#এক_মুঠো_অনুভূতি💖
লেখিকা- তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:০৭
বারান্দায় বসে বসে সন্ধ্যার আকাশ দেখছে আশ্বিন। সেদিন ওহিকে তার বাসায় পৌঁছে দেওয়ার পর থেকে আর দেখা হয়নি তাদের।
মেয়েটিকে বিরক্ত করে তার রাগী রাগী সেই মুখটা দেখতে খুব ভালো লাগে আশ্বিনের। ওহির কথা মনে হতেই একটা মুচকি হাসি দেয় সে।
–এখানে বসে কি করছো বাবা?
আশ্বিন পাশে ফিরে মায়ের দিকে তাকিয়ে,
–কিছু না আম্মু। এমনি বসে আছি।
–এই নাও তোমার কফি।
আশ্বিন মুচকি হেসে কফির মগ হাতে নিয়ে।
–এটাই দরকার ছিলো এখন। ধন্যবাদ আম্মু।
আশ্বিনের মা তার মাথায় হাত বুলিয়ে,
–মন খারাপ, বাবা?
–না আম্মু। কাল তো ভার্সিটিতে নবীন বরণ। এই ক’দিন ধরে অনুষ্ঠানের জন্য ব্যাস্ত ছিলাম। এখন খুব টায়ার্ড লাগছে। তার উপর আবার ওই চিরকুট লেখককে নিয়ে টেনশনে আছি। যেভাবে হুমকি দিচ্ছে, আবার কোনো ঝামেলা না করে বসে।
–আশ্বিন, কোন সমস্যা হলে সাথে সাথে তোমার বাবাকে ফোন করে জানাবে। একা একা ঝামেলায় জড়িয়ে যেও না আবার।
–তুমি চিন্তা করো না আম্মু। আমিও ভেবেছিলাম আব্বুর সাহায্য নিবো। এখন দেখা যাক কি হয়।
আশ্বিনের মা মুচকি হেসে মাথা নেড়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে আশ্বিনের দিকে তাকিয়ে,
–তারপর বলো, তার কি খবর?
আশ্বিন মায়ের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে,
–কার কথা বলছো তুমি?
–আরে তার, ওইদিন রোদ বললো না কোন মেয়ে। সানগ্লাস নাকি চশমা, কি জানি বললো রোদ্দুর?
আশ্বিন মায়ের থেকে মুখ ফিরিয়ে হেসে উঠে,
–ফাইজার কথা বলছো?
–আচ্ছা, তাহলে মেয়েটার নাম ফাইজা..।
–হুম। এক মিনিট, কি ভাবছো তুমি? আম্মু, তুমি যা ভাবছো তেমন কিছুই না। ফাইজা এবার ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছে। এসেই এক কাহিনীর মাধ্যমে তার সাথে আমার পরিচয়। তুমি জানো, সে আমাকে চ্যালেঞ্জ করেছে আমার রেজাল্টের রেকর্ড ভাঙার?
–তাই নাকি? তার মানে খুব ভালো স্টুডেন্ট সে।
–হুম। মেয়েটা না, একদম বাচ্চাদের মতো। একটুতেই রেগে যায়, গাল ফুলিয়ে বসে থাকে। তাকে রাগাতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। সেদিন কি হয়েছে জানো?
আশ্বিন হেসে উঠে মায়ের দিকে ফিরে কথাটা বলে আপনমনে ওহির গল্প মাকে বলতে থাকে। আশ্বিনের মা মুচকি হেসে আশ্বিনের দিকে তাকিয়ে তার কথাগুলো শুনতে থাকে। এই প্রথম আফরা ছাড়া অন্য কোন মেয়েকে নিয়ে আশ্বিনের মুখে প্রকাশ পাচ্ছে এতো সব গল্প! মা আগ্রহী নয়নে তাকিয়ে আছে আশ্বিনের দিকে।
রাতে,
ওহি পড়ার টেবিলে বসে আপন মনে বই পড়ছে হঠাত ফোনের দিকে চোখ যেতেই সকালের কথা মনে পড়ে যায় তার। মুহূর্তেই সোজা হয়ে বসে সে। কিছুক্ষণ ফোনের দিকে একধ্যানে তাকিয়ে বইটা বন্ধ করে ফোন হাতে নেয়। আজ আফরার কাছ থেকে আশ্বিনের নম্বর নিয়ে এসেছে সে।
সেদিনের পর থেকে এতোদিন ভার্সিটিতে আশ্বিন না আসায় ওহি নিজের অজান্তেই কাজটা করে ফেলেছে।
যার থেকে সে পালিয়ে বেড়াতে চায়, তার এই অনুপস্থিতি যে তাকে এভাবে মিস করাবে জানা ছিলো না ওহির। প্র্যাক্টিস শেষে অডিটোরিয়ামে যখন একা বসে থাকে তখন তাকে বিরক্ত করে রাগিয়ে দেওয়ার জন্য আশ্বিন এই ক’দিন না থাকায়, আজ তাকে ফোন দিয়ে দুটো বকা দিবে ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে।
ফোন হাতে নিয়ে আশ্বিনের নম্বর বের করে কল দিবে কিনা এই নিয়ে কিছুক্ষণ দো’টানে ভুগে অবশেষে ফোন দিয়েই বসে।
কিন্তু দুবার রিং হওয়ার পর আশ্বিন ফোন রিসিভ না করায় ওহি যেই না ফোন কেটে দিবে তখনই ফোনের অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসে চিরচেনা সেই কণ্ঠ,
–হ্যালো!
