#এক_মুঠো_প্রেম_রঙ্গনা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব ২২ |
——————–
–“এটা তো সেদিন-ও বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। এত দ্রুত ভুলে গেলে?”
নওরি ইতস্তত সহিত বলে,
–“নার্ভাসনেসে ভুলে যাচ্ছি!”
ইরা’দ নিরবে শুনলো। পড়া আবার বুঝালো। পরে কী ভেবে পকেট থেকে চুইংগাম বের করে নওরির দিকে এগিয়ে দিলো। নওরি একবার চুইংগাম তো একবার ইরা’দের দিকে তাকাচ্ছে।
–“এটা কেন?”
–“অফ কোর্স খাওয়ার জন্যে।”
–“হঠাৎ?”
ইরা’দ চুইংগামের প্যাকেট খুলতে খুলতে বললো,
–“নার্ভাস হলে মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দেয়, এজন্য অনেক সময় জানা কথা বা পড়াগুলোও ভুলে যাবার সম্ভাবনা থাকে। এজন্য মুখে চুইংগাম রাখো। চিবুলে তোমার মস্তিষ্ক নার্ভাসনেস বুঝতে পারবে না। নাও খাও!”
নওরির প্রথমে জড়তা হচ্ছিলো নিতে। নাকোচ করলেও পরবর্তীতে ইরা’দ জোর করে চুইংগাম মুখে দিয়ে দেয়। অতঃপর বলে,
–“চিবাও আর দ্বিতীয়বার পড়ায় মনোযোগ দাও। আমার বাইরে যেতে হবে। কাজ আছে!”
–“রাজনীতিতে কী শুধু মা!র-পিটই হয়?”
উঠে দাঁড়ানো ইরা’দ নওরির এহেম প্রশ্নে থমকে যায়। পরমুহূর্তে হেসে বলে,
–“জ্বী না। মানুষদের সুবিধা, অসুবিধা দেখা আমাদের কাজ। অ!ন্যায় হলে প্রতিরোধ করা। এছাড়া কাগজ-পত্রের কিছু কাজও আছে। যা তুমি বুঝবে না। আপাতত পড়ায় মনোযোগ দাও।”
ইরা’দ চলে গেলো। নওরি ইরা’দের যাওয়ার পানে তাকিয়ে হাসলো। আজকাল কেন যেন ইরা’দকে তার ভীষণ ভালো লাগে। ইরা’দের সাথে সময় কাটালে যেন পুরানো ক্ষত গুলো হারিয়ে যায়। কেন হয় নওরি জানে না। অদ্ভুত অনুভূতি হয় তাঁর। সবথেকে বড়ো কথা, ইরা’দের দেয়া অতিরিক্ত সম্মানে নওরি মুগ্ধের উপর পর্যায়ে যদি কিছু থাকে তাহলে সেটা! নওরি হাসি থামিয়ে পড়ায় মনোযোগ দিলো।
ইরা’দ সদর দরজা খুলতে গেলে তাঁর মন তেমন খচখচ করে উঠলো। ভ্রু কুচকে পিছে তাকালো। যা ভেবেছিলো তাই! এই বিড়াল এই জম্মেও তাঁর পিছু ছাড়বে না। ইরা’দ জোরে চেঁচিয়ে সারিফাকে ডাকলো। সারিফা হন্তদন্ত হয়ে ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে উদ্বিগ্ন গলায় বললো,
–“কী হয়েছে ভাইয়া!?”
–“এই স্টুপিড বিড়ালকে সরা আমার থেকে। এটা আজ নওরির পিছু পিছু আমার বাসা পর্যন্ত চলে গেছে। আর এখন আমার সাথেই যাবার প্ল্যান করছে!”
চেঁচামেচি শুনে নূরজাহানও আসলো। ইরা’দের মুখে ফ্রিশাকে নিয়ে অভিযোগ শুনে মুখ টিপে হাসলো। সারিফা গোমড়ামুখো ফ্রিশাকে কোলে নিয়ে বলে,
–“তুমি যাও। ফ্রিশা আর যাবে না!”
