এক মুঠো প্রেম রঙ্গনা পর্ব ১৭

0
1046

#এক_মুঠো_প্রেম_রঙ্গনা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব ১৭ |

———————-
মাজেদা বেগম চোখ-মুখ অসম্ভব কুচকালো। এদিকে ইরা’দের এরূপ উক্তিতে নওরির হেঁচকি উঠে গেলো। আর মৌসুমির কাশি। নিদ্র দ্রুত ছুটলো ডাইনিং টেবিল থেকে পানি আনতে। যেভাবে হাওয়ার বেগে গিয়েছে সেভাবেই হাওয়ার বেগে একটি পানির বোতল নিয়ে আসলো নিদ্র। দ্রুত নওরির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,
–“এটা খাও, হেঁচকি চলে যাবে।”

নওরি নিদ্রকে কোনো উত্তর না দিয়েই দ্রুত ভঙ্গিতে পানির বোতল খুলে ঢকঢক করে কয়েক ঢোঁক খেয়ে নিলো। সারিফা গিয়েছে মৌসুমিকে সামলাতে। ইরা’দ নওরিকে কোণা চোখে দেখে মুখ টিপে হাসলো।

মাজেদা বেগম তিক্ত স্বরে বললো,
–“নাউজুবিল্লাহ, আস্তাগফিরুল্লাহ। তওবা তওবা! আমার নাতির বউ হইবো এই মেয়ে? আমার নাতির জন্যে তো রাজকন্যে আনবো আমি।”
ইরা’দ নওরির দিকে কোণা নজরে তাকিয়ে বলে,
–“তাহলে তুমি আরেকজন কে বিব্রত করছো কেন? আমিও তো বলিনি, তোমার নাতবউ এখনই রাজকন্যা থেকে রাণী হয়ে তোমার রাজার হালে আসবে।”

নওরি পানি মুখে নিয়ে গোল গোল চোখে ইরা’দের দিকে তাকালো। ইরা’দের নজর এবং কথাবার্তা নওরির মাথার উপর দিয়ে গেলো। সে দ্রুত নজর ঘুরিয়ে ফেললো। ইরা’দ আলতো হেসে মিনমিন করে বলে,
–“যতই চোখের নজর ঘুরিয়ে নিন, হৃদয়ের নজর তো ঠিকই এদিকে পরে আছে।”

ইরা’দের কন্ঠস্বর ছিলো অত্যন্ত ধীর। যা মাজেদা বা মৌসুমি পর্যন্ত পৌঁছালো না।
–“সেই নাহয় বুঝলাম, তা তুই মাইয়া মানুষের পাশে বইসা রইছিস কেন?”
–“যাতে তোমার ভুলভাল কোনো কথা আমার প্যান্ট ঢিলে না করে। এই সোসাইটিতে যথেষ্ট সম্মানের পাত্র আমি। তুমি না বুঝলে কে বুঝবে আমার সুইটহার্ট নানু?”

বলতে বলতেই ইরা’দ নওরির পেছন দিয়ে হাত নিয়ে নিদ্র’র পিঠে চিমটি কাটলো। নিদ্র লাফ দিয়ে উঠে ঘাড় বাঁকিয়ে পিছে তাকালো। ইরা’দের হাত দেখে নিদ্র মাথা বের করে ইরা’দের দিকে তাকালো। ইরা’দ হেসে হেসে মাজেদা বেগমকে কথায় ব্যস্ত রাখতে রাখতে নিদ্র’র গুলতির দিকে ইশারা করলো। নিদ্র সেই ইশারা বুঝতে পারলেও গুলতি দিয়ে কী করবে সেটা বুঝলো না। তাই কিছু না ভেবে নওরির পাশ ছেড়ে ইরা’দ এবং নওরির মাঝামাঝি যতটুকু ফাঁকা ছিলো, সেই ফাঁকা জায়গায় বসলো। ইরা’দ হাসি, হাসি মুখ করে খুব-ই ধীর গলায় বলে,
–“গুলতির সঠিক সময়ে প্রয়োগের সময় এসেছে নিদ্র। যাও, কাজটা সেরে ফেলো। নানুর হাত থেকে নৌরি ফুলকে বাঁচাও।”

