#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
অন্তিম পর্ব
চার চারটে বছর পর দেশের মাটিতে পা রাখলো তৌফিকা। এয়ারপোর্টে নামতেই ভেতরটায় পুরোনো স্মৃতিগুলোর সাথে ব্যথাগুলো জেগে উঠতে লাগলো ওর। পা বাড়াতেই সামনে তাকিয়ে দেখে গাড়ি নিয়ে দোয়া দাড়িয়ে। আশেপাশে তাকিয়ে আরাবকে খুজলো ও। পরে মনে পরলো,ওর কথার জন্যই ওর সামনে আরাব আর আসবে না কোনোদিন। তৌফিকাকে দেখে চোখ জলে ভরে উঠলো দোয়ার। আলতোভাবে চোখ বন্ধ করে সে জলকে আটকে দিয়ে আবারো সামনে তাকালো ও। তৌফিকার ঠিক পেছনেই সাদা টিশার্টের উপর কালো জ্যাকেট,জিন্স,কেডস্ কাধে ব্যাগ নিয়ে একজন দাড়িয়ে। মুখ দিয়ে শ্বাস ছাড়লো দোয়া। আর বাধ মানলো না ওর চোখজোড়ার অশ্রু। টুপটাপ বেরিয়ে আসতে লাগলো।
তৌফিকা অশ্রুসিক্ত নয়নে হাসিমুখ করে এগোচ্ছিলো দোয়ার দিকে। কিন্তু পাশে টুইঙ্কেলকে দেখেই থেমে গেলো ও। কতো বড় হয়ে গেছে টুইঙ্কেল! কোমড় অবদি চুল,পরনে গাউন,চেহারায় কিছুটা পরিপক্কতা। চারবছর ব্যবধানে ওর মেয়ে অনেক বড় হয়ে গেছে। ওর মেয়ে? ওর মেয়ে কিভাবে হয়? যাতে ওর আর মুফতাহিরের নামটাও টুইঙ্কেলের সাথে না থাকে,এজন্য দেশ ছাড়ার সময় ও টুইঙ্কেলের দায়িত্বের পুরোটা দোয়ারাবের নামে করে গিয়েছিলো। কাগজে কলমে,দোয়ারাবই এখন টুইঙ্কেলের বাবা-মা। টুইঙ্কেলও হয়তো এ চার বছরে মানিয়ে নিয়েছে ওদের সাথে। তৌফিকার জন্য অভিমান আর ঘৃনাটাও জিইয়ে রেখেছে হয়তো। পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলো তৌফিকা। দোয়া কিছুই বললো না। টুইঙ্কেল তৌফিকার পথ আগলে দিয়ে বললো,
-আজকেও নিজের দায়িত্বকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছো তৌফিকা আইরাত?
তৌফিকা থেমে গেলো। টুইঙ্কেলের কথাতেও ওর বড় হয়ে যাওয়াটা স্পষ্ট ধরা পরছে। একপলক দোয়ার দিকে তাকালো ও। দোয়া মাথা নিচু করে নিচদিকে তাকিয়ে। কম্পিতকন্ঠে মেয়ের দিকে ফিরে বললো,
-ট্ টুইঙ্কেল?
-কে টুইঙ্কেল? কোনো টুইঙ্কেল নেই। আমি তো সুপ্তি! মুশফিকা সুপ্তি! যার ছোট্ট মনটাতে এতোগুলো দিনের মান অভিমানের সমস্তটা সুপ্ত ছিলো। এই একটা মানুষ ছাড়া,যার খোজ,কেউ নেয়নি। কেউ না!
দোয়ার দিকে আঙুল তুলে বললো টুইঙ্কেল। আরো বড়বড় চোখে তাকালো তৌফিকা। জল গরাতে শুরু করেছে ওর গাল বেয়ে। টুইঙ্কেল বললো,
-মা থাকা সত্ত্বেও আমাকে বলা হতো,সে স্টার হয়ে গেছে। বাবা থাকা সত্ত্বেও আমি পিতৃহীনা। কাগজে কলমে যাকে বাবা বানিয়ে বিদেশে পারি জমিয়েছিলে,সে মানুষটাও তোমারই জন্য আমার কাছে ছিলো না! উইশমামের কাছে ছিলো না! চার চারটে বছর হলো একাকী গুমরে মরছে উইশমাম! আরাব মামাকে ছাড়া! এসবের জন্য তুমি দায়ী আম্মু! তুমি দায়ী!