ইরা’দ ফ্রিশার দিকে একপলক গরম চোখে তাকিয়ে বেরিয়ে গেলো।
—————-
একমাস লাগিয়ে বিভিন্ন পাবলিক ভার্সিটিতে এডমিশন টেস্ট দিলো নওরি। নওরিকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করেছে সৈকত সাহেব এবং ইরাদ। তবে সৈকত সাহেব-ই বেশি সময় দিয়েছেন। তিনি এ নিয়ে ভীষণ ক্ষুব্ধ। কিন্তু স্ত্রীর অসংখ্য অনুরোধে তিনি আর না করতে পারেননি। কিন্তু এই গরমে এত মানুষের ভীড় ঠেলে চলাচল তাঁর জন্যে বড্ড কষ্টসাধ্য ব্যাপার। সৈকত সাহেব মুখে কিছু না বললেও তাঁর চেহারা – ভঙ্গি স্পষ্ট জানান দিচ্ছে যে তিনি কতটা বিরক্ত। নওরি বুঝেও একদম চুপ থাকে। মন-প্রাণ দিয়ে দোয়া করে যেন সৈকত সাহেবের কষ্ট বিফলে না যায়। মানুষটা আসলেই খেটেছে নওরির জন্যে। নওরি যেন একটা পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স পেয়ে যায়!
পরীক্ষা শেষে বের হবার পর সৈকত সাহেবের কল আসলো। সৈকত সাহেব কানে ফোন দিয়ে কথা বলে নেয়। অতঃপর কল কেটে বলে,
–“আমার অফিস আছে যেতে হবে।”
নওরি চোখ বড়ো বড়ো করে সৈকত সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলে,
–“আমি কী তাহলে একা যাবো?”
–“আমি বেপরোয়া নই যে তোমায় একা ছাড়বো। ইরা’দ আসবে নিতে। তুমি গেটের কাছে অপেক্ষা করো। আর এই নাও তোমার ফোন!”
বলেই সৈকত সাহেব নওরির ফোনটা দিয়ে চলে যায়। নওরি গেটের কাছেই নিরবে দাঁড়িয়ে রয়। চারপাশে মেলা মানুষের ভীড়ে নিজেকে বড়োই একা লাগছে নওরির। তবে নওরি পর্যবেক্ষণ করে দেখছে ভীড়ের মাঝে থাকা কিছু মানুষদের। বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রী’রা তাদের বাবা-মায়ের সাথে এসেছে। তাদের মুহূর্তও প্রাণভরে দেখছে নওরি। এর মাঝে বক্ষঃস্থলে শূণ্য অনুভূত হলো। খা খা করে উঠলো অন্তঃস্থল। কেন তাঁর মা নেই? বাবা কেন থেকেও নেই? আজ বড্ড মনে পরছে তাদের। মনে পরছে সেই দিনের কথা; যেদিন নওরির বাবা নিজে রাফিয়াকে নিয়ে ভার্সিটি ভর্তি করাতে নিয়ে গেছিলো। কী হাসি-খুশি ছিলো তাঁর বাবা। আজও চোখের সামনে ভাসছে সেই দিনটি। রাফিয়া, নওরির বাবা; সে কী হাসা-হাসি।
বুক চিরে দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসতে চাইলো যেন। নওরি বাঁধ সাধলো না। সপ্তপর্ণে চাপা দীর্ঘশ্বাসটি মুক্ত করলো। এসব নানান স্মৃতি চারণ করার মুহূর্তে-ই পেছন থেকে হাতে হেঁচকা টান পেলো। নওরি বাস্তবে ফিরে ঘাড় বাঁকিয়ে পিছনে তাকালো। পেছনে তাকাতেই সেই চিরচেনা পারফিউম নাকে এসে বিঁধলো। অপ্রস্তুত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো নওরি। তাঁর সম্মুখে দাঁড়িয়েছে ইরা’দ। বরাবরের মতোই তাঁর মুখে মাস্ক এবং চোখে কালো সানগ্লাস। এ রূপেও ইরা’দকে চিনতে অসুবিধে হয় না নওরির। নওরি বলে,
–“এসেছেন?”
–“হুম। পরীক্ষা ভালো হয়েছে?”
–“হ্যাঁ।”
–“তাহলে চলো। ভীড়ে থাকার দরকার নেই। রোদের যা উত্তাপ!”