নিদ্র তৎক্ষণাৎ কিছু বুঝতে না পারলেও ধীরে ধীরে বুঝলো৷ মাজেদা বেগম তখনই বলে ওঠে,
–“ওই তুই সর তো! আমি ওরে যা ইচ্ছা প্রশ্ন করুম, তোর কী? মৌসুমি তোর পোলারে ‘ক’ এহান থেইকা যাইতে। পরে আমার মাথা গরম হইলে কী করমু বুঝবার পারতাছোস না!”

মৌসুমি নিজেকে দমিয়ে রেখে কাঠ কাঠ গলায় বললো,
–“ইরা’দ বাবা। এখান থেকে যাও। এখানে তোমার কোনো কাজ নেই। আমি বলছি যেতে!”

ইরা’দ যেন কানেই শুনলো না। উল্টো আরাম করে সোফায় হেলান দিয়ে বলে,
–“আজ খুব ক্লান্ত আমি। সারিফা যা তো সরবত বানিয়ে নিয়ে আয়। তুই না পারলেও তোর এই বোনকে বল। আই হ্যাভ নো প্রব্লেম!”

ইরা’দের এরূপ ত্যাড়া কথায় মৌসুমি রেগে উঠে দাঁড়ালো। কর্কশ কন্ঠে ইরা’দকে ধমকে উঠলো,
–“নিদ্র!!”

সকলে যখন নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত, নিদ্র তখন কৌশলে গুলতি নিয়ে কিচেনের একটি গ্লাসের দিকে শুট মারলো। ভাগ্যক্রমে গুলতিটা কিচেনের জানালা দিয়ে বেরিয়ে গেছে। নিদ্র হাফ ছেড়ে বাঁচলো।

কাঁচ ভাঙার শব্দে সকলে কিচেনের দিকে তাকালো। নিদ্র ভালো ছেলের মতো চুপটি মেরে বসে রইলো। নওরি দেখেছে নিদ্র’র গুলতি মা!রা। কিন্তু সে বুঝেনি যে নিদ্র কাঁচ ভাঙবে। কিন্তু এই সময়ে নিদ্রকে কিছু বলার সাহস হলো না নওরির। দেখেও চুপ থেকে গেলো। মাজেদা বেগম চিন্তিত স্বরে বলে,
–“মৌসুমি, কিসের শব্দ হইলো? আয় আমারে উঠা! দেহি কী হইছে ওহানে?”

মৌসুমি কপালে ভাঁজ ফেলে ইতিবাচক মাথা নাড়ায়। অতঃপর মাকে ধরে ওদিকে নিয়ে যায়। মৌসুমি রা চলে যেতেই ইরা’দ নওরির উদ্দেশ্যে বললো,
–“আপনি দ্রুত বাসায় যান। এখানে আর থাকতে হবে না!”

নওরি উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
–“কেন?”
–“তিক্ত কথা শোনার ইচ্ছে থাকলে থেকে যান!”
নওরি বিরক্ত হলো। প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উল্টো ত্যাড়া কথা শুনাচ্ছে? এটা কীরকম অ!ভদ্রতা?
–“সোজা উত্তর দেয়া উচিত ছিলো।”
–“আমার উত্তর দেবার স্টাইল-ই এটা। সারিফা, ওনাকে নিয়ে যা তো!”

সারিফা ইতিবাচক মাথা নাড়িয়ে নওরির দিকে এগিয়ে এলো। নওরিও বিনা-বাক্যে সারিফার সাথে চলে গেলো। ইরা’দ নিদ্র’র সাথে হাই ফাইভ করে বলে,
–“গুড জব। তোকে আরও গুলতি কিনে দিবো। এখন তুইও যা!”
–“ওকে নিদ্র ভাইয়া!”