আরাবের কথা শুনে যেনো আকাশ ভেঙে পরলো তৌফিকার মাথায়। আস্তেধীরে দোয়ার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,
-আ্ আরাব কোথায় দোয়া?
দোয়া চোখ তুলে তাকালো। ওর জলভরা চোখ অনুসরন করে পেছনে তাকালো তৌফিকা। ঠিক পেছনে ব্যাগসহ আরাবকে দেখে প্রতিক্রিয়া করাটাই যেনো ভুলে গেলো ও। উশকোখুশকো চুল,শুকনো মুখচোখ। এ এক অন্য তাহসানুল আরাব। টুইঙ্কেল বললো,
-তোমাকে একাকী ছাড়বে না বলে,চারবছর আগে তোমার সাথেই লন্ডন চলে গিয়েছিলো আরাব মামা। আজ একই ফ্লাইটে ফিরেছো তোমরা।
তৌফিকার অপরাধবোধের সাথে রাগও সীমাপার করলো এবার। এগিয়ে গিয়ে আরাবকে প্রথমে চড় লাগিয়ে দিলো ও। আরাবের বুকে কিলঘুষি ছুড়ে কাদতে লাগলো তৌফিকা। জ্যাকেট দুহাতে ধরে ওকে ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে বলতে লাগলো,
-আর কতো? আর কতোভাবে আমাকে দোয়ার কাছে দোষী করে দিবি তুই? কতোভাবে? বেচে থাকতে তো মনে হয়না তুই ছাড়বি আমাকে। তুই চাস আমি মরে যাই আরাব? বেচে থাকার তো কোনো কারনও নেই আমার আর! কিন্তু দোয়াকে যে কষ্টগুলো দিয়ে গেলাম,মরেও তো শান্তি পাবো না আমি! কেনো? কেনো গেলি তুই লন্ডন? আমি কি নিজেকে সামলাতে পারতাম না? সামলে নেইনি?
-দু দুবার সুইসাইড করতে গিয়েছিলি তুই আপু। জন আর ন্যানি না থাকলে…
-মরিনি তো! বেচে আছি! দোয়াকে ছেড়ে তবুও কেনো গিয়েছিলি তুই ওখানে? বল! কে বলেছিলো? কে বলেছিলো তোকে লন্ডন যেতে? আমার কথা ভাবতে? কে বলেছিলো? কে?
চিৎকার করে কাদতে লাগলো তৌফিকা। মাটিতে লুটিয়ে পরেছে ও। আরাব বোনকে শক্তভাবে আকড়ে ধরেছে নিজের সাথে। তৌফিকা ছাড়ানোর চেষ্টা করেছে নিজেকে। পারেনি। এতোক্ষন চুপ করে থাকলেও,এবার মুখ খুললো দোয়া। শান্তভাবে বললো,
-আমি বলেছিলাম।
-থামো দোয়া।
আরাবের কথায় দোয়া তাচ্ছিল্যে হেসে বললো,
-আজ চারবছর পর কথা বললেন আপনি আমার সাথে। তাও কেনো? কেউ আপনাকে দোষারোপ করে যাচ্ছে,আমার করা দোষের জন্য আপনাকে শুনিয়ে যাচ্ছে,সেটা চুপচাপ শোনার জন্য? এতোগুলো দিন সবাই আপনাকে নিয়ে বলেছে আরাব। আমি কিচ্ছু বলিনি। কিন্তু আজ বলবো। আজ কেউ থামাতে পারবে না আমাকে! আপনিও নন!
-দোয়া!
দোয়া পাত্তা দিলো না আরাবের কথাকে। তৌফিকার দিকে তাকিয়ে বললো,
-মনে পরে আপু? চারবছর আগে মুফতাহির ভাইয়াকে অ্যারেস্ট করানোর পর, তুমি কি কি বলে রংধনু থেকে বেরিয়েছিলে?
-দোয়া প্লিজ স্টপ ইট!
