এক মুঠো প্রেম রঙ্গনা পর্ব ২০

0
940

#এক_মুঠো_প্রেম_রঙ্গনা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব ২০ |

——————————
–“ইরা’দ তাঁর কথা রাখে। সরে দাঁড়ান।”

নওরি হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে। ইরা’দের দিকে হতবিহ্বল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রইলো কিয়ৎক্ষণ। কিছু মুহূর্তের জন্যে বাকশক্তিও হারিয়ে ফেললো৷
–“শুনতে পাননি?”
–“কেন এসেছেন?”
–“কথা রাখতে।”
–“কোন কথা?”
–“কলের কথা ভুলে গেছেন? অলরেডি বিশ মিনিট হয়ে গেছে।”

নওরি মনে পরলো ইরা’দের বলা কথাগুলো। ফোনের কথা তো মাথাতেই ছিলো না। খাওয়া-দাওয়া করে নূরজাহানের সাথেই বসে পরেছিলো। নওরি কিছু বলার জন্যে প্রস্তুতি নিতেই নূরজাহানের কন্ঠস্বর কর্ণধারে প্রবেশ করলো।
–“কে এসেছে নওরি? আরে! আমার বড়ো নিদ্র যে। বাইরে দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে আসো!”

ইরা’দ নওরির দিকে তাকিয়ে চোখ তাকিয়ে আড়ালে চোখ টিপ দিলো। নওরি বিষম খেলো। ইরা’দ বাহির থেকে নওরির একদম নিকটে এসে দাঁড়ায়। নূরজাহান ততক্ষণে ভেতরে চলে গেছে। ইরা’দকে নিজের কাছে আসাতে নওরি নিঃশ্বাস গলায় আটকে গেলো। মাথা উঁচু করে ইরা’দের দিকে তাকাতেই ইরা’দ মৃদু স্বরে বলে,
–“আপনাকে স্পর্শ করার ইচ্ছে নেই। কিন্তু আপনি চাইলে আমি নিজে থেকে আপনাকে দরজার সামনে থেকে সরিয়ে দিবো!”

ইরা’দের এরূপ উক্তিতে নওরি চোখ কপালে উঠে যায় অবস্থা। কথাগুলোও কেমন শিহরণ বইয়ে দিলো সর্বাঙ্গে। নওরি তড়িৎ নিজ থেকে সরে দাঁড়ালো। হতবুদ্ধি সব হারিয়ে ফেলেছে একদম। ইরা’দ ঘাড় বাঁকিয়ে নওরির দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি দিলো। অতঃপর নওরিকে আপাদমস্তক দেখে বলে,
–“সাদাতেও আপনাকে সুন্দর লাগছে। হাতে চুড়ি থাকলে হয়তো আরও সুন্দর লাগতো।”

বলেই হনহন করে ভেতরে চলে গেলো। নওরি গোল গোল চোখে ইরা’দের যাওয়া দেখলো। কী আজব ছেলে। এর মতিগতি বোঝার জো নেই। ইরা’দ সামনে থাকলে নওরি তো পুরোই বো!কা বনে যায়। কী হচ্ছে তাঁর সাথে? অদ্ভুত!

——–
–“ইরা’দ বাবা, এই সময়ে আসলে যে!”
ইরা’দ নূরজাহানের সোফার পেছনে মূর্তির মতো দাঁড়ানো নওরির দিকে একপলক চাইলো। অতঃপর গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,
–“মা নেই। চায়ের তৃষ্ণা পেয়েছে। তাই এখানে চলে আসলাম!”

