এক মঠো অনুভূতি পর্ব ২২+২৩

0
701

#এক_মুঠো_অনুভূতি💖
লেখিকা- তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:২২ ও ২৩

বিকেলে ওহি আর মা একসাথে বসে টিভি দেখছে। ওসমান তাদের পাশেই ফোন নিয়ে বসে আছে। ওহির মা বিষয়টা এতো গুরুত্ব না দিলেও, ওহি ঠিকই বুঝতে পারছে যে তার ভাই এখন আফরা আপুর সাথে গল্পে ব্যাস্ত। ইদানীং দুজনকে একসাথে প্রায়ই সময় কাটাতে দেখা যায়। দুজনের ভাব ভঙ্গি দেখে ওহির আর বুঝতে বাকি নেই যে দুজন দুজনকে পছন্দ করে।
–ভাইয়া মনে হচ্ছে ইদানীং তুমি খুব ব্যস্ত?
ওহির কথায় ওসমান ফোন থেকে মুখ তুলে ওহির দিকে ফিরে তাকিয়ে,
–না তো, কি নিয়ে ব্যস্ত থাকবো?
–এখন তো তোমার ব্যস্ত থাকার অনেক কারণই আছে।
ওহি ওসমানের দিকে তাকিয়ে একটা ইশারা দিতেই ওসমান বুঝে যায় সে কি বলতে চাইছে। সে কিছু না বলে উঠে দাঁড়িয়ে ওহির মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে রুম থেকে চলে যায়। ফারজানা বেগম কিছুই বুঝতে না পেরে,
–ওসমানের আবার কি হলো?
–অনেক কিছুই হয়েছে মা। সময় হলে বুঝতে পারবে।
ওহির কথার অর্থ বুঝতে না পেরে মা টিভি দেখায় মনোযোগ দেয়।

হঠাত ওহির ঘর থেকে ফোনের শব্দ শুনে সে উঠে এসে দেখে আশ্বিনের ফোন।
–হ্যালো, আশ্বিন ভাইয়া।
–ফাইজা, রাফিনের সাথে এইমাত্র কথা হয়েছে আমার। ঘন্টা খানেক আগে ভালোভাবেই আন্টির অপারেশন সম্পন্ন হয়েছে।
–যাক আলহামদুলিল্লাহ। এখন আন্টি দ্রুত সুস্থ হয়ে গেলেই ভালো হবে। আমি ফোন দিয়েছিলাম রাফিন ভাইয়াকে, হয়তো ব্যস্ত ছিলো তখন।
–হুম। কি করছো তুমি?
–মায়ের সাথে টিভি দেখছি। আপনি?
–রোদ্দুরের সাথে আছি। কাল সন্ধ্যায় আফরার বাসায় দাওয়াত, মনে আছে তো? সময় মতো চলে আসবে কিন্তু।
–ঠিক আছে।
–হুম। আচ্ছা বাই।
–বাই।

আশ্বিন ফোন রেখে রোদ্দুরের দিকে তাকিয়ে,
–ফাইজাকে তো বলে দিয়েছি আসার কথা। কিন্তু আমরা তো এখনো কোন প্ল্যানই করিনি।
–আরে টেনশন করিস না। স্পেশাল কিছুই করবো আমরা। আমি আর আফরা তো আছিই। কি বলিস?
–হুম, আমাদের বাসার ছাদে ডেকুরেশন করলেই মনে হয় ভালো হবে আশ্বিন।
আফরার কথায় আশ্বিন কিছুক্ষণ ভেবে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। আশ্বিনের উত্তর পেয়েই সবাই কাজে লেগে পড়ে।
———————

