#এক_মুঠো_প্রণয়
#সিজন_টু
#পর্ব_০৯
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ
মিথিকে স্বভাবত বেশ চঞ্চল আর চতুর প্রকৃতির দেখালেও আসলে সে বোকা। বলা চলে নরম মনের মেয়ে। তাই তো ছোটবেলা থেকে যে বাবাকে ভয় পেত, মার খাওয়ার ভয়ে বাবার সামনে পর্যন্ত যেত না সে বাবারই অসুস্থতা দেখে আহাজারি করে কাঁদতে লাগল। আর যায় হোক ছোটবেলা থেকে সে পিতামাতা বলতে শুধু বাবাকেই চিনেছে, জেনেছে। মাকে তো তার মনেও পড়ে না। এমনকি মায়ের মুখটাও মনে নেই।মারুক, শাসন করুক তবুও বাবাকে বাবা হিসেবে চিনত তো? দেখতে তো পেত?মাকে তো সে চিনেও না। মা যেমন ছুড়ে ফেলে রেখে চলে গিয়েছিলেন বাবা কিন্তু সেভাবে তাদের ছুড়ে ফেলেও দেয়নি। এদিক থেকে বাবা শত খারাপ হলেও মায়ের থেকে ভালো নয় কি? মিথি আওয়াজ তুলে কাঁদতেই থাকল এসব ভেবে। ওপাশে জ্যোতি বারংবার প্রশ্ন করলেও উত্তর এল না মুখে। গলা দিয়ে শব্দ বের হতে চাইল না।তবুএ সবশেষে অস্ফুট স্বরে শুধু এইটুকু বলল,
“ আ ব্ বা! আব্বারে হসপিটালে নিয়ে গেছে জ্যোতি।আব্বা খুব অসুস্থ! ”
কথাটা শুনেই ঠোঁট চাপল জ্যোতি।এতদিনের সূক্ষ চিন্তাটা, আশংকটা যেন সত্যি হয়ে গেল। কিছুটা হলেও বুঝা হয়ে গেল সবটা। মিথিকে উত্তরে কি বলা উচিত ঠিক বুঝে আসল না তার। মিথির মতো বোধহয় তারও কান্না পেল। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো আব্বার সম্পর্কে। কিন্তু এই মুহুর্তে মিথিকে কিছু জিজ্ঞেস করা মানেই মেয়েটা দ্বিগুণ গতিতে কান্না শুরু করবে। তাই শুকনো ঢোক গিলে নরম স্বরে বলল,
“কিছু হবে না মিথি। চিন্তা করিস না,সব ঠিক হয়ে যাবে।আমি মিনার ভাইকে কল দিয়ে সবটা জেনে নিই হুহ? রাখি?”
শেষের শব্দটা অনেকটাই নরম হয়ে শুধাল জ্যোতি। মিথির কান্নার বেগ বোধহয় সেই নরম স্বর শুনেই বেড়ে গেল। কাঁদতে কাঁদতেই কল রেখে ছুটে গেল দাদীর কাছে৷ ওপাশে জ্যোতি দীর্ঘশ্বাস ফেলল৷ সঙ্গে সঙ্গে কল দিল মিনারকে।মিনার কল তুলল না।একবার, দুবার তিনবার অসংখ্যবার কল দিল। অথচ কল তুলল না সে। অবশেষে বাড়ির অন্যদের কাছেই কল করতে লাগল। শেষ পর্যন্ত তার ছোট চাচার কাছ থেকে জানতে পারল তার বাবা স্ট্রোক করেছেন।অবস্থা খুব বেগতিক বলেই ওখানকার হসপিটালে রাখেনি। অবশেষে শহরের হসপিটালে আনারই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো।সাথে মিনার আর তার চাচাই আসবেন৷ জ্যোতি সমস্তটা শুনে চুপ রইল। অবশেষে কল রেখেই চোখ বুঝে নিল। মনে হলো কোথাও একটা ছায়া সরে যাচ্ছে। কোথাও যেন জীবনের নিশ্চায়তা বিলীন হয়ে যাচ্ছে৷নিঃশ্বাস যেন ঘন হয়ে আসল। ইচ্ছে হলো মিথির মতোই বিলাপ জুড়ে কান্না করতে।কিন্তু পারল না।শুধু চোখজোড়া লালাভ হয়ে টলমল করল। তবুও সামনে রিতু আছে বলেই কাঁদল না। দাঁতে দাঁত চেপে শুধু প্রার্থনা করল ভালো হয়ে যাক তার বাবা৷ এবার সুস্থ হলেই সে সুন্দর করে কথা বলে আসবে বাবার সাথে। বাবা যতই শক্ত হোক সে নমনীয়তা দেখাবে বাবার সামনে।বাকি সব মেয়ের মতো বাবার যত্নও করবে। এসব কথা ভেবেই ঠোঁট কাঁমড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করল জ্যোতি।রিতু বোধহয় সে দৃশ্য দেখেই জিজ্ঞেস করে উঠল,