নওরির কেন যেন মনে হলো ইরা’দ মিথ্যে বলছে। আদৌ চা খাওয়ার জন্যে এসেছে নাকি অন্যকিছু? নূরজাহান সুর তুলে বলে,
–“ও আচ্ছা। কিন্তু ভাবী কোথায় গেলো?”
–“বলতে পারছি না। হয়তো শপিং এ।”
–“ভাই কী ব্যাংকে?”
–“হ্যাঁ। নানুও ঘুমোচ্ছে।”
–“ভালো করেছো এসে। নওরি চা বানিয়ে খাওয়াবে তোমাকে।”

নওরি চমকে তাকালো নূরজাহানের পানে। ইরা’দের দিকে তাকাতেই ইরা’দ চমৎকার হাসি দিলো। এই হাসি দেখে নওরির ভেতরটা কেমন ধ্ক করে উঠলো। নূরজাহানের অবাধ্যও হলো না। নওরি কিচেনে চলে গেলো। চা বানাতে বানাতে ভাবছে ইরা’দের কান্ডগুলো। ইরা’দের বাঁকা কথা, তাঁর আলাদা কেয়ার করা, রাগ দেখানো সবই তাঁর মস্তিষ্কে তরঙ্গিত হচ্ছে। গম্ভীর স্বভাব অন্যদের ক্ষেত্রে দেখলেও নিজের ক্ষেত্রে কখনো দেখেনি নওরি। হয়তো ইরা’দের কান্ডগুলো কোনো কিছুর ইঙ্গিত, যা নওরির মন আন্দাজ করলেও মস্তিষ্ক অবুঝ হয়ে আছে। এছাড়া নওরি তো এসব ভাবতে নতুন শহরে আসেনি। এসেছে জীবনকে নতুন সুযোগ দিতে। নিজেকে শক্তভাবে তৈরি করতে। তাহলে? সব কেন এলোমেলো লাগছে তাঁর?
–“কী ভাবছেন এত?”

নওরির ধ্যানে ছেদ ঘটে পুরুষালি ভরাট কন্ঠস্বরে। নওরি ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায়। ইরা’দ দাঁড়িয়ে। দৃষ্টি সন্দিহান।
–“আপনি এখানে?”
–“চায়ের খোঁজ নিতে আসলাম। না জানি উল্টো পাল্টা কিছু মিশিয়ে দেন।”
–“মেশাবো কেন?”
–“আমিও তাই ভাবছি। আপনার থেকে এসব আশানুরূপ নয়। আপনি তো সরল মানুষ।”

নওরি হাসলো। তাঁর হাসির সাথে তাল মিলিয়ে ইরা’দ হাসলো। যদিও ইরা’দের নিবিড় দৃষ্টি নওরির হাসিতে।
–“আপনি কী সবসময়ই এমন মজার মানুষ?”
–“ওমা! মজার মানুষ? আসলেই?”
–“মাঝেমধ্যে।”
–“আমার স্বভাব রংধনুর মতো। কখনো হাসি, কখনো রাগি। কখনো আবার আপনার মতে মজার মানুষ৷”

নওরি পুণরায় হাসলো। ইরা’দ দুই ধাপ এগোলো। ইরা’দের আগানো দেখে নওরির হাসি উড়ে গেলো। পিছিয়ে পেছনের শেল্ফের সাথে লেপ্টে গেলো। ইরা’দ শেল্ফে এক হাত রেখে নওরির দিকে ঝুঁকে বললো,
–“সত্যি বলবো?”
–“ক..কী?”
–“কাঁপছেন কেন?”
–“স..সরুন।”
–“গরম লাগছে। পারবো না। বাই দ্য ওয়ে, সত্যিটা বলি। আমি আপনার উপর রেগে আছি। অল্প! এখন আপনার হাতের চা খেলে রাগ ঝড়ে যাবে। সেদিন তো আপনার স্টুপিড বিড়ালটার জন্যে চা খেতে পারিনি। আজ খুব তৃপ্তি সহকারে খাবো!”

