এক মুঠো প্রেম রঙ্গনা পর্ব ৩

0
1282

#এক_মুঠো_প্রেম_রঙ্গনা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব তিন |

—————————-
প্রিতমদের বাড়ির ডানপাশে একটি বড়ো উঠান আছে। সেই উঠানে মানুষদের বিচরণ৷ কেউ কেউ চেয়ার টানছে বা কেউ লোহার একটি বারবিকিউ চুলা। এই চুলা অবশ্য নওরি টিভিতেই দেখেছে। সকলেই ব্যস্ত হয়ে ছুটছে৷ পরপর অট্টহাসির শব্দও শোনা যাচ্ছে।

নওরি মুখে ওড়না পেচিয়ে পিটপিট করে সকলকে লক্ষ্য করছে। আকবর বাড়ির সামনে আসার পূর্বেই ফ্রিশা এদিকে সেদিক খেলতে চলে যায়। তাই এই মুহূর্তে ফ্রিশা নওরির সাথে নেই। গেটে দারোয়ান ছিলো না বিধায় নওরি অনায়াসেই ঢুকে পরেছে। তাও ধরা খাওয়ার ভয় কাজ করছে তার মধ্যে। এতগুলো মানুষ দেখেই মূলত তার হৃদয়ে ভীত সৃষ্টি হয়েছে।

নওরি ওদের দেখতে দেখতে একটি আম গাছে পিছে এসে দাঁড়ালো। এই গাছটি দেয়াল ঘেঁষে না হলেও গাছের এলোমেলো ডালপালা দেয়াল ভেদ করে বাইরে চলে গেছে। গাছটা বেশ মোটা এবং শক্ত। নওরির মতো হ্যাংলা পাতলা মেয়েকে অনায়াসেই আড়াল করে ফেলবে। যদি না নওরি নিজেকে সেই ভাবে আড়াল করতে পারে।

সবার মাঝে নিবিড় দৃষ্টি বুলিয়ে দেখতে পেলো প্রিতমের মা কে। তিনি চেয়ারে বসে পাতলা নোটবুক নিয়ে মুখে বাতাস করছেন। বসেছেন গাছের ছায়াতলেই।

হঠাৎ কোথা থেকে প্রিতম চলে আসলো। গাছটার কাছাকাছি। কানে তাঁর ফোন। প্রিতমকে হঠাৎ দেখে নওরি চমকে উঠলো। সেই চমকে ভুলবশত তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিলো অস্ফুট শব্দ।
–“প্রিতম ভাই…”

কন্ঠস্বর ছিলো ক্ষীণ। তাও সেই স্বর প্রিতমের কর্ণধারে প্রবেশ করলো। প্রবেশ করা মাত্র কানে ফোন নিয়ে পিছে ঘুরে তাকালো। প্রিতমের হঠাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকানো দেখে তড়িৎ তার বের করা মাথা গাছের আড়ালে নিয়ে আসলো।

এটা প্রিতম খেয়াল করেছে। এক সেকেন্ডের জন্যে হলেও। পরবর্তীতে নিচের দিকে তাকাতেই দেখলো কামিজের অংশ। এতে ভুল দেখার কোনো সম্ভাবনাও নেই। প্রিতম কলের অপর প্রান্তে থাকা আগন্তুককে বলে ওঠে,
–“আমি তোমায় পরে কল করছি।”

নওরি এদিকে গলায় দম আটকে রেখেছে। ধরা খেলে কী জবাব দিবে সে? সব মানুষ তাঁর দিকে গোল গোল চোখে তাকিয়ে থাকবে, যা নওরির জন্যে লজ্জাজনক। হঠাৎ মেয়েলি কন্ঠে কেউ প্রিতমকে ডেকে উঠলো। প্রিতম হাঁক ছেড়ে বললো,
–“আসছি, অপেক্ষা কর।”

নওরি আঁতকে উঠলো। প্রিতমের কন্ঠস্বর শুনে বুঝতে পারলো প্রিতম তার বেশ কাছাকাছি। আতঙ্কে নওরি মুখে এক হাত চেপে ধরলো। প্রিতম গাছের পেছনে এসে দেখলো নওরি দাঁড়িয়ে আছে। হাসলো সে। গাছে এক হাত দিয়ে হেলান দিয়ে হাসি বজায় রেখে বললো,
–“তাহলে তুমি এখানে দাঁড়িয়ে?”

