ণে৷ নওরির পাশেই একটি লোক বসেছে। তাই তাঁর ভয়ের অন্ত নেই। গুটিশুটি মেরে বেশ শান্ত হয়ে বসে আছে সে। তবে মহিলার সাথে কথা বললে তাঁর ভয় লাগছে না। হয়তো নওরির পাশের ভদ্রলোক ভেবে নিয়েছে নওরি মহিলার পরিচিত। তাই সে অন্যদিকে ফিরে আছে। নওরি ভয়ে ভয়ে পুরোটা পথ কাটালেও তাঁর সাথে তেমন কিছুই হয়নি।

————————
দল থেকে কল করেছে। সকালে নাকি কোন দিকে লেগেছে। সেখানে পৌঁছানোটা ইরা’দের জরুরি। তাই সে কোনো রকমে রেডি হয়ে বাইক নিয়ে বেরিয়েছে। ঘুমের তাড়নায় চোখ ফুলে লাল হয়ে আছে। তীব্র বাতাসে উম্মুক্ত চুলগুলো বেশ উড়ছে। তাড়াহুড়োয় হেলমেট নিতেই ভুলে গেছিলো সে। নয়তো তাঁর সেট করা চুলের এই বেহাল দশা হতো না। ইরা’দ এক মোড় ঘুরতেই তার থেকে কিছুটা দূরত্বে তার পথে এক মেয়ে এসে দাঁড়ায়। আকস্মিক এসে দাঁড়ানোয় ইরা’দ বেসামাল ভঙ্গিতে খুব জোরে বাইক কষলো। একটুর জন্যে বেঁচে গেছে মেয়েটি। ইরা’দ কিছু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে গরম নজরে সামনে থাকা মেয়েটির দিকে তাকালো। ইরা’দ কিছু বলার জন্যে প্রস্তুতি নিতেই মেয়েটি হন্তদন্ত ভঙ্গিতে ইরা’দের কাছে এসে ইরা’দের এক হাত ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললো,
–“প্লিজ হেল্প মি! আমার ব্যাগটা ছিনতাই হয়ে গেছে।”

ইরা’দ চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে রয় মেয়েটির দিকে। মেয়েটির মাথা ওড়নায় জড়ানো। মুখে ওয়ান টাইম কালো মাস্ক। ইরা’দ থমকে তাকিয়ে রয় সেই আঁখিযুগলের দিকে। সেই চোখের গভীরতা অনুভব করলো ইরা’দ। মেয়েটি ইরা’দের চোখের সামনে চুটকি বাজিয়ে বলে,
–“হ্যালো,, শুনতে পাচ্ছেন?”

ইরা’দ চমকে মেয়েটির দিকে তাকালো। অতঃপর কী বুঝে হালকা গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,
–“তাতে আমি কী করতে পারি?”
–“কী করতে পারি মানে? একটা মেয়ের ব্যাগ চুরি হয়ে গেছে! মানে বিরাট বিষয়! আপনার কী সামান্য রেসপন্সিবিলিটি নেই?”

বলেই এক প্রকার দ্রুত ইরা’দের পিছে গিয়ে বসে মেয়েটি। অভ্যস্ত ভঙ্গিতে নয়। ইরা’দের কাঁধের এক অংশ খামচে ধরে বলে,
–“সোজাসুজি গিয়েছে চোরটা। একটু এগোলেই পাওয়া যাবে।”
–“ও হ্যালো! আমি আপনাকে কেন হেল্প….”
–“আমি নিরূপায় হয়েই আপনাকে বলেছি। নয়তো আমিও কোনো অপরিচিত ছেলের সাথে মিশতাম না। প্লিজ!”

মেয়েটির জন্যে একপ্রকার বাধ্য হয়েই ইরা’দ বাইক স্টার্ট দিলো। বাইক চলার মাঝে মেয়েটি হুট করে বলে ওঠে,
–“এমন সাইকেলের মতো চালাচ্ছেন কেন? বাইকে তেল নেই?”
এবার ইরা’দ বিরক্ত হলো মেয়েটির কথাবার্তায়৷ মেয়েদের এত পটপট একদমই পছন্দ না ইরা’দের। ভ্রু-দ্বয় অসম্ভব কুচকে বললো,
–“আপনি চুপ থাকলে বেশি খুশি হতাম।”
–“স্যরি! আমি একচুয়ালি এত কথা বলি না। কিন্তু টেনশনে আমার মাথা ঠিক নেই।”

ইরা’দ বাইকের স্পিড বাড়িয়ে দিলো। রাস্তা ফাঁকা, স্পিড বাড়াতে বাঁধা নেই। স্পিড বাড়ানোর সাথে সাথে মেয়েটি দুই হাত দিয়ে ইরা’দের শার্ট খামচে ধরলো। ইরা’দ কিছুটা অপ্রস্তুত হলেও নিজেকে সামলে নিলো। কিছু দূর যেতেই দেখলো একজন হাতে ব্যাগ নিয়ে ছুটছে। মেয়েটিও তাকে দেখলো। সেই লোকটির দিকে আঙ্গুল তুলে অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,
–“ওইযে আমার ব্যাগ!”

ইরা’দ সেটি খেয়াল করতেই দ্রুত সেদিকেই ছুটলো। হাতে একটি লোহার রিং ছিলো। যা খুবই শক্ত। লোকটির কাছাকাছি যেতেই ইরা’দ পেছন থেকে সেটা দিয়ে লোকটির মাথায় থাবা দিলো। লোকটি ব্যথায় কুঁকড়ে জমিনে মুখ থুঁবড়ে পরলো। ইরা’দ বাইক থামাতেই মেয়েটি ছুটে এলো তাঁর ব্যাগের দিকে। ইরা’দও মেয়েটির পিছু নিতে গেলেই দেখলো মেয়েটির কাঁধে একটি ব্যাগ। সেই ব্যাগের মধ্যে একটি বিড়াল। বিড়াল দেখে ইরা’দ কিছুটা ভ্রু কুচকালো। নওরি তাঁর ব্যাগটি লোকটির হাত থেকে নিতে যেতেই লোকটি নওরিকে ধাক্কা দিলো। ইরা’দ নওরির পিছেই ছিলো তাই সহজেই নওরির দুই বাহু ধরে তাকে সামলালো। নওরির পিছে ইরা’দকে দেখে লোকটির গলা শুকিয়ে এলো। আবার ব্যাগ নিয়ে পালাতে চাইলেই ইরা’দ খপ করে ধরে ফেললো। লোকটি অন্যহাতে তার পকেট থেকে মিনি ছুঁ!রি বের করে ইরা’দের হাতে কিছুটা আঘাত করে ব্যাগ ফেলেই পালালো।

~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here