এক মঠো অনুভূতি পর্ব ২১

0
660

#এক_মুঠো_অনুভূতি💖
লেখিকা- তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:২১

পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়েই ওহি রাফিনকে দেখতে পায়। রাফিন দুজন ছেলের সাথে টুকটাক কথা বলতে বলতে এদিকে এগিয়ে আসছে। ওহি রাফিনের সামনে যেয়ে,
–রাফিন ভাইয়া!
–ওহি! ভালোই হলো তোমার সাথে দেখা হয়ে গিয়েছে। একটু কথা ছিলো তোমার সাথে।
–জরুরি কিছু?
–হুম। চলো যেতে যেতে কথা বলি।
ওহি আর রাফিন মাঠের দিকে যেতে যেতে কথা বলতে থাকে।

–ওহি, আমি কাল চলে যাচ্ছি।
–কোথায়?
–কানাডা। আমার বাবা মায়ের কাছে। কদিন ধরেই মায়ের শরীরটা ভালো নেই, তাই আমাকে যেতে বলছেন। মা অনেকদিন ধরেই বলেছিলেন চলে যাওয়ার জন্য, কিন্তু পরীক্ষার জন্য আমার যাওয়া হয়নি।
–হুম, মায়ের সেবা যত্ন করার জন্য আপনার যাওয়া উচিত। এখন তো পরীক্ষাও শেষ হয়ে গেলো, অনেকদিন ক্লাস বন্ধ আছে। এরমাঝে ইনশাআল্লাহ আন্টি সুস্থ হয়ে যাবেন।
–আসলে, আমি সেখানেই সেটেল্ট হয়ে যাবো ওহি। ভার্সিটি থেকে এমনিতেও আমি স্কলারশিপ পেয়েছি, সেখানে গিয়ে পড়বো আর তারপর বাবার বিজনেস দেখাশোনা করবো।
রাফিনের কথায় ওহি থেমে যায়। সে অসহায় ভাবে রাফিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই বছর খানেকের মাঝে রাফিনের সাথে তার এক ভালো বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছিল। একজন ভালো বন্ধুকে হারিয়ে ফেলবে ভেবেই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে তার।
–আপনাকে অনেক মিস করবো রাফিন ভাইয়া। আমার বিপদের সময়, আমার ছোটখাট সকল প্রয়োজনে আপনাকে বন্ধুর মতো যেভাবে পাশে পেয়েছিলাম আমি, তা কখনো শোধ করতে পারবো না।
ওহি কথাটা বলেই কান্না করে দেয়। রাফিন ওহিকে এভাবে দেখে মুচকি হেসে মুখ ফিরিয়ে নেয়। সকলের কাছে সে সবসময় একজন রুড আর স্বা/র্থ/প/র ছেলে বলে গণ্য হলেও একমাত্র এই পিচ্চিই তাকে সবসময় বন্ধুর মর্যাদা দিয়েছে। তার চলে যাওয়ায় স্যারদের পর হয়তো পুরো ভার্সিটিতে এই পিচ্চিই সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাবে। রাফিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে,
–আমি সবসময় তোমার সাথে যোগাযোগ রাখবো ওহি। আর, দেশে আসলে সবার আগে তোমার সাথে দেখা করবো। তুমিও রোজ ভার্সিটিতে কি হচ্ছে এসব আমাকে জানাবে। ঠিক আছে?
রাফিনের কথায় ওহি চোখ মুছে মাথা নাড়ে। রাফিন ওহির গাল টেনে তাকে হাসানোর চেষ্টা করতে থাকে।

এদিকে,

দূর থেকে আফরা আর রোদ্দুর তাদের দেখছে। ওহি আর রাফিনকে একসাথে দেখে রোদ্দুর আফরার দিকে তাকিয়ে,
–তুই শুনেছিস রাফিন যে চলে যাচ্ছে?
–কাল বাবার সাথে আঙ্কেলের মানে রাফিনের বাবার কথা হয়েছিলো। বাবা বলেছে আমাকে। রাফিনের মায়ের অবস্থা বেশি ভালো না। জরুরি অপারেশন দরকার, কিন্তু আন্টি রাজি হচ্ছেন না। তাই রাফিন যাচ্ছে মাকে বোঝানোর জন্য।
–শুনে খুব খারাপ লাগল। যদিও রাফিনের সাথে আমাদের কখনও বন্ধুত্ব ছিলো না তবুও তার চলে যাওয়ার কথা শুনে ভালো লাগছে না। কিন্তু আমাদের থেকেও বেশি মন খারাপ হয়তো ওহির হবে। খুব ভালো বন্ধু ছিলো দুজন।
রোদ্দুর কথাটা বলে আবারও ওহি আর রাফিনের দিকে তাকায়। আফরা কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে হঠাত বলে উঠে,