পরদিন,

একটা নীল রঙের রাউন্ড ড্রেস পড়ে, হালকা সাজে ওহি রেডি হয়ে বসে আছে আফরার বাসায় যাওয়ার জন্য। কিছুক্ষণের মধ্যেই জাইমা চলে এসেছে ওহিকে নিয়ে যেতে।
–এতোক্ষণ লাগে তোর আসতে জাইমা? আর, এতো সাজগোজ করেছিস কেনো?
–কোথায় সাজগোজ করলাম? একটু শুধু..।
–হয়েছে বাদ দে। চল, দেরি হয়ে যাচ্ছে।
ওহি মায়ের কাছে বিদায় নিয়ে জাইমার সাথে আফরার বাসায় চলে আসে। আফরা তখন রান্নাঘরে টুকটাক রান্না করছিলো। ওহি আর জাইমা যেতেই,
–ভালোই হয়েছে তাড়াতাড়ি চলে এসেছো। একা একা এতকিছু করতে পারছিলাম না।
–বাসার বাকিরা কোথায় আফরা আপু?
–সবাইকে আজকে ছুটি দিয়েছি আমি। আর বাবা, শহরের বাহিরে গিয়েছে। রাতের আগে আসতে পারবে না মনে হয়।
ওহি আর কথা না বাড়িয়ে আফরার কাজে সাহায্য করতে থাকে।
জাইমা কিছুক্ষণ আশেপাশে তাকিয়ে,
–রোদ আর আশ্বিন ভাইয়া আসেনি আফরা আপু।
–আ..আসবে কিছুক্ষণ পরেই।
আফরা কথাটা বলেই জাইমাকে কিছু একটা ইশারা দেয়। ওহি সেদিকে খেয়াল না করে নিজের মতো কাজে সাহায্য করে যাচ্ছে। হঠাত আফরার ফোনে একটা ম্যাসেজ আসতেই সে সেদিকে তাকিয়ে তাড়াহুড়ো করে কয়েকটি বাটি ওহির দিকে এগিয়ে দিয়ে,
–ওহি, এই বাটিগুলো ছাদে রেখে আসবে? আসলে আমরা ছাদে পিকনিকের মতো আয়োজন করতে চেয়েছিলাম আরকি।
–আমাকে দাও আমি রেখে আসছি।
জাইমা আফরার হাত থেকে বাটিগুলো নিতে চাইলে আফরা সরে দাঁড়িয়ে,
–তুমি আমাকে কাজে সাহায্য করো জাইমা। ওহি এগুলো নিয়ে যাবে।
আফরার এমন আচরণে ওহি কিছুটা অবাক হলেও কিছু না বলে সেগুলো হাতে নিয়ে ছাদে চলে যায়। ওহি চলে যেতেই জাইমা আফরার দিকে তাকাতেই আফরা একটা রহস্যজনক হাসি দেয়।

এদিকে,

ওহি ছাদে প্রবেশ করে আশেপাশে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়। কিছুক্ষণ চুপচাপ সেখানেই দাঁড়িয়ে থেকে ধীরে ধীরে ভেতরে প্রবেশ করে সে টেবিলের উপর হাতের জিনিসগুলো রাখে।
পুরোটা ছাদ মরিচবাতি আর ক্যান্ডেল দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। কিন্তু এই সাজগোজে ওহি যতটা না অবাক হয়েছে, তার থেকেও বেশি অবাক হয়েছে পুরো ছাদ জুরে তার ছবি লাগানো দেখে। সবগুলো ছবির মাঝে বেশিরভাগ ছবিই ওহির অজান্তেই তোলা হয়েছে।
ভার্সিটির প্রথম দিন থেকে শুরু করে সেদিন রাতে সবাই মিলে লং ড্রাইভে যাওয়ার ছবিও এখানে আছে।
ওহি অবাক হয়ে পুরো ছাদ ঘুরে ঘুরে ছবিগুলো দেখে যাচ্ছে।
প্রথম দিন ছাদে রুমাল হাতে আশ্বিনের সাথে দেখা হওয়া, নবীন বরণের দিন আশ্বিনের হাত থেকে ফুল নেওয়ার ছবিও এখানে আছে। তবে সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হলো প্রথম দিন যেদিন বাবা আর ওসমানের সাথে ভার্সিটিতে ভর্তির জন্য এসেছিলো সেদিনের একটি ছবি এখানে আছে। ওহি ছবির দিকে তাকিয়ে কোনভাবেই ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারছে না যে এই ছবি আশ্বিনের কাছে কিভাবে এলো?

–অবাক হয়েছো নিশ্চয়ই?