“জ্যোতি? কি হয়েছে তোর? এমন করছিস কেন? ”
জ্যোতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার দ্বারে গেল। বলল,
“আব্বা স্ট্রোক করেছে রিতু। শহরের হাসপাতালেই আনছে।আনতে আনতে বোধহয় আরো রাত হবে তাই না?হোস্টেল থেকে অতো রাতে বের হতে দেবে? ”
রিতু অবাক হলো। পরমুহুর্তেই জ্যোতির দিকে পা বাড়িয়ো কাঁধে হাত রাখল। নরম গলায় বলল,
“ বলে রাখলে দেবে না কেন?তুই চিন্তা করিস না জ্যোতি, ঠিক হয়ে যাবে। ”
রিতু আশ্বাসের সুরে কথাটা বললেও জ্যোতি খুব একটা শান্তি পেল না।ফের কল দিল মিনারের ফোনে।মিনার কল তুলল এবারে।জানাল, জ্যোতির বাবাকে নিয়ে এম্বুলেন্সে করে তারা রওনা হয়েছে। এখানে শহরে চেনা পরিচিত বলতে কেবল গ্রামের প্রতিবেশি হিসেবে মেহেরাজদের পুরো পরিবারই।থাকার সমস্যার কথা ভেবে তাই জ্যোতির ছোট চাচা মেহেরাজের চাচাদেরও জানিয়েছে বিষয়টা।খুব দ্রুতই এসে পৌঁছাবে তারা।
এটুকু জানানোর পরই মিনার ব্যস্ত হয়ে কল কাঁটতে নিল। জ্যোতি উদাসীন গলায় প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠল,
“ মিনার ভাই?আমি এখানে অপেক্ষা করব। এসে একবার জানিও আমায় মিনার ভাই। আমি আব্বাকে না দেখা পর্যন্ত ছটফট করব। প্লিজ, আমায় এসে একবার নিয়ে যাবে? ”,
মিনার ভরসা দিল,
“ এত চিন্তা করছিস কেন?মামার কিছু হবে না জ্যোতি। আমি পৌঁছালেই তোকে জানাব। ”
“ আমি অপেক্ষায় থাকব মিনার ভাই। জানিও আমায়। ”
মিনার এবারে ফের কথা বলল না। রেখে দিল কল। জ্যোতি ফোনের স্ক্রিনে একপলক চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।উপর দিয়ে স্থির থাকলেও ভেতরে যেন তার গুমোটবাঁধা চিন্তার বাস। অনেকটা রাত পর্যন্ত প্রায় সেভাবেই চিন্তা নিয়ে কাঁটাল সে৷ অপেক্ষা করল মিনারের ফোনকলের। কিন্তু অনেকটা সময় কেঁটে যাওয়ার পর ও মিনারের কল আসল না। বরং তার বদলে কল আসল মেহেরাজের। জ্যোতি অবশ্য আননোন নাম্বার হওয়াতে জানল না এটা মেহেরাজের কল। মিনারের কল ভেবেই দ্রুত কল তুলল। ওপাশ থেকে শোনা গেলা মেহেরাজের ব্যস্ত গলা,
“ হসপিটালে কি এখন ই যাবি জ্যোতি? ”
মেহেরাজ খবরটা তখনই ওর চাচাদের কাছ থেকে পেয়েছিল। এক মুহুর্তের জন্য মনে হয়েছিল জ্যোতিকে কল করে জানানো উচিত খবরটা। পরমুহুর্তে চিন্তা করবে ভেবেই আর জানায়নি। কিন্তু জ্যোতি যে বিষয়টা আগেই জেনেছে তা জানতে পেরেছে চাচারা সহ জ্যোতির বাবাকে হসপিটালে এডমিট করানোর সময়ই। তারপরই মিনারের কথা শুনে জ্যোতির নাম্বার নিয়ে ছুটে আসল এখানে।তবুও যেন অস্থিরতা কমল না।অস্থিরতাটা কি জ্যোতিকে নিয়েই? বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে নিশ্চয় মেয়েটা ভেঙ্গে পরেছে?ভাবনাটা বোধহয় সত্যিই হলো। ওপাশ থেকে জ্যোতির বিনয়ী স্বরে প্রশ্ন আসল,
“আপনি জানেন কি আব্বা কেমন আছে?”