নওরি চমকে মাথা উঁচু করে তাকালো। প্রিতম অদ্ভুত দৃষ্টিতে নওরির চোখ জোড়া দেখছে। প্রিতমের চোখ জোড়া মুগ্ধতায় ডুবে। বিব্রতবোধ করলো নওরি। নওরি দুই ধাপ পিছিয়ে আমতা আমতা করে বললো,
–“কথা ছিলো।”
–“বলে ফেলো।”
–“আপনার মা আমার জন্যে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে।”
–“হয়তো।” প্রিতমের সহজ স্বীকারোক্তি। নওরি পিটপিট করে প্রিতমের দিকে তাকিয়ে বলে,
–“আপনি মেনে নিচ্ছেন?”

প্রিতমের হাসিটা উধাও হয়ে গেলো। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
–“মায়ের পছন্দ তো নাকোচ করতে পারি না।”
–“আপাকে ভালোবাসেন না আপনি?”

প্রিতম যেন ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। এর মানে কী নওরি রাফিয়া আর তাঁর বিষয়ে সবটা জানে? প্রিতম থমথমে গলায় বললো,
–“বাসি।”
–“তাহলে সব কেন মেনে নিচ্ছেন?”
–“মায়ের তোমায় পছন্দ। আমি চাইলেও বলতে পারছি না।”

নওরি হাসলো। তাচ্ছিল্যের হাসি। হাসি বজায় রেখেই ম্লান কন্ঠে বললো,
–“আপনার ভালোবাসায় বিরাট খাদ আছে প্রিতম ভাইয়া। যদি আপাকে বিয়েই করতে পারবেন না, সেহেতু খামাখা কেন আপার গায়ে প্রেমের রঙ লাগালেন? আন্টি মানবে না, আপনি আন্টিকে জানাতে পারবেন না, এসব চিন্তা-ভাবনা করেই আপনার প্রেম করা উচিত ছিলো।”

নওরি চলে আসতে নিতেই প্রিতম নওরির হাত ধরে আটকালো। বলিষ্ঠ হাতের স্পর্শে নওরির আ!ত্মা কেঁপে ওঠে। চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে প্রিতমের দিকে তাকালো সে।
–“যদি বলি তোমায় বিয়ে করে তোমায় ভালোবাসতে চাই? অধিকার দিবে না?”
–“ছাড়ুন আমার হাত! আপনার মানসিকতা কেমন সেটা আমার বোঝা হয়ে গেছে। খবরদার আমার এবং আমার আপার দিকে নজর তুলে তাকাবেন না।”

প্রিতম হাসলো। এক ফোঁটা রাগ না দেখিয়ে বললো,
–“ঠিকাছে। তবে তোমার দিকে তাকাবো। একশোবার তাকাবো। বিয়ে তো আমাদের হচ্ছেই। সে যাই বলো না কেন! মা! দেখো কে এসেছে। তোমার বউমা এসেছে।”

প্রিতমের মা এসেছিলেন প্রিতমের সাথের মেয়েটা কে দেখার জন্যে। কাছাকাছি আসতেই প্রিতম তাকে ডেকে উঠলো। প্রিতমের মা লম্বা লম্বা পা ফেলে ওদের মাঝে এসে দাঁড়ায়। নওরির মুখ থেকে কাপড়টা সরিয়ে নওরির থুঁতনি চেপে হাসি মুখে বললো,

–“আরে? নওরি যে! এসেছো আবার পালিয়ে যাচ্ছো? ভাগ্যিস প্রিতম তোমায় ধরে ফেলেছে৷ ভালো সময়ে এসেছো। প্রিতমের বন্ধু-বান্ধুবী’রা মিলে পার্টি করবে। তুমিও থাকো।”

নওরি পরলো অস্বস্তির চরম সীমানায়। জড়তার সাথে প্রিতমের দিকে তাকালো। প্রিতম তাঁর দিকে তাকিয়েই মুচকি মুচকি হাসছে। নওরির গা ঘিনঘিন করে উঠলো। পরিস্থিতি সামাল দিতে নওরি জড়তার সাথে আওড়ায়,
–“আমায় যেতে হবে আন্টি। ফ্রিশাকে খুঁজতে খুঁজতে এদিকে এসে পরেছি। দুঃখিত আপনাদের বিরক্ত করার জন্যে।”
–“এমা কী বলছো? কিসের বিরক্ত করলে? আমিও তো বললাম থেকে যেতে।”
–“না, না আন্টি। এখন ফ্রিশাকে নিয়ে চিন্তিত। খুঁজতে হবে ফ্রিশাকে। আপনি আশা করছি আমার বিষয়টি বুঝবেন। আসছি।”

বলেই কোনোরকমে কথা কাটিয়ে নওরি চলে আসতে নিলো, এরকম সময়ই পেছন থেকে কারো মেয়েলি কন্ঠস্বর শুনতে পেলো।
–“মেয়েটা কে ছিলো আন্টি?”
–“তোমাদের প্রিতমের হবু বউ!”