হঠাত কথাটা শুনে ওহি পিছনে ফিরে দেখে আশ্বিন। সে আশ্বিনের দিকে কিছুটা এগিয়ে এসে,
–এই ছবিগুলো আপনি কোথায় পেয়েছেন আশ্বিন ভাইয়া?
–কোথায় আর পাবো? আমি আর রোদ্দুর তুলেছি এগুলো।
–আর এই ছবিটা? আমি তো ভার্সিটির প্রথম দিন আপনাকে দেখিনি। আর না আপনি আমাকে দেখেছেন। তাহলে?
–তুমি আমাকে না দেখে থাকলেও, আমি ঠিকই দেখেছিলাম তোমাকে। হাসান স্যারের রুম থেকে আমার পাশ কাটিয়ে তুমি আর ওসমান চলে গিয়েছিলে। হলদে রঙের জামা পড়া ছিলে, চোখে অবশ্য তখন অন্য রকম এক চশমা ছিলো। পরদিন ভার্সিটিতে সেই চশমা পড়ে ভেঙে গিয়েছিল, জাইমার সাথে দৌঁড়ে যাচ্ছিলে তখন। তাই না?

আশ্বিনের কথায় ওহি হা করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আশ্বিন তাকে প্রথম দিন থেকেই চিনে আসছে! অথচ সে এতদিন এর কিছুই জানতো না। ওহির ভাবনার মাঝেই আশ্বিন বলে উঠে,

–সেদিন আমি মাঠ থেকেই দেখেছিলাম তোমাকে ভার্সিটির ছাদ থেকে রুমাল ফেলে দিতে। ভেবেছিলাম হয়তো তোমার হাত থেকে ভুল করেই পড়ে গিয়েছে। তাই রুমালটা হাতে নিয়ে সেই চিরকুট দেখে ছাদে গিয়েছি, আর তারপর কি হলো সেটা তো তুমি জানোই। তবে, এমন কিছু হবে এটা আমি একদম আশা করিনি।

আশ্বিন কথাটা বলে সেখান থেকে সরে গিয়ে টেবিলের উপর থেকে আইসক্রিমের বাটি নিয়ে খেতে শুরু করে। ওহি এখনও তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
–আপনি এই কথাগুলো আমাকে এতদিন পর বলছেন আশ্বিন ভাইয়া? আর এতদিন যখন বলেননি, তাহলে আজ কেনো বললেন?
ওহির কথায় আশ্বিন উঠে দাঁড়িয়ে ওহির সামনে এসে,
–সঠিক সময়ের অপেক্ষায় ছিলাম তাই এতদিন বলিনি। এখন সেই সময় এসেছে।
–কিসের সময়?
আশ্বিন ওহির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে একটা তুড়ি বাজাতেই দুজনের উপর ফুলের পাপড়ি পড়তে শুরু করে। ওহি উপরের দিকে তাকিয়ে আবার আশ্বিনের দিকে ফিরে তাকায়। ছাদের এক কোণে সাউন্ড বক্সে বেজে চলেছে একটি গান,

“দিও তোমার মালা খানি
বাউলের এই মনটারে,
আমার ভেতর ও বাহিরে
অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে”

আশ্বিন ধীরে ধীরে ওহির কাছে এসে ওহির হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে,

–সেদিন হাসান স্যারের রুমের সামনে প্রথমবার তোমাকে দেখেই মুগ্ধ হয়েছিলাম। সে ছিলো দুষ্টমী ভরা মায়াবী এক চাহনি! সেদিন বিষয়টা এতো গুরুত্ব না দিলেও দুদিন পর তোমাকে আর জাইমাকে আবার একসাথে দেখি। সেদিন থেকে প্রায়ই তোমাকে দূর থেকে দেখেছি। তোমার এই রুমালটা এখনও আমার কাছে আছে।
নবীন বরণের জন্য যখন অডিটোরিয়ামে গানের প্র্যাক্টিস করতে তখন আমি তোমার দিকে মুগ্ধ হয়ে সেই গান শুনেছি।
মিথ্যা বলবো না, তবে রাফিনকে তোমার আশেপাশে আমার কখনও সহ্য হয়নি। মানতে পারিনি আমি ছাড়াও কেউ তোমাকে নিয়ে ভাবুক। সে রাফিন হোক বা অন্যকেউ।
রোহানের সাথে ঝামেলার পর যখন জাইমা এসে যখন বললো তোমাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, কেনো জানি না বারবার মনে হচ্ছিল, আমার অপন কিছু একটা হারিয়ে যাচ্ছে। দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম যখন ঐ বদ্ধ ঘরে তোমাকে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখেছি।
তুমি জ্ঞানহীন হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলে অথচ আমি সারারাত সেই হাসপাতালের বাহিরে বসে থেকে শুধু ভেবেছিলাম আমি তোমার মায়ার জালে কতটা বাজে ভাবে বেঁধেছি। আমি সেদিনই বুঝে গিয়েছি, তুমি কিভাবে আমার অস্তিত্বে মিশে গিয়েছো, কিভাবে আমার মনে নিজের জায়গা করে নিয়েছো।
তোমাকে না দেখে থাকাটা আমার কাছে কতটা কঠিন হয়ে গিয়েছিল যে পরীক্ষার আগে মাঝরাতে তোমার বাসার সামনে গিয়ে তোমার রুমের বারান্দার দিকেই তাকিয়ে থেকেছি। জানি, এতো রাতে তুমি বারান্দায় আসবে না, তবুও কোন মায়ায় যেন গিয়েছি আমি।
আমার পক্ষে এই অদ্ভুত অনুভূতিকে অস্বীকার করা আর সম্ভব না, তাই কথাগুলো এতো না প্যঁচিয়ে বলে ফেলেছি সব।

