#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-৯
হাতের রুমালটা ঘুরাতে ঘুরাতে দোয়ার দিকে এগোচ্ছে রনোক।রনোকের পেছনে আরো দুজন।গাড়ির জন্য ওপাশের কিছুই দেখা যাচ্ছে না।পেছনে তাকিয়ে বেশ অনেকটা দুরে দুজন মধ্যবয়স্ক লোককে দাড়িয়ে থাকতে দেখলো দোয়া।রাস্তার ওপাশ দিয়ে এক মহিলা হেটে যাচ্ছিলেন।খানিকটা সন্দেহের নজরে চারজনের দিকেই তাকিয়ে ছিলেন উনি।পরপরই বিরক্তির চেহারা করে হাটা লাগালেন।দৌড়াবে,অতোটা গায়ের জোর নেই ওর এই মুহুর্তে।দোয়া ব্যাগে হাত ঢুকালো স্প্রে বের করবে বলে।সবে মহিলাটাকে ডাকতে যাবে,হুট করেই রনোক রুমালটা একদম মুখে পুরে পেছনে বেধে দেয় ওর।গায়ের জোরে ওকে সরিয়ে দিচ্ছিলো দোয়া।মরিচগোলানো স্প্রে টাও বের করেছে।কিন্তু বাকি ছেলেদুটোর একজন পেছনে মুচড়ে ধরলো ওর হাত।ধাক্কাতে থাক্কাতে ওকে গাড়িতে তুলে গাড়ি স্টার্ট দিলো।
আকসাৎ এরকম ঘটনার সম্মুখীন হওয়া একটা মেয়েই জানে তার মনের অবস্থা।আত্মরক্ষা বোধহয় আর সম্ভব হলো না ভেবে কেদে দিলো দোয়া।গাড়ির ব্যাকসিটে একপাশের একজন দুহাত মুড়িয়ে পেছনে ধরে রেখেছে ওর।রনোক আরেকপাশে।দোয়ার জামার বড়হাতা একটানে ছিড়ে দিয়ে রাগী গলায় বললো,
-খুব তেজ তোমার না?খুব তেজ?এই স্প্রের বোতল,আর রাস্তায় দুচারজন মানুষের আনাগোনা নিয়েই এতো তেজ তোমার?এতো তেজ?
রনোকের নখের আচড়ে হাত কেটে গেছে অনেকটা। জববলছে।প্রানপনে আওয়াজ করা আর ছোটার জন্য চেষ্টা করছে দোয়া।কিন্তু জ্বরের দুর্বলতায় আরো বেশি করে হাপিয়ে উঠছে যেনো।রনোক আবারো বললো,
-গত চারদিন হলো এই রাস্তায় ঘুরঘুর করছি।আর তুমি?কোনো পাত্তাই নেই!কোনো ভয় নেই!চোখ সরিয়ে বিনাসংকোচে আমারই সামনে দিয়ে হেটে যাও?তোমার সাহস কি করে হয় রনোকের চাওনিকে এড়িয়ে চলার?হাউ ডেয়ার ইউ?
আরেকবার ঝাড়া মারলো দোয়া। রনোক এবার গলা টিপে ধরলো ওর। রনোকের স্পর্শের চেয়ে মৃত্যুকে বারবার কামনা করতে লাগলো দোয়া।রনোক ওর গলা আরো জোরে চেপে ধরে বললো,
-চাইলেই তোমাকে শেষ করে দিতে পারি দোয়া।শরীরের টেম্পারেচার যা দেখছি,দুমিনিটও লাগবে না তোমার নাম পৃথিবী থেকে মুছে দিতে।
পরপরই ছেড়ে দিলো।কাশি উঠে গেছে এতেই দোয়ার।ভুল বলেনি রনোক।এই চারদিনে ওর উপস্থিতিকে পুরোপুরিভাবে অগ্রাহ্য করেছে ও।ভয় পেলে আরো বেশি করে ভয় দেখাবে রনোক।এমনটাই বুঝিয়েছিলো ও নিজেকে।অন্তত নিজের পারিবারিক মর্যাদার কথা ভেবে পাব্লিক প্লেসে বাজে কোনো পরিস্থিতি তৈরী করবে না এমনটা ধারনা করেছিলো ও।কিন্তু ওকে ভুল প্রমান করেছে রনোক।দোয়া কাদছেই। যদি রনোককে দেখা শুধু ভয় পাওয়াটা আজকে ওর আত্মসম্মানকে বাচিয়ে দেয়,তবে পাবে ও ভয়।ভয় পেয়েই এ পথে চলবে ও।কিন্তু সে সুযোগ কি পাবে ও?বলারই কি সুযোগ পাবে? এই চলন্ত গাড়ি কোন অন্ধকারের অতলে নিয়ে যাচ্ছে ওকে ভাবতেই বুকফেটে কান্না আসছে দোয়ার।রনোক আবারো বললো,
-বাট তোমার ইগ্নোরেন্সের শাস্তি তো আমি মৃত্যু ঠিক করিনি দোয়া! তারথেকেও যন্ত্রনার কিছু ঠিক করেছি যে! যাতে প্রতিদিন মরো তুমি! আমাকে দেওয়া থাপ্পরের চেয়ে বড় অপমানে প্রতিদিন অপমানিত হও তুমি! এমন শাস্তি দোয়ারানী! এমন শাস্তি চুজ করেছি তোমার জন্য!
বিস্ফোরিত চোখে তাকালো দোয়া। রনোক বাকা হেসে বললো,
-এবার তবে সব হিসেব মেটানো যাক?