কোথা থেকে আবারও ইরা’দের পায়ে সুঁড়সুঁড়ি লাগলো। যাকে বলে মারাত্মক ধরণের সুঁড়সুঁড়ি। ইরা’দ ছিটকে দূরে সরে দাঁড়ালো। নওরির পায়ের কাছে ফ্রিশা অবস্থান করছে। ইরা’দের বুঝতে বাকি রইলো না ফ্রিশা সেদিনের মতোই তাঁর পায়ে এসে বসেছে। বিরক্তিতে ইরা’দের কপালে পরেছে কতশত ভাঁজ। নওরি পায়ের কাছে ফ্রিশাকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। আরেকটুর জন্যে তো দম আটকে মা!রা পরতো সে৷ ইরা’দ বিরক্তি প্রকাশ করে বললো,
–“ওকে! তবে আগের বারের মতো আমার চা পান করায় যেন ব্যঘাত না ঘটায়! আপনার বিড়ালকে সাবধান করে দিন!”

ফ্রিশা পিটপিট করে ইরা’দের দিকে তাকালো। অতঃপর কয়েক ধাপ এগোতেই ইরা’দ লম্বা লম্বা পা ফেলে বেরিয়ে যায় কিচেন থেকে। ফ্রিশা ইরা’দের পেছনে ছুটতে গেলে নওরি ওকে কোলে তুলে নেয়।
–“মিঁয়্যাও!”
–“তাকে বিরক্ত করিস না! আমার সাথে থাক!”
–“মিঁয়্যাও!”

এমন সময়-ই নিদ্র এলো। নিদ্র এসে নওরির কাছে ফ্রিশাকে চাইলো।
–“ফ্রিশাকে আমায় দাও।”
–“কেন?”
–“নিদ্র ভাইয়া বলেছে। ভাইয়া ওইদিনও ফ্রিশার জন্যে চা খেতে পারেনি। আমায় দাও। আমি ওকে নিয়ে ছাদে যাবো!”

—–
–“ইরা’দ বেশ তৃপ্তি নিয়ে চা পান করলো। আজ কোনো বাঁধা, বিপত্তি নেই। কী মজা করেই না খেয়েছি।”

নওরি দূরে দাঁড়িয়ে নিরবে শুনলো শুধু। নূরজাহান ইরা’দের সম্মুখেই বসে। নওরি শূণ্য কাপটি টি-টেবিলে রেখে বলে,
–“যেজন্য এসেছি। সারিফা বললো নৌরি ফুলের পড়া বুঝতে সমস্যা হয়!”

নওরি চমকে তাকালো ইরা’দের পানে। সারিফা কী ইরা’দকে তাঁর সমস্যার কথা বলে দিয়েছে? নূরজাহান অবাক হয়ে বলে,
–“তাই নাকি? আমি তো জানতাম না? নওরি? এটা কী সত্যি?”
নওরি মাথা নিচু করে ফেলে। খুবই ধীর গলায় জবাব দেয়,
–“জ্বী আন্টি!”
নূরজাহান কিছু বলার পূর্বেই ইরা’দ বলে ওঠে,
–“আজ থেকে আমি আপনাকে পড়াবো নওরি। চাচী, তোমার বাসায় আসা-যাওয়া বাড়লে তোমার কোনো সমস্যা হবে না তো?”

ইরা’দের মুখে “আপনি” সম্বোধনটা নওরির ভীষণ লজ্জাজনক লাগলো। কী ভাববে নূরজাহান তাকে? বেমানান এই সম্বোধন নওরিকে যেন মাটির সাথে মিশিয়ে দিচ্ছে একদম। নূরজাহান বলে,
–“কীসব বলছো তুমি বাবা। কিসের সমস্যা? আসো। এতে নওরির-ই উপকার হবে।”