মেহেরাজ উত্তর দেওয়ার মতো কিছু খুঁজে পেল। এডমিট করিয়েই তো চলে এসেছে।আর কিছু জানাও হয়ে উঠেনি। তাই উত্তর না দিয়েই বলল,
“ তোর হোস্টেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি জ্যোতি৷ এখানে কথা বলে নিয়েছি, তুই নেমে আয়। ”
জ্যোতি অপেক্ষা করল না এবারে। মেহুর ভাই আর চেনাজানা ভালো বলেই মেহেরাজের পরিচিতি আছে এখানে।সে অনুযায়ী বলতে গেলে, মেহেরাজের কথানুযায়ী এত রাতেও হোস্টেল থেকে তাকে যাওয়ার অনুমতিটা সহজেই দিয়ে দিবে এটা স্বাভাবিক৷ জ্যোতি ঘড়িতে সময় দেখল। বুঝল রাত একটা পেরিয়ে গেছে।জ্যোতি আর দাঁড়াল না। রিতুকে বলেই দ্রুত নেমে গেল। রাস্তার আলোতে মেহেরাজকে দেখে এগিয়ে গিয়ে ফের বলল,
“আব্বা কেমন আছেন মেহেরাজ ভাই? ”
মেহেরাজ গম্ভীর গলায় উত্তর দিল,
“ হসপিটালে এডমিট করিয়েই এসেছি এখানে। বাকিসব ওখানে গেলে জানা যাবে জ্যোতি। ”
জ্যোতি ঠোঁট চেপে নিঃশ্বাস ফেলল। নরম গলায় বলল,
“ মিনার ভাই না এসে আপনাকে পাঠাল যে?”
“ ও চেনে?তাছাড়া ও বললেই তোকে যেতে দিত? ”
জ্যোতি কথা বলল না এবারে। কিয়ৎক্ষন পর বলল
“ আমি হসপিটালে যাব মেহেরাজ ভাই। নিয়ে যাবেন আমায়? ”
মেহেরাহ এদিক ওদিক তাকিয়ে রিক্সা খুঁজল। বলল,
“ নিয়ে যেতেই এসেছি। ”
জ্যোতি আর কিছু বলল না। অবশেষে মেহেরাজ রিক্সাম পেতেই উঠে বসতে বলল। জ্যোতি চুপচাপ উঠে বসল। পাশাপাশি উঠে বসল মেহেরাজও৷ ভরাট গলায় জিজ্ঞেস করল,
“রাতে খেয়েছিস? ”
নিষ্প্রভ কন্ঠে উত্তর দিল জ্যোতি,
“খাবার খেতে ইচ্ছে হয়নি। ”
“ তুই খাবার না খেলে তো চাচা সুস্থ হয়ে যাবে না জ্যোতি।”
ফের দীর্ঘশ্বাস ফেলল জ্যোতি। উত্তে দিল,
“জানি। ”
এরপর অবশ্য বাকিটা পথ আর কথা হলো না কারোরই।তবুও পাশাপাশি বসে যেন উপে দিয়ে স্বাভাবিক থাকা জ্যোতির সমস্ত হাহাকার টের পেল মেহেরাজ। বয়ে গেল তার মাঝেও অস্থিরতার শীতল স্রোত!
.
মেহু আজও ঘুমাল না। হুট করেই তার সমস্ত ঘুম উধাও হয়ে গেল বলেই বোধ হলো তার। তার উপর মেহেরাজ সেই কখন বেরিয়েছিল এখনও ফেরেনি। কেন গিয়েছে, কোথায় গিয়েছে কিছুই জানল না।শুধু জানাল একটা দরকারে যাচ্ছে। মেহু বসে বসে অপেক্ষা করল ভাইয়ের ফেরার জন্য। ঠিক তখনই কল এল সাঈদের৷ এত কষ্ট, এত অভিমানের পরেও মেহু কলটা না তুলে পারল না।ওপাশ থেকে পুরুষালি গলাটা শুধাল,
“কেমন আছো মেহু?”