“হবু বউ” শব্দটি শুনে নওরির গা গুলিয়ে আসলো। হাঁটার গতি বাড়িয়ে দ্রুত চলে আসলো কেউ তাকে দেখার আগেই।

——————-
রাতে নওরি বারান্দার কর্ণারে বসে ফ্রিশার খাওয়া দেখছে। এমতাবস্থায় পেছন থেকে তার উপর আ!ক্রমণ হলো। কেউ নওরিকে হেঁচকা টানে দাঁড় করিয়ে ফেললো। নওরি রাফিয়াকে দেখে কিছু বলার পূর্বেই রাফিয়া নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে নওরির গালে শক্ত একটি চ!ড় বসালো।

নওরি এমনিতেই কিছু না খাওয়ার কারণে দুর্বল। দুর্বল শরীরে শক্ত চ!ড় পরায় নওরি টাল সামলাতে না পেরে গ্রিলে গিয়ে পরলো। যার ফলস্বরূপ কপালে জোরে ব্যথা পেলো। অসহনীয় ব্যথায় নওরি ক্ষীণ আর্তনাদ করে উঠলো। রাফিয়া ওই অবস্থাতে নওড়িকে টেনে তাঁর দুই বাহু চেপে চিৎকার বলে উঠলো,

–“চুপ! একদম চুপ! ধো!কাবাজ! দুধ-ভাত দিয়ে এতদিন যে কা!ল সা!প পুষেছি তা তো জানতামই না! এই ছিলো তোর মনে? এতটা নিচে নামতে পারলি তুই?”

রাফিয়া কাঁদছে। চোখে জল থাকলেও ক্রোধে কপালের রগ ফুলে আছে। নওরি ক্রন্দনরত অবস্থায় ভাঙ্গা গলায় বললো,
–“এমন করছো কেন আপা? আমি কী করেছি? আমি…”
–“আরেকটা কথা বললে তোর গালে আরেকটা চ!ড় দিতে সময় লাগবে না। আমার-ই খাস, আবার আমার পেছনেই ছুঁ!রি বসালি? আমার বিশ্বাসের এই মর্যাদা দিলি? প্রিতমের সাথে তোর কী?”

হঠাৎ নওরির কান্না বন্ধ হয়ে গেলো। কী বলছে রাফিয়া? সে কী জেনে গেছে প্রিতমের বাসায় যাওয়ার কথা? নওরি আটকে গলায় বললো,
–“তুমি ভুল বুঝছো আপা। আমি…”
রাফিয়া হঠাৎ নওরিকে ছেড়ে দিলো। হাসতে হাসতে বললো,
–“ওহ তাই? আমি ভুল বুঝছি। বাহ৷ বেশ তো!”

বলতে বলতেই রাফিয়া তার হাতের ফোন থেকে একটি ছবি বের করলো। সেই ছবিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে প্রিতম নওরির হাত ধরে আছে। নওরি নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রয় ছবিটির দিকে। কে পাঠালো এই ছবিটা? কী চায় সে?

–“কী? জবান বন্ধ? তুই এভাবে আমার ভালোবাসায় কুনজর দিবি আমি তা ভাবতে পারিনি রে নওরি। প্রিতমের বন্ধু ছবিটা না পাঠালে আমি হয়তো ভুল বোঝার মধ্যেই থাকতাম! কী পেলি আমায় এভাবে ধো!কা দিয়ে? কীভাবে পারলি?”

শেষ কথাগুলো বলতে বলতে রাফিয়া কেঁদে দিলো। হুঁ হুঁ করে। নওরির চোখেও অশ্রুর মেলা। ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলতে লাগলো,
–“তুমি যেমনটা ভাবছো তেমনটা নয় আপা। আমায় বুঝো তুমি। আমি তো জিজ্ঞেস করতে গেছিলাম কেন তোমায় ছেড়ে আমায় বিয়ের প্রস্তাব দিলো? আমি শুধু এই উত্তরটুকু জানতে গেছি আপা। চোখের দেখা সবসময় সত্যি হয়নি। সবকিছুর মধ্যেই নির্দিষ্ট এক সত্য এবং ঘটনা থাকে।”
–“সেই ঘটনা হচ্ছে তোর সাথে প্রিতমের সম্পর্ক আছে। তাইতো?”