নওরি হ্যাঁ, না কিছু বললো না। ইরা’দ নওরির হাত ছাড়লো না। বরং নওরির হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে সাবধানে চলাচল করতে থাকে। ইরা’দের ভাব-ভঙ্গি এমন, হাত ছাড়লেই নওরি ছোট বাচ্চার মতো ভীড়ের মাঝে হারিয়ে যাবে। নওরি আনমনেই হাসলো। এই ছোট ছোট যত্নগুলো খুব-ই প্রশান্তিময়, একরাশ ভালো লাগার।
ইরা’দ উবার নিয়ে এসেছে। এখান থেকে তাদের বাসা মিনিমাম দুই ঘন্টার পথ। জ্যামেরও কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাঁর উপর যা গরম। বাসে করে যাওয়াও সম্ভব না। অন্তত ইরা’দের পক্ষে তো অসম্ভব এবং অসম্ভব।
গাড়ি চলতে শুরু করেছে। ইরাদ ফোন চালাতে ব্যস্ত। নওরি আড়চোখে ইরাদকে খেয়াল করছে। ইরাদ মাস্ক এবং চশমা খুলে ফেলেছে। উবারের ভেতরে ঠান্ডা কৃত্রিম হাওয়া বিচরণ।
–“বাহিরে মাস্ক পরেন কেন?”
–“সেফটির জন্যে!”
–“কিসের?”
ইরাদ ফোন রেখে নওরির দিকে তাকালো। হাসার চেষ্টা করে লহু কন্ঠে বলে,
–“সব জায়গাতে-ই আমার শত্রু’রা ওঁৎ পেতে থাকে। তাঁরা আমার চেয়েও আমার আপন, প্রিয়জনদের ক্ষতি করতে বেশি পছন্দ করে। এজন্য আমার সাথে জড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর জন্যে এই পথ অবলম্বন করতে হয়!”
–“মাস্ক পরিহিত আপনাকে চিনতে পারে না কেউ?”
–“না। সানগ্লাসও চোখে দেই, এজন্য চেনা সম্ভব হয় না।”
–“এই কাজে যেহেতু এতই বিপদ, তাহলে ছাড়ছেন না কেন?”
–“যেটা রক্তের সাথে মিশে যায় সেটা কী ছাড়া সম্ভব?”
নওরি ফ্যালফ্যাল নজরে তাকিয়ে রয় ক্ষণিক সময়। “প্রিয় মানুষ” শব্দ দুইটি কেমন ভেতরটা নাড়া দিয়ে উঠলো যেন। ইরাদ ফোনের দিকে তাকিয়েই বলে,
–“তোমার দেখা শেষ হলে চলো লাঞ্চ করা যাক। খেতে খেতেই নাহয় বাকিটা পথ পার করবো। অথবা দৃষ্টিকথনে এই লম্বা পথ পাড়ি দিবো। এখন বলো, কোন অপশনটা বেছে নিতে রাজি?”
——————-
বাসায় আসতেই নওরি অচেনা একজন মেয়েকে দেখতে পেলো। পোশাক – আশাকে মর্ডান মনে হয়। দেখতেও দারুণ মেয়েটা। বৈঠকঘরে মেয়েটি নূরজাহান এবং সারিফার সাথে গল্প করছে। নওরিকে প্রথমে নূরজাহান দেখতে পেলো। অমায়িক সুন্দর হাসি দিয়ে এগিয়ে এলেন। নূরজাহানের সাথে সেই অচেনা মেয়েটিও নওরির দিকে তাকালো। সারিফাও মুচকি হাসি দিয়ে নওরির দিকে তাকিয়ে আছে। নূরজাহান এগিয়ে আসলে নওরি সপ্তপর্ণে সালাম দেয়। নূরজাহান বেশ মিষ্টি হাসি দিয়ে সালামের উত্তর নিয়ে বলে,
–“পরীক্ষা কেমন হলো?”
–“জ্বী আন্টি ভালো।”
–“যাক, তাহলে তো ভালোই হলো। ভেতরে চলো আমার কাছে। কিছু জানানোর আছে!”
নওরি দ্বিরুক্তি না জানিয়ে নূরজাহানের পিছে চলে গেলো। যাওয়ার পূর্বে একপলক মেয়েটিকে পুণরায় দেখে নিলো। মেয়েটির চাহনিতে কীরকম অহং এবং অশান্ত মনোভাব অনুভব করলো নওরি। পরমুহূর্তেই মনের ভুল ভেবে বিষয়টি এড়িয়ে গেলো।
নূরজাহান নওরিকে রান্নাঘরে এনে বললো,
–“আফিফাকে দেখেছো?”
–“কে আফিফা?”
–“সারিফার সাথে বসেছিলো যে মেয়েটা!”
নওরির মাঝে হালকা অপ্রস্তুত ভাব আসলো। আমতা আমতা করে বললো,
–“দেখেছি।”
–“কেমন?”