বলেই নিদ্র খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে চলে গেলো। ততক্ষণে মাজেদা বেগম বিলাপ করতে করতে বৈঠকঘরের দিকে আসছিলো।
–“বিলাই আইছিলো মনে হয়! বাপের সম্পদ পাইছে তো এজন্যেই জানালা দিয়া আইসা একখান গেলাস ভাইঙা আবার পলাইছে। অ!সভ্য বিলাইয়ের জাত!”

বৈঠক ঘরে দুজনে এসে চমকালো। কারণ, কেউ নেই। মাজেদা বেগম ইয়া বড়ো হা করে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,
–“কই গেলো সব?”

————————
পড়তে বসার পরপর নওরির বেশ কয়েকবার নিদ্র’র কথা মাথায় এলো। যদিও নিদ্র তাঁর পাশে-ই বসে আছে। কিন্তু ব্যাপারটা সেটা নয়। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটাটা নওরিকে ভাবাচ্ছে। পড়ায় মনোযোগ দেয়া নিদ্র’র দিকে এক পলক তাকালো নওরি। পরে কী ভেবে বলে,
–“তুমি এখানেই বসে পড়ো নিদ্র। আমি আসছি!”

নিদ্র চঞ্চল চোখে নওরির দিকে তাকিয়ে উপরে নিচে মাথা নাড়ালো। নওরি নিদ্র’র মাথায় হাত বুলিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। নওরি গেলো সারিফার রুমে। সারিফা তখন পড়ার ফাঁকে ফাঁকে ফোন চালাচ্ছে। নওরি চৌকাঠে দাঁড়িয়েই সারিফাকে ডাকলো। সারিফা চমকে মোবাইল বইয়ের নিচে লুকিয়ে নওরির দিকে তাকালো। নওরি আলতো স্বরে বলে,
–“নিক্স বা মুভ জাতীয় ব্যথার মলম আছে?”
–“আছে আম্মুর কাছে। আমার কাছেও একটা নিক্স রয়েছে। কেন?”
–“একটু দরকার দিবে?”
–“কেন আপু? তুমি ঠিকাছো?”
–“হ্যাঁ ঠিকাছি। কিন্তু সময়ের তো আশ্বাস নেই।”

সারিফা আর কথা না বাড়িয়ে ড্রয়ার থেকে নিকস বের করে ফেললো। সারিফা সেটা নওরির হাতে ধরিয়ে দিতে গিয়ে বললো,
–“বুঝেছি। এডমিশনের জন্যে তো প্রচুর পড়াশোনা। মাঝেমধ্যে মাথা ব্যথাও উঠতে পারে। প্রব্লেম নেই, এটা তোমার কাছে রেখে দিতে পারো। আমার এসব লাগে না।”
নওরিকে সেভাবে কিছু উল্লেখ করলো না এবং সারিফার কথার উত্তরেও কিছু বলার প্রয়োজনযোধ মনে করলো না। মুচকি হেসে নিকসটি নিয়ে চলে এলো।

নিদ্র হাতে ছোট আমটি নিয়ে বসে আছে। পড়ায় মনোযোগ নেই তাঁর। বরং আমটি খাওয়ার জন্যে মনে তীব্র এক আকাঙ্খা এবং উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। নওরির অনুপস্থিতিতে সারা ঘর খুঁজে অবশেষে তাঁর সাধের আমটি পেয়েছে।

নওরির উপস্থিতি টের পেলে নিদ্র চট করে আমটি লুকিয়ে ফেললো। নওরি চেয়ারে বসতে বসতে বললো,
–“দেখি নিদ্র এদিকে ফিরো!”