—————–
এডমিশনের দিন যেন ঘনিয়ে এসেছে। ইরা’দ নওরিকে বেশ ভালোভাবেই পড়িয়েছে। ইরা’দ রাজনীতি ভালো জানলেও তাঁর জ্ঞান ভান্ডার দেখে নওরি ভীষণ মুগ্ধ। নূরজাহান আন্টির কাছে শুনেছে, ছাত্রজীবনে ইরা’দ ভীষণ ভালো ছাত্র ছিলো। পড়াশোনাতেও তাঁর অধিক ধ্যান ছিলো। তাইতো সময়-সাপেক্ষে বইয়ের সাথে বন্ধুত্ব করে উঠেছিলো চরম গম্ভীর মানুষ। কথা কম বলাও তাঁর স্বভাবের অন্যতম। কিন্তু নওরির সামনে কী করে যে তাঁর স্বভাবটি ব্যতিক্রম ধারণ করে তা তার জানা নেই।

ইরা’দ রাজনীতি ভালোবাসতো। এজন্যই একজন রাজনীতিবিদ হয়ে দেখিয়েছে। এই পজিশনের জন্যে সে কয়েক বছরের পরিশ্রম ঢেলেছে। যেরূপ পড়াশোনা করেছে, সেই পর্যায়ে চাকরি করতে গেলে আজ তাঁর ভালো পজিশন হতো। কিন্তু ওইযে, মন-মস্তিষ্কে রাজনীতি ধারণ করেছে সে। রাজনীতিও অবশ্য খারাপ নয়। তবে খারাপ লাগা এক জায়গাতেই আটকে। মা!রা-মা!রি এবং সংঘর্ষে। মৌসুমির তো এটা ভেবেই প্রেশার বেড়ে যায়, যে তাঁর পড়ুয়া ছেলে এসবে কী করে জড়িয়ে গেলো।

নওরি একবার জিজ্ঞেস-ও করেছিলো। ইরা’দ মুচকি হাসি দিয়ে বলেছিলো,
–“আমাদের দেশটায় আসল নেতার বড্ড অভাব। এ দেশের যা দু!র্নীতি, তাতে সব দেখেও না দেখার ভান ধরা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি নিজে একজন সৎ নেতা হয়ে দেখাবো। যার জবানের মতোই হবে তাঁর কাজ-কর্ম। আবার আমি নিজেকে নিয়েও প্রসংশা করছি না। মানুষ মাত্র-ই ভুল। আমারও আছে। মহান নই আমি। তবে ভুলগুলো শুধরে নেবার চেষ্টা করি।”

ইরা’দকে বুঝতে নওরির জন্যে একটা মাস-ই যথেষ্ট ছিলো। ইরা’দকে যত দেখেছে ততই মুগ্ধ হয়েছে। ঘর এবং বাহির কতটা নিখুঁত ভাবে সামলায়। ক্লান্ত শব্দটা তাঁর মধ্যে ধারণ করতে দেখেনি নওরি।

এক সপ্তাহ পর এডমিশন। নওরি টিউশনির থেকে ছুটি নিয়ে দিন-রাত এক করে পড়ছে। তাঁর একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স পাওয়া। এ নিয়ে ইরা’দের সাহায্যও ছিলো ব্যাপক। সময় এখন সন্ধ্যা সাতটা ঊনিশ। মাগরিবের নামাজ সেরে নওরি পড়তে বসেছে। মিনিটখানেকের মধ্যেই কলিংবেলের শব্দ পেলো। নওরি জানে কে এসেছে। কিছুক্ষণ পর ইরা’দ আসলো।
–“দেখি কী পড়ছেন!”

নওরি হঠাৎ পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়লো ইরা’দের দিকে।
–“আপনি কেন আমায় “আপনি” সম্বোধন করেন? ধারণা করছি আপনি আমার থেকে প্রায় দশ-এগারো বছরের বড়ো! এত বড়ো ছেলে হয়ে আমার মতো পিচ্চি মেয়েকে “আপনি” সম্বোধন করছেন। এটা বড্ড অস্বস্তিকর আমার জন্যে!”

—————————
~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম। মন্তব্য ভালো আসলে ইন-শা-আল্লাহ্ রাতে আরেকটি পর্ব দেবার চেষ্টা করবো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here