আশ্বিনের কথায় ওহি আহাম্মকের মতো তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে কি সব ভুল শুনছে? নাকি স্বপ্ন দেখছে? যদি এটা স্বপ্ন হয় তবে এই স্বপ্ন যেনো সহজে শেষ না হয়। ওহিও যে তার মনের কথাগুলো আশ্বিনকে বলতে চায়।

হঠাত আশ্বিন একটা সাদা গোলাপ ফুল নিয়ে এসে ওহির সামনে বসে,
–তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি ফাইজা। অনেক বেশি। যা গুছিয়ে বলতে পারার মত ভাষা আমার জানা নেই। তাই…।
–সমস্যা নেই।আমি জানি, এই ভালোবাসা অপ্রকাশেও অনেক সুন্দর। কারন আপনার এই ভাষা আমি অনুভব করতে পেরেছি। আপনার অব্যক্ত কথাগুলো সেদিনই বোঝা হয়ে গিয়েছে আমার।

ওহি কথাগুলো বলতেই তাদের পেছন থেকে রোদ্দুর জাইমা আর আফরা এসে,
–ওহি এভাবে বললে হবে না। আশ্বিন তোমাকে ভালোবাসি বলেছে, তোমাকে আগে ফুলটা হাতে নিয়ে উত্তর দিতে হবে। ঠিক সেদিন জাইমা আর রোদ্দুরের মতো।
আফরার কথায় ওহি কিছুটা লজ্জা পায়। এরা এতোক্ষণ ধরে এখানেই ছিলো! কথাটা মনে হতেই গালগুলো লালচে হয়ে আসে তার। আশ্বিন সেদিকে একবার তাকিয়ে,
–ভালোবাসি ফাইজা!
ওহি মাথা নিচু করে আশ্বিনের হাত থেকে ফুল নিয়ে,
–আমিও ভালোবাসি!
ওহির উত্তরে সবাই একসাথে হাত তালি দিতে থাকে। ওহি সবার দিকে তাকিয়ে একটা লাজুক হাসি দিতেই আশ্বিন উঠে দাঁড়িয়ে ওহিকে দুই হাতে আগলে নেয়। ওহির খুশি হয়ে আশ্বিনের বুকে মুখ গুঁজে থাকে।

হঠাত রোদ্দুর নিচ থেকে কিছু একটা নিয়ে এসে,
–চল সবাই মিলে একসাথে ফানুস উড়িয়ে দেই।
কথাটা বলতেই সবাই একসাথে এসে একটা ফানুস নিয়ে আকাশে উড়িয়ে দেয়। সন্ধ্যার আকাশে ফানুস ধীরে ধীরে তার আলো ছড়িয়ে দিয়ে বিলিন হয়ে যায়। যা সূচনা করে যায় আশ্বিন আর ওহির ভালোবাসার।

–চলবে(ইনশাআল্লাহ)

#এক_মুঠো_অনুভূতি💖
লেখিকা- তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:২৩

খাটের উপর হেলান দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় বসে আছে ওহি। গতকাল রাতে সবার সাথে হাসিখুশি ভাবে থাকলেও এখন তার মাথায় শুধু একটি কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে। তা হলো,
“বাবা হয়তো কখনও এই সম্পর্ক মেনে নিবে না।”
একটু ঘুরতে যাওয়ার জন্য বাবা যেভাবে রাগ দেখিয়েছিলেন, আশ্বিনের কথা জানতে পারলে না জানি বাসায় কি হবে। কথাগুলো মনে হতেই মাথা ধরে আসছে ওহির। আজ সারাদিন ধরে কিছুতেই মাথা থেকে কথাগুলো সরিয়ে রাখতে পারছে না সে।