নিদ্র চমকে নওরির দিকে তাকায়। নওরি একপলক নিদ্র’র দিকে তাকিয়ে বিনা-বাক্যে নিদ্র’র চেয়ার টেনে নিজের দিকে ফেরালো। নিদ্র বড়ো বড়ো চোখে নওরির দিকে তাকিয়ে বলে,
–“কী হয়েছে?”
–“সেটা তো তুমি বলবে। ব্যথা কোথায় কোথায় পেয়েছো সেটা বলো?”
নিদ্র আকাশসম বিস্ময় নিয়ে নওরির দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে,
–“তুমি কী করে বুঝলে নৌরি ফুল?”
–“যেভাবে বসেছিলে, কিছুটা ধারণা হয়েছিলো। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটা দেখে নিশ্চিত হয়ে গেলাম। এখন বলো, ব্যথা কোথায় পেয়েছো আমায় বলো। আমি মলম লাগিয়ে দিচ্ছি!”

নিদ্র মুখ ছোট করে হাটুতে এবং ডান কনুইয়ে দেখিয়ে দিলো। দুই জায়গায় নীলচে ভাব ফুটে উঠেছে। যা দেখে নওরি চমকে উঠলো।
–“এ কী নিদ্র! পরে যাওয়ার কথা কাউকে বলোনি কেন?”
–“ভয় পেয়েছিলাম। সুযোগও হয়নি। তবে বাথরুমে গিয়ে পানি দিয়েছি ব্যথার জায়গা গুলোতে।”

নওরি তড়িৎ গতিতে নিকসের মুখটা খুলে ফেললো। নিদ্র’র ব্যথার জায়গাতে অতি যত্ন সহকারে মলম লাগিয়ে দিতে দিতে বলে,
–“এটা অন্যায়! ব্যথা পেলে তোমার অবশ্যই বলতে হবে। পরবর্তীতে আর লুকাবে না। ঠিকাছে?”

নিদ্র ইতিবাচক মাথা নাড়ায়। কিছুক্ষণ নিরবতা চললো। হঠাৎ নিদ্র বলে ওঠে,
–“তুমি এত ভালো কেন নওরি ফুল?”
–“তুমি যে ভালো ছেলে তাই।”

নিদ্র হাসলো। সাথে নওরিও। দু’জনের কাজ কর্ম সৈকত সাহেব দরজায় দাঁড়িয়ে দেখছিলো। কী মনে করে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে নিজের রুমের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হলেন।

———————–
–“কখনো তো দেখিনি কোনো মেয়ের ধারেকাছে, তো আজ কোন অষ্টম আশ্চর্য হলো যে তুই ওই মেয়ের পাশে বসে ওই মেয়ের হয়ে কথা বলতে বসেছিলি?”

ইরা’দের উত্তর নেই। সে এক মনে টিভিতে নিউজ দেখতে ব্যস্ত। গুরু-গম্ভীর মুখশ্রী। বড্ড সিরিয়াস অভিব্যক্তি। ছেলের তরফ থেকে মৌসুমি পাত্তা না পেয়ে তেঁতে উঠলেন।
–“কিছু জিজ্ঞেস করেছি ইরা’দ! উত্তর দে। নয়তো টিভি বন্ধ করে দিবো!”
–“কিসের উত্তর?”
–“ওই মেয়ের সাথে এত কী তোর? আগে থেকেই চিনিস নাকি?”
–“চিনলে তোমার কী?”
–“আমার উত্তর এটা নয়।”
–“হ্যাঁ চিনি। এর বেশি বলা সম্ভব না। কফি লাগবে আমার, মাথা ম্যাজম্যাজ করছে!”
মৌসুমি অসম্ভব রকম রেগে গেলেন।৷ রাগ গলায় আটকে কিড়মিড় কন্ঠে বললেন,
–“তোর জন্যে নতুন মেয়ে দেখেছি। আগামী পরশুই আমার সাথে মেয়েটাকে দেখতে যাবি ব্যাস!”

——————————

~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।
রিচেক দেয়া হয়নি। ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন। চেষ্টা করছি নিয়মিত হবার। এখন একান্ত-ই আপনাদের প্রেরণা প্রয়োজন৷ গঠনমূলক মন্তব্যের অপেক্ষায় থাকলাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here