মুহূর্তেই চুপসে যায় ওহি। আশ্বিনের উপর রাগ করে তাকে বকে দেওয়ার জন্য ফোন দিয়ে থাকলেও এখন তার কণ্ঠ দিয়ে কোন কথাই আসছে না আর। এদিকে, অপর প্রান্ত থেকে ক্রমশ ভেসে আসছে আশ্বিনের কণ্ঠ,
–হ্যালো, কে বলছেন? আজব তো! কথা বলছেন না কেনো?
এবার ওহি নিচু সুরে বলে উঠে,
–আশ্বিন ভাইয়া, আমি ওহি বলছি।
হঠাত করে ওহির কথায় আশ্বিন কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে ফোনের স্ক্রিনে নম্বরের দিকে তাকিয়ে,
–তুমি আমাকে ফোন দিয়েছো? আমার নম্বর কোথায় পেয়েছো?
–আফরা আপু দিয়েছে। কেনো? কোনো সমস্যা?
–না, সমস্যা কেনো হবে? কিছু বলবে?
আশ্বিনের কথায় ওহি কিছুক্ষণ চুপ থেকে পড়ার টেবিল থেকে উঠে ধীরে ধীরে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে,
–আপনি এই কদিন ধরে ভার্সিটি আসছেন না। তাই ফোন দিলাম..।
–হুম। নবীন বরণের প্রস্তুতির কাজ নিয়ে এই ক’দিন খুব ব্যস্ত ছিলাম। ভার্সিটিতে গিয়েছিলাম দু এক বার, তখন তোমাদের ক্লাস ছিলো না হয়তো।
–ওহ!
–হুম। আমাকে মিস করেছো নাকি?
আশ্বিনের সোজা সাপ্টা কথায় মুহূর্তেই ওহির বুক ধক করে উঠে। মিস তো করেছেই সে, তাই তো আফরার কাছে নম্বর নিয়ে তাকে ফোন দেওয়া। কিন্তু আশ্বিনের কাছে তা প্রকাশ করলে মুহূর্তেই সে হয়ে উঠবে একজন হাসির পাত্রী। তিল’কে তাল বানিয়ে ফেলতে দু’মিনিট ও ভাববে না আশ্বিন। তাই কথাটা চেপে গিয়ে ওহি বলে উঠে,
–মিস করবো কেনো? আপনি আমার সিনিয়র ভাইয়া, ভার্সিটিতে আসছেন না। তাই আরকি খোঁজখবর নিলাম। তাছাড়া কিছুই না।
ওহির কথায় আশ্বিন শব্দ করে হেসে উঠে,
–দেখেছো? কদিন ভার্সিটি যাইনি, এর মধ্যেই আমার বিরক্ত করাগুলো মিস করছো তুমি। নিশ্চয়ই আমার মতো অন্য কারো উপর রাগ দেখাতে পারছো না। তাই না?
–আপনাকে কে বলেছে এই কথা? শুধু শুধু বেশি বোঝেন। আপনার খোঁজ নেওয়াই দেখছি আমার ভুল হয়েছে।
–আচ্ছা ঠিক আছে, মেনে নিলাম তোমার কথা। এখন রাখছি, কাল দেখা হবে। বাই।
আশ্বিনের কাছে বিদায় জানিয়ে ওহি বারান্দার দোলনায় বসে পড়ে। সত্যিই কি এই ক’দিনেই আশ্বিনের বিরক্ত গুলো খুব মিস করছে সে? উত্তর জানা নেই তার। আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমে চলে আসে।
এদিকে, ওহির সাথে কথা বলে আশ্বিন এখনো মুচকি হেসে তাকিয়ে আছে ফোনের দিকে। নম্বরটা সুন্দর করে চশমা লিখে সেভ করে রেখেছে সে।
মনের অজান্তে দুজনেই মিশে যাচ্ছে দুজনের রোজকার অভ্যাসে। আর, মনের অন্তরালে প্রকাশ পাচ্ছে এক মুঠো অনুভূতির।
পরদিন,
ফারজানা বেগম সকাল থেকে ওহিকে শাড়ি পড়িয়ে চুল আঁচড়ে দিচ্ছেন। ওসমান একবার ওহির রুমে এসে,
–এতোক্ষণ লাগে তোর রেডি হতে? ঘুম থেকে উঠেই দেখছি লেগে পড়েছিস, এখনও হয়না তোর?