আরো উত্তেজিত হয়ে পরলো দোয়া। ওর ছটফটানি বেশ আনন্দের সাথে কিছুক্ষন দেখলো রনোক।তারপর বললো,
-ওমন করে না দোয়ারানী! কিচ্ছুটি করবো না তোমাকে আজ! বলেছি তো,তোমাকে মারবো,ভয়ে ভয়ে!ভয় দেখতে চাই তোমার চেহারায়! তাই আজ শেষবারের মতো ওয়ার্নিং দিয়ে গেলাম ম্যাডাম!রনোক কে ভয় পাও!নইলে পরেরবার…
কথা শেষ না করে বাকা হাসলো রনোক।গাড়িও থামলো।ধাক্কা মেরে দোয়াকে গাড়ি থেকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেলো ওরা।মেইন রাস্তায়ই ছেড়েছে ওরা দোয়াকে।আসেপাশের লোকজনের অভাব নেই।সবাই দোয়াকে ওই অবস্থায় দেখে বলাবলি শুরু করে দিলো।ওড়না চাদরের মতো জরিয়ে ছেড়া হাতাটা আগে ঢাকলো দোয়া।ভীত দৃষ্টিতে চারপাশের অবজ্ঞার দিকে তাকালো।হাতের কনুই কেটে রক্ত ঝড়ছে।এক মহিলা ছুটে এসে বললেন,
-কি হলো মা তোমার? ওরা কারা ছিলো?
মহিলার দিকে তাকিয়ে তারবুকে মুখ গুজে হুহু করে কেদে দিলো দোয়া।এতোক্ষনে যেনো শ্বাস ফেলার জায়গা হয়েছে ওর।ওর সাথে তো তেমন কিছুই ঘটেনি,যেমনটা সবাই ভাবছে। তাই কারো ভাবনা নিয়ে মাথাব্যথা নেই ওর। কিন্তু রনোকের স্পর্শের কথা মনে পরতেই ভেতরটা দুমরে মুচড়ে যাচ্ছে ওর।দোয়ার কান্নায় নুইয়ে গেলেন মিসেস ওয়াহিদ।তৌফিকাসহ বাকি সবার সাথে বাইরে বেরিয়েছিলেন ওনারা।তৌফিক ওয়াহিদ রেস্ট্রুরেন্টের বিল পে করছিলেন। উনি বাইরে এসে দাড়িয়েছিলেন।আর বাকিসব ভেতরেই ছিলো।এরইমাঝে রনোকের গাড়িটা ফেলে যায় দোয়াকে।একটা মেয়ের এই দুরবস্থায় যখন বাকিসব বলাবলিতে ব্যস্ত,না এগিয়ে গিয়ে থাকতে পারেননি উনি।অনেকটা সময় দোয়াকে কাদতে দিয়ে বললেন,
-শান্ত হও মা।আর কেদো না।অনেকক্ষন হলোই কাদছো তুমি।
দোয়া শক্ত করে ধরে রাখলো মিসেস ওয়াহিদকে।ফুপাচ্ছে।ভয় পুরোপুরি কাটে নি ওর।মিসেস ওয়াহিদ বললেন,
-তুমি চেনো ওদের?
দোয়া এবার মাথা তুললো।বাস্তবতা বুঝে চোখের পানি মুছে নিলো।নাক টেনে বললো,
-ওরা আমার সাথে কিছুই করেনি আন্টি।বিশ্বাস করুন,শুধুমাত্র ভয় দেখাবে বলে এভাবে…
আবারো কেদে দিলো। অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন মিসেস ওয়াহিদ। শুধুমাত্র ভয় দেখানো মানে? কান্না থামিয়ে দোয়া আবারো বললো,
-এতোক্ষন আমাকে সময় দেওয়ার জন্য থ্যাংকস্ দিলে কম পরবে আন্টি। তবুও,থ্যাংকস্।আসছি।
মিসেস ওয়াহিদকে বলার সুযোগ না দিয়ে হাটা লাগালো দোয়া।যন্ত্রমানবীর মতো সোজা বাড়িতে ঢুকলো।উপরতলা থেকে ওর অবয়বকে দেখেই সালমা বেগম বললেন,
-দোয়া এসেছিস?নিচের কলপাড় থেকেই মুখহাত ধুয়ে আয়।ওয়াশরুমে তৃষা আছে।ওদেরটায় পানি আসছে না নাকি!
মাথা তুলে উপরে তাকালো দোয়া।তারপর তাকালো টিউবওয়েলের কাছে থাকা পানিভর্তি বালতির দিকে।এগিয়ে গিয়ে বসে গেলো ওখানেই।ব্যাগটা পাশে রেখে একের পর এক মগভর্তি পানি মাথায় ঢালতে শুরু করলো। রনোকের নখের আচড়ে হাতের কেটে যাওয়া জায়গাটা জ্বলতে শুরু করেছে।ওড়না সরিয়ে সেদিকে তাকাতেই তীব্র ঘৃনায় বুকফেটে কান্না আসছিলো দোয়ার। নিশব্দে অশ্রুবিসর্জন দিতে দিতে আরো ডলতে লাগলো কাটা জায়গাটা। গলা টিপে ধরেছিলো,সেখানটাও ডলছে।ওর কব্জি একজন মুঠো করে রেখেছিলো,সেখানেও ছাড় দেয়নি।যেনো চামড়া খুলে নিতে পারলে সুবিধা হতো ওর।
পানি পরার আওয়াজ শুনে অরুনাভ মুখার্জী ঘর থেকে একপ্রকার ছুটে বেরিয়ে এলেন। দোয়া ওভাবেই পানি ঢালছে আর কাটা জায়গাটা ডলছে। রক্তও বেরোচ্ছে ওখান থেকে।অরুনাভ মুখার্জী দৌড়ে এসে মগটা কেড়ে নিলেন ওর কাছ থেকে। চোখ তুলে তাকালো দোয়া। ভেজা চেহারার জন্য কান্নাটা বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু চোখ অসম্ভব লাল হয়ে আছে ওর। অরুনাভ মুখার্জী খানিকটা আতকে উঠে বললেন,
-কি হয়েছে তোর দোয়া? এমন করছিস কেনো?