আরাবের কথাকে উপেক্ষা করে দোয়া বলতে লাগলো,
-তুমি বলেছিলে,রংধনুতে থাকবে না তুমি। টুইঙ্কেলকে নিয়ে যেতে নিজের সাথেই। কিন্তু ওকে দেখলে তোমার প্রতিবার মুফতাহিরের কথা মনে পরবে। নিজেকে সামলাতে পারবে না তুমি। ক্ষতি হয়ে যেতে পারে টুইঙ্কেলের। তাছাড়া তুমি চাও টুইঙ্কেল আমার আর আরাবের পরিচয়ে বড় হোক। সবরকম ব্যবস্থা করে লন্ডন চলে যাও তুমি। একটাবার ভাবো নি,তোমাকে ছাড়া আমরা কিভাবে থাকবো। একাকী ভীনদেশে থাকছো,এটা ভেবে আমরা কিভাবে থাকবো। একবারও ভাবলে না,টুইঙ্কেলকে সামলাতে পারলেও,আমরা তুমি ছাড়া অসম্পুর্ন! আমার খোজ করিস না কেউ-এটা বলে তুমি তো চলে গিয়েছিলে। কিন্তু সাথে রংধনুর সবার কাছে তোমার জন্য এক আকাশ দুশ্চিন্তাও রেখে গিয়েছিলে। কেউই ভালো ছিলো না তোমার চিন্তায়। মাকে দেখতাম,সবসময় মুখ গুজে কাদতে। বাবাকে দেখতাম,না খেয়ে উঠে যেতে। তোমার ভাইকে দেখতাম,অপরাধবোধ নিয়ে আস্তেআস্তে শেষ হয়ে যেতে।
-দোয়া প্লিজ শান্ত হও!
দোয়া শান্ত হয়নি আরাবের কথায়। এগিয়ে এসে বললো,
-তোমার অনুপস্থিতে রংধনুর কারো কিছু হয়ে গেলে না তুমি আমাকে ক্ষমা করতে,নাইবা লন্ডনে তোমার কোনো ক্ষতি হয়ে গেলে,আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারতাম আপু। তাই আমিই আরাবকে বলেছিলাম,লন্ডন চলে যেতে। তোমার খেয়াল রাখতে। আড়ালে থেকেও জন আর ন্যানিকে দিয়ে আরাব…
আরাব তুলে দাড় করালো তৌফিকাকে। দোয়ার দিকে এগিয়ে অসহায়ের মতো করে বললো,
-প্লিজ দোয়া। এসব আর বলো না প্লিজ। চার চারটে বছর গোপন যুদ্ধ করেছি। নিজের সাথে। সবার সাথে। আমি ক্লান্ত। প্রচন্ড ক্লান্ত আমি।
দোয়া থামলো। শ্বাস আটকে আস্তেধীরে মাথা রাখলো আরাবের বুকে। আরাব চোখ বন্ধ করে দুহাতের বাহুডোরে আগলে নিলো ওকে। দোয়াও এবার জাপটে জরিয়ে ধরলো আরাবকে। আজ ও কাদবে না। কোনোভাবেই কাদবে না। যতোই সুখের কান্না পাক,কাদবে না ও। শুধু সুখ খুজবে। ওই বুকে মুখ গুজে শ্বাস নেবে,সেই চেনা ঘ্রানে বুকভরে শ্বাস নেবে ও। টুইঙ্কেল তৌফিকার কাছে গিয়ে বললো,
-টুইঙ্কেলকে আদর করবে না আম্মু? সব অভিমান ক্ষোভ তোমার উপর ঢেলে দিলাম তো!
মেয়েকে জরিয়ে পাগলের মতো চুমো দিতে লাগলো তৌফিকা। দোয়ারাবের কাছে এসে দাড়িয়ে বললো,
-আমি কি আদৌও ক্ষমার যোগ্য দোয়া?