নওরি এবার নির্বাক হয়ে রইলো। রাফিয়া নগন্য দৃষ্টিতে নওরির দিকে তাকিয়ে আছে। মুখে তার তাচ্ছিল্যের হাসি। নওরি শূণ্য নজরে তাকিয়ে রইলো তার আপার দিকে। দুজনের নিশ্চুপ। ফ্রিশা খাবার ছেড়ে বড়ো বড়ো চোখে সবটা দেখলো। নওরির কপালের এক অংশ ফুলে লাল টকবগে হয়ে আছে সেটাও দেখেছে। রাফিয়া চোখ মুছতে মুছতে বললো,

–“আজ থেকে আমি জানবো, আমার কোনো বোন নেই। আমার বোন মারা গেছে, মায়ের সাথেই। তুই ম!রে গেছিস আমার কাছে আজ। তোকে দুই দিন সময় দিলাম, এই বাড়িতে যেন তোকে আর না দেখি।”

বলেই রাফিয়া চলে গেলো। শুধু নওরি-ই সেখানে দাঁড়িয়ে রইলো। ব্যথায়, যন্ত্রণায় বুক ফেটে কান্না উপচে আসছে তার। রাফিয়ার কথাগুলো তীরের মতো করে তার বক্ষে এসে লেগেছে। কিছুটা শুকিয়ে আসা ক্ষ!ততে পুণরায় গভীর ক্ষ’ত সৃষ্টি হলো। হৃদয়ের রক্ত!ক্ষরণ হলো। ফ্রিশা খাওয়া শেষ করে নওরির পায়ে জিভ দিচ্ছে। নওরির গা ঘেঁষছে।

—————–
নিস্তব্ধ লিভিংরুম। আশরাফ সাহেব ঝিমুচ্ছেন ঘুমে। ঘড়ির কাঁটা পৌণে বারোটায়। মৌসুমি আক্তার বারবার ফোন দেখছেন আর আশরাফ সাহেবের ঝিমানো দেখছেন। চোখে-মুখে তাঁর একরাশ বিরক্ত। বিরক্তিতে কপালে পরেছে কতশত ভাঁজ। সপ্তপর্ণে ফুঁসছেনও ক্রোধে। ক্রোধ উপচে আসতে চাইছে যেন। কিন্তু মৌসুমি ক্রোধ উপচে আসার পূর্বেই গিলে নিচ্ছেন। চিন্তায় রীতিমতো মাথা ভনভন করছে।

হাতের সেলফোনে একটি ডায়াললিস্ট দৃশ্যমান। ডায়াললিস্টের সর্বপ্রথম নাম্বারের পাশে জ্বলজ্বল করছে দুইটি সংখ্যা। ৪৭। সাতচল্লিশ বার নাম্বারের মালিককে কল দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেই মালিক রেসপন্স করেনি। সন্ধ্যা থেকে সেই মানবটির সেলফোন বন্ধ। মৌসুমি রাগে-ক্ষো!ভে সবকিছু বিরক্তির সাথে দেখছেন।

আশরাফ সাহেব ঘুমোচ্ছেন ন’টা থেকে৷ কারণ, মৌসুমি খাবারের সাথে লোকটিকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিয়েছিলেন। মৌসুমি ইচ্ছে করে নয় বরং একপ্রকার বাধ্য হয়েই এই পন্থা অবলম্বন করেছেন। যার কারণে আশরাফের কোনো সাড়াশব্দ নেই, সময়েরও খেয়াল নেই।

মৌসুমির নিঃশ্বাস ঘনঘন হচ্ছে। আর সহ্য করতে পারছে না সে। মিনমিন করে শুধালো,
–“ছেলেটা আমায় আর বিন্দুও শান্তি দিলো না।”

হঠাৎ আশরাফ সাহেবের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ফোলা চোখ জোড়া দিয়ে চারিপাশ পরখ করতে লাগলো। হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গায় কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। একটা ঘোরের মধ্যে আছেন যেন। ঘুমের ঘোর।