দোয়ার হুশ ফিরলো। তাড়াহুড়ো করে ওড়না দিয়ে ভালোমতো ঢেকে নিলো আচড়ের জায়গাটা। ভেজা কাপড়েই দৌড়ে চলে এলো দোতালায় । বারান্দার তালাটা আটকানো।দুবার নাড়াতেই তা খুলে দিলো তন্নি। দোয়া একছুটে নিজেদের ঘরে চলে গেলো। সবে ওয়াশরুম থেকে বেরোনো তৃষা ওর ছুটে ভেতরে ঢোকা দেখলো।মিহি স্বরে ডাকও লাগালো দোয়াপু বলে। দোয়া তোয়াক্কা করেনি।ছুটে গিয়ে ওয়াশরুমের দরজা লক করে দিয়েছে।পাশেররুম থেকে সালমা বেগম,দিয়ান দুজনেই বেরিয়ে আসলো। তৃষা নির্বোধের মতো বললো,
-দোয়াপু মনে হয় কাদছিলো চাচীমা।ভিজে গেছে পুরোপুরি।
দিয়ান,সালমা বেগম দুজনেই হতবাক।দোয়ার কান্নার কোনো কারন খুজে পেলো না কেউই। নাইবা ভেজার কারন আছে।দুবার দোয়াকে ডাকলেন সালমা বেগম।ভেতর থেকে আওয়াজ এসেছে আসছি।বেশি সময় নেয়নি দোয়া।জামাকাপড় পাল্টে বেরিয়ে আসলো।সালমা বেগম বললো,
-তুই নাকি ভিজে গিয়েছিলি?কেদেছিলি?
-কলপাড়ে হাতমুখ ধুতে গিয়ে পরে গিয়েছিলাম।
-কি?দেখি দেখি,কোথায় লেগেছে?খুব লেগেছে?কিছু বলছিস না যে?
সবে দোয়ার গায়ে হাত দিতে যাবে,লাফিয়ে দু পা পিছিয়ে গেলো ও।বললো,
-ব্যস্ত হয়ো না মা। কিছু হয়নি আমার।ঘুম পাচ্ছে। খেয়েদেয়ে ঘুমাবো!
মেয়ের মুখে যেনো অশ্রুতপুর্ব কথা শুনলেন সালমা বেগম।তাড়াতাড়ি সরে এসে দুপুরে রান্না করা খাবারটা বেড়ে নিলেন। আজ দোয়া এগোয়নি।চাদরের মতো করে ওড়না জরিয়ে এককোনে বসে ছিলো শুধু। রনোকের কাজটার কথা ভাবতেই শরীর জ্বলে উঠছে ওর।তাছাড়া জ্বরও বাড়ছে।মায়ের ধারেকাছে গেলেই মা টের পেয়ে যাবে, ব্যস্ত হয়ে উঠবে। তাই দুরে থাকাই শ্রেয়।খাওয়া শেষে কাথা জরিয়ে চুপচাপ উল্টোপাশ হয়ে শুয়ে পরলো দোয়া।দিয়ানও শুয়ে পরেছে ওর ঘরে।কিন্তু সালমা বেগমের মন মানতেই চাইছে না।আস্তেধীরে মেয়ের দিকে এগোলেন উনি।কপালে হাত দিয়ে পর্যবেক্ষন করে বুঝলেন তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশ কম।কাথাটা দোয়ার গায়ে আরেকটু জরিয়ে দিয়ে সরে আসলেন ওখান থেকে।
হাতের মুঠোয় থাকা ভেজা কাপড়ের টুকরোটা আরো জোরে মুঠো করে ধরলো দোয়া। জানতো মা সন্দেহ করবে,তাই বেশ অনেক্ষন যাবত নিজেনিজেই কপাল ভেজা কাপড় দিয়ে মুছে নিচ্ছিলো। মায়ের চলে যাওয়া দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেললো ঠিকই,কিন্তু শরীর যেনো আরো বেশি দুর্বল হয়ে পরতে লাগলো।
•
মুখার্জি বাড়ির সামনে এসে বাইক থামালো আরাব।জরুরি কাজে আগে ল্যাবে যেতে হয়েছিলো ওকে।তাছাড়া ও জানতো ও সময় দোয়া টিউশনিতে থাকবে,তাই আগে ল্যাবে গিয়ে কাজ সেরেই আসলো একপলক দোয়াকে দেখবে বলে।বাইক থেকে চাবি খুলে সোজা দোতালায় তাকালো আরাব।আর তৎক্ষনাৎ তৃপ্তির হাসির দেখা মিললো ওর ঠোটে।বারান্দার রেলিংয়ে মাথা ঠেকিয়ে উল্টোদিক হয়ে বসে কেউ।তার ঢেউখেলানো ছাড়া চুলগুলো জানান দিলো,সে দোয়া।রাতের অন্ধকার যেমন চারপাশের দৃশ্যকে গ্রাস করে,তেমনি ওই চুলগুলো আড়াল করে দিয়েছে দোয়ার সম্পুর্ন আঙিকে।
বাসার ভেতর থেকে হাসনাহেনার তীব্র ঘ্রান নাকে লাগছে।পুর্নচাদ পুর্নতার সাথেই তার কিরন বিলি করতে ব্যস্ত।খোলা সদর দরজা দিয়েই দেখা যাচ্ছে ও,নিচতলার মেসের ছেলেগুলো ফিরেছে।ঘরগোছাতে ব্যস্ত সবাই।আরেকবার দোতালার বারান্দার দিকে তাকিয়ে বাইকের চাবিটা পকেটে পুরলো আরাব।পা বাড়ালো অরুনাভ মুখার্জীর ঘরের দিকে।কিছুটা এগোতেই টুপ করে দুফোটা জল সোজা এসে ওর গালে পরলো।
চোখ বন্ধ করে সে জলকনাকে অনুভব করলো আরাব।পুরো দেহমনই প্রশান্তি অনুভব করছে তাতে।একপা পিছিয়ে আবারো উপরে তাকাতেই দ্বিতীয়বারের মতো জলের ফোটা ভিজিয়ে দিলো ওর চিকুর।গালে হাত দিয়ে পানিটুকো ছুইয়ে দিলো আরাব।স্পষ্ট বুঝতে পারছে,এ জল,দোয়ার ভেজাচুল থেকেই গরাচ্ছে।খানিকটা হাসির রেখা দেখা দিতে গিয়েও থেমে গেলো। চিন্তিত হৃদয় প্রশ্ন করে বসলো আরাবকে,এ সময় দোয়ার চুল ভেজা কেনো?এ অসময়ে কেনো গোসল করলো দোয়া?এখন গোসল করলে অসুখ করবে,এটা একবারও ভাবলো না মেয়েটা?কেনো?