হঠাত কলিং বেল এর শব্দ শুনে ওহি খাট থেকে নেমে রুমের দরজার দিকে যেতেই ড্রইং রুম থেকে বাবার কণ্ঠ শুনতে পায়। বাবা অনেক রেগে ওহিকে ডাকছে তাই ওহির মা এসে,
–কি হয়েছে আপনার? কি করেছে ওহি?
–এটা তো ওহি আসলেই জানতে পারবে ফারজানা। সে কি করেছে।
বাবার কথার মাঝে ওহি চলে আসতেই বাবা তার দিকে ফিরে তাকিয়ে রেগে,
–এর জন্য তোমাকে কষ্ট করে লেখাপড়া করিয়েছি আমি? কাল তোমার রেজাল্ট আর আজ তোমার স্যার আমাকে কাল দেখা করতে বলেছে। কিসের জন্য? কি বলবেন উনি?
বাবার কথায় ওহি কিছুটা অবাক হয়। স্যার হঠাত বাবাকে যেতে বললেন কেনো? তবে কি তার রেজাল্ট ভাল হয়নি?
–আপনি এতো হাইপার হবেন না। আমি জানি ওহি এমন কিছুই করেনি যাতে আপনার অসম্মান হবে। হয়তো…।
–তুমি থামবে ফারজানা? স্যার কি আমাকে এমনি এমনি যেতে বলবে তার ভার্সিটি? মেয়েটার লেখাপড়ায় কোন আগ্রহই নেই। এই দুই ভাই বোন কি দেখছে না, তাদের ভবিষ্যত সুন্দর করতে, তাদের লেখাপড়ার জন্য আমি আমার জীবনটা কিভাবে অক্লান্ত পরিশ্রম করে কাটিয়ে দিচ্ছি? কি চেয়েছি আমি তাদের কাছে? শুধু এটাই যেন তারা বড় হয়ে ভালো কিছু করে সমাজে সম্মানিত হতে পারে। আমি কি ভুল কিছু করেছিলাম?
বাবার কথায় ওহি মাথা নামিয়ে চুপচাপ শুনে যাচ্ছে। চোখ দুটো বারবার ঝাঁপসা হয়ে আসছে তার।
–আপনি একটু শান্ত হোন। আমি তো দেখেছি আমার মেয়েকে আপনার স্বপ্ন পূরণের জন্য কীভাবে নাওয়া খাওয়া ভুলে গিয়ে, দিন রাত এক করে পড়েছে। ওহির চেষ্টার কোন কমতি ছিল না। আমার বিশ্বাস ওহির রেজাল্ট খারাপ হবে না। আপনি দেখে নিয়েন।

ফারজানা বেগমের কথা শুনে ওহির বাবা কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে উঠে নিজের ঘরে চলে যায়। ওহিও কিছুক্ষণ বসে থেকে ধীরে ধীরে নিজের ঘরে চলে আসে। কাল সকালে রেজাল্ট! এতোক্ষণ ধরে রেজাল্ট নিয়ে তার তেমন মাথা ব্যথা না থাকলেও, এখন খুব টেনশন হচ্ছে তার। হঠাত ওহির ফোন বেজে উঠায় ওহি তাকিয়ে দেখে সবাই মিলে তাকে ভিডিও কল দিয়েছে। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও ফোন রিসিভ করে ওহি।