নওরি জড়তার সঙ্গে বললো,
–“ভালো।”
নূরজাহানের চোখ-মুখ হঠাৎ চকচকে হয়ে গেলো। ঝলমলে চোখে কিচেনের বাহিরে একপলক তাকিয়ে নিলো নূরজাহান।
–“কিন্তু আন্টি উনি কে?”
–“তুষারের হবু স্ত্রী। আমি ওকে তুষারের জন্যে পছন্দ করেছি। মেয়েটাও তুষারকে খুব পছন্দ করে।”
—————
–“মৌসুমি কই রে? হুনলাম নূরজাহানে নাকি হের পুলার লেইগা মাইয়া ঠিক করছে? হাছানি?”
মাজেদা বেগম পান মুখে নিয়ে উচ্চস্বরে কথাগুলো বলছিলেন। পান মুখে মানেই তাঁর ফুরফুরে আমেজ। কথা বলতেও আলাদা শান্তি বিরাজ করে। ইদানীং ডাক্তার, হাসপাতাল আর ছেলের বাড়ি করতে করতেই কেটে গেছে। কতদিন তাঁর প্রিয় লাঠিটার যত্ন নেয়া হয় না। আজ সময় নিয়ে লাঠিটাকে তেল দিচ্ছে আর নরম কাপড় দিয়ে মুছে নিচ্ছে। এমতাবস্থায় রুমে প্রবেশ করলো নিদ্র। কোলে তাঁর ফ্রিশা। নিদ্র শুনেছে মাজেদা বেগমের চেঁচিয়ে বলা কথাগুলো।
–“কেন গো নানু। আমার ভাইয়ের জন্যে বউ ঠিক হয়েছে বলে কী তুমি হিংসে করছো?”
মাজেদা বেগম চোখ উল্টে নিদ্র’র দিকে তাকালো। ফ্রিশাকেও ভালোভাবে লক্ষ্য করলো।
–“এই পাকনা কাডাল আইলি কইত্তে? আর এইডি কী-সব পশু-পাখি ছাদনাতলায় আনছিস?”
–“এটা বিড়াল নানু। ওর নাম ফ্রিশা। বুড়ো বয়সে পশুর একটা নাম জানো না?”
–“চুপ কর! কানা না আমি। আমি ভালোভাবেই দেখতাছি ওইডা বিলাই। এই বিলাই তুই আনছিস কেন? দূর হ! এসব ছাইপাশ আমার এহানে কী?”
–“কী বলছো? সারাজীবন তো ইসলাম নিয়ে জ্ঞান দিলা, অথচ এটা জানো না আমাদের নবীজি(স.) এর বিড়াল পছন্দ! এখন তো মনে হচ্ছে আমার না বরং তোমার ক্লাস টু তে ভর্তি হওয়া উচিত। আমি তো তোমার থেকেও জ্ঞানী!”
–“এসব আলতু-ফালতু কথা বলতে আইছিস তুই? শেষবার কইতাছি! ভাগ নয়তো এই লাঠি দিয়া তোর পাছা লাল করুম। সাহস কতো বড়ো, আমারে জ্ঞান দেয়!”
ফ্রিশা তৎক্ষণাৎ বিছানায় উঠে গেলো। অসাবধান বশত পানের বড়ো বোয়ামটা ঠাস করে পরলো। যার ফলে বিছানা জর্দা, সুপারি, পান এবং নানান মশলায় ছড়াছড়ি। এসব দেখে মাজেদা বেগম ঘর কাঁপানো চিৎকার দিয়ে উঠলো। ফ্রিশা আরও কিছু সর্বনাশ করার পূর্বেই নিদ্র ফ্রিশাকে নিয়ে দ্রুত কেটে পরে।
——————
আজ নওরির রেজাল্ট দিয়েছে। প্রতিটি ভার্সিটি থেকেই। সকাল থেকে রেজাল্ট দেখে নওরির পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেলো। তাঁর এতদিনের পরিশ্রম, সংগ্রাম এক নিমিষেই যেন হাওয়ায় মিশে গেলো। প্রাপ্তির পাল্লা ভারি হবার পূর্বেই যেন সব খুঁইয়ে পথে বসে পরলো নওরি। কেন সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনা এভাবে ঘুরে গেলো? সে কী ভালো থাকতে পারবে না, নাকি ভালো থাকাটা তাঁর ভাগ্যে নেই?
~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের অপেক্ষায় আছি।