-আরে আরাব!তুমি?
ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন অরুনাভ মুখার্জী।আরাব জোরপুর্বক হাসি টেনে বললো,
-জ্বী।কেমন আছেন কাকাবাবু?
-এইতো!তুমি?হাতপায়ের কাটাছেড়া…
-পুরোপুরি সুস্থ্য আছি কাকাবাবু।
-কিভাবে এলে তুমি?
-ড্রাইভ করেই এসেছি। অসুবিধা হয়নি।
অরুনাভ মুখার্জী আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন।আরাব সুযোগ না দিয়ে বলে উঠলো,
-কাকাবাবু,দোয়া?
একটা ছোট শ্বাস ফেললেন উনি।বললেন,
-আছে।ভালোই আছে।উপরে গিয়ে দেখা করে আসো?
এই দেখা করে আসো অনুমতিটাই চাইছিলো আরাব।একমুহুর্ত দেরী করলো না।সিড়ি বেয়ে চলে আসলো দোতালায়।বন্ধ কেচিগেইটের ওপারে বারান্দায় মাথা ঠেকিয়ে বসে দোয়া।রাতের আধারে চেহারা অস্পষ্ট।ওর চোখের কোনের জল দৃশ্যমান হলো না আরাবের কাছে।কারো কাছেই যাতে না হয় তাইতো ঘুমোনোর ভান করে ছিলো এতোক্ষ। বারান্দায় এসে ওড়না জরিয়ে বসেছে কান্না করার জন্য।জলপটি দেওয়াতে জ্বর কমলো নাকি আরো বেড়ে গেলো,বুঝতেই পারছে না। খানিকটা সময় নিরবে ওর ওই অবয়বকেই দেখে পার করে দিলো আরাব।এতেও শান্তি আছে।কিছুক্ষন পরই দোয়ার মা একটা জামা হাতে বেরিয়ে এলেন ভেতর থেকে।মেয়ে যে ঘুমোয়নি,টের পেয়েছেন উনি।কাধে হাত রাখতেই একপ্রকার ধরফরিয়ে উঠলো ও। তার অলক্ষে চোখের কোনার জল মুছে নিলো।সালমা বেগম বললেন,
-কিরে মা?ঘুমোসনি?
-ন্ না মানে,এতো তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে অভ্যাস নেই তো,তাই ঘুম আসছিলো না।ত্ তুমি যাও,আসছি আমি।
বড় বড় শ্বাস ছেড়ে বললো দোয়া। সালমা বেগম ওর কাছে বসতে যাচ্ছিলো। উঠে আরো দাড়ালো দোয়া। দাড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে,টলছে। তবুও মাকে বুঝতে দেওয়া যাবে না। সালমা বেগমও দাড়িয়ে বললেন,
-এমন করছিস কেনো তুই?
-মা প্লিজ। ঘরে যাও না! আসছি আমি! বললাম তো!
দোয়া খানিকটা ধমকির সুরে বলেছে কথাটা। ওর ধমক শুনে তন্নি বেরিয়ে এলো ঘর থেকে । কিই বা করবে দোয়া?মায়ের সামনে অসুস্থ্যতা দেখানো যাবে না কোনোমতে। এদিকে দাড়িয়ে থাকাও এখন ওর জন্য অসম্ভব হয়ে উঠেছে। চারপাশ ঘুরছে ওর।সালমা বেগম বললেন,
-আচ্ছা শান্ত হ! যাচ্ছি আমি!
দোয়ার দিক থেকে চোখ সরিয়ে তন্নি গেইটে তাকাতেই চকিত হলো। আরাব গেইট মুঠো করে ধরে দাড়িয়ে। সেদিনের দেখায় ওর ধারনা আরাব দোয়ার আত্নীয়। ঘরে গিয়ে চাবিটা এনে তালা খুলে দিলো। সৌজন্য হাসলো আরাব। গেইট টেনে ভেতরে ঢুকতে যাবে,সালমা বেগম হাতের আধভেজা জামাটা দেখিয়ে বলে উঠলেন,
-আচ্ছা দোয়া?এই জামাটার হাতা কি করে ছিড়লো রে?এটা তো তুই টিউশনিতে পরে গিয়েছিলি!