-না। যতোক্ষন না ভাইকে আদর করছো,যতক্ষন না রংধনুতে ফিরছো,কোনো ক্ষমা নেই তোমার।
দোয়ার কথায় তৌফিকা আরাবের দিকে তাকালো। একহাতে বোনকেও জরিয়ে নিলো আরাব। বুকজুড়ে এতোগুলো দিন হলো থাকা সমস্ত শুন্যতা আজ পরিপুর্নতা পেলো যেনো। মান অভিমানের রদবদল শেষে রংধনুতে ফিরলো সবাই একসাথে। দুই ছেলেমেয়েকে দেখে কান্নায় ভেঙে পরলেন মিসেস ওয়াহিদ।দোয়া আগেই মানিয়ে নিয়েছিলো তৌফিক ওয়াহিদকে। আরাব তৌফিকার আলিঙ্গনে,সমস্ত অভিযোগ ঘুচে যায় নিমিশেই।
•
আজকে তাজীন নিরবের ছেলের তিন বছর পুর্ন হলো। ছেলেটার নাম রেখেছে তাইরব নির্ঝর। নিরবের মতোই একদম শান্তশিষ্ট হয়েছে ছেলেটা। বার্থডে পার্টিতে গিয়েছিলো রংধনুর সবাই। আনন্দ ছিলো সবার মাঝে। তবে তাজ-নিরবের বিপরীতে দোয়ারাবের ফাকা কোলটার দিকে তাকিয়ে কষ্টটাও অনুভব হয়েছে সবার। এই চারটে বছর ওদের জীবন থেকে অনেকটা সময় কেড়ে নিয়েছে। তবুও হাসিমুখেই তাজীনদের ওখান থেকে ফিরলো সবাই।
রাত বেড়েছে। ব্যালকনিতে আরাবের বুকে পিঠ ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে দোয়া। পেছন থেকে ওকে জরিয়ে আরাব। রুপার থালার মতো বড় চাঁদটা সূর্যের থেকে তার সবটুকো চুরি করা আলো ঢেলে দিচ্ছে যেনো এ বারান্দায়। সামনের কাঠগোলাপ গাছটায় দুটো পাখির আবছা অবয়ব। রঙ বোঝা যায় না অন্ধকারে। তবুও আরাব সেদিকেই তাকিয়ে। ঠোট দিয়ে পাখিদুটো কতো খুনশুটি করে চলেছে একে অপরের সাথে। আরাব বলে উঠলো,
-তোমায় সুখে মুড়িয়ে রাখতে চেয়ে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। তাইনা দোয়া?
দোয়া আরাবের দুহাতে আরো শক্তভাবে জরিয়ে নিলো নিজেকে। চোখ বন্ধ রেখেই বললো,
-আপনি কি করে আমাকে কষ্ট দিতে পারেন আরাব?
-এতোগুলো দিন….
-সবকিছুর জন্য তো আমিই দায়ী আরাব।
আরাব ছেড়ে দিলো দোয়াকে। অপরাধবোধটা মিটবে না দোয়ার কোনো কথাতেই। দোয়া পেছন ফিরে আরাবের দুগালে হাত রেখে বললো,
-আপনি জানেন? যেদিন আমি জানতে পারলাম আপুর জন্য আপনি মুফতাহিরের মতো কাউকে বাচিয়ে দিচ্ছেন,আমি সেদিনই বুঝে গিয়েছিলাম,আপনার জীবনে আপু কি। বিশ্বাস করুন আরাব,তাতে আপনার প্রতি আমার ভালোবাসাটা শুধু বেড়েছেই। তাই চারবছর আগে সেদিন যে কথাগুলো বলে তৌফিকা আপু বেড়িয়ে গিয়েছিলো,তাতে আপনি যদি ওর সাথে না যেতেন,আর আপুর কিছু হয়ে যেতো,তখন অপরাধবোধটা আমার হতো আরাব। কারন আমি আপনার লাইফে আসার পরই মুফতাহিরের সত্যিটা সামনে এসেছে। আমিই ওর সংসার ভাঙার জন্য দায়ী! আমার জন্যই এ পরিবারে এতো অশান্তি! এজন্যই সেদিন আপনাকে বলেছিলাম,আপুর দায়িত্ব নিতে। আমি আপনাকে অনুভব করেই বাচবো না হয়!