–এই তো ওহি চলে এসেছে।
আফরার কথায় সবাই একসাথে ওহিকে এটা সেটা নিয়ে প্রশ্ন করলেও, ওহি শুধু হ্যা না দিয়ে সংক্ষিপ্ত উত্তর দিচ্ছিলো। ওহির আচরণ সন্দেহজনক লাগায় আশ্বিন ওহির দিকে তাকিয়ে,
–ফাইজা, কি হয়েছে তোমার? বাসায় কোন সমস্যা হয়েছে?
ওহি কিছুক্ষণ চুপ থেকে একবার আশ্বিনের দিকে তাকিয়ে ওহির বাবার কাছে হাসান স্যারের কল দিয়ে কাল দেখা করার বলে দেয়। সবটা শোনার পর আশ্বিন আফরা আর রোদ্দুর কিছুটা অবাক হয়। তাদের জানা মতে হাসান স্যার কখনও কোন অভিভাবকদের সাথে রেজাল্ট নিয়ে কথা বলেন না।
আশ্বিন কিছু বলতে নিবে তার আগেই রোদ্দুর বলে উঠে,
–জাইমা তোমার বাবাকে কি ফোন দিয়েছে স্যার?
–না তো। এমন কিছু হলে তো বাবা আমাকে এসে বলতো।
–তাহলে ঠিক আছে। ওহি, এতো চিন্তা করো না।
ফে/ই/ল করার জন্য তাহলে কোন অভিভাবকদের ফোন দেয়নি। দিলে তো সবার আগে জাইমার বাবাকেই…।
কথাটা শেষ করার আগেই থেমে যায় রোদ্দুর। জাইমা রেগে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
–কি বললেন আপনি? আপনার মতে আমি ফে/ল করার মতো স্টুডেন্ট?
জাইমার রেগে বলা কথা শুনে রোদ্দুর চুপসে যায়।
–আরে না, কি বলো এসব? আমি আসলে এটা বোঝাতে চাইনি। আমি তো জানিই আমার জান পাখিটা ক্লাসে প্লেইজে থাকার মতো স্টুডেন্ট। তাই না আফরা?
আফরা কি বলবে তার আগেই জাইমা রেগে গিয়ে ভিডিও কল থেকে চলে যায়।

রোদ্দুর অসহায়ের মতো একবার আশ্বিনের দিকে তাকিয়ে,
–গার্লফ্রেন্ড কে সামলানো অনেক কঠিন রে ভাই। না জানি বউ হলে সামলানো কতো কঠিন হবে!
কথাটা বলে রোদ্দুরও চলে যায়। আফরা রোদ্দুরের কথায় হাসতে হাসতে সেও সরে আসে। এখন শুধু আশ্বিন আর ওহি সংযুক্ত আছে।
–ভয় নেই ফাইজা। তোমার উপর আমার বিশ্বাস আছে। ইনশাআল্লাহ ভালো কিছুই হবে। আর, যতো যাই হোক আমি তোমার পাশে আছি। ঠিক আছে?
–হুম।
আশ্বিনের কথায় কিছুটা ভরসা পায় ওহি। কিন্তু তবুও সে নিশ্চিত হতে পারছে না। সারা রাত দো’টানে পার করে দেয় সে।
———————-

সকাল সকাল বাবাকে সাথে নিয়ে ভার্সিটি এসেছে ওহি।জাইমা আর আফরা একবার ওহির সাথে দেখা করে গিয়েছিলো। আশ্বিন দূর থেকে ওহিকে ইশারায় নির্ভয় থাকতে বলে। কিছুক্ষণ পর রেজাল্ট বের হতেই ওহির বাবাকে হাসান স্যার উনার রুমে ডেকে পাঠায়। বাবার পিছু পিছু ওহিও প্রবেশ করে। ওহির বাবা হাসান স্যারের মুখোমুখি গিয়ে বসে,
–স্যার, ওহির রেজাল্ট কি ভালো হয়নি? এমনটা তো হওয়ার কথা না, কারণ আমি সবসময় মেয়ের পড়ালেখার উপর নজর রেখেছি। আজ পর্যন্ত তার রেজাল্ট কখনও খারাপ হয়নি। কিন্ত এখন..।
বাবার কথায় ওহি একবার বাবার দিকে ফিরে চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। হাসান স্যারের পাশে বসে থাকা সকল স্যার ম্যামরা একে অপরের দিকে ফিরে তাকায়।
হাসান স্যার ব্যাপারটা বুঝতে পেরে,
–আপনি ভুল বুঝেছেন মিস্টার ওয়াহীদ। আপনার মেয়ে ওহি প্রতি বারের মত এবারও খুব ভাল রেজাল্ট করেছে। আমাদের ভার্সিটির সব স্যার এই নিয়ে খুবই খুশি। স্যাররা অবশ্য প্রায়ই আমাকে বলতো আপনার মেয়ের কথা, যে ফার্স্ট ইয়ারে ওহি নামের মেয়েটি সবার থেকে একটু আলাদা।
ফার্স্ট ইয়ারেই এমন রেজাল্ট সাধারণত খুব কম দেখতে পাওয়া যায়। আপনি খুব ভাগ্যবান একজন বাবা। আপনার মেয়ে ভার্সিটিতে একটা সর্বোচ্চ নম্বর নিয়ে এসেছে। আমাদের সব স্যারদের বিশ্বাস একদিন আপনার মেয়ে অনেক বড় কিছু হয়ে আপনার সম্মান বৃদ্ধি করবে ইনশাআল্লাহ।