–খুব অদ্ভুত তাই না? ভার্সিটির সবচেয়ে দাম্ভিক, রাগী আর ইগো দেখানো ছেলেটা একদিন তার নিজের অজান্তেই এক মেয়েকে ভালোবেসে ফেললো। যে ছেলে তার আশেপাশে কোন মেয়েকে সহ্য’ই করতে পারতো, অথচ সেই ছেলেকে সেদিন তার নিজ থেকে ওহির সাথে বন্ধুত্ব করা দেখে আমরা কতোটা অবাক হয়েছিলাম। যে কখনও নিজের স্বার্থ না থাকলে কোন কাজ করতো না, সে ওহির হারিয়ে যাওয়ার কথা শুনে আমাদের সাথে কিভাবে হন্ন হয়ে ওহিকে খোঁজার জন্য বেরিয়েছিলো। রোহানের সাথে কোন ঝামেলা তার ছিলো না, তবু বিপদ আছে যেনেও সে ওহির জন্য রোহানের শাস্তির ব্যবস্থা করলো। শুধুমাত্র ওহির জন্য নিজের শত ব্যস্ততার মাঝেও সময় বের করে ফেলতো সে।
ওহি হয়তো কখনও জানতে পারবে না যে, রাফিনের ভয়ে ভার্সিটির কোন ছেলেই তার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার সাহস পায় না।

–ভালোবাসা খুব অদ্ভুত এক অনুভূতি আফরা। কখন, কিভাবে, কার মনে এসে বাসা বাঁধাবে, সে বুঝতেই পারবে না। কে জানতো রাফিনের মতো এক ছেলেও একটি মেয়েকে ভালোবাসবে। অপ্রত্যাশিত ভালোবাসা! যে ভালোবাসায় কোন স্বার্থ নেই।
সবার ভালোবাসা জিতে যায় না। রাফিনের না পাওয়ার মাঝেই অনেক বড় পাওয়া আছে। তাই তো, আজ তার চলে যাওয়ার কথায় দেখ ওহি কিভাবে কেঁদে যাচ্ছে।
রোদ্দুরের কথায় আফরা সায় দেয়। দুজনের খুব খারাপ লাগছে রাফিনের জন্য।
———————–

পরীক্ষা শেষ উপলক্ষ্যে আশ্বিনের বাসায় আফরা আর রোদ্দুর এসেছে লং ড্রাইভ পার্টি করতে। কিন্তু দুজন চলে আসার পরেও আশ্বিন কারো জন্য অপেক্ষা করছে।
–কার জন্য অপেক্ষা করছিস তুই? আর কে আসবে?
–এখনি দেখতে পারবি।
আশ্বিন কথাটা বলতেই কলিং বেল বেজে উঠে। আশ্বিন গিয়ে দরজা খুলে দিতেই সবাইকে অবাক করে দিয়ে রাফিন আশ্বিনের বাসায় আসে।
–কি খবর সবার?
রাফিন আফরা আর রোদ্দুরের উদ্দেশ্যে কথাটা বলে সোফায় এসে বসে। আশ্বিন রুমে এসে,
–এই প্রথম রাফিনকে নিয়ে আমরা পার্টি করবো। আমাদের দুজনের মাঝে আজ থেকে সব ভুল বোঝাবুঝি শেষ। এখন থেকে রাফিন আমাদের বন্ধু।
আশ্বিনের কথায় সবাই খুশি হয়ে যায়। মুহূর্তেই তারা খুশি হয়ে লং ড্রাইভের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।

এদিকে,

ওহি ভার্সিটি থেকে এসেই মন খারাপ করে বসে আছে। কোথায় আজ পরীক্ষা শেষ বলে তার খুশি হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু রাফিনের চলে যাওয়ার সংবাদ তাকে খুশি হতে দিচ্ছে না। এই ক্ষুদ্র জীবনে খুব কম সংখ্যক বন্ধু ছিলো ওহির। স্কুল আর কলেজ জীবনে শুধু জাইমা আর ভার্সিটিতে এসে আশ্বিন আফরা রোদ্দুর আর রাফিন। কিছুদিনের মাঝেই তারা এভাবে অপন হয়ে যাবে ধারনাও ছিলো না ওহির।
ওসমান কিছুক্ষণ ওহিকে বোঝানোর, মন ভালো করার চেষ্টা করেছিলো কিন্ত লাভ হয়নি। হঠাত, বাসার কলিং বেল বেজে উঠায় ওহি গিয়ে দরজা খুলে দেখে আশ্বিন। সে কিছুটা অবাক হয়েই,
–আশ্বিন ভাইয়া, আপনি হঠাত! ভেতরে আসুন।
ওহির মুখে আশ্বিনের নাম শুনে ওসমানও চলে আসে।
–আরে আশ্বিন, ভেতরে এসো।
–না ওসমান ভাই। আমরা আপনাকে আর ফাইজাকে নিয়ে যেতে এসেছি। রাফিন কাল চলে যাবে তাই আমরা পুরো শহর লং ড্রাইভ পার্টি করে দিনটা স্মরণীয় করে রাখতে বেরিয়েছি। জলদি চলো, জাইমাও আছে আমাদের সাথে। সবাই গাড়িতে বসে আছে।
আশ্বিনের কথায় ওহি আর ওসমান মায়ের দিকে ফিরে তাকায়। ফারজানা বেগম অনুমতি দিতেই ওহি খুশি হয়ে রেডি হতে চলে যায়।