-দোয়া…
-আর আপনি কি করলেন? আমার কথা রাখতে লন্ডন ঠিকই গেলেন। কিন্তু এমনভাবে,যাতে আপনার দুরে সরে যাওয়ার দায় আমার উপর না আসে। হাহ্! সত্যিই! সবাই আপনাকেই স্বার্থপর বলেছে। আর ওই আটমাসে আপনার খোজ না পেয়ে আমি মরে…
দোয়ার মুখে আঙুল দিয়ে আটকে দিলো আরাব। করুনভাবে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। দোয়া মুচকি হেসে বললো,
-আপনি স্বীকার করুন,বা নাই করুন,আপনার জীবনের সবটা উত্থানপতনের জন্য আমিই দায়ী আরাব। প্রথমে সুমন,তারপর মুফতাহির,তারপর জারা,তারপর তৌফিকা আপু,টুইঙ্কেল,বাবা মা,আমাদের এতোবড় বিচ্ছেদ,আপনাকে বলা সমস্ত কটকথা,সবকিছুর জন্য এই আমিই দায়ী।
-না দোয়া। তুমিতো আমাকে প্রেমের রঙে রাঙিয়েছো। আমার পরিবারকে ভালোবাসায় পরিশুদ্ধ করেছো। আর আমি যে কারনেইহোক,যেভাবেই হোক,নিজেকে সরিয়ে,দায়িত্বের বোঝায় বেধে রেখেছিলাম তোমাকে।
পুরোনো কথাগুলো বিষাক্ত লাগছিলো দোয়ার। একটু চুপ থেকে গোড়ালি উচিয়ে ও গলা জরিয়ে ধরলো আরাবের। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
-যা ছিলো,তা অতীত। একটা অনুরোধ রাখবেন? আমার এই বর্তমান আর ভবিষ্যতের দিনগুলো,রাতগুলো আমার ভাবনার চেয়েও আরো সুন্দর করে দেবেন আরাব? উশুল করে দেবেন সবটা? প্লিজ?
আরাব নিশব্দে হাসলো। দোয়ার দুগাল ধরে ওর কপাল,নাক,ঠোটে ঠোট ছুইয়ে দিলো সন্তর্পনে। আরাবের টিশার্ট মুঠো করে চোখ নামিয়ে দাড়িয়ে রইলো দোয়া। আরাব ওর একহাত মুঠো করে নিয়ে হাটা লাগিয়ে বললো,
-চলো।
দোয়া পা বাড়ালো ওর সাথে। রংধনু থেকে বেরিয়ে গ্যারেজ থেকে বাইক বের করলো আরাব। দোয়া উঠে বসলো ব্যাকসিটে। বাইক স্টার্ট দিলো আরাব। পূর্নচন্দ্রের রাত,ফাকা রাস্তা,ল্যাম্পপোস্টের আলো। দোয়া পেছন থেকে খানিকটা উকি দিয়ে তাকালো আরাবের মুখের দিকে। একহাতে দোয়ার একহাত একদম বুকের বা পাশে নিয়ে আরাব বললো,
-মনে পরে দোয়া? এমনি কোনো এক রাতে প্রথমবার তোমার এক অস্পষ্ট অবয়ব দেখেছিলাম আমি। সে রাতেও এমনই শাড়ি পরেছিলো তুমি।
দোয়া মুগ্ধতার চাওনি স্থির রাখলো আরাবের দিকে। আরাব বললো,
-সে রাতে তোমার চেহারাটাও দেখিনি দোয়া। আজ দেখো,এই তুমি সবটাই আমার।
দোয়া মাথা ঠেকালো আরাবের পিঠে। বাইক ছুটেছে। বাতাস চোখমুখ ছুইয়ে দিচ্ছে দুজনের। সে এক তীব্র প্রশান্তি। আরাব বলে চলেছে,
-জানো দোয়া? অ্যালেন এ বছর বাইক রেসে ফার্স্ট হয়েছে। গত সপ্তাহে মিশেলের সাথে চার্চে বিয়ে হলো ওর।
…
-জনের এনগেইজমেন্ট হয়ে গেছে দুইমাস আগে। ছেলেটা আপুকে খুব ভালোবাসতো জানোতো। কিন্তু আপুই…
….