–ভাইয়া, আমি কোন সিনেমার নায়িকা না যে, শাড়ি পড়ে চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে চোখে একটু কাজল দিলেই একদম রেডি হয়ে যাবো। মা শাড়ি পড়িয়ে দিয়েছে এখন হালকা করে সাজিয়ে দিবে তারপর আমি রেডি।
–তোকে ভার্সিটি নামিয়ে দিয়ে আমার ক্লাসে যেতে হবে। আজ মনে হচ্ছে আর ক্লাস করতে হবে না আমার।
ওসমান কথাটা বলে ওহির ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। ওহি গাল ফুলিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে,
–মা, দেখেছো তুমি ভাইয়া কেমন করলো?
–দুই ভাই বোন মিলে সারাদিন ঝগড়া করাই তো তোমাদের কাজ। এখন দেখি, তাকাও আমার দিকে।
ওহি আর কথা না বাড়িয়ে মায়ের দিকে ফিরে।
কিছুক্ষণ পর ওহি রেডি হয়ে ড্রইং রুমের দিকে আসতেই ওসমান তার দিকে তাকিয়ে,
–সুন্দর লাগছে তোকে। কিন্ত তোর চশমা কোথায়?
–সাজগোজ করেছি তাই আজ চশমা পড়বো না।
–উষ্টা খেয়ে পড়ে গিয়ে যখন দাঁত ভেঙে ফেলবি, তখন বুঝবি এই সাজগোজ করে তোর কতো লাভ’টাই হয়েছে।
ওসমানের কথায় ফারজানা বেগম মাথা নাড়ল,
–ওসমান ঠিক বলেছে ওহি। চশমা সাথে নিয়ে যাও। ছবি তোলার সময় আর গানের সময় নাহয় চশমা খুলে রেখো।
মায়ের কথায় ওহি চশমা পড়ে ওসমানের সাথে বেরিয়ে এসে জাইমাকে কল করে,
–কোথায় আছিস তুই?
–আমি তো রেডি হচ্ছি। আর বেশিক্ষণ লাগবে না আমার।
–ঠিক আছে। আমি ভাইয়ার সাথে চলে যাচ্ছি। তুই ভার্সিটি পৌঁছে আমাকে ফোন করিস।
–ঠিক আছে।
ওসমান ওহিকে ভার্সিটির সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে যায়। ওহি চুপচাপ ভার্সিটিতে প্রবেশ করে আশেপাশে সবাইকে দেখতে থাকে।
আজ ভার্সিটি খুব সুন্দর করেই সাজানো হয়েছে। মেয়েরা সুন্দর করে শাড়ি পড়ে এসেছে আর ছেলেরা পাঞ্জাবী। ওহি তাদের দিকে তাকিয়ে সামনে ফিরে দেখে দূর থেকে আশ্বিন আর রোদ্দুর কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে।
আশ্বিনকে দেখে ওহি স্তব্ধ হয়ে যায়। এতদিন পর তাকে দেখতে পেয়ে ওহির ঠোঁটের কোণে হাসি ফুঁটে উঠে। এদিকে আশ্বিন কথা বলতে বলতে সামনে তাকাতেই ওহিকে দেখে থমকে যায়। শ্যামবর্ণের অধিকারী এই মায়াবী পিচ্ছি মেয়েটাকে শাড়ি পড়া অবস্থায় দেখে, আশ্বিনের চোখ আটকে যায় তার দিকেই। ওহিও দূর থেকে তাকেই দেখছে।
আশ্বিন ধীর পায়ে ওহির দিকে এগিয়ে আসতে নিতেই হঠাত রাফিন চলে আসে ওহির কাছে। রাফিনকে দেখে আশ্বিন থেমে যায় তারপর কিছুক্ষণ তাদের দিকে তাকিয়ে রোদ্দুরের সাথে চলে যায় সে।
ওহি রাফিনের সাথে কথা বলার সময় আড়চোখে আশ্বিনের চলে যাওয়া দেখে ক্ষুব্ধ হয়। মনে মনে বলে উঠে,
–দেখা করে গেলে কি এমন হতো? আমিও এখন আর কথা বলতে যাবো না। দেখি কি করেন উনি।
–চলবে(ইনশাআল্লাহ)
))