সবাই মিলে একসাথে রাতের শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হঠাত হঠাত গাড়ি থামিয়ে খাওয়া দাওয়া, গান বাজনা আর গল্প গুজব করে সময়টা খুব ভালোই যাচ্ছে তাদের। রাফিন এই প্রথম তাদের সাথে ঘুরতে এসে অনেক খুশি হয়েছে। আশ্বিন গাড়ি ড্রাইভ করে পার্কের মাঠে এসে দাঁড়াতেই সবাই নেমে যায়। ছোট চায়ের দোকানে সবাই একসাথে বসে চায়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। আশ্বিন আর রাফিন পাশাপাশি বসে আছে। তাদের মুখোমুখি বসে আছে আফরা জাইমা আর ওহি। এতোক্ষণ ধরে মন খারাপ নিয়ে বসে থাকা ওহি কিভাবে এখন খিলখিল করে হেসে গল্প করছে তা মুগ্ধ নয়নে দেখছে আশ্বিন। তখন তার কানে রাফিনের কথা ভেসে আসে,

–ওহিকে অনেক ভালোবাসো তাই না?
রাফিনের কথায় আশ্বিন তার দিকে ফিরে তাকায়।
–জানি না। হয়তো বাসি, অনেক বেশি ভালোবাসি। আমার কাছে ফাইজা সদ্য ফোঁটা ফুলের মতোই পবিত্র। যার সৌন্দর্য আর ব্যবহার মানুষকে তার প্রতি মুগ্ধতা তৈরি করাতে সাহায্য করে। যাকে দেখে দিনের পর দিন মনে ভালোলাগা কাজ করে। যার অনুপস্থিতি আমাকে ব্যথিত করে। তবে ভালোবাসি বলেই তাকে আমার পেতেই হবে এমনটা কিন্তু না। দূর থেকেও ভালোবাসা যায়। কে আমাদের জীবনে আসবে, কে চলে যাবে তা আগে থেকেই আমাদের ভাগ্যে লেখা আছে। ভাগ্য পরিবর্তন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব না। তবে হ্যা, আমাকে যদি জিজ্ঞেস করে, আমার কাকে চাই? আমি নিঃসন্দেহে ফাইজাকেই চাইবো আমার হয়ে। আমি চাই, সে ফুল হয়ে থাকুক আমার হৃদয় জুড়ে।
আশ্বিন কথাগুলো ওহির দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে। রাফিন এতোক্ষণ মাথা নিচু করে আশ্বিনের কথাগুলো শুনছিলো। শেষে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে,
–আমি চাই ওহি তোমার মতো একজন মানুষ নিয়ে সারাজীবন ভালো থাকুক। কারন তুমি তাকে সারাজীবন আগলে রাখবে, এই নিয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই। আশ্বিন, সুযোগ সবার কাছে আসে না। তোমার কাছে এসেছে। সময় থাকতে এই সুযোগ কাজে লাগাও। নিজের মনের কথাগুলো ওহির কাছে প্রকাশ করো। আমি মন থেকে তোমাদের জন্য দোয়া করি।
আশ্বিন কথাগুলো শুনে মাথা নাড়ে। এর মাঝে বাকিরা তাদের ডেকে উঠায় তারা সকলের সাথে আড্ডায় ব্যাস্ত হয়ে পড়ে।
———————

কিছুক্ষণ আগেই রাফিন চলে গিয়েছে সকলের কাছে বিদায় নিয়ে। তাকে বিদায় জানাতে সবাই একসাথে এসেছিলো। ওহির মন কেনো যেন ভারি হয়ে আসছে। আশ্বিন তার অবস্থা বুঝে তাকে সান্তনা দিতে যেতেই ওহি আশ্বিনকে আগলে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। আশ্বিন এক হাতে ওহিকে আগলে ধরে অন্য হাতে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। সবাই ওহিকে কিছু বলতে চাইলে আশ্বিন সবাইকে ইশারায় চলে যেতে বলে। তাই সবাই তাদের রেখে চলে আসে। কিছুক্ষণ পর ওহি শান্ত হলে আশ্বিন তার চোখ মুছে দিয়ে,
–রাফিন, কিছুদিনের মধ্যেই চলে আসবে। তাছাড়া আমাদের সাথে তার যোগাযোগ তো হবেই। এভাবে কেঁদে নিজের চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছো। চলো যাই একসাথে আইসক্রিম খেয়ে আসি।
ওহি আশ্বিনের কথায় মাথা নেড়ে আশ্বিনের হাত ধরে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে আসে। আশ্বিন একবার পিছনে ফিরে কাল রাতে রাফিনের কথাগুলো মনে করে মুচকি হাসি দেয়।

–চলবে(ইনশাআল্লাহ)

((আসসালামু আলাইকুম। ভুল ক্ষমার চোখে দেখবেন। সবাই রাফিনকে অপছন্দ করেন, তাই রাফিন চলে গেলো সবাইকে রেখে🥺 এবার কিন্তু রাফিনকে মিস করা যাবে না🙂))

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here