জামাটা দেখেই সন্ধ্যের সমস্ত ঘটনা দোয়ার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো।আর পারলো না নিজেকে আয়ত্ত্বে রাখতে।চারপাশ অন্ধকার হয়ে এলো ওর।ওকে টলতে দেখেই ছুট লাগিয়েছে আরাব। অজ্ঞান হয়ে পরেই যাচ্ছিলো দোয়া। কিন্তু আরাব বাহুডোরে সামলে নেয় ওকে। দোয়ার গায়ের তাপমাত্রা অনুভব হতেই মাথা ফাকা হয়ে যায় আরাবের। ততোক্ষনে সালমা বেগম দোয়া বলে আর্তনাত করে উঠেছেন। কোনোকিছুর পরোয়া না করে দোয়াকে কোলে তুলে নিলো আরাব।
#চলবে…
#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-১০
দুহাতে জরিয়ে শুন্যে তুলে নিয়ে দোয়াকে ঘরে নিয়ে আসলো আরাব। সালমা বেগম মুখে আচল গুজে কাদছেন। তন্নি,তৃষা,দিয়ান সবাই আছে। দোয়াকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে কপালে হাত রাখলো আরাব। জ্বরের মাত্রাটা বেশিই। দোয়ার শ্যামবর্নের চেহারায় হলুদাভ বর্নের ছোয়া। একমুহুর্ত দেরী না করে ও ছুট লাগালো নিচতলায়।অরুনাভ মুখার্জী বই হাতে চশমা খোজায় ব্যস্ত।আরাব দৌড়ে ঘরে ঢুকে বললো,
-কাকাবাবু…দোয়া….
অরুনাভ মুখার্জী পেছন ফিরলেন।আরাবের হন্তদন্ত অবস্থা দেখে উনিও ঘাবড়ে গেছেন অনেকটাই। বললেন,
-কি হয়েছে আরাব? কোনো সমস্যা?দোয়া কিছু বলেছে তোমাকে?
-নাহ্!
কোনোমতে শব্দটা বের করে ঔষুধের বক্স খুজতে ব্যস্ত হয়ে পরলো আরাব।অরুনাভ মুখার্জী ভ্রুকুচকে তাকিয়ে রইলেন। ছেলেটার এমন ব্যবহারের আগামাথা কিছুই ঢুকছে না তার মস্তিষ্কে।এগিয়ে গিয়ে বললেন,
-কি খুজছো আরাব?
-ওষুধের বক্স কোথায় আপনার?
মাথার চুলগুলো উল্টে ধরে দিশেহারার মতো দুসেকেন্ড দাড়িয়ে আবারো হন্ন হয়ে খুজতে লাগলো আরাব। অরুনাভ মুখার্জী টেবিলে তাকালেন। পাশের টেবিলে,আরাবের চোখের সামনেই ওটা রাখা। তবুও চোখে পরেনি ওর।এগিয়ে গিয়ে বক্সটা দিলেন উনি। আরাব ওটা নিয়ে খুজতে খুজতে বললো,
-দোয়া জ্বরে সেন্সলেস হয়ে গেছে। আই থিংক ওষুধ খাওয়ানো পসিবল হবে না,আর এ মুহুর্তে তা কাজেও দেবে না। ইন্জেক্ট করতে হবে।
বিমুর্তভাবে কিছুক্ষন আরাবের মুখপানে তাকিয়ে রইলেন অরুনাভ মুখার্জী। দোয়ার অবস্থা শুনে চকিত উনি। তবে কেনো যেনো আরাবের ব্যস্ততা তার চোখে গাঢ়ভাবে ধরা দিচ্ছিলো।নিজেকে সামলে বললেন,
-ইন্জেকশন আছে দেখো ওতেই। আমার চশমাটা যে কোথায় রাখলাম! খুজ্…
-পেয়েছি। আপনিও আসুন কাকাবাবু!
আরাব আবারো দৌড় লাগিয়েছে দোতালায় । ততক্ষনে তন্নি,তৃষা বালতিভর্তি পানি এনে বিছানার কাছে রেখেছে। সালমা বেগম মুদ্যুভাবে দোয়ার গালে হাত রেখে কাদতে কাদতে ডেকে চলেছেন। দিয়ান এখনো আকস্মিকতায়। আরাব ইন্জেকশন হাতে এগিয়ে বললো,
-আন্টি দোয়ার বড়হাতা একটু গুটিয়ে দিন।ওকে ইন্জেকশন পুশ করতে হবে।
দিয়ানের হুশ ফিরলো যেনো। ছুটে গিয়ে দোয়ার হাত ধরে বললো,
-আপুনি!কি হলো তোর? চোখ খুলছিস না কেনো? আরাব ভাইয়া দেখ ইন্জেকশন নিয়ে এসেছে!আমার ভয় করছে আপুনি! চোখ খোল প্লিজ!চোখ খোল!
-শান্ত হও দিয়ান। কিছুই হবে না তোমার আপুনির। সেন্স ফিরলেই হসপিটাল নিয়ে যাবো ওকে। শি উইল বি ফাইন।
আরাব দিয়ানকে টেনে তন্নিকে ইশারা করলো ওকে সামলানোর জন্য। সালমা বেগম কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে আছেন একপ্রকার। ওদের সব পরিস্থিতিতে দোয়াই ওদের ঢাল।সবসময় সামলেছে ওদেরকে। আজ ওর এই পরিস্থিতিতে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে।আরাব আবারো দোয়ার পাশে বসে বললো,
-আন্টি হাতাটা গুটিয়ে দিন!
ভাষাহীন দৃষ্টিতে শুধু আরাবের দিকে তাকালেন সালমা বেগম। অরুনাভ মুখার্জী বললেন,
-আরাবকে ইন্জেকশনটা দিতে দাও সালমা। নইলে দোয়ার জ্ঞান ফিরবে না। আমার চশমাটাও খুজে পাচ্ছি না!