মেহু তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসল৷ জানাল,
“সেটা তো আপনার জানার প্রয়োজন নেই। ”
সাঈদ ওপাশে তপ্তশ্বাস ফেলল।জানার প্রয়োজন নেই?সত্যিই কি জানার প্রয়োজন নেই? এই যে সেদিন এতোটা কান্না করে তার কাছে ভালোবাসা ভিক্ষা চাইল সেদিনের পর সাঈদের দিনগুলোও খুব ভালো কেঁটেছে?সেই কান্নাভেজা গলাটার কথা ভেবেই কি সকাল থেকে রাত প্রতিটাক্ষন অস্থিরতায় কাঁটায়নি সে?মেহেরাজের কাছ মেহুর জ্বরের কথা শুনে কি তার একটিবার কল করে খোঁজ নিতে মন চায়নি?চেয়ছিল তো। তবুও অনেক কষ্টে নিজেকে দমন করেছিন। আজ যেন সে দমন করাটা আর খাটল না।নিয়ন্ত্রন রাখতে পারল না আর নিজের উপর। তাই তো অস্থিরতা মেটাতে কল করে বসল মেহুকে। সাঈদ ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কথাগুলো ভাবল। প্রসঙ্গ বদলে বলল,
“ মেহু?ছেলেটাকে নিষেধ করে দিলে? ”
মেহু উত্তর দিল,
“আমি করিনি, ভাইয়া বলেছে।কেন?”
“ছেলেটা তোমায় ভালোবাসত। ”
মেহু হাসল। বলল,
“ভালো তো আমিও আপনাকে বাসতাম সাঈদ ভাইয়া। ”
সাঈদ এবারে কিঞ্চিৎ হাসল। কৌতুক স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“এখন বাসো না আর?”
মেহু শক্ত গলায় জবাব দিল,
“ বাসি না। ”
সাঈদ এবারেও হাসল। গলায় রসিকতা টেনে বলল,
“জাস্ট দুদিনেই ভালোবাসা শেষ?আমার থেকেও ফার্স্ট দেখছি তুমি!”
মেহুর ভালো লাগল না কথাগুলো। বিপরীতে বলে উঠল,
“এত রাতে কল দিয়েছেন কেন?এসব বকবক করার জন্য? আমি নিশ্চয আপনার প্রেমিকা নই সাঈদ ভাইয়া যে কল দিয়ে যখন তখন এসব বকবক করবেন।”
সাঈদ এবারও রসিকতা নিয়ে শুধাল,
“ প্রেমিকা হতে চেয়েছিলে তো? ”
ফের শক্ত গলায় জবাব দিল মেহু,
“এখন আর চাই না। ”
সাঈদ এবারে চুপ হয়ে গেল। কিয়ৎক্ষন পর হঠাৎই সব রসিকতা বাদ দিয়ে শান্ত গলায় বলে উঠল,
“ জানো মেহু? আমার মনে হচ্ছে আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে পারছি না।কি যন্ত্রনার বিষয়।”
“ রাখছি, ঘুমাব৷ ”
সাঈদের মন খারাপ হলো। এতদিন পর এটুকু কথাতে কি তার অস্থিরতা মিটল? জানা হলো কি মেহু কেমন আছে? নাহ তো।তাই কথা বলার জন্য নতুন প্রসঙ্গ খুঁজে বলে উঠল হাসি হাসি গলায়,
“আমি তোমাদের বিয়ের জন্য সত্যিই উৎফুল্ল হয়ে অপেক্ষা করছিলাম। ”
মেহু বিরক্ত হলো খুব।জিজ্ঞেস করল,
“ হ্যাঁ তো?”
সাঈদের গলাটা এবার নরম শোনাল। জিজ্ঞেস করল,
“ তুমি ভালো আছো মেহু?”
মেহু উত্তর দিল না। মুখের উপরই কলটা রেখে দিল। যাকে ভালোবাসবে না, যার সাথে সম্পর্কে জড়াবে না কখনো তার সাথেই কেন এই রাতদুপুরে কথা বলতে হবে? তার খোঁজটাই কেন নিতে হবে?তাকে কি ফের আরো বেশি দুর্বল করে দিতে চায় সাঈদ?
#চলবে….
[ অনেক ব্যস্ত বলা চলে। কি লিখেছি জানা নেই। এই সিজনটাও হয়তো তাড়াহুড়োতেই শেষ হবে,গুঁছানো হচ্ছে না কেন জানি। যায় হোক, কেমন হয়েছে জানাবেন।]