এদিকে মৌসুমির ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো। যাকে বলে গলা শুকিয়ে কাঠ কাঠ। কপালেও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে যা বেশ ভালো ভাবে টের পেলো সে। এখন কী হবে? আশেপাশে পানি খুঁজলো মৌসুমি। জল তৃষ্ণায় বক্ষ মোঁচড় দিয়ে উঠছে যেন।

আশরাফ সাহেবের মস্তিষ্ক সক্রিয় হতেই সে সটান মেরে বসলো। কোথায় এসেছে এবং কেন এসেছে সেটাও মস্তিষ্ক পরিষ্কার করেছে। আশরাফ সাহেব ঘনঘন পলক ফেলে বললো,
–“দুঃখিত ভাবী। কখন যে চোখ লেগে এলো বুঝতে পারিনি। আপনার ছেলে এসেছে?”

মৌসুমি শুকনো ঢোঁক গিলে বললো,
–“আসছে। কাছাকাছি-ই আছে।”

আশরাফ সাহেব হাত ঘড়িতে সময় দেখতেই তার চোখ কপালে উঠে গেছে। মাঝরাত হয়ে গেছে আর সে কি না এতটা সময় ঘুমিয়েছে? আশরাফ কিছু বলতে নিলেই বাহির থেকে হর্ণের শব্দ এলো। মৌসুমি হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। ভাগ্যিস ছেলেটা সময় মতো এসেছে। নয়তো কত কিছু যে বলতে হতো ভাবতেই গা গুলিয়ে আসছে তার। মৌসুমি মুখে হাসি ফুটিয়ে বসা থেকে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে,
–“ওইতো এসে পরেছে আমার ছেলে। জনসেবা করে তো, তাই মাঝেমধ্যে রাত- ও হয়ে যায় আসতে আসতে। আপনি আরেকটু বসুন, আমার হিরার টুকরো ছেলেকে দেখে যান।”

আশরাফ সাহেব ধৈর্য ধরে আরও কিছুক্ষণ বসলেন। মিনিটখানেকের মধ্যে-ই সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করলো একজন লম্বা – চওড়া, সুদর্শন যুবক। মৌসুমি সদর দরজা খুলেই রেখেছিলেন। ছেলেকে দেখে খুশিতে গদগদ হয়ে গেলেন। তবে ছেলের এলোমেলো হাঁটা দেখে মৌসুমির হাসি উড়ে গেলো। আশরাফ সাহেব কারো পায়ের শব্দ পেয়ে পিছে ফিরে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। প্রথমে মুখে হাসি ফোটালেও পরক্ষণে মৌসুমির মতোই হাসি উড়ে গেলো তাঁর। মৌসুমির ছেলের হাতে বিয়ারের কাচের বোতল। শার্টের দুই একটা বোতাম খোলা। টাই ঢিলে হয়ে আছে। ইন করা শার্টটি একদমই ঠিক নেই। চুল উষ্কখুষ্ক। চেহারার অঙ্গি-ভঙ্গিতে বোঝাই যাচ্ছে ছেলেটি মাতাল।

মৌসুমি ছেলের এই রূপ দেখে আকাশ থেকে পরলেন। এ কী হাল করেছে তাঁর ছেলে। মৌসুমি রাগে চিৎকার দিয়ে উঠলো,
–“ইরা’দ! এসব কী? নিজের এ কী হাল করেছো?”
–“কেন আম্মি? আজ নতুন দেখছো এই হাল? আমি তো প্রায় সময়ই এভাবে বাড়ি ফিরি। আপনার কী মনে হয় আঙ্কেল?

ইরা’দের কথায় আশরাফ সাহেব অপ্রস্তুত হলেন। বেসামাল ভঙ্গিতে কেশে দিয়ে বলে,
–“তুমি কী আসলেই মাতাল বাবা?”
–“কেন? দেখছেন না? চোখে ঝাপসা দেখেন? চোখে সমস্যা হলে আমায় বলুন, আমার একজন ভালো আই ডক্টরের সাথে পরিচয় আছে। আপনি বললে এপোয়েনমেন্ট নিয়ে দিতে পারি।”
–“ইরা’দ!”
–“হোয়াট মা? হেল্প করছি! জনগণের সেবা!”