-তন্নির জন্য মায়ের পছন্দটা কিন্ত ভালোই ছিলো বলো? শাফিনকে একবার দেখেই ভালো লেগেছে আমার। ওদের বিয়েটা ভালোয়ভালোয় মিটেছে শুনে কতো শান্তি লাগছিলো,বলে বোঝাতে পারবো না তোমায়। কাল ফোন করেছিলো শাফিন। ওরা সাজেক থেকে আজ ফিরেছে হয়তো।
….
-ওহ্! বলা হয়নি তোমাকে! অনিন্দার রেজাল্ট দিয়েছে। সলিমুল্লাহ্ মেডিকেলে চান্স পেয়েছে ও। সুন্দর না? যে যাই বলুক,সবটার ক্রেডিট কিন্তু স্বস্তিকেরই বলো? ও যদি কাকাবাবু,অনিন্দাকে নিয়ে রায়নগর ছেড়ে ঢাকায় সেটেল্ড না হতো,অনিন্দার রেজাল্ট কিন্তু এতো ভালো হতো না। আমাকে বলেছে অনিন্দা,স্বস্তিক নাকি পড়াশোনা নিয়ে খুব কড়াকড়ি করেছে ওর সাথে।
…
-এই দোয়া? শুনলাম তৃষা নাকি তোমাদের তিনতলার ভাড়াটির বড় ছেলে,কি যেনো নাম? উম্…ফাহাদ! হ্যাঁ! ফাহাদের সাথে নাকি ফুচকা খেতে বেরোয়? আমাকে ওর ভার্সিটির একজন বললো। খোজ খবর নিলাম ছেলেটার। ভালোই! ফুচকা টুচকা খাওয়ানো শেষে যদি কাজি অফিসেও নিয়ে যায়,তৃষাকে বলো মানা যেনো করে না। ভালো মানাবে দুজনকে।
দোয়া এবার শব্দ করে হেসে দিলো। এই একটা মানুষ,কতোগুলো জীবনের সাথে জুড়ে আছে,তা আর কেউ না জানলেও,ও জানে।আস্তেধীরে বললো,
-অ্যালেনের বোনের পড়ার খরচ,ওর চিকিৎসা আর বাইক রেসের ট্রেনিংয়ের যাবতীয় খরচের দায় আপনি নিয়েছেন তাইনা আরাব?
….
-জনকে বিয়ের জন্য আপনিই বুঝিয়েছেন। তাইনা?
….
-আপনার কি মনে হয় আরাব? শাফিনকে দিয়ে তন্নির জন্য বিয়ের সমন্ধটা যে আপনিই পাঠিয়েছেন তা আমি জানতে পারবো না? নিজে পাত্রপক্ষের হয়ে বিয়ে মিটমাট করিয়ে,সব ক্রেডিট আমার মাকে দিয়ে দিলেন?
সাথেসাথে ব্রেক কষে বাইক থামালো আরাব। পেছনদিকে তাকানোর আগেই দোয়া আরো শক্ত করে জরিয়ে ধরলো ওকে। চোখ বন্ধ রেখে বললো,
-অনিন্দার দায়িত্ব নিতে হবে,এই ভাবনাটা স্বস্তিককে ভাবানোর জন্যও আপনি দায়ী। ভুল বললাম আরাব?
-কি বলছো তুমি এসব দোয়া?
-ভালো চাকরির অফার পেয়ে ফাহাদ তো ওর মা ভাইকে নিয়ে চিলেকোঠা ছেড়ে দু বছর আগেই চলে যাচ্ছিলো। তারচেয়ে ভালো চাকরি অফার করে,তৃষার জন্য ওকে চিলেকোঠায় আটকে দেওয়ার মানুষটা আপনিই আরাব। তাইনা?
মুখ দিয়ে শ্বাস ছাড়লো আরাব। বললো,
-সবটা জানো তারমানে।
দোয়া আবারো মাথা ঠেকালো ওর পিঠে। বললো,
-আপনি নিজেও জানেন,আপনি ছাড়া ওই বেরঙ চিলেকোঠা আজীবন বেরঙ। নিজেকে যতোই লুকোনোর চেষ্টা করুন না কেনো,এতোগুলো মানুষের জীবনে আপনার ভুমিকা কেমন,তার উপলব্ধি আছে আমার।পুরো পরিবার থেকে আলাদা ছিলেন,আমার সাথে যোগাযোগটা করেননি তাই। জানি। তবে বাইক রেস জেতার পর কাকাবাবুর সাথে যোগাযোগ রেখে ভালোই করেছেন। আপনি ছাড়া,এতোগুলো জীবন এতো সার্থকতা কোথায় পেতো বলুন? যাকগে,কোথাও যাচ্ছিলাম আমরা!