ওনার কথায় দেরী না করে দোয়ার জামার হাতা গুটাচ্ছিলেন সালমা বেগম।কিন্তু রনোকের নখের আচড়ের দাগটা চোখে পরতেই থেমে গেলেন উনি।একপলক বাইরে শুকোতে থাকা দোয়ার আধভেজা জামার ছেড়া হাতার দিকে তাকালেন।ওনাকে থেমে যেতে দেখে অরুনাভ মুখার্জী বললেন,
-কি হলো সালমা?থামলে কেনো?
নিরুত্তর রইলেন সালমা বেগম। অনেকটা পাথরের মতো। এদিকে দোয়ার হাতের দাগ দেখেই হাত মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে আসলো আরাবের। ভেতরটায় তোলপাড় হচ্ছে ওর। সহ্য হচ্ছে না কিছুই। দোয়ার শরীরে আঘাতের দাগ ওকে কতোটা ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে,ক্ষনে ক্ষনে অনুভুত হতে লাগলো ওর। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে,ওটা নখের আচড়। দাতে দাত চেপে নিজেকে শক্ত করলো আরাব। তারপর দোয়ার হাতা নামিয়ে দিয়ে চুপচাপ আরেকহাতে ইন্জেকশন পুশ করে দিলো।আলতোভাবে দোয়ার গালে হাত রেখে ধীর গলায় বললো,
-দোয়া?এই দোয়া?চোখ খোলো?শুনতে পাচ্ছো?দোয়া?
একটুপরই দোয়ার চোখের পাপড়ির নড়াচড়া দেখা মিললো। পাশ থেকে উঠে বারান্দায় এসে দাড়ালো আরাব।শক্ত হাতে রেলিং চেপে ধরে তাকিয়ে রইলো নিস্তদ্ধ অন্ধকার আকাশের দিকে।
জ্ঞান ফেরার পর চারপাশে সবাইকে দেখে দোয়া টের পেলো কিছু একটা ঘটেছে।উঠে বসতে গিয়ে মাথা ঘুরে উঠলো।অরুনাভ মুখার্জী বললেন,
-থাক না!শুয়েই থাক!তৃষা?ওকে একটু জলপটি দে,আমি গাড়ি ডাকতে যাচ্ছি! হসপিটাল নিয়ে যাবো।
নিজেকে সামলে উঠে বসলো দোয়া। তপ্ত শ্বাস ফেলতে ফেলতে বললো,
-আ্…আমি ঠিক আছি কাকাবাবু। হসপিটালে যেতে হবে না।
দিয়ান ছুটে এসে বোনের কাছে বসলো। বললো,
-আপুনি?চল না হসপিটাল? তোর অনেক জ্বর!
দোয়া মৃদ্যু হেসে ওর গালে হাত রেখে বললো,
-না রে! এখন আর অতোটা খারাপ লাগছে না।ঘরে আসলাম কিভাবে আমি?
-তোকে তো আর্…
-শুয়ে পর দোয়া! আমি জলপটি দিচ্ছি। সকালে যাবো হাসপাতালে।
দিয়ানকে বলতে না দিয়ে কথাটা বলে দোয়াকে শুইয়ে দিলেন সালমা বেগম। দিয়ান আদেশের মতো করে বললো,
-হ্যাঁ! চুপচাপ শুয়ে থাক তুই! আর একটাও কথা না!
-ছোটু,তুই এভাবে অস্থির হয়ে পরেছিস কেনো বলতো? কিছুই হয়নি আমার! মা? তুমিও এমন কেনো করছো?
সালমা বেগম চুপ রইলেন। অরুনাভ মুখার্জী গম্ভীরভাবে বললেন,
-কাল তুই ভার্সিটি যাবি না দোয়া। তোকে নিয়ে হসপিটাল যাবো আমি।
কথাটা বলেই বেরিয়ে এলেন উনি ঘর থেকে।বারান্দায় আরাবকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে থামলেন অরুনাভ মুখার্জী। বললেন,
-বাসায় যাবে না আরাব?
আরাব পেছন ফিরলো। আকাশে চাদ ছিলো।সে আলোতে স্পষ্ট দৃশ্যমান হলো ওর ছলছল চোখ,শক্ত চোয়াল।হাত মুঠো করে অরুনাভ মুখার্জীর দিকে একপা এগিয়ে আরাব বললো,
-দোয়া বিকেলে কোথায় কোথায় টিউশনি করায় কাকাবাবু?
-এটা তুমি কেনো জানতে চাইছো?
-নিজের জন্য।
অরুনাভ মুখার্জী নির্লিপ্ত দৃষ্টি আটকে রাখলেন আরাবের দিকে। কি ছিলো ওর ভাষায়,ওর ভঙিমায়,বুঝে উঠলেন না তিনি। তবে এটা ভালোমতোই অনুভব করতে পেরেছেন,যা ছিলো,তা দোয়ার নামে ওর নিজের জন্য ছিলো।তা বড্ড দরকার দোয়ার।বড্ড দরকার!
•
টিউশনি শেষ করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রাস্তায় বেরোলো দোয়া। ভার্সিটি যায়নি আজ,অরুনাভ মুখার্জী জোর করে সরকারী হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলো ওকে। ওষুধে জ্বর কমেছে খানিকটা।টিউশনি কামাই করলে মৃত্তিকার আম্মুর আড় কথা শুনতে হয়। সালমা বেগমের বারন করা সত্ত্বেও তাই বেরিয়েছে ও। তবে মায়ের ব্যবহারে কিছু তো আলাদা ছিলো আজ সকালে। ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলো,কোনো ঝামেলা হয়েছে কি না।কিন্তু কেনো জিজ্ঞাসা করলো মা ?সে জানবে কি করে?নাকি শুধু ওর অসুস্থতার জন্য বেশি ভেবেছে?আর ভাবতে পারছিলো না দোয়া। মাথায় যন্ত্রনা অনুভব হয়। দুর্বলতা তো আছেই।
মৃত্তিকাদের বাসার নিচে নামতেই দুর থেকে দোয়া লক্ষ্য করলো রনোক নামের ঘৃন্য মানুষটা পায়ের উপর পা তুলে চায়ের দোকানটায় বসে বিশ্রি হাসছে। মাথা নিচু করে দ্রুত পা চালালো ও।হঠাৎই সামনে এসে দাড়ালো কেউ।জুতোজোড়া দেখেই দোয়া বুঝলো,এটা রনোক।মাথা তুলে তাকাতেই নিজের অনুমানের সত্যতা খুজে পেলো ও।একা এসেছে রনোক। বাকা হেসেই বললো,
-দোয়ারানী,মাথা নিচু করে যাচ্ছো যে?