বলেই ইরা’দ হাসলো। অদ্ভুত হাসি। আশরাফ সাহেব থতমত খেয়ে গেলেন ইরা’দের এরূপ কথাবার্তায়। যা বুঝার তা বুঝেও নিলেন। মৌসুমির দিকে ফিরে বলে,
–“স্যরি ভাবী! আপনার ছেলের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দিবো না। আপনি ছেলের যেমন গুণগান গেয়েছেন, এ বাড়িতে এসে তার এক আনাও প্রমাণ পেলাম না। ভালো থাকবেন, আসছি।”

বলেই আশরাফ গম্ভীর মুখে একপলক এলোমেলো হয়ে দাঁড়ানো ইরা’দের দিকে তাকিয়ে বড়ো বড়ো ধাপ ফেলে বেরিয়ে গেলেন। মৌসুমি তাকে মানানোর জন্যে বেশ কয়েকবার পিছু ডাক দিলেন। কিন্তু আশরাফ সাহেব শুনলেন না। ইরা’দ উঁকি মেরে যখন বুঝলো আশরাফ সাহেব চলে গেছে তখনই ইরা’দ সোজা হয়ে দাঁড়ালো। পাশের সোপিজে বোতলটা রেখে চুল ঠিক করছে হাত দিয়ে। মৌসুমি রাগে গিজগিজ করতে করতে বলে,
–“এর মানে সব অভিনয় ছিলো?”
–“এছাড়া আর উপায় কী বলো? যেভাবে আমার বিয়ে নিয়ে উঠে পরে লেগেছো, আমি বাধ্য হয়েছি!”
–“আমার নাক ডুবাতে তোর লজ্জা করলো না ইরা’দ?”
–“কেউ যদি নিজে থেকে নাক ডুবাতে আগ্রহী হয় তাতে আমার কী করার আছে শুনি?”
–“তো কী তুই বিয়ে করবি না? এভাবেই থাকবি সারা জীবন? সারা জীবন কী তোর রাজনীতি করেই যাবে?”
–“গেলো। করলাম না বিয়ে৷ তবে এর পর থেকে বিয়ের কথা উঠাবা না। নয়তো পরবর্তীতে ভাঙ্গ-চুড় করবো।”
–“কী ভাঙ্গবি?”
–“তোমার ওসব সম্বন্ধীদের মাথা।”

মৌসুমি রাগে কী করবে নিজেই বুঝতে পারলো না। একপ্রকার নিজের চুল টানতে ইচ্ছে করছে তাঁর। এই ছেলের ত্যাড়া কথাবার্তা রীতিমতো তাকে পাগল করে তুলেছে। মৌসুমির সামনেই হঠাৎ বিয়ারের বোতলে চুমুক দিলো ইরা’দ! মৌসুমির এদিকে চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম।
–“এসব কী? তুই এই ছাঁই-পাশ গিলছিস?”
–“কই? কোকাকোলা খাচ্ছি।”
–“বো!কা পেয়েছিস আমাকে?”
–“একদম না। এগুলা কোকাকোলা। অভিনয়ের জন্যে এটায় কোকাকোলা রেখেছি!”
–“মগের মুল্লুক পাইছিস? কোকাকোলা থাকবে এসব বোতলে? তুই কিন্তু নিজের সীমানা অতিক্রম করে ফেলছিস ইরা’দ!”
–“আহ হা! রাগছো কেন? এই বোতল বাজারে এভেলিয়েভল পাওয়া যায়। এই বোতল তো নকল। তুমিও না আম্মি!”

বলতে বলতে ইরা’দ নিজের ঘরের দিকে চলে গেলো। মৌসুমি ইরা’দের কথা বিশ্বাস করলো না। সে বোতলটা নিয়ে নাকের সামনে নিয়ে শুকলো। আজেবাজে গন্ধ আসছে না তবে একপ্রকার গ্যাস তাঁর নাকে এসে বিঁধছে। ডাইনিং টেবিলের সামনে গিয়ে গ্লাসে ঢেলে বুঝলো আসলেই এটা কোকাকোলা। ভালোই কায়দা করেছে ছেলে বিয়ে ভাঙ্গার। বিয়ে ভাঙ্গার কথা মাথায় আসতেই মৌসুমির রাগে মাথা ভনভন করে উঠলো। এত পরিকল্পনা করে, এত কাঠখোড় পুড়িয়েও কোনো লাভ হলো না?
যখন ড্রইংরুমে মা-ছেলের যুদ্ধ চলছে তখন ইরা’দের বাবা সিদ্দিক সাহেব নিজ কক্ষে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।

[কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]
————————-

~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here