হাসি ফুটলো আরবের ঠোটের কোনে। ওর সর্বাঙ্গীনী ওকে নিয়ে সবটাই জানবে,এটাই স্বাভাবিক। কোনো কথা বলেনি আর ও। বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে এলো রায়নগর। দোয়া কিছুটা অবাক হলেও বললো না কিছু। চাবি দিয়ে দরজা খুলে মুখার্জীবাড়ির ভেতরে ঢুকলো আরাব। এখানে থাকার মধ্যে দোতালা,তিনতলার পরিবারগুলো,আর নিচতলার মেসের ছেলেরা। তন্নি শশুড়বাড়ি,তৃষা ভার্সিটির হলে,অরুনাভ মুখার্জী আর অনিন্দাকে নিয়ে স্বস্তিক মুলশহরে,দিয়ান বিকেএসপিতে আর সালমা বেগম রংধনুতে। চিলেকোঠা এখন ওখানে বসবাসরত সবার নামে।
রাত্রি গভীর,আর চিলেকোঠার সবাইও গভীর ঘুমে আছন্ন। উকিঝুকি দিয়ে,দোয়ার হাত ধরে সোজা অরুনাভ মুখার্জীর ঘরে ঢুকলো আরাব। ঘরে ঢুকে দোয়ার হাত ছেড়ে একটা লম্বা শ্বাস ছাড়লো ও। ততোক্ষনে দোয়া বিছানাটা আলতোভাবে ছুইয়ে দিয়ে মুচকি হাসছে। সেই ঘর! সেই বিছানা! আরাবের সেবায় কাটানো সে রাতের মতো,আজও তেমনি এক রাত! আরাব বললো,
-কিছু মনে পরে গেলো বুঝি?
দোয়ার হাসি প্রসারিত হলো। প্যান্টের পকেটে হাত গুজে আরাব জানালার দিকে এগোলো। দোয়া এসে জানালাটা খুলে,ছেড়ে দিলো সাদা পর্দাটাও। আরাবের দিকে ফিরে বললো,
-আপনার কিছু মনে পরলো না সাইকো সাইন্টিস্ট?
ঠোট কামড়ে অন্যদিক তাকিয়ে একটা হাসি দিলো আরাব। সামনে দাড়িয়ে থাকা দোয়ার কোমড় দুহাতে জরিয়ে কাছে টেনে নিলো একদম। আরাবের গলা জরিয়ে ধরলো দোয়া। জানালার ধারে দাড়িয়ে,একফালি চাঁদের আলোর মাঝে লোহার রডগুলোর ছায়া পরছে দুজনের চোখেমুখে। একহাতে দোয়ার বাধা চুলগুলো খুলে দিয়ে ওর কপালে কপাল ঠেকালো আরাব। মৃদ্যুকন্ঠে বললো,
‘ সকালের সদ্যফোটা ঝলমলে আলোতে
কৃষ্ণবর্নের সে ঢেউখেলানো চুল,
আমার বেখেয়ালি মনজুড়ে হঠাৎ
সাদা ওড়নার একরাশ শুভ্রতার ঝড় তুমুল।
কোনো মায়াবী মুখশ্রী দেখার,এক অনন্ত নেশা
কারো ভেজাচুলের পানিকনায় সিক্ত,
আমার সর্বদিশা।
তার স্পষ্টভাষায়,হয়েছি ঘায়েল বিশেষ
তার লাজুকতায় মাতাল হওয়ায়
সুখ আকা অশেষ।
অজান্তেই অহর্নিশ
ভালোবেসেছি তোমায়,
পাগলামি প্রেমের রঙ গায়ে মেখেছিলাম
এক বেরঙ চিলেকোঠায়
এক…বেরঙ চিলেকোঠায়…
~সমাপ্ত?
[ আসসালামু আলাইকুম পাঠকমহল,