দোয়া কিছু না বলে পাশ কাটিয়ে চলে আসছিলো। আবারো সামনে এসে দাড়ালো রনোক।বললো,
-ভীতু ম্যাডামকে যে আজ বেশ লাগছে দেখতে।
….
-ইশ্!আফসোস হচ্ছে এবার দোয়া।বড্ড আফসোস হচ্ছে,কাল তোমাকে একটু আদ্…
এরমধ্যে পাশ থেকে দুজন মহিলা এগিয়ে এলেন।দোয়ার পাশে দাড়িয়ে একজন বললেন,
-এই ছেলে!কি সমস্যা তোমার?
-সমস্যা কেনো হবে?আমাদের বিষয়।আপনি মাঝে আসছেন কেনো?
আরেকজন মহিলা বললেন,
-তোমাদের বিষয় বুঝলাম।কিন্তু এভাবে কথা বলছো কেনো মেয়েটার সাথে?
দোয়া কিঞ্চিত অবাক হলো। মহিলাদুটোকে এর আগে এ রাস্তায় দেখেছে বলে মনে পরলো না ওর। আগেরদিনের ঘটনার পর এ রাস্তার কেউ যে ওর সাথে রনোকের ব্যবহারকে লক্ষ্য করবে,এমনটার আশা ছেড়ে দিয়েছিলো ও। তাছাড়া রনোক কথাগুলো অনেকটা ধীরে বলেছে,যা এই মহিলাদুটোর শোনার কথা না।রনোক বললো,
-শুনুন,আমি ওকে চিনি। সো আমাদের কথার মাঝে আপনারা আসবেন না।নিজেদের কাজে যান!
-তুমি চেনো ওকে?
একজন মহিলা দোয়ার কাধে হাত রেখে বললো। চমকে উঠলো দোয়া। অনাকাঙ্ক্ষিত ছিলো এটুক আশ্বাস।আগেরদিন তো চিত্র ভিন্নই ছিলো।আরেক মহিলা বললো,
-বলো?তুমি চেনো ওকে?নাকি থ্রেট দিয়েছে কোনো তোমাকে?
বিস্ময়ে তাকালো দোয়া। কিন্তু রনোকের ধৈর্য্যের বাদ ভেঙে গেছে।চেচিয়ে বলে উঠলো,
-আপনাদের নিজস্ব কাজ নেই কোনো? ওর আমার গার্লফ্রেন্ড! আমি ওর লাভার!এবার যান তোহ্!আমাদের নিজেদের কোয়ালিটি টাইমে বিরক্ত করছেন কেনো?
-মাঝ রাস্তায় একটা মেয়েকে হ্যারাস করছো,আর বলছো গার্লফ্রেন্ড,বয়ফ্রেন্ড?কোয়ালিটি টাইম?তোমাকে এর আগেও এই মেয়েটার সাথে ধমকাধমকি করতে দেখেছি আমি।
আরো বিস্ফোরিত চোখে তাকালো দোয়া।মধ্যবয়স্ক দুজন লোক। সবাই অচেনা। আজব লাগছে,কিন্তু প্রত্যেকের কথায় মন ভরে উঠছে ওর।রনোক হুট করেই দোয়ার হাত ধরে টান লাগিয়ে বললো,
-চলোতো দোয়া ! এরা তো…
দাড়িয়ে গেলো দোয়া।বললো,
-হাত ছাড়ুন!
-কেনো?
– যাবো না আমি।
-তুমি যাবে!চলো!
-হাত ছাড়ুন প্লিজ!
দোয়ার মানা শুনে একটু ভ্রুকুচকে তাকালো রনোক।তারপর বুঝলো আশেপাশের লোকজনই দোয়ার এই সাহসের কারন। খানিকটা এগিয়ে নিচু হয়ে বললো,
-বাড়াবাড়ি করো না দোয়া! আমার ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিও না! তোমাকে লাস্ট ওয়ার্নিং দিয়েছিলাম।আমার কথামতো না চললে আমি কিন্তু তোমাকে…
-হাত ছাড়ুন!
কড়া গলায় বললো দোয়া।তবুও হাত ছাড়েনি রনোক।বরং আরো জোরে টান লাগিয়েছে। দোয়া হুমড়ি খেয়ে পরেছে একপ্রকার।পরমুহুর্তেই সশব্দে চড় পরলো রনোকের গালে। ওর স্পর্শ সহ্য হচ্ছিলো না দোয়ার। বিষাক্ত লাগছিলো। নিজেই হাত ছাড়িয়ে চড় লাগিয়েছে রনোককে। গালে হাত রেখে রনোক চেচিয়ে বলে উঠলো,
-এই দোয়া!হাউ ডেয়ার ইউ?
ততক্ষনাৎ দুতিনটে ছেলে এসে রনোকের কলার চেপে ধরলো। একজন রনোকের নাক বরাবর ঘুষি লাগিয়ে বললো,
-আবে শালা! আমাদের এলাকায় এসে ইভটিজিং করিস? তোর সাহস তো কম না!