স্যারের কথায় ওহির বাবা স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। ওহি পিছনে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে। কেনো যেন খুব কান্না পাচ্ছে ওহির। দুজনকে চুপ থাকতে দেখে হাসান স্যার আবারও বললেন,
–আসলে আমরা সেদিনের রোহানের বাবার কথায় আপনাকে সেই কথাগুলো বলেছিলাম। আপনাকে বা ওহিকে কষ্ট দেওয়ার কোন ইচ্ছে আমাদের ছিলো না, বরং আমি চেয়েছিলাম ওহির আর যেন কোন ক্ষতি না হয়। ওহি আমার মেয়ের মতোই, তার জন্য যা ভালো তা আমি অবশ্যই করবো।
আপনার মেয়ে অনেক মেধাবী, মিস্টার ওয়াহীদ। ওহি যদি তার এই রেকর্ড ধরে রাখে তবে একদিন তার জন্য আমাদের ভার্সিটির সম্মান বৃদ্ধি পাবে। আমরা সেই দিনের অপেক্ষায় থাকবো। আর ওহির এই সাফল্যের জন্য আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।

ওহির বাবা হাসান স্যারের সাথে টুকটাক কথা বলে তাদের কাছে বিদায় নিয়ে ওহির সাথে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। বাহিরে আফরা আর জাইমা দাঁড়িয়ে আছে। ওহির বাবা আর ওহিকে বেরিয়ে আসতে দেখে তারা ওহির পাশে এসে দাঁড়ায়। ওহির বাবা তাদের দিকে একনজর তাকিয়ে,
–ওহি, তুমি তোমার বান্ধবীদের সাথে কথা বার্তা শেষ করে বাসায় চলে যেও। আমার একটু কাজ আছে। আমি যাচ্ছি।
ওহি বাবার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ে। সে ঠিকই বুঝতে পারছে কথাগুলো বলার সময় বাবার গলা ধরে আসছিলো। বাবা কিছু না বলে ধীরে ধীরে ভার্সিটির গেইট দিয়ে বেরিয়ে একটা রিকশায় উঠে চলে যায়। ওহি সেদিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে। নিজের অজান্তেই আজ তার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। বাবা কি তার রেজাল্টে অবাক আর খুশি হয়েছে? সে কি তার ছোট বেলার সেই স্বপ্ন পূরণ করে দেখিয়েছে? উত্তর জানা নেই ওহির।

হঠাত মাঠের এক প্রান্তে আশ্বিনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওহি কোন কিছু না ভেবে এক ছুটে দৌড়ে গিয়ে আশ্বিনকে জড়িয়ে ধরে। কিছু বুঝে উঠার আগেই এমনটা হওয়ায় আশ্বিন কিছুটা অবাক হলেও পরে নিজেকে সামলে নেয়।
এদিকে, ওহি আশ্বিনকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছে। আশ্বিন ওহির অবস্থা বুঝতে পেরে তাকে আগলে ধরে,
–অনেক অনেক অভিনন্দন ভবিষ্যত মিসেস আশ্বিন চৌধুরী। আপনার সাফল্যে একজন অংশীদার হতে পেরে নিজেকে অনেক সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে। আপনি করে দেখিয়েছেন, আমার বিশ্বাস ধরে রেখেছেন।
আশ্বিনের কথায় ওহি আশ্বিনকে ছেড়ে সরে দাঁড়ায়। এতক্ষণে তার হুশ হয় যে আশেপাশের সবাই তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। সে সবার দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে আশ্বিনের দিকে তাকিয়ে চোখ মুছে,
–আমার উপহার কোথায়?
ওহির কথায় আশ্বিন মুচকি হাসি দেয়। ওহির এতদিন পরেও এই কথাটা মনে আছে। সে ওহির হাতে একটা চকলেট ধরিয়ে দিয়ে,
–খুব শীঘ্রই পাবে।
ওহি আর কিছু না বলে আশ্বিনের দিকে তাকিয়ে থাকে।

–চলবে(ইনশাআল্লাহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here