তিনজনে মার লাগাতে লাগলো রনোককে।মধ্যবয়স্ক লোকদুটো কিছুই বলছে না ওদের।মহিলাদুজন দোয়ার কাধে হাত রেখে ওকে শান্তনা দিচ্ছে। শক্ত হয়ে দাড়িয়ে রইলো দোয়া। সবটা ওর মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।ঘটনাপ্রবাহ এমন হবে কল্পনাও করেনি ও।একসময় বললো,
-ছেড়ে দিন ওনাকে,এভাবে মারলে…
পাশের মহিলা বললেন,
– কিছুই হবে না। তুমি এতো ভেবো না!
-কিন্তু….
দোয়াকে ধরে উল্টোপথে হাটা লাগালেন মহিলা দুজন। একজন বললেন,
-অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শেখো মা! অভিযোগ করতে শেখো!মনে রেখো,তুমি একা নও।আমরা আছি তো তোমার পাশে!আজকে তুমি একে ছাড় দিলে ও আর ভয় পাবে না। কাল এ আরেকটা মেয়েকে এভাবে হ্যারাস করবে। আজকে তোমার হাত ধরেছে,কাল হয়তো অন্যকাউকে আরো বাজেভাবে…পুলিশ আসছে,ওকে পুলিশে দিয়ে দেবে ওরা। আর বিরক্ত করতে পারবে না তোমাকে।
চোখ ভরে উঠলো দোয়ার। প্রতিবাদ তো করতে চায় ও। করতোও।কিন্তু আগেরদিন ওকে রনোক যেভাবে বলেছিলো…পেছন ফিরে দেখলো আরেকবার। রনোক তখনও মার খাচ্ছে ছেলেগুলোর হাতে। মহিলাদুটো সরিয়ে নিয়ে আসলো ওকে ওখান থেকে।
দুর থেকে বাইকে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে পকেটে দুহাত গুজে সবটাই দেখছিলো আরাব।মাস্কের জন্য ওর ঠোটের হাসিটা দৃষ্টিগোচর হলো না শুধু। আগেররাতে আর বাসায় ফেরেনি ও। অরুনাভ মুখার্জীর কাছ থেকে দোয়ার টিউশনির জায়গার কথা জেনেছে । সারাদিন ঘুরে ঘুরে,চায়ের দোকানদারটা থেকে রনোকের দোয়ার পথ আগলে দাড়ানোর বিষয়ে খবর লাগিয়ে,এদিকটায় ওই মহিলাদুটোকে ঠিক করে রেখেছিলো রনোকের সামনে ওভাবে বলার জন্য। ছেলেগুলোও ওর চেনাজানা।ওর সাহায্য নেওয়ার মতো মেয়ে দোয়া নয়। কিন্তু পথচারীদের আশ্বাসে কোনো প্রশ্নবোধক চিহ্ন থাকবে না দোয়ার কথায়।তাই বাধ্য হলো এভাবে কাজ হাসিল করার জন্য। গনধোলাইয়ের পর্যায় শেষ করবে বলে আরাব এগোলো এবার । ছেলেগুলো ওকে দেখেই ছেড়ে দিলো রনোককে।আরাব ওর সামনে দাড়িয়ে পকেটে হাত গুজে বললো,
-শিক্ষা হয়েছে?
উঠে দাড়িয়ে গায়ের ময়লা ঝাড়ছিলো রনোক। আরাবের কথায় চোখ তুলে তাকালো। মারামারি করার ইচ্ছা থাকলেও আরাবের আশেপাশের ছেলেগুলোকে দেখে সাহসটা হলো না রনোকের।বললো,
-কিসের শিক্ষা?রনোককে শিক্ষা দেওয়ার তোরা কে?আমি চাইলেই তোদের…
ছেলেগুলো আবারো এগুচ্ছিলো ওকে মারবে বলে।আরাব থামিয়ে দিলো ওদের। একপলক সবাইকে দেখে নিয়ে রনোক রাগী গলায় আঙুল উচিয়ে বললো,
-শোন,যা করলি,একদম ঠিক করলি না! রনোকের গায়ে হাত দিয়েছিস তোরা! এতো সহজে এসব ভুলবো না আমি! সবটার হিসেব নেবো!সবটার!
কথাগুলো বলে গাড়ি নিয়ে চলে গেলো রনোক।কিছুক্ষন সেদিক তাকিয়ে তাচ্ছিল্যে হাসলো আরাব। হিসেব মেটানো তো ওর বাকি। দোয়ার গায়ের আচড়ের কারন যে রনোক,তা আরেকটু পরিস্কার হলো ওর কাছে । বাকিটা ওর কাছেই না হয় শুনবে। ডানহাতে শার্টের বা হাতাটা টান মেরে চোয়াল শক্ত করে বাইকের দিকে এগোলো ও। এমনিতেও পুরোপুরিভাবে আত্মিক প্রশান্তি মেলেনি। আর যতোক্ষন না সে প্রশান্তি মিলছে,কোনোকিছুতেই মনোযোগ থাকবে না ওর। রনোক নামক এই বিষাক্ত কাটার জন্য দোয়া কেনো কষ্ট পাবে?আরাব কেনো যন্ত্রনায় রবে? যার যা প্রাপ্য,তাকে তা দিয়ে দিলেই তো হয়!ছোটখাটো সরল যুক্তিতে নিজের মতামতকে অধিষ্ঠিত করে নিলো ও।অতঃপর বাকা হেসে বাইক স্টার্ট দিলো। রনোকের গাড়ির ঠিক পেছনেই ছুটতে লাগলো বাইকটা।
#চলবে….
[ ভুলত্রুটি মার্জনীয় ]